Friday 6 August 2021

রবীন্দ্রনাথের শেষ লেখা

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯৪১)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শারীরিকভাবে বেঁচেছিলেন আশি বছর (১৮৬১ – ১৯৪১)। তাঁর মৃত্যুর বয়সও আশি হয়ে গেল। অথচ তিনি আমাদের জীবনের মননশীল সব কাজে চিন্তায় আনন্দে বিষাদে প্রেমে বিরহে হেলাফেলায় সারাবেলায় কী অপরূপভাবে জীবন্ত। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘শেষ লেখা’ প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর। ১৩৪৮ বাংলার ভাদ্র মাসে। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ ঘটে তার কিছুদিন আগে – ১৩৪৮ বাংলার ২২শে শ্রাবণ।

‘শেষ লেখা’ গ্রন্থের নামকরণ রবিঠাকুর নিজে করে যেতে পারেননি। বইয়ের ভূমিকায় কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন এ কথা। এই বইতে ১৫টি কবিতা আছে – যার মধ্যে কয়েকটি কবিতা কবি নিজের হাতে লিখতে পেরেছিলেন। বাকিগুলি কবি রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে মুখে মুখে বলেছিলেন – অন্যরা লিখে নিয়েছিলেন। কবি পরে সেগুলি দেখে সংশোধন করেছিলেন। একেবারে শেষের কবিতা “তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি’ সংশোধন করার সময় পাননি। 

এই কবিতাগুলির কোনটারই শিরোনাম নেই। কবিতার প্রথম লাইনকেই কবিতার শিরোনাম ধরা হয়েছে। এই ১৫টি কবিতার মধ্যে কয়েকটি কবিতা নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। বহুল আলোচিত কবিতার একটি হলো – 


“প্রথম দিনের সূর্য

প্রশ্ন করেছিল

সত্তার নূতন আবির্ভাবে,

কে তুমি—

মেলে নি উত্তর।

বৎসর বৎসর চলে গেল,

দিবসের শেষ সূর্য

শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম-সাগরতীরে,

নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়,

কে তুমি—

পেল না উত্তর।“

এই কবিতাটি কবি লিখেছিলেন ২৭ জুলাই ১৯৪১ সালে – তাঁর মৃত্যুর মাত্র ১২দিন আগে। এই কবিতার অনেক রকমের দার্শনিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে – এখনো হচ্ছে। কবিতাতে যে ব্যাপারটা স্পষ্ট – সেটা হলো জীবনের অস্পষ্টতা। যে আমিত্বের বড়াই মানুষ করে – তার স্বরূপ কী? কে আমি? – এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। 

রবিঠাকুরের জীবনের সর্বশেষ রচনা – 

“তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি

বিচিত্র ছলনা-জালে,

হে ছলনাময়ী।

মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে

সরল জীবনে।

এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত;

তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি।

তোমার জ্যোতিষ্ক তারে

যে পথ দেখায়

সে যে তার অন্তরের পথ,

সে যে চিরস্বচ্ছ,

সহজ বিশ্বাসে সে যে

করে তারে চিরসমুজ্জল।

বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু,

এই নিয়ে তাহার গৌরব।

লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত।

সত্যেরে সে পায়

আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে।

কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে,

শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে

আপন ভাণ্ডারে।

অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে

সে পায় তোমার হাতে

শান্তির অক্ষয় অধিকার।“ 


মৃত্যুর আট দিন আগে রচিত (৩০ জুলাই ১৯৪১) এই কবিতায় কি কোনোভাবে কবির বিরক্তি প্রকাশিত হয়েছে ছলনা এবং মিথ্যার কারণে? 

‘মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে সরল জীবনে’ – এ যেন আমাদের প্রত্যেকের মনের কথা – যখন আমাদের বিশ্বাস ভেঙে যায় প্রতারণার ফাঁদে। 

কবির জীবনের শেষ পংক্তি – ‘অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে, সে পায় তোমার হাতে – শান্তির অক্ষয় অধিকার।“ এ যেন নিজেকে সান্তনা দেয়া – ছলনা সয়ে যাবার পরেও মনে মনে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা। কষ্ট লাগে – যখন জীবনের সায়াহ্নে বসে বিশ্বকবিকেও ভাবতে হয় কী ছলনাময় এই জগতের চারপাশ। 


No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts