Saturday, 8 February 2025

রিফাৎ আরার ছোটগল্প - প্রত্যাশা



__________________________________________

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

গল্পগ্রন্থ - জীবনের গল্প ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪

গল্প - প্রত্যাশা
__________________________________________

প্রত্যাশা

 

সন্ধ্যে হয়ে আসছে। এবার উঠতে হবে। অনেক কাজ পড়ে আছে। আয়াকে ডাকলেন সাইদা - "হালিমা, হালিমা।"

          পাশের ঘর থেকে সাড়া দিল হালিমা, আমি এখানে বিছানা করছি।

          উঠে দাঁড়ালেন সাইদা। দাঁড়াতেই মেরুদন্ডটা টন্‌ টন্‌ করে উঠল। আজকাল এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াতে পারেন না। পিঠটাও একটু বেঁকে গেছে। সোজা হয়ে হাঁটতেও পারেন না। পা ঘষটে ঘষটে পাশের কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলেন।

          হালিমা মেঝেতে বিছানা পাতছে। বিছানা বলতে মোটা সতরঞ্জির উপর সাদা চাদর। ধবধবে সাদা। প্রায় প্রতিদিনই চাদরগুলো হালিমাকে দিয়ে ধোয়ান। এটাই একমাত্র বিলাসিতা এখন সাইদার জীবনে। প্রতিদিন বাচ্চারা বিছানা ময়লা করে দেয়, ওদের গড়াগড়িতে কুঁচকে যায়। পরদিন আবার ধুয়ে টানটান করে শুকাতে দেন। সন্ধ্যায় আবার ধবধবে বিছানা। হালিমা গজ গজ করে। প্রতিদিন ধুতে চায় না। কিন্তু এ একটা ব্যাপারে আপোষ করেন না সাইদা। বাচ্চারা শোয় বসে গড়াগড়ি দেয়। নোংরা চাদর ভাল লাগে না। তাছাড়া নোংরা-ময়লা তাঁর নিজেরও ভাল লাগে না। সাদা বকের পালকের মত বিছানা না দেখলে কাজে মন বসে না।

          কাজ! নিজের মনেই হেসে উঠলেন সাইদা। একে কি কাজ বলে? কিন্তু না বলেই বা কী বলবেন। এ করেই তো তাঁর দিন কাটছে। সংসারটা চলে যাচ্ছে। সংসার বলতে অবশ্য তিনি আর হালিমা।

          তিন তিনটে সংসার করে একটি মাত্র মেয়ে নিয়ে হালিমা যেদিন এসে দাঁড়াল সেদিন ওকে ফিরিয়ে দিতে পারেন নি সাইদা। বরং মনে হয়েছিল তাঁর নিঃসঙ্গ জীবনে ও বুঝি একটা আশীর্বাদ। তারপর মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে সেও এখন একা। সাইদা আর হালিমা পরস্পরকে জড়িয়ে আছে। কে যে লতা আর কে গাছ বোঝা যায় না।

          মোমবাতিটা কোথায়?

          তাকের ওপরে।

          তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়। ছেলে-পিলে আসার সময় হয়ে যাচ্ছে

          সন্ধ্যেবেলায় পাড়ার যত বাচ্চা তাঁর কাছে আসে। আসে গল্প শুনতে। মা-বাবারা ওদের দিয়ে যায়। কেউ কেউ বুয়ার হাত ধরে আসে।

          সারাদিন এ সময়টার প্রতীক্ষায় থাকেন সাইদা বেগম। সারাদিন তেমন কোন কাজ থাকে না। টুকিটাকি কাজ আর বই পড়া। বাচ্চাদের গল্প শোনাতে গেলে গল্প পড়তে হয়। বারবার একই গল্প পড়তে পড়তে মুখস্থ হয়ে গেছে।   ইদানীং চোখেও ঝাপসা দেখেন। একটানা বেশিক্ষণ পড়তে পারেন না। তখন এঘরে ওঘরে হাঁটাহাঁটি করেন।

