Friday, 21 February 2025

রিফাৎ আরার উপন্যাস - অচেনা আপন - পর্ব ৭

 


-----------------------------------

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

উপন্যাস - অচেনা আপন ।। প্রকাশক - মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫

___________________________________

 

গাড়ি চলতে শুরু করলে তৌহিদা বেগমের কাফনে ঢাকা নিথর শরীরটা কি একটু কেঁপে উঠল? তাঁর কি এখনও মনে পড়ছে বিয়ের প্রথম রাতের সেই কাঁপুনির কথা?

          একহাত ঘোমটার নিচে অলঙ্কার ভর্তি শরীরটা পালঙ্কের থাম ধরেও থরথর করে কাঁপছিল মানুষটা হয়তো বুঝতে পেরেছিল তাই বলেছিল, "এত ভয় পাচ্ছেন কেন? আসেন খাটে বসেন"

          লজ্জায় অধোবদন তৌহিদা বিস্মিত হলেনএত বড় মানুষটা তাকে আপনি করে বলছে, এটা কেমন কথা! কে স্বামী তায় বয়সে কত বড় নববধূকে অনড় দেখে শরাফত চৌধুরী নিজেই কাছে এসে হাত ধরে কাঠের চৌকি বেয়ে বিশাল পালঙ্কে উঠতে সাহায্য করেছিলেন তারপর সেই প্রথম রাতেই ষোল বছরের তরুণী তুহি জীবনের একমাত্র পুরুষের স্পর্শে আশ্লেষ আলিঙ্গনে রাতারাতি নারী হয়ে উঠেছিলেন

          কিন্তু কাকডাকা ভোরে ঘুম ভাঙতেই দেখলেন মানুষটি পাশে নেই বিশাল পালঙ্কের একপাশে শুধু তৌহিদা সার্টিনের চাদরটা আঁকড়ে ধরে ভয়ে শিউরে উঠেছিলেন, কাল রাতে কার সাথে ঘুমিয়ে ছিলেন? তিনিই কি তার স্বামী? বিয়ের দিন সারাদিনে একবারও চোখ তুলে দেখা হয়নি স্বামীটি কেমন ভয়ে আতঙ্কে বুক শুকিয়ে এলরাতে যা কিছু ঘটেছে সেও তো বাতি নেভার পরে

          "কই গো ভাবীজান গোছলে যাইবেন না? একটু পরে তো সবাই উইঠা পড়ব ভাইজান তো বৈঠকখানা বাড়িতে চইলা গেছে চলেন আপনার শাশুড়ি উঠার আগে আপনারে গোসল করায়ে আনি" বাড়ির পুরনো বাঁদি রাবেয়া শাশুড়ি তাকেই ভার দিয়েছেন নতুন বউকে তত্ত্বাবধান করার

          যেন বুকের ওপর থেকে একটা হাজারমণি পাথর নেমে গেল তৌহিদার এই তাহলে নিয়ম কিন্তু সংসারের সঙ্গে তখনও চেনাপরিচয় হয়নি এরপর কয়েকবার বাপের বাড়ি শ্বশুরবাড়ি যাতায়াত পর্দাঘেরা পালকিতে রেল স্টেশন সেখানে পর্দায় ঘিরে রেলের কামরায় উঠা বাবার বাড়ির দিকে পর্দা থাকলেও এত বনেদিয়ানা ছিল না তাই গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে পালকি বা গরুর গাড়িতে উঠতেন আর বাবার বাড়ি শ্যামপুরে যাওয়ার রাস্তাটা দুচোখ ভরে দেখতে দেখতে যেতেন

          তার এই ব্যাকুল দৃষ্টি দেখে সঙ্গে থাকা ছোটভাই জানতে চাইত "মেজবু আপনি এত আশ্চর্য হয়ে কী দেখেন? এসব গাছপালা, খালবিল জলা সবতো একরকম"

          মেজবু হাসতেন, "তুই কি বুঝবিরে পাগল? শ্বশুরবাড়ির কয়েদখানায় তো তোরে থাকতে হয় না"

          "কেন, কেন কয়েদখানা কেন? দুলাভাই কত্তো ভালমানুষ এই দ্যাখেন আমারে একটা টাকা দিছে" বুক পকেট থেকে টাকাটা বের করে দেখায় হালিম

          মনটা ভরে যায় তৌহিদার মানুষটা আসলেই ভাল কোন কিছু নিয়ে ঝঞ্ঝাট করে না আর করবেই বা কীভাবে? তাদের তো দেখাই হয় না শ্বশুর সাহেবতো অন্দর বাড়িতে ঢোকার আগেই জোরে গলাখাঁকারি দেন যাতে পুত্রবধু এবং বাড়ির অন্যান্য জেনানারা সরে যায় ভয়ে ভয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে দু-একদিন যতটুকু দেখেছেন তাতে এখনও পুরো চেহারাটা ধরতে পারেননি

          আর আছেন শাশুড়ি উহ্‌ তার কথা মনে হলেই বুকের রক্ত হিম হয়ে যায় তৌহিদার এমন কঠিনপ্রাণ মানুষও আছে এই দুনিয়ায়! সুন্দরপুরের মিয়ার বেটি ওহিদুন্নেসা চৌধুরানী বাপের একমাত্র বেটি হওয়ার কারণে গরবে মাটিতে পা পড়ে না এমনকি স্বামীটিকেও খুব একটা পাত্তা দেন না সম্পর্কে ফুপাত ভাইয়ের সাথে বিয়ে হলেও এতিম ভাইটি যে তার বাবার গৃহেই লালিত পালিত হয়েছে এবং তার বর্তমান বসতবাটি থেকে সহায়সম্পত্তি বেশির ভাগই যে তার পিতার দান সেটা তিনি ভুলতে পারেন না তার উপর আছে শুচিবাই কেবল ঝাড়ু দাও কেবল ধোও পিতলের বদনাটা পর্যন্ত সোনার মত চকচক করতে হবে না হলে লাথি মেরে ফেলে দেবেন, নয়তো আচমকা বাঁদিদের মুখের উপর ছুড়ে মারবেন

          বিয়ে হয়েছে প্রায় আড়াই বছর কিন্তু একমাত্র এই এক জনের ভয়ে তৌহিদা সারাক্ষণ কুঁকড়ে থাকেন এতজন চাকর বাকর থাকতেও কাকভোরে উঠে গোসল করে চারমুখো বিশাল আখায় তৌহিদাকে আগুন দিতে হয় নাহলে নাকি সংসারের লক্ষ্মী থাকবে না

          তাইতো শীত-গ্রীষ্ম সব ঋতুতেই কাকভোরে উঠে বাঁদী রাবেয়াকে নিয়ে সন্তর্পনে তোলা পানিতে বেড়াঘেরা গোসলখানায় গোসল করে রান্নাঘর ঝাড়ু দিয়ে বিসমিল্লাহ বলে তাঁকে গাল ফুলিয়ে মালশার আগুন থেকে গন্ধকের কাঠি জ্বালিয়ে চুলায় আগুন দিতে হয় নারকেলের ছোবড়া থেকে সে আগুন শুকনো কাঠে লেগে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে ততক্ষণে তৌহিদার ফর্সা মুখটা আগুনের আঁচে লাল হয়ে জ্বালা করতে শুরু করে

          বড় বড় ডেকচি আর লোহার কড়াইতে ভাত-ডাল, আগের দিন বাগান থেকে তুলে আনা সবজি কেটে রান্না বসানো পুকুর থেকে সেসব ধুয়ে আনতো আশেপাশের বাড়ি থেকে কাজ করতে আসা বৌ-ঝিয়েরা

