Saturday, 8 February 2025

রিফাৎ আরার ছোটগল্প - পিতা



__________________________________________

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

গল্পগ্রন্থ - জীবনের গল্প ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪

গল্প - পিতা
__________________________________________

পিতা

 

ঘরের দরজাটা বন্ধ করতে এসে হ্যাপি থমকাল। বাবা চেয়ারে বসে আছেন। প্রতিদিনই এভাবে ঘরের ভিতর দিকের দরজা বন্ধ করতে এসে হ্যাপি থমকে দাঁড়ায়। একবার চোখ বুলিয়ে দেখে পানির গ্লাস, বিস্কুটের বয়াম সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। তারপর একঠাঁয় বসে থাকা মানুষটার দিকে এক পলক স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঝট্‌ করে দরজার পাল্লাটা বন্ধ করে।

          এই ঝটতি বন্ধ করার মধ্য দিয়ে কি হ্যাপির নিজের মনের দুয়ারটাও বন্ধ করতে চায় কি না তাও ভাবতে চায় না। কারণ এ নিয়ে ভাবতে গেলে দরজা বন্ধ না করে সারারাত এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবেভাবনা বড় খারাপ জিনিস। ভাবাতে ভাবাতে কখন যে কোথায় দাঁড় করিয়ে দেবে যেখান থেকে এ জীবনে আর ফেরা যাবে না।

          এই যেমন বাবা - ভাইয়া যাওয়ার পর থেকে আজ তিন বছর এভাবেই প্রতীক্ষা করছেন তার বাবর ঘরে ফিরবে। আর সারাদিন শত কাজের মাঝে যে ঘটনাটি ভুলে থাকে রাতে দরজা বন্ধ করতে এসে প্রতিদিনই এ বাড়ির বড় ছেলের হারিয়ে যাবার ঘটনাটা তার মনের ভিতর একটা বিষন্ন আবহাওয়া তৈরি করে যা বিছানায় অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করেও কাটতে চায় না। আর আলমগীরের কাছে তো এ প্রসঙ্গ তোলা যায় না। রাগে-দুঃখে সে এত বেশি ক্ষেপে উঠে যে হ্যাপির ভয় হয় সেও না পাগল হয়ে যায়!

          টেবিল ল্যাম্পের আলোটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলেন সরওয়ারডায়রিটা টেনে পাতা ওল্টালেন। গত কয়েকদিন দিনে এত ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন যে রাতে ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে পড়েন। যেদিন একটু ভাল বোধ করেন সেদিন আগের ক'দিনের ঘটনাগুলো লিখে রাখার চেষ্টা করেন। না হলে ভুল হয়ে যায়। তাছাড়া টাকা পয়সার হিসেবেরও কিছু ব্যাপার আছে। সেগুলো মনে রাখার জন্য লিখে রাখতে হয়।

          ডায়রিটা হাতে নিয়ে প্রতিদিন প্রথমপৃষ্ঠা থেকে একবার চোখ বুলান। ঘটনাগুলো দু-একটি সংক্ষিপ্ত বাক্যে লেখা কিন্তু পড়ার সাথে সাথে মনে পড়ে যায় সমস্ত ঘটনা।

          আজ সাতদিন ধরে বাবরকে খুঁজে পাচ্ছি না। প্রথমে ভেবেছিলাম গ্রামের বাড়িতে গেছে। সেখানে খোঁজ নিলাম - যায়নি। তারপর তার নানার বাড়ি, খালা-মামাদের বাসা, ঢাকা-চট্টগ্রাম, পটিয়া, নারায়ণগঞ্জ কোথাও কারো বাসায় যায়নি।

          অথচ সেদিন তার মায়ের মৃত্যুর তৃতীয়দিন। অন্যদিনের মত সে যখন বেরিয়ে গেল তখন কি তিনি ভাবতে পেরেছিলেন ছেলেটা এভাবে ঘর ছাড়বে। মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল।

          কিন্তু সে তো এক যুগের বেশি। কখনও কোথাও গিয়ে তিন দিনের বেশি থাকেনি। মায়ের কাছে ঘরেই ফিরে আসতনিজের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত সরওয়ার ছেলের দিকে কখনও মনযোগ দেননি বা দেবার অবকাশও পাননি। বরং সোমত্ত ছেলে নিজের দোষে মাথাটা গুলিয়ে অকর্মার ধাড়ি বনেছে বলে মাঝে মাঝে মা-ছেলেকে দুষেছেন।