          আজকাল হাঁটতেও কষ্ট হয়। অথচ সময় যেন কাটতে চায় না। পুরনো ইজি চেয়ারটায় শুয়ে তখন অতীতের স্মৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া চলে। তাও কি ভাল লাগে! জীবনে এত স্মৃতি এত ঘটনা। তবু ঘুরে ফিরে শুধু একটি মুখ, একজন মানুষের কথাই মনে পড়ে।

          জীবনতো এমন কিছু দেয়নি তাঁকে। বাবার মৃত্যুর পর মায়ের হাত ধরে মামাদের সংসারে। তারপর অনেক কষ্ট করে লেখা-পড়া। কোন রকমে ম্যাট্রিক। তারপর মামা-মামীদের উৎপাত। অনেক পড়েছে। মেয়ে কি জজ-ব্যারিস্টার হবে? এবার বিয়ে দাও

          মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল বাবার সামান্য যা কিছু ছিল তা দিয়ে মেয়েকে পড়ানোর। কিন্তু বৈরী পরিবেশের সাথে পেরে উঠলেন না। বাধ্য হয়ে যা জমা-পাতি ছিল তাই শূন্য করে মেয়ের বিয়ে দিলেন। স্বামীর সঙ্গে তার কর্মস্থলে গিয়েছিলেন। ছিমছাম একটা সংসার গুছিয়ে নিচ্ছিলেন।

          মানুষটা ভালই ছিল। তারও সংসারে তেমন কেউ ছিল না। বাবা-মা বিগত। বড় ভাইয়েরা সবাই আগে থেকেই যার যার মত সংসারে ব্যস্ত। সাইদা স্বপ্ন দেখেছিলেন মাকে নিজের কাছে নিয়ে আসবেন। সংসার গুছিয়ে আবার পড়াশোনা করবেন।

          কিন্তু আঘাতটা এল আচমকা। ঘূর্ণিঝড়ের পর উপদ্রুত এলাকায় অফিস থেকে ত্রাণ দিতে গিয়েছিল তাঁর স্বামী মঈন। এলো পায়ে ক্ষত নিয়ে। তারপর চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে শুরু হলো যমে-মানুষে লড়াই। আর ভাগ্য এমন যে যমেরই জিত হলো। ধনুষ্টঙ্কারে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তরতাজা লোকটা কবরে ঢুকে গেল।

          সাইদা শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। আর মাতো একদম পাগল। আর সবচেয়ে আশ্চর্য - সাইদাকে মোটেও সহ্য করতে পারতেন না। চোখের সামনে দেখলেই হাতের কাছে যা পেত তাই ছুঁড়ে মারত। এ অবস্থায় একদিন টের পেলেন শরীরে আরেকজনের আগমন।

          আবার মামাদের সংসারে। কী কষ্ট আর যন্ত্রণা যে পেয়েছেন। কারো সামনে মুখ দেখাতে ইচ্ছে করতো না। মনে হতো বাবার মৃত্যু, মায়ের পাগলামী আর মঈনের মৃত্যুর জন্য সবাই তাকে দুষছে।

          তারপর একদিন এলো সেই রাজপুত্তুর। আশ্চর্য। সাইদা বা মঈন কেউ ততো সুন্দর ছিল না। ছেলেটা কীভাবে এত সুন্দর হল। শেষে এমন হল মামাবাড়ির মানুষেরাই ওকে বুকে করে বড় করতে লাগল।

          সাইদা ইতিমধ্যে পি-টি-আই পাশ করে স্কুলে একটা চাকরি নিয়েছে। তারপর একদিন চাকুরি নিয়ে এ মফস্বল শহরে।

          সে কতদিন আগের কথা। তখনো আজকের মত মেয়েদের চাকরির এত চল ছিল না। একজন মহিলা একা অপরিচিত একটি জায়গায়।

          সেদিন হালিমার মা পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। অনেক ঝড়-ঝাপটা থেকে তাকে রক্ষা করেছে। দুহাতে সবকিছু থেকে আড়াল করেছে। তন্ময়কে বড় করেছে। ঘর-সংসার নিয়ে ভাবতে হয়নি। পাড়া-পড়শীরাও সময়ে অসময়ে সাহায্য করেছে। জ্বালাতনও করেছে কেউ কেউ। হিতাকাঙ্ক্ষী দুএকজন প্রলোভন দেখিয়েছে আবার নতুন করে জীবন শুরু করার।

          কিন্তু সাইদার মন সরেনি। একবারে যখন সংসার করা হলো না তখন আর দরকার কী। আর তন্ময়! সাত রাজার ধন মানিককে কার হাতে তুলে দেবে? তেমন মানুষ কি আছে? তার চেয়ে বুকের মানিককে বুকে ধরে রাখাই ভাল।

          চোখ ফেটে জল এলো। ধরে রাখতে পারলেন কি? ওতো শুধু তার সঙ্গে ছল করতে এসেছিল। নইলে অমন স্বর্গীয় সম্পদ তাঁর কাছে থাকবে কেন? কত আদর করে মানুষ করছিলেন। এত আদরের ধন। অথচ কী হল!

          এখানে আসার পর কিছু কিছু করে জমিয়ে এ বাড়িটার জায়গাটুকু কিনেছিলেন। তখন সস্তাগন্ডার দিন। মা-বেটা খেয়েও কিছু কিছু সঞ্চয় থাকত। সাহস করে একদিন ছোট্ট এই বাড়িটাও শুরু করেছিলেন।

          ততদিনে এ শহরে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি। যে সব মেয়েদের পড়ালেখা করিয়েছেন তাদের অনেকে বিয়ে থা করে সংসারী। সাইদাআপাকে তারা শ্রদ্ধা করে। সবাই সাহায্য সহযোগিতা করেছে। একদিন সাইদা দেখলেন তাঁর বাড়িটা দাঁড়িয়ে গেছে।

          কিন্তু ততদিনে তার ভাগ্যের আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। তন্ময় এস-এস-সি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। এ সময় একদিন শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। কিছুতেই ছেলেকে ধরে রাখতে পারেন নি সাইদা। নয়টা মাস কী অপরিসীম যন্ত্রণায় কেটেছে প্রতিটি প্রহর। সারাদিন পথের দিকে চেয়ে থাকা, আর রাতে নিঃশ্বাসের শব্দেও মনে হত ঐ বুঝি এলো।

          কত রকম গুজব। একজন এসে একদিন একরকম কথা বলে যায়। আশা আর নিরাশার সে কি দ্বন্দ্ব। তবুতো শেষ হয়েছিল সে দিন। একদিন উজ্জ্বল ভোর হয়েছিল।

          দেশ স্বাধীন হলে তন্ময় ফিরে এসেছিল। একমুখ গোঁফ-দাড়ি। আশ্চর্য। নয়টা মাসের মধ্যে কিশোর ছেলেটি যুবক হয়ে গেল। সাইদা একটু একটু করে দেখতে পেলেন না ওর পরিবর্তন। ছেলে বরাবরই শান্ত গম্ভীর প্রকৃতির। ফিরে এসে শুধু মাকে জড়িয়ে ধরেছিল অনেকক্ষণ। সাইদাও কোন কথা বলতে পারেন নি। মায়ের বুকে ছোট্ট পাখির মতো যুবক সন্তানের বুকে মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে কেঁদেছিলেন।

          দিদা

          কে? চমকে উঠলেন। ও শামু, আয় আয়

          তুমি এতক্ষণ কী ভাবছিলে? আমি অনেকক্ষণ এসে দাঁড়িয়ে আছি। বুয়া আমাকে দিয়ে কখন চলে গেছে

          আজ মা আসেনি?

          না, মা কোথায় বেড়াতে যাবে

          ঝাপসা হয়ে আসা চশমাটা খুলে মুছে নিলেন। এ চশমাটা না বদলালে নয়। শামুকে কাছে ডেকে ওর মাথাটা শুঁকলেন। বাচ্চাদের মাথার গন্ধ নিতে খুব ভাল লাগে। মনটা কেমন মমতায় ভরে ওঠে। শামুকে গিয়ে বসতে বললেন।

          এবার মাগরেবের নামাজ পড়ে তিনিও তৈরি হবেন। ইতিমধ্যে বাচ্চারা এসে যাবে।

          একে একে ওরা সবাই এলো - দশ বারোটি বাচ্চা। এ পাড়ার সব ছোট ছোট বাচ্চারা। যাদের বয়স তিন চার থেকে দশ বারোর মধ্যে। মাঝে মাঝে অন্য পাড়া থেকেও দুএকজন আসে।

          এ অভ্যেসটা ছোটবেলা থেকেই ছিল। গল্পের বই পড়তেন। যেখানে যা পেতেন গোগ্রাসে গিলতেন। ছোট ছোট মামাতো ভাই-বোনগুলোকে সে সব গল্প শোনাতেন। যখন বলতেন তখন দেখতেন ওরা হা করে তার গল্প শুনছে। তারপর স্কুলের চাকরিতে এসে মেয়েগুলোকে গল্প শোনাতেন। ওরা অসম্ভব পছন্দ করত। এ নিয়ে অনেক সহকর্মীর ঈর্ষাও ছিল। অথচ ওরাও কোন ঘটনা অন্যকারো চাইতে সাইদার মুখে শুনতে ভালবাসত। তন্ময় যখন খেতে চাইত না তখন গল্পের কথা বললে ওর শান্ত গভীর কালো চোখ দুটো ঝিলিক দিয়ে উঠতো। আর আজ এই গল্প বলা তাঁর পেশা হয়ে গেছে।

          দিদা এসো না। আজ তোমার কী হয়েছে, এত দেরি করছ কেন? ছোট্ট মুমু এসে নামাজের শাড়ি ধরে টানাটানি শুরু করল। প্রতিদিনই এমন হয়। ওদের তর সয় না। একটা শেষ হলতো আরেকটা। কোন কোন গল্প ওরা প্রতিদিন শুনতে চায়।

          বাতিটা নিভিয়ে মোমবাতি ধরালেন সাইদা। মুহূর্তের মধ্যে ঘরের পরিবেশটা যেন বদলে গেল। বাচ্চাদের চোখে-মুখে গভীর আগ্রহ। দেয়ালে কম্পমান শিখার প্রতিফলন। শিখাটা কাঁপছে। সাইদা বেগম শুরু করলেন -           আজ আমি তোমাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলবো---- সে এক কালো রাত। ভয়াল ভীষণ। ঘরে ঘরে দরজা বন্ধ। কেউ জানে না কী ঘটতে চলেছে। শিশুরা মায়ের বুকে ঘুমুচ্ছে। আহ্‌ কি শান্তি। এমন সময় গুড়ুম! ও কিসের শব্দ! বাবা চমকে উঠলেন। মা ভয়ে নিঃশ্বাস রুদ্ধ। আবার গুড়ুম! আবার। ঘুমভাঙা চোখে মানুষগুলো দেখলো দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। সব কিছু পুড়ে যাচ্ছে। চিৎকার- চিৎকার শোনা যাচ্ছে মানুষের - বাঁচাও বাঁচাও। এভাবে শুরু হলো আক্রমণ। মানুষ - মানুষতো নয় পশু। মানুষের মত দেখতে পশুগুলো- দেখতে দেখতে রাক্ষসের মত হয়ে গেল। ওরা রক্ত শুষে নিচ্ছে। আর অসহায় মানুষগুলো ভয়ে দিশেহারা। কোথায় যাবে! কোথায় গেলে রক্ষা পাবে--। ওরা ছুটছে, ছুটছে -

          বলতে বলতে সাইদা বেগমের চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটি মুখ। সেই মুখ- ছুটছে ছুটছে। পেছনে তাড়া করছে পুলিশ। তারপর পেছন থেকে গুলি। গুড়ুম। পড়ে গেল রাস্তায়। পুলিশ দৌড়ে এসে টেনে তুললো। ট্রাকে তুলে নিল। তারপর! তারপর কেউ বলতে পারে না কোথায়- কোথায় গেল সে!

          দিদা, ও দিদা। চুপ করে আছ কেন? বলনা গল্প। তারপর কী হলো? কোলের পাশে বসে থাকা নিলয় ঘন হয়ে বসে কোলের উপর  মাথা রাখল। মুখ নিচু করে ওর মাথার গন্ধ নিলেন।

          হ্যাঁ বলছি। তারপর কী যেন বলছিলাম? খেই হারিয়ে ফেললেন সাইদা। কোথায় যেন শুরু করেছিলেন কিছুতেই মনে পড়ছে না। বেশ কিছুদিন থেকে এমন হচ্ছে। গল্প শুরু করলে বলতে বলতে খেই হারিয়ে ফেলেন। মনে করতে পারেন না।

          আবার বলতে শুরু করলেন। কিন্তু জমছে না। যে আগ্রহ নিয়ে ওরা শুনতে শুরু করেছিল এখন তা নেই। দুএকজন ইতিমধ্যে উঠতে শুরু করেছে। আসলে সাইদা বেগমও বুঝতে পারেন- বয়স তাঁকে কাবু করছে। স্মৃতি ভারাক্রান্ত মন তার সঙ্গী। অতীত নিয়ে মানুষ কত বাঁচতে পারে। আর বাঁচার দরকারই বা কী।

          রিটায়ার করার পরও গত বার বছর বেঁচে আছেন। আশা করেন নি এতদিন বাঁচবেন। মৃত্যু তাঁর আকাঙ্খিত। তবু ওরা আছে বলে বেঁচে আছেন। মনে এখনো নেশা লাগে। ছোট ছোট শিশুগুলো যখন ঘিরে ধরে গল্প শুনতে তখন ক্ষীণ একটা ইচ্ছে জেগে ওঠে বেঁচে থাকার।

          হালিমা এসে বাতি জ্বালিয়ে দিল। মোমবাতিটা নিভিয়ে দিলেন সাইদা। ছেলেমেয়েরা চলে গেছে। আজ গল্প শেষ করতে পারেননি। কেন যে এমন হল।

          সেই রিটায়ার করার পর সামান্য কিছু পেনশান নিয়ে চলা। সঞ্চয় যা ছিল তা তো বাড়ি করতে শেষ। সময় কাটে না। তখন একজন দুজন করে এসেছিল সন্ধ্যেবেলা বাচ্চাদের গল্প শোনাতে হবে।

            আপনার গল্প শুনতে বাচ্চারা খুব ভালবাসে। আমরাই হা করে শুনি

            শুনে চমৎকৃত হয়েছিলেন। এ এক নতুন পেশা - গল্প শোনানো। কিন্তু টাকা নিতে মন চায়নি। কিছুতেই রাজী হননি। অবশেষে ওরা মেনে নিয়েছে। যে মেয়েরা একদিন তাঁর কাছে পড়েছে তারা কৌশলে সাহায্য করেছে। কেউ ঈদে শাড়ি, কেউ শীতে চাদর, কেউ কক্সবাজার থেকে আনা স্যান্ডেল যখন যেটা প্রয়োজন দিয়ে যাচ্ছে। বাড়ি থেকে রান্না করেও নিয়ে আসে।

            দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়ালেন সাইদা। ওরা আছে বলেই তিনিও আছেন। নইলে একাকীত্বের এ শূন্য গহ্বরে কীভাবে বাঁচতেন। আরো কত দুঃসহ হত।

            তন্ময়টা চলে গেল। এমনি করে যাবে কে জানতো। যুদ্ধ থেকে আসার পর আবার পড়াশোনা শুরু করেছিল। আইএ পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিল। সাইদার চোখে স্বপ্ন। যে ভাবেই হোক ছেলেকে মানুষ করতে হবে। টিউশনি বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু কোথায় গেল ছেলে!

          সর্বনাশা জোয়ার এল। কোথায় ভেসে গেল কেউ জানে না। শুধু তিনি আজো মনে মনে ডেকে ফিরেন- তন্ময়, তন্ময়

          কখন কীভাবে ও রাজনীতিতে জড়িয়ে ছিল সাইদা জানতেন না। আর জানবেন কীভাবে। মফস্বলে বসে ঢাকা শহরে কী ঘটছে কে জানতো। তিনি তো ব্যস্ত টিউশনি নিয়ে। একদিন খবর এলো। ওর বন্ধুরাই এনেছিল খবর। খুব চুপি চুপি। এর আগে পাড়ার লোকেরা কানাকানি করছিল। সাইদা পড়তে পারেননি তাদের চোখের ভাষা।

          আজো বিশ্বাস হয় না। আর কাউকে বলতেও পারেন না। কিন্তু সাইদা মনে আশা নিয়ে আছেন - যদি সে আসে। যদি মিথ্যে হতো লোকের সব খবর। মনের অত্যন্ত গভীরে এ আশাটুকু নিয়ে বেঁচে আছেন একথা কেউ জানে না। শুনেছেন ওদের দলটা আন্ডারগ্রাউন্ড ছিল। ও যদি কোথাও লুকিয়ে থাকে। মিথ্যে মিথ্যে মিথ্যে।

            না, সত্যি সত্যি সত্যি বিড় বিড় করে উঠলেন সাইদা।

            আজ সকাল থেকে আকাশটা মেঘলা। মেঘ দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়। তাহলে আজ সন্ধ্যায় ওরা আসতে পারবে না। অবশ্য মেঘলা দিনেও দুএকজন মাকে জোর করে নিয়ে আসে। মা এসে বলে কিছুতেই রাখা গেল না সাইদা আপা। গল্প শুনতে আসতেই হবে

            সাইদা তখন ওদেরকে ঝড়ের রাতের গল্প শোনান। যে রাতে ভয়ঙ্কর এক ঝড়ে হারিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের উপকূলের অনেক মানুষ। তারপর সেই মেয়েটি যাকে  অনেক বছর পরে খুঁজে পেয়েছিল তার বাবা-মা।

            একটু পরেই জোরে বৃষ্টি নামল। এলোমেলো ঝড়ো বাতাস। সাইদা জানালার পর্দা তুলে দিলেন। গাছে গাছে হাওয়ার দাপাদাপি। বুকটা কেমন মুচড়ে ওঠে। আজ বুকটা ব্যথাও করছে।

            দুপুরের পর আবার সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। চারদিকে ঝকঝকে আলো। সাইদার মনটা খুশি হয়ে উঠলো। আজ যেন অকারণে খুশি লাগছে। যাক। আজ ওরা এলে একটা মজার গল্প শোনাবেন- যে গল্প শুনে ওরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়বে।

            সন্ধ্যে হয়ে গেল। আজ কেউ আসছে না। সাইদা হালিমাকে ডাকলেন- চাদর বিছিয়ে দে

            নামাজ পড়ে মোমবাতিটা হাতে নিলেন। আশ্চর্য এখনো কেউ এলো না। ঝড়ের দিনেও ওরা আসে। আর আজ! তবে কি সাইদার গল্প শুনতে ওদের ভাল লাগছে না! তিনি যে ভুলে যান, খেই হারিয়ে ফেলেন এটা ওরা বুঝতে পারছে। ছোট শিশুরা অনেক কিছু বুঝতে পারে।

            মোমবাতিটা সামনে নিয়ে অনেকক্ষণ বসে রইলেন। বুকের ভিতরটা কেমন মোচড় দিচ্ছে। উঠে দাঁড়াতে গেলেন। হালিমাকে ডাকতে চাইলেন। মনে হল বাচ্চারা এসে গেট নাড়াচ্ছে। দরজা খুলতে হবে। হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন। গোঁ গোঁ একটা শব্দ বের হল গলা দিয়ে। না বলতে পারার দুঃখে শরীরটা কাঁপছে।

            মোমবাতির শিখাটা তেমনি নিষ্কম্প।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

Terry Wogan's "The Little Book of Common Sense"

  What we call common sense in English is not very common at all. If common sense could be learned by reading books, then those who have re...

Popular Posts