          এসব করতে করতে ক্ষেতের কামলারা এসে যেত আগের দিনের বাসি তরকারী আর পান্তা খেয়ে ডাবা হুকোয় দু'চারটি টান দিয়ে ওরা ছুটত হাল গরু নিয়ে তারপর মেয়েরা খেতে বসত ততক্ষণে রোদ উঠতে না উঠতে জেলেরা এসে পুকুরে জাল ফেলত ঝাঁকাভর্তি মাছ উঠোনের মাঝখানে ঢালা হলে ছাই আর বঁটি নিয়ে 'জন বসে যেত মাছ কুটতে এরই মাঝখানে সন্তানদের বাঁদির হাতে তুলে দিয়ে তৌহিদাকে ছুটতে হতো রান্নাঘরে ভোরে জ্বাল দেয়া ঘন সর আর দুধ বাটিতে ঢেলে খই-মুড়ি-গুড় সহ রেকাবিতে করে পাঠাতে হতো শ্বশুর-শাশুড়ির ঘরে

          ফজরের নামাযের পর একঘুম দিয়ে শাশুড়ি উঠতেন টানা বারান্দার একপাশে ঘের দেয়া অজুখানায় ঢুকে অনেকক্ষণ পর বের হয়ে এসে নাশতা সেরে যখন উঠানে নামতেন তখন কাজের বৌ-ঝিদের কলকাকলী বন্ধ হয়ে ঘোমটা আরও লম্বা হয়ে মাথাগুলো নুয়ে পড়ত মিয়ার বেটি উঠানের একপাশের আমগাছটার ছায়ায় নির্দিষ্ট জলচৌকিটাতে বসে সংসারের চারদিকে দৃষ্টি দিতেন

          ফর্সা টকটকে গায়ের রঙের ওপর দুধ সাদা জমিনে সবুজ বা নীল পাড়ের শাড়িতে কিছুটা বক্র কিন্তু দীর্ঘ দেহের অধিকারী শাশুড়িকে দেখে তৌহিদার শুধু বকের কথা মনে হত লম্বা ঘোমটার ভেতর থেকে ভয়ে ভয়ে তাকাতেন আর কাজ করতে কেবলই ভুলভাল হয়ে যেত কোন দিন হাতের মাটির ঢাকনাটাই পিছলে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যেত কোনদিন মাড় গালতে গিয়ে অনেকগুলো ভাত মাড় গড়িয়ে পড়ত তখনই শুরু হত গঞ্জনা

          অত কম বয়সে তো বিয়া হয় নাই কিন্তু তোমার মা কাজকাম কি কিছু শিখায় নাই? এত দিনের বরুনাটা ভাইঙ্গা ফেললা

          বাটনা-কুটনার বৌ-ঝিয়েরা কৌতূহলে ঘোমটার ভেতর চোখ ঘুরাতো বৌয়ের দুরবস্থা দেখার আশায় আর বৌ তখন মাথাটা নোয়াতে নোয়াতে মাটির সাথে মিশে যেতে চাইত অথচ শুচিবাইগ্রস্ত মহিলাটি কোন জিনিসের পরিচ্ছন্নতা নিয়ে সামান্য সন্দেহ হলে হাতে ছুঁড়ে ফেলার চেয়ে লাথি মেরে ফেলতে পছন্দ করতেন

          রান্নার পাশাপাশি চুলায় পিতলের ডেকচিতে পানি বসানো হত মিয়ার বেটির গোসলের জন্য পিতলের ডেকচিতে ঢাকনা দেয়া সেই পানি আর কাকভোরে তার খাসবাদীর পুকুর থেকে তোলা পিতলের কলসীর পানি বড় গামলায় মেশানো হলে বাঁদীর কাঁধে হাত দিয়ে তিনি লম্বা অথচ ঈষৎ বাঁকানো শরীরটা টেনে টেনে গোসলখানায় ঢুকতেন

          তখনও এত সুগন্ধি সাবানের চল হয়নি একালের জিনিস তিনি পছন্দও করতেন না সপ্তায় একদিন বাঁদী তার গায়ে হলুদ দুধের সর আর চালের গুড়া মিশিয়ে সারা শরীর ডলে দিত আর একদিন মাথায় মুশুরিডাল বাটা প্রসাধন বলতে ঘরে তোলা নারকেল তেলশীতে গায়ে ঘানিভাঙ্গা সর্ষের তেল গোসল সেরে ধবধবে ক্যালিকো মিলের শাড়ি পরে যখন গোসলখানা থেকে বের হতেন তখন তাকে ভারী অভিজাত দেখাত

          তৌহিদার হাসি পাচ্ছে - এত সুন্দর মহিলাটি তার জীবনটা জ্বালিয়ে কয়লা কয়লা করে দিয়েছিল স্বামীর এনে দেওয়া সুগন্ধি তেল, সাবান, আতর, সায়া এখন যাকে সবাই পেটিকোট বলে সেগুলো লুকিয়ে ব্যবহার করতে হত কিন্তু সবচেয়ে যে কষ্টটি মৃত্যুর পরও দেহের ভিতর জ্বলছে সেটি খেতে না পাওয়ার কষ্ট

          যতদিন শাশুড়ি সংসারের র্ত্রী ছিলেন ততদিন সংসারের সবাই খেলেও শাশুড়ি না খাওয়া পর্যন্ত তিনি খেতে পারতেন না কতদিন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে কোলের বাচ্চা দুপুরে ঘুমিয়ে উঠে পড়েছে বিকেলের পালার কাজের লোকেরা এসে গেছে, তবু তৌহিদা বেগমের খাওয়া হত না

          গ্রীষ্মের দীর্ঘ দুপুর যখন হেলতে শুরু করত তখন শাশুড়ি তাঁর এবাদতখানা থেকে বের হয়ে আসতেন তারপর বিশাল রান্নাঘরে একপাশে পাতা আসনে বসতেন চাকরানি চিলমচি আর বদনা নিয়ে হাত ধুয়ে দিলে তৌহিদা ভাত বেড়ে বারবার জ্ঞিজ্ঞেস করে তরকারী বেড়ে দিতেন কখনও বাদীর হাত থেকে পাখাটা নিয়ে হাওয়া করতেন আর তখন লক্ষ করতেন শাশুড়ির সুন্দর রুক্ষ মুখে এক চিলতে হাসি দেখা দিয়েই হারিয়ে যেত           

খাওয়া শেষে পানদান থেকে পানের খিলি আর বোঁটায় করে চুনটা এগিয়ে দিলে হঠাৎ একদিন বলতেন, "তুমি খাইতে বস বউ, বেলা হইছে"           

কথাটা শুনলেই শাড়ি আর ঘোমটায় ঢাকা তৌহিদার ঈষৎ নত দেহটা সেই মুহূর্তে কষ্টে আর ক্ষোভে কেঁপে উঠত ইচ্ছে করত মাটিতে গড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতে, মাথা ঠুকে রক্তাক্ত করতে কিন্তু সম্ভ্রান্ত পরিবারের বড়বৌ একুশ বছরে দুই সন্তানের জননীর পক্ষে এই ভয়ঙ্কর চিন্তা কি আর দ্বিতীয় কারো কাছে প্রকাশযোগ্য? এমনকি স্বামীর কাছেও? বোবাকান্নাকে বুকের ভেতর চেপে রাখতে হত দাসী-বাঁদীরা কেউ দেখলেও বিপদ বউ কাঁদে এর চেয়ে বড় অপরাধ আর কী? বুকের কাছে দলা পাকানো কষ্ট নিয়েও ক্ষুধার জ্বালায় তৌহিদাকে ভাতের গ্রাস গিলতে হত

 

****

No comments:

Post a Comment

Latest Post

জামাল নজরুল ইসলাম: মহাবিশ্বের নিয়তির সন্ধানে

  বিজ্ঞানজগতে বাংলাদেশের গর্ব বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান ও কসমোলজিতে তাঁর যুগান্তকারী অবদান রয়েছে। তাঁর মৌলিক গবেষণা...

Popular Posts