          মা পারতপক্ষে ছেলেকে বাপের সামনে আসতে দিত না। ছেলেকে সামনে দেখলেই তার প্রতি শত অভিযোগ বাবার ভিতরে গুমরে উঠত আর সেটাই বকাবকি হয়ে মা-ছেলেকে যুগপৎ বিঁধত। মাঝে মাঝে বাবার মন ভাল থাকলে মা অনুযোগ করতেন - "ছেলেটা অসুস্থ। তুমি ওকে এত গালি-গালাজ না করলে হয় না? নিজের ছেলেকে মানুষ বাপ তুলে গালি দেয়! ও তো তোমার বড় ছেলে। মনে করতো তিন-তিনটে মেয়ের পর ও যখন হল তখন কতো খুশি হয়েছিলাম আমরা।"

          "সেই দুঃখেই তো মরি। বড় ছেলে! কোথায় আমার কাজ-কর্ম দেখবে। কন্ট্রাক্টরি করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজের ব্যবসাটাকে দাঁড় করালাম। ভাবলাম এবার ছেলে দেখবে। তা না - এত সাধের ছেলে আমার হল পাগল।"

          "আহ্‌! পাগল কেন বলছ? ওর সমস্যাটা মানসিক। ডাক্তার পাগল বলতে মানা করেছে"

          "রাখো তোমার ডাক্তার। পাগলকে পাগল বলব না তো কি পায়ে হাত দিয়ে কদমবুসি করব? থাক্‌। তোমার সাথে কথা বলাই বিপদ। এমন হাউ হাউ শুরু কর যে পাড়ার লোক পর্যন্ত ঘুম ভেঙে জেগে উঠে।"

          বাবরের মা নাসিমা বেগম স্বামীর মুখ বন্ধ করার জন্য মাঝে মাঝেই বিছানা ছেড়ে ছেলের কাছে চলে যেতেন।

          সরওয়ার নিজেও আশ্চর্য হতেন পাঁচটা ছেলে-মেয়ে তার। ছোট ছেলেটা ইউনিভার্সিটি শেষ করে বাবার ব্যবসা দেখছে। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে ওই অসুস্থ ছেলেটাই যেন দিনে দিনে মায়ের আরো বেশি আপন হয়ে উঠেছিল। এ নিয়ে ঘরের সবার মধ্যেও এক ধরণের অসন্তোষ ছিল।          ছোট মেয়ে রুমা প্রায়ই বলত - "আম্মার অবস্থা দেখে মনে হয় সুস্থ হওয়ার চেয়ে পাগল হওয়াই ভাল। তাহলে মায়ের আদর বেশি পাওয়া যায় তাইনা রে ভাইয়া!!"

          খোঁচাটা খেয়েও বাবর হাসত। আবার মাঝে মাঝে মায়ের কাছে সিগারেটের পয়সা না পেলে এই ছেলেই জিনিসপত্র ভেঙে চুরমার করে একটা কান্ড বাঁধাত। তারপর নিখোঁজ।

          কিন্তু সেও তিনদিনের বেশি নয়। ফিরে এসে মায়ের পা ধরে মাফ চাইত। আর মা - হারানো ছেলে পেয়ে আকাশের চাঁদ পেত যেন। মা-ছেলের এ আদিখ্যেতা একদম পাত্তা দিতেন না বাবা। তাকালেন ডায়রির পাতায় লেখা -

          "আজ সাতদিন আমি জানি না আমার ছেলেটা কোথায়।"

          এক মাস কেটে গেছে থানায় এজাহার করে, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে আর আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে খোঁজাখুঁজি করে। আত্মীয়ের আত্মীয়ের বাড়িতেও লোক পাঠিয়েছেন যদি তারা কেউ কিছু জানে। ছেলেটা নাকি নতুন কারো সাথে পরিচয় হলে পরের বার তার বাড়িতেও হাজির হত। মাঝে মাঝে মা-কে বলত - "মা আমরা ছোটবেলা থেকে দাদার বাড়িতে যাই না কেন?"

          "তোর বাপকে জিজ্ঞেস কর নেয় না কেন?"

          মায়ের কথা শুনে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে আরো সঙ্কুচিত ভাবে ছোট হয়ে বসার চেষ্টায় নিজেকে গুটিয়ে নিত।

          "তুমি যাচ্ছ তো বাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে। আর কারো যাবার দরকার আছে? যেটুকু মানসম্মান ছিল সেটার তো বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছ। লোকে জানছে আমার ছেলে একটা পাগল।"

          "জানো মা, বাড়ির ঘরটা না একদম পুরনো হয়ে গেছে। বেড়াগুলো ভাঙা, আর টিনের চালটায় অনেক ফুটো" - বাবার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মাকে কথাগুলো বলত।

          মা সঙ্গে সঙ্গে আশ্বাস দিতেন - "তুই ভাল হয়ে যা। তাহলে আমরা গিয়ে নতুন ঘর তুলব।"

          "না মা, দাদার ঘরটাই ভাল। ওটা মেরামত করব।"

          "বাহ্‌ খুব বুদ্ধিমানের মত কথা। ভালো ভালো -" বলে বিদ্রুপ করে উঠে পড়তেন বাবা।

          আসলে আর বসতে ইচ্ছে করত না। বাড়ির কথা উঠলেই একটা পলায়নী প্রবৃত্তি জেগে উঠে। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর ফুপুর বাড়িতে থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে নিজেদের মফস্বল শহর থেকে এই চট্টগ্রাম শহরে পালিয়ে এসেছিলেন।

          ফুপুর দেবরের ছেলে তখন শহরের বড় কন্ট্রাক্টর। চাকরির দিকে না গিয়ে তারই হাত ধরে একটু একটু করে ব্যবসা শিখে নিজের প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছেন। সেই যে নাগরিক মানুষ হয়ে গেলেন আর গ্রামে ফিরে যান নি। অবশ্য অন্য কারণও ছিল। বাড়িতে গেলে সংসারের দায়িত্ব নেয়ার প্রশ্ন উঠত। ছোটবেলা থেকে টানাটানির সংসারে হিসেব করে চলতে চলতে হিসেবটা ভালই শিখেছিলেন।

          সংসারের সবার জন্য খরচ করতে মন চাইত না। বাবা-মায়ের খরচটাও যতটা না দিলেই নয় ততটাই দিতেন। আর ঘরে যাকে এনেছিলেন তার সবার জন্য প্রাণ কাঁদত বলে আত্মীয়দের আরো বেশি এড়িয়ে চলতেন। নাসিমা বেগম আপন-পর ভাবতেন না। আর একটু বড় হতেই দেখেছিলেন ছেলেটাও স্বভাবে মায়ের মতো। যাদের দেখেনি সেইসব আত্মীয়দের দেখতেও কোথায় কোথায় চলে যায়। শুধু এত আকাঙ্ক্ষিত সন্তান হয়েও বাবার সাথে ছিল তার জন্মের দূরত্ব।

          আজ এক মাস কোথাও পেলাম না বাবরকে। আপনজনকে চিনতে পারিনি বলে কি আমার ছেলেই আমাকে পর করে দিল? কোথায় সে? কোথায় পাবো তারে?

          সরওয়ার পাতা উল্টালেন -

          দু'মাস সতের দিন হল বাবর হারিয়ে গেছে। না, হারিয়ে গেছে বলা ভুল হবেচলে গেছে। আমার ওপর অভিমান করে চলে গেছে। ওর মায়ের মৃত্যুর পর হয়তো মনে হয়েছে আমরা কেউ ওর আপন নই। যে ছিল তার সবার চেয়ে আপন সে চলে যাবার পর আর ঘরে ফিরতে মন চায় নি।

          ডায়রি থেকে চোখ সরিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে চারপাশে তাকালেন। দেয়ালের ঘড়িটা টিক্‌টিক্‌ শব্দে সময় জানিয়ে যাচ্ছে। রাত দুটো বেজে দশ মিনিট। সরওয়ার উঠে দাঁড়ালেন। ঘরময় একবার পায়চারি করে জানালা দিয়ে উঁকি দিলেন।

          পাড়ার নাইটগার্ডদের হুইসেলের শব্দ আর রাতজাগা কুকুরের চিৎকার রাতের নিস্তব্ধতাকে যেন মাঝে মাঝে ফুঁড়ে খান খান করে দিচ্ছে। রাতের পালার দারোয়ান গেটের কাছে টুলে বসে ঝিমাচ্ছে।

          বাবর চলে যাওয়ার বারোদিনের মাথায় রাতের পালায় আরেকজন পাহারাদার রেখেছেন গেটের দরজাটা খোলা রাখার জন্য। ভাড়াটেরা আপত্তি জানিয়েছিল। কারো আপত্তি শোনেননি। বরং অনুরোধ করেছেন - "আপনারা নিরাপদ বোধ না করলে অন্য কোথাও যান। আমি এ বাড়ির দরজা বন্ধ করতে পারব না আমার ছেলে ফিরে না আসা পর্যন্ত।"

          পাতা উল্টিয়ে যান সরওয়ার -

          আজ সাড়ে তিন মাস আমার স্ত্রী গত হয়েছেন। স্ত্রী-শোক ভুলে গেছি কিন্তু পুত্র-শোক ভুলতে পারছি না। ব্যর্থ এক পিতা আমি। প্রিয় সন্তান আমাকে পর ভেবে ঘর ছেড়েছে - এ কষ্ট আমি ভুলি কী করে?

          মনে পড়ছে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়ার পর একজন ফোন করে বলেছিল এরকম একটা লোককে সে পাগলা শাহ্‌র মাজারে দেখেছে।

          হঠাৎ মনে হয়েছিল একথাটা এতদিন মনে পড়েনি কেন? অসুস্থ হবার পর তার মা-তো ছেলেকে নিয়ে মাজারেও কম ধরনা দেয়নি। সত্যি সত্যি মাজারে যায়নি তো!

          প্রায় তিন সপ্তাহের মতো সারা দেশের মাজারে ঘুরেছেন। পেছন থেকে কতজনকে বাবর মনে হয়েছে, তারপর মুখ ফিরাতেই চূড়ান্ত হতাশা। যেন শিখর থেকে গহ্বরে পতন। কত ঘরভোলা পাগলকে খুঁটিয়ে দেখেছেন পা থেকে মাথা পর্যন্ত। তারপর আবার সেই বুকভাঙা কষ্ট নিয়ে ঘরে ফেরা।           নাসিমা বেঁচে থাকলে হয়তো এ কষ্ট ভাগাভাগি করে নেয়া যেত। কিন্তু সে তো গম্যের বাইরে। তাছাড়া সে থাকলে তো তার এই পাগলটাকে নয়নের মণি করে রাখত।

          আজ রাঙামাটি গিয়েছিলাম - পাতা উল্টাতেই চোখে পড়ল।

          মনে পড়ল পাড়ার এক দোকানি বলেছিল রাঙামাটিতে একজন বড় গুণীন আছে। তার কাছে তদবীর করালে ভাল ফল পাওয়া যায়।

          হ্যাঁ, গিয়েছিলেন সেই দোকানিকে নিয়ে। অদ্ভুত এক কাজ করতে হয়েছিল। দোকান থেকে কাঁচা মাংস কিনে সেই মাংস গুণীনকে দিয়ে মন্ত্রপূত করে একটা কুকুরকে খাওয়াতে হয়েছিল। অন্যসময় অন্য কেউ হলে হয়তো তিনি নিজেও এটা নিয়ে হাসাহাসি করতেন। কিন্তু সেদিন কুকুরকে মাংস খাওয়াতে খাওয়াতে আল্লাহ্‌কে ডেকেছিলেন মনস্কামনা পূরণের জন্য। কিন্তু না, কিছুই হয়নি। সব প্রার্থনা মিথ্যে হয়েছে। তবু যাচ্ছেন, খুঁজছেন।

          তিন বছর হয়ে গেল। তুকতাক দোয়াতাবিজ নিখোঁজ সংবাদ প্রচার কতকিছুই তো করলেন। মাঝে মাঝে মনে হয় ছেলের মতই যেদিকে দু'চোখ যায় বেরিয়ে যেতে - দেশের প্রতিটা ঘরে, প্রতিটা কোণে, প্রতিটা লতা-পাতার নিচে খুঁজে দেখতে। কিন্তু এই বয়সে যে সে শক্তি নেই।

          তবু আমি তোকে খুঁজব। তোর অপেক্ষায় বসে থাকব। তুই শুধু একবার আয়। আর কখনও তোকে দূর দূর করব না। তুই যে আমার প্রাণের ধনরে বাপ। দেখিস না তোর জন্য আমি দরজা বন্ধ করি না। তুই যদি বন্ধ দরজা দেখে ফিরে যাস -  

          খস খস করে লিখতে থাকেন। তার দু'চোখে জলের ধারা।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

Henry Cavendish: A Strange Man, an Extraordinary Scientist

  The ladder of science and technology on which humanity has climbed so high was built upon the foundations laid in great research laborator...

Popular Posts