Wednesday 1 April 2020

পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালাম - পর্ব ১০


মৃত্যু এবং তারপর

১৯৯৩-৯৪ সালে শরীর ক্রমশ খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো আবদুস সালামের। ১৯৯৪ সালে আই-সি-টি-পি'র পরিচালক পদ থেকে অবসর গ্রহণ করলেন তিনি। আই-সি-টি-পি'র পরিচালনা পরিষদ তাঁকে সেন্টারের আজীবন সভাপতি মনোনীত করলো।  
       ইতালিতে ট্রিয়েস্তের বাসায় সালাম একা থাকতেন। একদিন রাতে অসুস্থ আবদুস সালাম বাথরুমে পড়ে গেলেন। মাথা ফেটে গেলো তাঁর। অজ্ঞান না হলেও শরীরে শক্তি ছিল না উঠার, কাউকে ফোন করার। সারা রাত পড়েছিলেন বাথরুমের ভেজা ঠান্ডা ফ্লোরে। পরদিন সকালে তাঁর ড্রাইভার এসে তাঁকে পেলেন সেই অবস্থায়।
          আবদুস সালামের দুই স্ত্রীর কেউই তাঁর সেরকম নিত্যসঙ্গী হননি। প্রথম স্ত্রী হাফিজা সালামের দ্বিতীয় বিয়ের খবর জানার পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। স্বামীর সাথে ইতালিতে গিয়ে থাকতে রাজি হননি তিনি। তাছাড়া তাঁর ছেলেমেয়েদের পড়াশোনাসহ সবকিছু লন্ডনে।
          সত্তর পেরোবার আগেই পার্কিনসন্স রোগে আক্রান্ত হন আবদুস সালাম। আস্তে আস্তে পায়ে হাঁটার ক্ষমতা চলে যায় তাঁর। হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতে হতো। মাঝে মাঝে তিনি জোর করে হাঁটতে গিয়ে পড়ে যেতেন। কথা বলার ক্ষমতাও আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছিলো।
          ১৯৯৬ সালে তাঁর অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকে। ১৯৯৫ সালে তাঁর ওজন ছিল প্রায় ৮৫ কেজি। সেখানে ১৯৯৬ সালে তাঁর ওজন নেমে আসে ৪৫ কেজিতে। সালাম তখন অক্সফোর্ডে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে থাকেন। সালামের প্রাক্তন ছাত্র, সহকর্মী ও বন্ধুরা ১৯৯৬ সালের ২৯ জানুয়ারি তাঁর ৭০তম জন্মদিন পালনের প্রস্তুতি নেয়। পাকিস্তান অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মুনির আহমেদ চৌধুরি অক্সফোর্ডে এসে আবদুস সালামকে নিমন্ত্রণ করে যান। তাঁকে জন্মদিন উপলক্ষে পাকিস্তানে নিয়ে যাবার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু শরীর এতটাই খারাপ ছিল যে যাওয়া হয়নি সালামের।
           ১৯৯৬ সালের ২১ নভেম্বর অক্সফোর্ডের বাড়ীতে মারা যান আবদুস সালাম। সালামের ইচ্ছানুসারে মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ নিজের দেশের মাটিতে দাফন করার জন্য পাকিস্তানে নিয়ে আসা হয়। নভেম্বরের ২৪ তারিখ ৮টা ৪৫ মিনিটে মৃতদেহ লাহোর বিমান বন্দরে পৌঁছায়। সেখান থেকে মৃতদেহ নিয়ে আশা হয় তাঁর বাবার বাড়িতে। ২৫ নভেম্বর সকাল দশটায় তাঁকে দাফন করা হয় রাবওয়াতে তাঁর মা-বাবার কবরের পাশে।
          আহমদিয়াদের নিজেদের শহর- রাবওয়া। কিন্তু রাবওয়া নামটাও গ্রহণযোগ্য নয় সেখানে। রাবওয়া নাম বদলে রাষ্ট্রীয় হুকুমে নাম রাখা হয়েছে- চেনাব নগর। সালামের নিজের গ্রাম ঝাং। সালাম মৃত্যুর পর সেখানেই থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মৌলবাদীদের বাধায় সেখানে কবর দেয়া যায়নি তাঁকে।
          তাঁর নিজের গ্রামের মানুষ, যাদের স্কুল ও কলেজের জন্য আবদুস সালাম তাঁর নোবেল পুরষ্কারের পুরো টাকাই দিয়ে দিয়েছেন- সেই আইন মেনে চলা মানুষ, ধর্ম মেনে চলা মানুষ দেখতে যান দাফনের সবকিছু আইনমতো হয়েছে কিনা ধর্মমতো হয়েছে কি না। অর্থাৎ আহমদিয়া 'অমুসলিম'রা আবার মুসলমানদের মতো কিছু করে ফেললো কিনা। করলেই রাষ্ট্রীয় আইনে ছয় মাসের সশ্রম কারাদন্ড!

আবদুস সালামের কবর
চেনাব নগরে আবদুস সালামের সমাধি-ফলকে লেখা ছিল: “Abdus Salam the First Muslim Nobel Laureate” সমাধি-ফলক স্থাপনের পর পুলিস সাথে নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট এসে মুসলিম শব্দটা মুছে দেন। তাতে লাইনটি দাঁড়ায় “Abdus Salam the First Nobel Laureate” এর যে কোন অর্থ হয় না তাতে কিছু আসে যায় না আইনের ও ধর্মের অনুসারীদের।
          মৃত্যুর পর তেমন কোন রাষ্ট্রীয় সম্মান দেখানো হয়নি পাকিস্তানের একমাত্র নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীকে। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে একটা গতানুগতিক শোকবার্তা জানানো হয়।
          মৃত্যুর পর লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি বিভাগে আবদুস সালাম চেয়ার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়া পাকিস্তানের আর কোথাও আবদুস সালামের সম্মানে কিছুই করা হয়নি। প্রচারমাধ্যমে আবদুস সালামের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে কিছুই প্রকাশ করা হয় না।
          ১৯৯৮ সালে আবদুস সালামের নামে দুই রুপির একটি স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করে পাকিস্তান সরকার। কিন্তু সেই ডাকটিকেট কোন পোস্ট-অফিসে বিক্রির জন্য পাঠানো হয়নি।
          ২০০১ সালে বেনিন প্রজাতন্ত্র আবদুস সালামের সম্মানে দুটো স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করে।



জেনেভায় ইউরোপিয়ান নিউক্লিয়ার গবেষণাগার সার্নের একটি রাস্তার নাম রাখা হয় আবদুস সালামের নামে।



১৯৯৭ সালের নভেম্বর মাসে আবদুস সালামের স্মরণ সভা হয় আই-সি-টি-পিতে। সেই সভায় এই কেন্দ্রের নামের সাথে আবদুস সালামের নাম যোগ করা হয়। 'আবদুস সালাম ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিররেটিক্যাল ফিজিক্স' এখনো তাঁর উত্তরাধিকার সগৌরবে বহন করে চলেছে।
          ১৯৮১ সালের ২ জুলাই ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর আবদুস সালামকে সম্মানসূচক ডিএসসি প্রদান অনুষ্ঠানে রয়েল সোসাইটির ফেলো প্রফেসর জন হাইম্যান বলেছিলেন "আবদুস সালাম একজন একব্যক্তির বহুজাতিক কর্পোরেশন যিনি মেধাভিত্তিক প্রকৌশল পৃথিবীর অনুন্নত দেশগুলোতে ব্যস্ততার সাথে সরবরাহ করছেন।" এই এক-ব্যক্তির বহুজাতিক কর্পোরেশন' আবদুস সালামের কাছে উন্নয়নশীল বিশ্বের পদার্থবিজ্ঞান চিরঋণী হয়ে থাকবে। 




2 comments:

  1. Prof Abdus Salam as a Nobel Laureate in Physics and a brilliant scientist will remain as the brightest star in the Muslim world. But those mullahs, Pakistan as a state etc will go down in the history as the most despicable entities.

    ReplyDelete
    Replies
    1. Thank you sir for your insightful important comment. What professor Salam did for the development of science in the third world countries, a lot of people yet to understand the values of it.

      Delete

Latest Post

বিজ্ঞানী গীতাঞ্জলি রাও

  পানি-দূষণের মাত্রা নির্ধারণের দ্রুততম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ‘টেথিস’ উদ্ভাবন করে গীতাঞ্জলি রাও যখন   ২০১৭ সালে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ তরুণ বিজ্ঞানীর শ...

Popular Posts