Friday, 10 April 2020

জগদীশচন্দ্র বসু - পর্ব ৪


লন্ডন ও কেমব্রিজে উচ্চশিক্ষা

১৮৮০ সালে লন্ডনের উদ্দেশ্যে সমুদ্র-যাত্রা করলেন জগদীশচন্দ্র। কিন্তু তাঁর শরীর ভালো ছিল না। কালাজ্বরের প্রভাবে তখনো তিনি ভীষণ দুর্বল। দীর্ঘ জাহাজ-ভ্রমণ তাঁর মোটেও ভালো লাগেনি। জাহাজের মধ্যেই তিনি একদিন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। সহযাত্রীদের অনেকেই শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন এই ভেবে যে জগদীশচন্দ্র বুঝি মারা যাবেন।
          লন্ডনে জগদীশচন্দ্রের জামাইবাবু আনন্দমোহন বসু জগদীশের থাকার জায়গা ঠিক করে রেখেছিলেন। সেখানে কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে জগদীশ ডাক্তারি পড়ার জন্য ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অন্তর্ভুক্ত একটা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ভর্তি হবার জন্য ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি ও বায়োলজির পরীক্ষায় তিনি সহজেই পাস করে যান। কিন্তু অ্যানাটমির ক্লাসে মাথাঘুরে পড়ে গেলেন জগদীশচন্দ্র। শব ব্যবচ্ছেদের পরিবেশ সহ্যই হলো না তাঁর। শরীরও খারাপ। এ অবস্থায় শারীরবিদ্যার অধ্যাপক তাঁকে পরামর্শ দিলেন - চিকিৎসাবিজ্ঞান বাদ দিয়ে অন্য কোন বিষয়ে পড়াশোনা করার। হাসপাতালের চিকিৎসক প্রফেসর রিঙ্গার জগদীশচন্দ্রের চিকিৎসা করছিলেন। তিনিও একই পরামর্শ দিলেন।

আনন্দমোহন বসু

          একটা বছর নষ্ট হলো জগদীশচন্দ্রের। পরের বছর কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হলেন তিনি। এ ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করেছেন তাঁর জামাইবাবু আনন্দমোহন বসু। ১৮৭০ সালে আনন্দমোহন কেমব্রিজে ভর্তি হয়ে ১৮৭৪ সালে গণিতে ট্রাইপস করে ভারতবর্ষের প্রথম রেংলার হয়েছিলেন। আনন্দমোহন বসুর সুপারিশে ক্রাইস্ট কলেজে জগদীশচন্দ্রের জন্য একটা বৃত্তির ব্যবস্থাও হলো।
          ক্রাইস্ট কলেজে পড়ার সময় শুরুতে কী কী সাবজেক্ট নেবেন তা ঠিক করতে পারছিলেন না জগদীশ। তাই প্রথম দিকে তিনি যতটা সম্ভব সব বিষয়ের লেকচার শুনেছেন। প্রফেসর মাইকেল ফস্টারের শারীরবৃত্ত ও জিওলজিতে প্রফেসর হিউজের লেকচার শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। পরে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও উদ্ভিদবিজ্ঞানের ক্লাস করেন নিয়মিত। রসায়নে প্রফেসর লিভিং ও বোটানিতে ফ্রান্সিস ডারউইন ছিলেন তাঁর প্রিয় প্রফেসর। ফ্রান্সিস ডারউইন ছিলেন বিবর্তনবাদের জনক চার্লস ডারউইনের ছেলে। তবে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক লর্ড র‍্যালের লেকচারে। জগদীশচন্দ্রের পদার্থবিজ্ঞানী হবার পেছনে যে দু'জন প্রফেসরের লেকচার সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে তারা হলেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ফাদার লাঁফো এবং কেমব্রিজের প্রফেসর লর্ড র‍্যালে (Lord Rayleigh)। লর্ড র‍্যালে আর্গন গ্যাস আবিষ্কার করার জন্য ১৯০৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন।

লর্ড র‍্যালে

গ্র্যাজুয়েশানে জগদীশচন্দ্র বসু

          কেমব্রিজে তিন বছর পড়াশোনার পর ১৮৮৪ সালে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি ও বোটানির সমন্বয়ে ন্যাচারাল সায়েন্সে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন জগদীশচন্দ্র। কেমব্রিজের রেজাল্টের ভিত্তিতে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বিএসসি ডিগ্রি লাভ করলেন জগদীশচন্দ্র। সেই সময় এরকম ব্যবস্থা ছিল। লেখাপড়া সম্পন্ন করার উপযুক্ত প্রমাণপত্র দাখিল করলে তা ডিগ্রির জন্য গৃহীত হতো।
          লন্ডনে থাকার সময় আনন্দমোহন বসুর সুবাদে পোস্টমাস্টার জেনারেল ফসেটের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয় জগদীশচন্দ্রের। ভারতে আনন্দমোহন বসুর তখন অনেক প্রভাব। তাঁর শ্যালক হিসেবে জগদীশচন্দ্রও অনেক সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন ইংল্যান্ডে। খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ও ইংল্যান্ডের তৎকালীন পোস্টমাস্টার জেনারেল হেন্‌রি ফসেট (Henry Fawcett) ছিলেন আনন্দমোহন বসুর রাজনৈতিক বন্ধু।


 
হেনরি ফসেট


কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও ফেলো হেনরি ফসেটের ছিল বহুমুখী ক্যারিয়ার। ১৮৫৬ সালে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন ফসেট। ১৮৫৮ সালে শিকার করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় তিনি অন্ধ হয়ে যান। কিন্তু অন্ধ হয়েও তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যান। অত্থনীতি ও আইন পড়েন। ব্যারিস্টারও হয়েছিলেন। তবে অর্থনীতিবিদ হিসেবে তাঁর সুনাম বিশ্বব্যাপী। ১৮৬১ সালে চার্লস ডারউইনের বিবর্তন-তত্ত্বের সপক্ষে তিনি মামলা লড়েন এবং বিবর্তনবাদ প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। ১৮৬৩ সালে তিনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির পলিটিক্যাল ইকোনমিক্সের প্রফেসর নিযুক্ত হন। ১৮৬৫ সালে তিনি ব্রাইটন থেকে লেবার পার্টির এম-পি নির্বাচিত হন। ১৮৮০ সালে তিনি পোস্ট-মাস্টার জেনারেল নিযুক্ত হন। লন্ডনে পড়াশোনার সময় জগদীশচন্দ্র হেনরি ফসেটের সাথে দেখা করতেন।
          
কেমব্রিজ ও লন্ডনের লেখাপড়া শেষ করে জগদীশচন্দ্র যখন ভারতে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখন ফসেট জগদীশচন্দ্রের পরবর্তী পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চান। স্বাভাবিকভাবেই তখন একটা চাকরির দরকার তাঁর। গবেষণা করবেন এরকম কোন ইচ্ছা বা পরিকল্পনা তখন ছিল না জগদীশচন্দ্রের। তাঁর মাথায় তখন একটাই চিন্তা - দেশে ফিরে কীভাবে বাবাকে ঋণমুক্ত করবেন। একটা চাকরি দরকার তাঁর - যে কোন চাকরি।
          প্রফেসর ফসেট ভেবে দেখলেন ভারতীয় শিক্ষা বিভাগে জগদীশচন্দ্রের চাকরির ব্যবস্থা করতে পারলেই সবচেয়ে ভালো হয়, কেমব্রিজের ডিগ্রিরও একটা মর্যাদা হয়। ফসেট তাঁর সহকর্মী ও তৎকালীন ভারতসচিব লর্ড কিম্বারলিকে জিজ্ঞেস করলেন - ভারতবর্ষে শিক্ষাবিভাগে জগদীশচন্দ্রকে নিয়োগ দেয়া যাবে কি না। কিন্তু ভারতবর্ষের শিক্ষাবিভাগে কী কী উপযুক্ত পদ খালি আছে তা কিম্বারলি তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারলেন না। ফসেট জগদীশচন্দ্রকে পরামর্শ দিলেন ভারতবর্ষে গিয়ে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড রিপনের সাথে দেখা করতে। একটা সুপারিশপত্রও লিখে দিলেন হেনরি ফসেট।
          অনেক আনন্দ এবং উচ্চাশা নিয়ে ভারতে ফিরে এলেন জগদীশচন্দ্র। 



No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts