Friday, 10 April 2020

জগদীশচন্দ্র বসু - পর্ব ৩




শৈশব কৈশোর

জগদীশচন্দ্র বসুর পৈত্রিক বাড়ি ছিল পুরাতন ঢাকা জেলার অন্তর্গত বিক্রমপুরে। প্রাচীন বঙ্গের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল বিক্রমপুর। মোগল আমলে বিক্রমপুর ছিল একটি পরগণা।  মোগল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদ রায় ও কেদার রায় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন বলে বিক্রমপুর ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছিল। বর্তমানে বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার একটি অঞ্চল হিসেবে শুধু বিক্রমপুর নামটি বেঁচে আছে বটে কিন্তু সরকারিভাবে বিক্রমপুর নামে কোন জায়গা আর নেই। তাই বিক্রমপুর অঞ্চলের প্রকৃত সীমা নির্ধারণ করা সহজ নয়।           পশ্চিমে পদ্মা, উত্তর ও পূর্বে ধলেশ্বরী এবং দক্ষিণে আড়িয়াল খাঁ ও মেঘনার সংযোগস্থলের মধ্যবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বিক্রমপুর।[1] সপ্তদশ শতাব্দীতে পদ্মার ভাঙনে এই অঞ্চলের চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের অনেক কীর্তি ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে এখানে এসে পদ্মার নাম হয় কীর্তিনাশা। প্রত্নতাত্ত্বিক নিরীক্ষণের ভিত্তিতে অনুমান করা যায় যে মুন্সিগঞ্জ শহরের কাছে রামপাল এলাকায় প্রায় পনেরো বর্গমাইল জুড়ে ছিল প্রাচীন বিক্রমপুর। এর উত্তরদিকে ইছামতি নদী এবং পূর্বদিকে ব্রহ্মপুত্র প্রবাহিত। পার্শ্ববর্তী বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মেছিলেন পন্ডিত অতীশ দীপঙ্কর।
          বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামের সম্ভ্রান্ত বসু পরিবারের সন্তান ভগবানচন্দ্র। ভগবানচন্দ্রের বাবার আর্থিক সঙ্গতি তেমন ছিল না। তাই ছোটবেলা থেকেই কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে বড় হতে হয়েছে তাঁকে। ১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা কলেজের প্রথম যুগের কৃতী ছাত্রদের একজন ছিলেন ভগবানচন্দ্র। তারপর সরকারি চাকরিতে যোগ দেন ১৮৪৩ সালে।
          তিনটি কন্যার পর ভগবানচন্দ্র ও বামাসুন্দরী দেবীর চতুর্থ সন্তান জগদীশচন্দ্র বসুর জন্ম ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর, ময়মনসিংহে।
          ময়মনসিংহ শহরে ইংরেজ সরকার তখন প্রথম ইংরেজি স্কুল স্থাপন করেছে। ভগবানচন্দ্র ছিলেন সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। জগদীশচন্দ্রের জন্ম হয় ভগবানচন্দ্রের ময়মনসিংহের বাসায়।
          তরুণ বয়সে ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন ভগবানচন্দ্র। ব্রাহ্ম আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য হিসেবে অনেক রকমের সামাজিক কাজে অংশ নিয়েছেন তিনি। সামাজিক উন্নয়ন ও শিক্ষা-বিস্তারে ভগবানচন্দ্রের উৎসাহ ও উদ্যম ছিল অসীম। ময়মনসিংহে ব্রাহ্মসমাজের একটি সাপ্তাহিক প্রার্থনা সভার প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। পরে সেটাকে কেন্দ্র করে আরো অনেক সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজের সূচনা হয়।


জগদীশচন্দ্রের জন্মের কয়েক বছর পর ডেপুটি মেজিস্ট্রেট হয়ে ফরিদপুরে চলে আসেন ভগবানচন্দ্র। ফরিদপুরেই কাটে জগদীশচন্দ্রের শৈশব এবং কিছুটা কৈশোর। ছোটবেলা থেকেই জগদীশচন্দ্র তাঁর বাবার বিভিন্ন জনসেবামূলক কাজ দেখতে দেখতে বড় হয়েছেন।

          ফরিদপুরের ডেপুটি মেজিস্ট্রেট হয়ে ভগবানচন্দ্র দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক দারিদ্র্য দূর করার চেষ্টা করেন। গ্রামের মানুষ বেশিরভাগই কৃষি ও হস্তশিল্প নির্ভর। ভগবানচন্দ্র তাদের জন্য নিয়মিত আয়োজন করতে লাগলেন কৃষি ও হস্তশিল্প মেলা। গ্রামীণ সংস্কৃতিকে উৎসাহ দিয়ে মানুষকে স্বদেশী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার ব্যাপারেও সচেষ্ট ছিলেন তিনি। যাত্রাপালা, কবিগানের আসর, মল্লযুদ্ধ ইত্যাদি গ্রামীণ সংস্কৃতি ও খেলাধূলার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মাঝে প্রাণের সঞ্চার করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।
          সাধারণ মানুষের হাতের কাজে দক্ষতা বাড়ানোর জন্য ফরিদপুরে একটি কারিগরী বিদ্যালয় স্থাপন করলেন ভগবানচন্দ্র। জগদীশচন্দ্র ছোটবেলায় সেই স্কুলে গিয়ে হাতের কাজের নানারকম নিদর্শন দেখতেন। দেখতেন কীভাবে মানুষের হাত দিয়ে তৈরি হয় নানারকম যন্ত্রপাতি। পরবর্তীতে নিজের গবেষণার জন্য যন্ত্রপাতি তৈরিতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে তাঁর ছোটবেলার এই অভিজ্ঞতা।
          ফরিদপুরের জনসাধারণের আর্থিক অসঙ্গতির কারণে চুরি-ডাকাতির ব্যাপক উপদ্রব ছিল এই অঞ্চলে। পুলিশের হাতে ধরাপড়া অনেক চোর-ডাকাতের বিচার করে শাস্তি দিয়েছেন ভগবানচন্দ্র। অনেক দুর্ধর্ষ ডাকাত জেলে যাবার আগে শাসিয়ে গেছে প্রতিশোধ নেবে বলে। কিন্তু ভগবানচন্দ্র তাতে ভয় পাননি। তিনি তাঁর কর্তব্য করে গেছেন নিষ্ঠার সাথে।
          একবার এক ডাকাত জেল থেকে ফিরে রাতের অন্ধকারে আগুন লাগিয়ে দেয় ভগবানচন্দ্রের বাংলোয়। প্রতিবেশীদের সহায়তায় সবার প্রাণ রক্ষা হলেও বাংলোর সব কিছুই পুড়ে যায়। কিন্তু তাতেও দমে যান না ভগবানচন্দ্র। তাঁর সামাজিক উন্নয়ন ও প্রশাসনিক কাজকর্ম চলতে থাকে আগের মতোই।
          ভগবানচন্দ্র অপরাধকারীদের শাস্তি যেমন দিয়েছেন তেমনি তাদের সংশোধনের সুযোগও দিয়েছেন। একবার এক ডাকাত দীর্ঘদিন জেল খেটে এসে দেখা করলো ভগবানচন্দ্রের সাথে।
          "কী চাই?"
          "হুজুর, আপনি আমাকে জেলে পাঠিয়েছিলেন।"
          "আমি নই, তোমার অপরাধ তোমাকে জেলে পাঠিয়েছিল। তুমি ডাকাতি করতে। তার শাস্তি ভোগ করেছো। আইন তোমাকে শাস্তি দিয়েছে।"
          "এখন আমি কী করবো হুজুর?"
          "ভালো হয়ে যাও। সোজা পথে চলো। কাজ করে খাও।"
          "কাজের চেষ্টা তো অনেক করেছি হুজুর। কিন্তু জেলফেরত ডাকাতকে কেউ চাকরি দিচ্ছে না। চাকরি না পেলে আমাকে তো আবার ডাকাতিই করতে হবে হুজুর।"
          "না, চুরি-ডাকাতি আর নয়। অসৎ পথে তুমি আর যাবে না।"
          "সৎ পথে ফেরার চেষ্টাই তো করছি হুজুর। কিন্তু কেউ তো বিশ্বাস করছে না। একটা চাকরি আমাকে না দিলে ডাকাতি ছাড়া আর কোন্‌ পথ খোলা আছে আমার?"
          "তুমি যদি সত্যিই সৎ থাকো তাহলে একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হবে।"
          "কীভাবে হবে হুজুর? ডাকাত দলের সর্দার ছিলাম। তিন বছর জেল খেটেছি। আমাকে কে বিশ্বাস করবে হুজুর? কে চাকরি দেবে? আপনি দেবেন?"
          "দেবো। আমি তোমাকে চাকরি দেবো।"
          ভগবানচন্দ্র সেই ডাকাতকে নিজের বাড়িতে চাকরি দিলেন। দায়িত্ব দিলেন নিজের ছেলেমেয়েদের দেখাশোনার।
          ভগবানচন্দ্রের বিশ্বাসের অমর্যাদা করেননি ডাকাত-সর্দার। ছোট্ট জগদীশচন্দ্রকে কোলে-পিঠে চড়িয়েছেন, ঘোড়ায় চড়তে শিখিয়েছেন, নানা রকম দুর্ধর্ষ গল্প বলে তাঁর শৈশবকে আনন্দময় করে তুলেছিলেন এই ডাকাতসর্দার। শুধু তাই নয়, ভগবানচন্দ্র ও তাঁর পরিবারকে অনেক বিপদের হাত থেকেও বাঁচিয়েছেন এই দস্যু-সর্দার।
          একবার ফরিদপুর থেকে পরিবারের সবাইকে নিয়ে নৌকায় করে বিক্রমপুরের গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলেন ভগবানচন্দ্র। নির্জন দীর্ঘ নদীপথে হঠাৎ জলদস্যুদের নৌকা পিছু নিলো। ভগবানচন্দ্র দেখলেন জলদস্যুদের হাত থেকে বাঁচার আর কোন উপায় নেই। কিন্তু তাঁর কর্মচারী প্রাক্তন ডাকাত-সর্দার নৌকার ছাদে উঠে এমন এক হাঁক পাড়লেন যে জলদস্যুরা নৌকা ফিরিয়ে চলে গেলো। ডাকাতদের নিজেদের মধ্যে সাংকেতিক যোগাযোগের কোন ভাষা হয়তো ছিল সেই হাঁকের মধ্যে।
          ফরিদপুরের সদর রাস্তার ধারে ভগবানচন্দ্রের বাংলো। রাস্তার পাশে চওড়া নালা। সেই নালার ওপর একটি ছোট সেতু পেরিয়ে রাস্তা থেকে বাংলোয় যাবার পথ। সারাদিন বাড়ির মধ্যে দস্যিপনা করে সময় পেলেই এই সেতুর উপর দাঁড়িয়ে নিচে বয়ে চলা পানির স্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকে জগদীশ। দেখে সেখানে ছোট ছোট মাছ, শামুক, পোকামাকড় ইত্যাদির জীবনচক্র। প্রকৃতির প্রতি আকর্ষণ জগদীশের একেবারে ছোটবেলা থেকেই।
          ছেলেমেয়েদের প্রকৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার ব্যাপারে ভগবানচন্দ্রের বিশেষ যত্ন ছিল। বিভিন্ন পশুপাখি সংগ্রহ করে তিনি বাড়িতেই গড়ে তুলেছিলেন ছোট্ট চিড়িয়াখানা। ছোট্ট জগদীশ চিড়িয়াখানার পশুপাখিদের সাথেও অনেক সময় কাটাতো। ছোটবেলার এই চিড়িয়াখানাকে জগদীশ এতোই ভালবাসতেন যে নিজের গড়া 'বসু বিজ্ঞান মন্দির'-এও তিনি পশু ও পক্ষীশালা তৈরি করিয়েছিলেন।
          পাঁচ বছর বয়স হবার আগেই জগদীশচন্দ্রকে একটি টাট্টু ঘোড়া কিনে দিলেন তার বাবা। দস্যু-সর্দার কয়েকদিনের মধ্যেই জগদীশকে ঘোড়ায় চড়তে শিখিয়ে ফেললেন। শুরু হলো জগদীশের ঘোড়ায় চড়া। টাট্টু ঘোড়ায় চড়ে ছোট্ট জগদীশ চষে বেড়াতে লাগলো ফরিদপুরের আনাচ-কানাচ।
          একবার ঘোড়া নিয়ে ঘোড়দৌড়ের মাঠে চলে গেলো জগদীশ। বাচ্চা-ঘোড়ার উপর বাচ্চা-সওয়ারী দেখে দর্শকদের মধ্যে কেউ কেউ মজা করে জিজ্ঞেস করলেন, "কি খোকা, তুমিও দৌড়াবে নাকি তোমার ঘোড়া নিয়ে? তোমার ঘোড়া দৌড়ে আসতে পারবে মাঠের চারদিক?"
          "হ্যাঁ পারবে।"
          দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে ঘোড়া ছোটালো জগদীশ। সবার পেছনে হলেও বিশাল মাঠের চারদিকে ঘুরে এলো ঘোড়া নিয়ে। কাজ শুরু করে মাঝপথে ছেড়ে দেবার পাত্র যে জগদীশ নয় তা ছোটবেলা থেকেই বোঝা গিয়েছিল।
          পাঁচ বছর বয়সে স্কুলের পড়াশোনা শুরু হলো জগদীশচন্দ্রের। ফরিদপুরে তখন দুটো স্কুল - একটি ইংরেজি মাধ্যম এবং অন্যটি বাংলা মাধ্যম। ইংরেজি স্কুলটি ছিল জগদীশচন্দ্রদের বাড়ির কাছাকাছি। ইংরেজ সাহেব ও উচ্চ-পদের সরকারি কর্মকর্তাদের ছেলেমেয়েদের পড়ার সুযোগ ছিল সেই স্কুলে। ভগবানচন্দ্র ইচ্ছে করলেই সেই স্কুলে ভর্তি করাতে পারতেন তাঁর ছেলে জগদীশচন্দ্রকে। কিন্তু তিনি চাননি যে তাঁর ছেলে ছোটবেলা থেকেই ধনী-দরিদ্র উঁচু-শ্রেণি নিচু শ্রেণি এরকম মানুষে মানুষে বিভেদের চেহারাটা দেখে ফেলুক। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর ছেলে সাধারণ মানুষের ছেলেমেয়েদের সাথে মিলেমিশেই বড় হোক। তাই তিনি জগদীশচন্দ্রকে ভর্তি করালেন বাংলা স্কুলে। এই স্কুলটি ভগবানচন্দ্রই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর মায়ের নামে নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার সুবিধা দেয়ার জন্য।
            ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করিয়ে ইংরেজ সরকারের আমলা হবার উপযুক্ত করে গড়ে তোলাই যেখানে সব বাবা-মায়ের স্বপ্ন সেখানে ডেপুটি মেজিস্ট্রেটের ছেলেকে ভর্তি করানো হলো বাংলা মাধ্যমে! সবাই বেশ অবাক হয়ে গেলেন ভগবানচন্দ্রের সিদ্ধান্তে। কিন্তু ভগবানচন্দ্র বিশ্বাস করেন - জাতীয় সংস্কৃতির সাথে সত্যিকারের পরিচয় ও দেশের জনগণের সাথে একাত্ম হতে হলে মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষা শুরু করা উচিত। তিনি জানতেন সবার জন্য উন্মুক্ত এই বাংলা স্কুলেই জগদীশ পাবে দেশের প্রকৃত অবস্থার পরিচয়। সেখানেই সে মিশতে পারবে সত্যিকারের ভারতীয়দের সাথে।
          ভগবানচন্দ্রের চিন্তা ঠিকই ছিল। জগদীশচন্দ্র সমাজের একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের সাথে মিলেমিশে জীবনের শিক্ষা নিয়েছেন একেবারে ছোটবেলা থেকেই। চাষীর ছেলের কাছ থেকে শিখেছেন কীভাবে ফসল ফলে, জেলের ছেলের কাছ থেকে শিখেছেন মাছ ধরা।
          ছেলেবেলার স্কুল সম্পর্কে জগদীশচন্দ্র নিজে বলেছেন, শৈশব কালে পিতৃদেব আমাকে বাংলা স্কুলে প্রেরণ করেন। তখন সন্তানদিগকে ইংরেজি স্কুলে প্রেরণ আভিজাত্যের লক্ষণ বলিয়া গণ্য হইত। স্কুলের দক্ষিণ দিকে আমার পিতার মুসলমান চাপরাশির পুত্র এবং বাম দিকে এক ধীবরপুত্র আমার সহচর ছিল। তাহাদের নিকট আমি পশুপক্ষী ও জীবজন্তুর বৃত্তান্ত স্তব্ধ হইয়া শুনিতাম। সম্ভবত প্রকৃতির কার্য অনুসন্ধানে আমার অনুরাগ এইসব ঘটনা হইতেই বদ্ধমূল হইয়াছিল। ছুটির পর যখন বয়স্যদের সহিত আমি বাড়ি ফিরিতাম তখন মাতা আমাদের আহার্য বন্টন করিয়া দিতেন। যদিও তিনি সেকেলে এবং একান্ত নিষ্ঠাবতী ছিলেন, কিন্তু এই কার্যে যে তাঁহার নিষ্ঠার ব্যতিক্রম হয় তাহা কখনও মনে করিতেন না। ছেলেবেলায় সখ্যতা-হেতু ছোটো জাতি বলিয়া যে এক স্বতন্ত্র শ্রেণীর প্রাণী আছে এবং হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে এক সমস্যা আছে তাহা বুঝিতেও পারি নাই।"[1]
          ১৮৬৯ সালে ভগবানচন্দ্র সহকারী কমিশনার হয়ে বর্ধমানে বদলী হয়ে যান। এদিকে জগদীশচন্দ্রের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ হয়েছে। এবার কলকাতায় ভালো কোন ইংরেজি স্কুলে তাকে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করলেন ভগবানচন্দ্র। কলকাতার হেয়ার স্কুলের খুব নামডাক তখন। সেখানে ভর্তি করানো হলো জগদীশচন্দ্রকে। কিন্তু প্রথম দিন স্কুলে গিয়েই জগদীশচন্দ্র বুঝলো এখানের পরিবেশ ফরিদপুরের চেয়ে কত আলাদা। সহপাঠীরা জগদীশকে গাঁইয়া বলে ক্ষেপাতে লাগলো। সহপাঠীদের সাথে মারপিট করতে হলো তাকে। কিন্তু মারপিট করে জিতেও বেশিদিন টিকে থাকতে পারলো না সেই স্কুলে। তিন মাসের মাথায় হেয়ার স্কুল ছেড়ে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি হতে হলো জগদীশচন্দ্রকে।
          সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল খুব বিখ্যাত স্কুল। খ্রিস্টান পাদ্রীদের পরিচালিত এই স্কুলে ভর্তি হয়ে শুরুতে বেশ অসুবিধার মধ্যে পড়তে হলো জগদীশচন্দ্রকে। স্কুলের প্রথম দিনেই র‍্যাগিং-এর শিকার হয় জগদীশচন্দ্র। স্কুলের বেশির ভাগ ছাত্রই শ্বেতাঙ্গ। ক্লাস শুরু হবার তিন মাস পরে ভর্তি হওয়া জগদীশকে পেয়ে সবাই যেন ক্ষেপে উঠলো। নানা রকম টিটকারি, বিদ্রুপ ইত্যাদিতেও জগদীশকে বিচলিত করতে না পেরে ধাক্কা মারতে শুরু করলো তারা। জগদীশও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। হেয়ার স্কুলেও তাকে মারামারি করতে হয়েছে। সে বুঝে গেছে - কলকাতার স্কুলে টিকে থাকতে হলে গায়ের জোরও দেখাতে হবে। এখানেও ধাক্কার বদলে প্রতিধাক্কা দিলো জগদীশ। তাতে প্রতিপক্ষরা বুঝে গেলো যে জগদীশচন্দ্রকে এত সহজে কাবু করা যাবে না।
          অন্যায় কাজ শুরু করার পর তাতে ন্যায়ের মোড়ক লাগিয়ে প্রচার করা ইংরেজদের স্বভাব। এখানেও তারা তাই করলো। জগদীশচন্দ্রকে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান করা হলো। বলা হলো ক্লাসের সেরা মুষ্টিযোদ্ধার সাথে তাকে লড়তে হবে। জগদীশচন্দ্র যদি জিততে পারে তবেই ক্লাসে থাকতে পারবে। আর যদি হারে - আর কোনদিন স্কুলে আসতে পারবে না। মুষ্টিযুদ্ধ হবে একেবারে নিয়ম মেনে। জগদীশচন্দ্রের বুঝতে বাকি রইলো না - কেমন তাদের নিয়ম। কিন্তু যুদ্ধ না করে পালিয়ে যাবার ছেলে জগদীশ নয়। পরিণত বয়সে জগদীশচন্দ্র এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন এভাবে:
          "আমি তখন মুষ্টিযুদ্ধের কিছুই জানতাম না। তা সত্ত্বেও আমি এই দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান গ্রহণ করেছিলাম। যার ফলে কপালে জুটেছিল কঠিনতম শাস্তি। তবুও আমি লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলাম, এবং প্রবলতম বাধার কাছে নতি স্বীকার না করার সুদৃঢ় সংকল্পের ফলে শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হলাম। এই মনোভাবই উত্তর জীবনের বুদ্ধিগত প্রতিযোগিতায় আমাকে উত্তীর্ণ করেছিল।"[2]
          যাই হোক, ক্লাসে শারীরিক শক্তি-পরীক্ষায় টিকে গেলেও আরেকটি প্রধান অসুবিধা হলো ভাষা নিয়ে। এখানে কেউ বাংলা বলে না। শিক্ষকদের বেশিরভাগই ইংরেজ সাহেব। সহপাঠীরাও সবাই ইংরেজিতে কথা বলে। আর জগদীশ এতদিন ইংরেজি শিখেনি তেমন করে, এবার দ্রুত ইংরেজি শিখতে বাধ্য হলো। পরবর্তীতে এই ইংরেজি শিক্ষা বিদেশে পড়াশোনায় খুব কাজে লেগেছিল।
          জগদীশের মা-বাবা ভাইবোন সবাই বর্ধমানে। কলকাতায় তার থাকার ব্যবস্থা হলো মির্জাপুর স্ট্রিটে এক ব্রাহ্ম-ছাত্রাবাসে। ছাত্রাবাসটি পরিচালনা করতেন ব্যারিস্টার আনন্দমোহন বসু। অখন্ড ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ব্যারিস্টার আনন্দমোহন বসু ততদিনে জগদীশচন্দ্রের আত্মীয় হয়ে গেছেন। জগদীশের বড়দিদি স্বর্ণপ্রভা বসুর সাথে বিয়ে হয়েছে আনন্দমোহন বসুর।
          ছাত্রাবাসের সবাই বয়সে জগদীশচন্দ্রের চেয়ে বড়। জগদীশের দিন কাটে একা একা। পড়ালেখার বাইরে যতক্ষণ সময় পায় তা নিজের মনে বাগান করে পাখি পুষে কেটে যায়। ছুটিতে ফিরে আসে বর্ধমানের বাসায়। সেখানে জগদীশের অন্যতম আকর্ষণ তার বাবার গড়া ছোট ছোট কারখানার কাজ। তাছাড়া তার একটি ছোটবোন ও একটি ছোটভাইও হয়েছে।
          বর্ধমানে এসেও ভগবানচন্দ্র তাঁর প্রশাসনিক ও সামাজিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু বছর যেতে না যেতেই ১৮৭০ সালে হঠাৎ ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় বর্ধমানে। ভগবানচন্দ্র ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের যথাসাধ্য ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু ব্যাপক প্রাণহানির পর গ্রামে যারা বেঁচে রইলো তারা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলো। ভগবানচন্দ্র নিজের সাধ্যমতো বাড়িতেই ছোট ছোট কারখানা তৈরি করে অনেকের কাজের ব্যবস্থা করলেন। এই কারখানা থেকে তৈরি কিছু নিদর্শন জগদীশচন্দ্র আজীবন রেখে দিয়েছিলেন নিজের বাড়িতে।
          ১৮৭৫ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষাবৃত্তি লাভ করলো জগদীশচন্দ্র। তারপর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষা শুরু হলো জগদীশ বসুর। সেসময় ফাদার লাঁফো ছিলেন সেন্ট জেভিয়ার্সের নামকরা ফিজিক্স প্রফেসর। প্রবীণ এই অধ্যাপকের আকর্ষণীয় ক্লাস জগদীশচন্দ্রকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করলো।
          ফাদার লাঁফো পদার্থবিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো সহজভাবে ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি বিভিন্ন পরীক্ষার সাহায্যে দেখাতেন কীভাবে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম কাজ করে। শুধু শিক্ষার্থীদের সামনে নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিজ্ঞান চেতনা জাগানোর লক্ষ্যে প্রফেসর লাঁফো বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা ও প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতেন নিয়মিত। ১৮৭৬ সালে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার যখন 'ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান ফর দি কালটিভেশান অব সায়েন্স' প্রতিষ্ঠা করলেন প্রফেসর লাঁফো সেখানেও বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা দিতেন। জগদীশচন্দ্র ক্রমশঃ পদার্থবিদ্যার প্রতি গভীর আগ্রহ অনুভব করতে শুরু করলেন। ক্রমে প্রফেসর লাঁফোর প্রিয় ছাত্রে পরিণত হলেন জগদীশচন্দ্র।


ফাদার লাঁফো


এদিকে ১৮৭৫ সালে ভগবানচন্দ্র বর্ধমান থেকে কাটোয়ায় বদলি হয়ে যান। সেখানেও সরকারি কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজস্ব সমাজসেবা চলতে থাকে সমানে। সরকারি চাকরির দৌলতে ভগবানচন্দ্র অনেকটাই সাহেবী আদবকায়দায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর চার কন্যা ও দুই পুত্রের সবাইকেই উন্নতমানের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বড় করার ব্যাপারে তিনি খুব সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর কন্যাদের সকলেই উচ্চশিক্ষিত হয়েছিলেন। বড় মেয়ে স্বর্ণপ্রভা বসুর সাথে বিয়ে হয়েছিল অখন্ড ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ব্যারিস্টার আনন্দমোহন বসুর সাথে। দ্বিতীয় কন্যা লাবণ্যপ্রভা বসু বেথুন কলেজ থেকে পাশ করে বাংলা বিজ্ঞানসাহিত্য ও শিশু সাহিত্যের প্রথম যুগের লেখিকা ছিলেন। তৃতীয় কন্যা হেমপ্রভা বসু ছিলেন বাঙালী মেয়েদের মধ্যে প্রথম চারজন এম-এ পাশের একজন। বেথুন কলেজের অধ্যাপক ছিলেন হেমপ্রভা। নারীবাদী হেমপ্রভা সারাজীবন বিয়ে করেননি। ছোট কন্যা সুবর্ণপ্রভা বসুও বেথুন কলেজ থেকে পাশ করেন। আনন্দমোহন বসুর ছোটভাই ডাক্তার মোহিনীমোহন বসুর সাথে বিয়ে হয় সুবর্ণপ্রভার। মোহিনীমোহন ও সুবর্ণপ্রভার ছেলে দেবেন্দ্রমোহন বসু পরবর্তীতে পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন।
          ১৮৭৭ সালে জগদীশচন্দ্র এফ-এ পাশ করেন দ্বিতীয় বিভাগে। এরপর ১৮৮০ সালে বিজ্ঞান বিভাগে সাধারণ মানের বি-এ। ইতোমধ্যে তাঁদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে গেছে। বর্ধমানে থাকতে বেশ ভালোই ছিলেন ভগবানচন্দ্র। কিন্তু ১৮৭৫ সালে সেখানে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব ঘটে, বহু কর্মক্ষম মানুষ মারা যায়। তাদের পরিবারকে সাহায্য করার লক্ষ্যে ভগবানচন্দ্র নিজের বাড়িতে কামারশালা সহ আরো কিছু কুটিরশিল্পের ব্যবস্থা করে দেন। ছুটির সময় জগদীশচন্দ্রও কলকাতা থেকে বাড়িতে এসে এসব কাজে হাত লাগাতেন। এভাবে নিজের হাতে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরি করার নেশা তৈরি হয়ে গিয়েছিল জগদীশের।
          ১৮৮০ সালে মন্বন্তর হয় কাটোয়ায়। ভগবানচন্দ্র তখন প্রৌঢ়। কিন্তু মানুষের মঙ্গল করার ব্যাপারে থেমে থাকতে জানেন না তিনি। দুর্গত মানুষের সেবা করার কঠিন পরিশ্রমে শরীর ভেঙে পড়লো তাঁর। বাধ্য হয়ে সরকারি চাকরি থেকে সাময়িক অবসর নিলেন। কাজ থেকে অবসর নিয়েও দেশের জন্য মহৎ কিছু, বড় কিছু করার পরিকল্পনা করতে লাগলেন। ভাবলেন দেশের কৃষি ও শিল্পের উন্নতি করতে পারলে দেশের মঙ্গল। দেশে তখনো চা শিল্প গড়ে ওঠেনি। বন্ধু দুর্গামোহন দাশ ও জামাতা ব্যারিস্টার আনন্দমোহন বসুর সহযোগিতায় আসামে একটি চা বাগান গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। আসামে প্রায় দু'হাজার একর জমি কিনে 'ন্যাশনাল টি কোম্পানি' প্রতিষ্ঠা করেন ভগবানচন্দ্র। চা শিল্পে সেটাই ছিল প্রথম ভারতীয় উদ্যোগ। ভারতীয় যুবক শ্রীনাথ দত্ত তখন বিদেশ থেকে কৃষিবিজ্ঞানে হাতে কলমে দক্ষতা অর্জন করে দেশে ফিরেছেন। শ্রীনাথ দত্তকে নিয়োগ করা হলো চা কারখানা স্থাপন প্রকল্পে। ভগবানচন্দ্র নিজের সর্বস্ব বিনিয়োগ করলেন এই শিল্প স্থাপনে। কিন্তু প্রকল্পটি সফল হলো না। নিজের বিষয়-সম্পত্তি বন্ধক রেখে ঋণ নিয়ে বোম্বে সহ আরো কয়েক জায়গায় তন্তুবায় শিল্প এবং ফরিদপুরে সমবায় ব্যাংক ও কুটির শিল্প স্থাপন করেন। কিন্তু তাঁর ব্যবসায়িক বুদ্ধি এতই কম ছিল যে এক বছরের মধ্যে সর্বস্বান্ত হয়ে ঋণে জর্জরিত হয়ে গেলেন।
          সাফল্যের মুখ না দেখলেও ভগবানচন্দ্রের এই জনহিতকর প্রচেষ্টাকে কখনোই ছোট করে দেখেননি জগদীশচন্দ্র। ১৯১৫ সালে বিক্রমপুর সম্মিলনে সভাপতির ভাষণে তিনি তাঁর বাবার উদ্যোগ সম্পর্কে বলেছেন:
          "এক বিফল জীবনের কথা শোন - ইহা অর্ধ শতাব্দীর পূর্বের কথা। যাঁহার কথা বলিতেছি তিনি অতদিন পূর্বেও দিব্যচক্ষে দেখিয়াছিলেন যে, শিল্প, বাণিজ্য এবং কৃষির উদ্ধার না করিলে দেশের আর কোন উপায় নাই। দেশে যখন কাপড়ের কল প্রথম স্থাপিত হয় তাহার জন্য তিনি জীবনের প্রায় সমস্ত অর্জন দিয়াছিলেন। যাঁহারা প্রথম পথপ্রদর্শক হন তাঁহাদের যে গতি হয়, তাঁহার তাহাই হইয়াছিল। বিবিধ নতুন উদ্যমে তিনি বহু ক্ষতিগ্রস্ত হন। কৃষকদের সুবিধার জন্য তাঁহারই প্রযত্নে সর্বপ্রথমে ফরিদপুরে লোন অফিস স্থাপিত হয়। এখানে তাঁহার সমস্ত স্বত্ব পরকে দিয়াছিলেন। এখন তাহাতে শতগুণ লাভ হইতেছে। তাঁহারই প্রযত্নে কৃষি ও শিল্পের উন্নতির জন্য ফরিদপুরে মেলা স্থাপিত হয়। তিনিই আসামে স্বদেশী চা-বাগান স্থাপন করেন। তাহাতেও তাঁহার অনেক ক্ষতি হইয়াছিল। কিন্তু তাঁহার অংশীদারগণ এখন বহুগুণ লাভ করিতেছেন। তিনিই প্রথমে নিজ ব্যয়ে টেকনিক্যাল স্কুল স্থাপন করেন এবং তাহার পরিচালনে সর্বস্বান্ত হন। জীবনের শেষভাগে দেখিতে পাইলেন যে, তাঁহার সমস্ত জীবনের চেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে। ব্যর্থ? হয়তো এ কথা তাঁহার নিজ জীবনে প্রযোজ্য হইতে পারে; কিন্তু সেই ব্যর্থতার ফলে বহু জীবন সফল হইয়াছে। আমি আমার পিতৃদেব ভগবানচন্দ্র বসুর কথা বলিতেছিলাম। তাঁহার জীবন দেখিয়া শিখিয়াছিলাম যে, সার্থকতাই ক্ষুদ্র এবং বিফলতাই বৃহৎ। এইরূপে যখন ফল ও নিস্ফলতার মধ্যে প্রভেদ ভুলিতে শিখিলাম, তখন হইতেই আমার প্রকৃত শিক্ষা আরম্ভ হইল। যদি আমার জীবনে কোনো সফলতা হইয়া থাকে তবে তাহা নিষ্ফলতার স্থির ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।"[1]
          জগদীশচন্দ্র তখন সবেমাত্র বিএ পাশ করেছেন। বি-এ পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো না হওয়াতে বেশ বিষন্ন ছিলেন জগদীশচন্দ্র। লেখাপড়া তাঁর ভালো লাগে। তবে শুধুমাত্র লেখাপড়া নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন না তিনি। মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে ঘোড়ায় চড়া, শিকারে যাওয়া, গভীর অরণ্যে অভিযান এসবও ছিল। একবার ছুটির সময় এক বন্ধুর আমন্ত্রণে আসামের জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে ভীষণ বিপদে পড়েন জগদীশ। রেলস্টেশন থেকে প্রায় একুশ মাইল পথ রাতের অন্ধকারে পালকিতে চড়ে আসামের জঙ্গলে পৌঁছেন জগদীশ ও তাঁর বন্ধুরা। তারপর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গভীর অরণ্যে শিকারের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে বন্য মশার কামড় খেয়ে রাতের বেলায় প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত হন জগদীশ। জ্বরের প্রকোপ বাড়ার কারণে কলকাতায় ফিরে আসতে হয় জগদীশকে। ফিরে আসার ব্যবস্থাটাও খুব একটা ভালো ছিল না। কোন পালকি না পেয়ে বন্ধুরা জগদীশকে একটা ঘোড়ার পিঠে তুলে দেন। ঘোড়াটি এমন বেয়াড়া ছিল যে জগদীশচন্দ্র প্রায় আধমরা হয়ে যান স্টেশনে পৌঁছতে। অনেকদিন কালাজ্বরে ভুগতে হয় তাঁকে।
          বাবাকে ঋণমুক্ত করার উপায় খুঁজতে শুরু করলেন জগদীশচন্দ্র। ঠিক করলেন ইংল্যান্ডে গিয়ে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেবেন। চাকরি পেলে আর্থিক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু বাধ সাধলেন স্বয়ং ভগবানচন্দ্র। তিনি চান না যে তাঁর ছেলে ইংরেজ সরকারের অধীনে চাকরি করুক। আই-সি-এস অফিসার হবার চেয়ে অনেক ভাল ডাক্তারি পড়া। তাতে স্বাধীনভাবে উপার্জনও করা যায়, সাথে আর্তজনের সেবা করাও হয়।
          বাবা ছেলেকে ডাক্তার বানাতে চাইলেও বাধ সাধলেন মা। কালাপানি পার হয়ে ছেলে বিলেত যাবে তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না বামাসুন্দরী দেবী। তাছাড়া মাত্র কিছুদিন আগে জগদীশের ছোট ভাই মারা গেছে দশ বছর বয়সে। তাই জগদীশকে তিনি কিছুতেই ছাড়তে রাজি নন। কিন্তু জগদীশচন্দ্র যাবেনই। বাবার আর্থিক অবস্থা ফেরানোর জন্য, ঋণ শোধ করার জন্য তাঁকে বিলেতে যেতেই হবে। মা-কে বোঝালেন। শেষপর্যন্ত বামাসুন্দরী দেবী রাজী হলেন। কিন্তু বিলেত যাবার টাকা আসবে কোত্থেকে? ঠিক হলো মায়ের গয়না বিক্রি করে বিলেত যাবেন জগদীশচন্দ্র।



[1] জগদীশচন্দ্র বসু, বিক্রমপুর সম্মিলনে সভাপতির ভাষণ, ১৯১৫। প্রবাসী, মাঘ ১৩২২'অব্যক্ত' গ্রন্থে 'বোধন' শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত। পৃঃ ১৩১-২।


[1] জগদীশচন্দ্র বসু, বিক্রমপুর সম্মিলনে সভাপতির ভাষণ, ১৯১৫। প্রবাসী, মাঘ ১৩২২।
[2] সালাম আজাদ, জগদীশচন্দ্র বসু, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯৫। পৃ: ৮।


[1] বাংলাপিডিয়া, বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ, ২০১৫। http://bn.banglapedia.org/


No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts