Friday, 10 April 2020

জগদীশচন্দ্র বসু - পর্ব ১



"অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান
প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ, আদিপ্রাণ-
ঊর্ধ্বশীর্ষে উচ্চারিলে আলোকের প্রথম বন্দনা
ছন্দোহীন পাষাণের বক্ষ-'পরে; আনিলে বেদনা
নিঃসাড় নিষ্ঠুর মরুস্থলে।।"

বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসুর প্রভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা 'বৃক্ষবন্দনা'। কবিতার শুরুতে বৃক্ষ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছেন তার অনেকখানি প্রযোজ্য বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর ক্ষেত্রেও। ইওরোপে বিজ্ঞানচর্চা শুরু হবার কয়েক শতাব্দী পরেও আমাদের এই উপমহাদেশের বিজ্ঞান-ভূমি ছিল অন্ধকারে। জগদীশচন্দ্র বসুই ছিলেন প্রথম বিজ্ঞানী যিনি এই উপমহাদেশে আধুনিক বিজ্ঞান-গবেষণার জাগরণ ঘটিয়েছিলেন। তিনিই বিশ্ববিজ্ঞানের আসরে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে সুবিধাবঞ্চিত তৎকালীন পরাধীন ভারতের বাঙালিও নিজের অধ্যবসায় ও মেধার জোরে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে।
          জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন উপমহাদেশের প্রথম পদার্থবিজ্ঞানী। শুধু তাই নয়- বিশ্বের বিজ্ঞানজগতে তাঁর যে অবদান তার সবটুকু আমরা সেই সময়ে বুঝতেও পারিনি। সেমিকন্ডাক্টর পদার্থবিজ্ঞানের স্বতন্ত্র যাত্রা শুরু হবার অনেক আগেই - তিনি সেমিকন্ডাক্টর দিয়ে দেশীয় পদ্ধতিতে যন্ত্রপাতি তৈরি করে গবেষণা করেছেন। সলিড স্টেট ফিজিক্সের জন্মের অনেক বছর আগেই জগদীশচন্দ্র সলিড স্টেট ফিজিক্সের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।
          মাইক্রোওয়েভ গবেষণার একজন পথিকৃৎ জগদীশচন্দ্র। তাঁর তৈরি যন্ত্র ব্যবহার করে বেতার যোগাযোগে সাফল্য দেখিয়েছেন ইতালির গুল্গিয়েল্‌মো মার্কনি এবং সেজন্য তিনি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। আমরা এখন হা-হুতাশ এবং ক্ষোভ দেখাই যে জগদীশচন্দ্র বসুকে বঞ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু জগদীশচন্দ্র বসু নিজে কোনদিন এই ব্যাপারে একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি। কারণ পুরষ্কারের দিকে তাঁর কোন নজরই ছিল না কখনো। তাছাড়া সেই সময়ে (আজ থেকে শতাধিক বছর আগে) নোবেল পুরষ্কার নিয়ে এত বেশি বাড়াবাড়ি রকমের হৈ চৈ করা হতো না। নোবেল পুরষ্কার তখন ছিল যে কোন পুরষ্কারের মতই একটা ইওরোপীয় পুরষ্কার মাত্র। বৈজ্ঞানিক ইতিহাসের সাম্প্রতিক গবেষণায় বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে যে প্রথম দিকের বেতার যোগাযোগব্যবস্থায় জগদীশচন্দ্র বসুর অবদান অনস্বীকার্য। মার্কনির নাতি ড. ফ্রান্সেস্কো মার্কনি - যিনি নিজেও একজন বেতার-জ্যোতির্বিজ্ঞানী - কলকাতায় বসু বিজ্ঞান মন্দিরে এসে বলেছেন যে নোবেল পুরষ্কার জগদীশচন্দ্র বসুরই প্রাপ্য ছিল।
          পদার্থবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানের সমন্বয়ে বায়োফিজিক্স বা জীবপদার্থবিজ্ঞান এখন একটি দ্রুত সম্প্রসারণশীল গবেষণাক্ষেত্র। কিন্তু একশ' বছর আগে যখন জগদীশচন্দ্র বসু এই সম্মিলিত ক্ষেত্রে গবেষণা করেছেন তখন এই বিষয়ের আলাদা কোন অস্তিত্বই ছিল না। তিনি ছিলেন বিশ্বের প্রথম জীবপদার্থবিজ্ঞানী।
          ১৮৯৫ সালে জার্মানির উইলহেল্‌ম রন্টগেন যখন এক্স-রে আবিষ্কার করেন - জগদীশচন্দ্র বসু তখন ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ - মাইক্রোওয়েভ নিয়ে গবেষণা করছেন। এক্স-রেও উচ্চ-কম্পাঙ্কের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ। কলকাতায় নিজের গবেষণাগারে সেই সময় তিনি এক্স-রে উৎপাদন করেছিলেন। এই উপমহাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থায় এক্স-রে'র প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু।
    পদার্থবিজ্ঞানে অনেক যুগান্তকারী আবিষ্কারের পাশাপাশি উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা নিয়ে গবেষণার সূত্রপাত করেন জগদীশচন্দ্র। উদ্ভিদও যে উদ্দীপনায় সাড়া দেয় - এ তথ্য জগদীশচন্দ্র বসুর আগে কেউ উপলব্ধি করেননি, প্রমাণ করতে পারেননি। জীব ও জড়ের মধ্যে সাড়ার যে ঐক্য অর্থাৎ বাইরের উত্তেজনায় জীব ও জড় যে প্রায় একই রকমের সাড়া দেয় জগদীশচন্দ্রের আগে তা কেউ চিন্তাও করেননি। এখন আমরা যে রোবটিক সায়েন্স নিয়ে এত মাতামাতি করি - তার শুরু কিন্তু হয়েছিল জগদীশচন্দ্রের হাতে।
          শুধু বিজ্ঞান নয়, বাংলা ভাষায় প্রথম কল্পকাহিনির লেখকও ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। তাঁর লেখা সায়েন্স ফিকশান 'নিরুদ্দেশের কাহিনি' প্রথম 'কুন্তলীন পুরষ্কার' লাভ করেছিল। শিশুকিশোরদের জন্য বেশ কিছু বিজ্ঞান-প্রবন্ধ লিখেছিলেন জগদীশচন্দ্র যার সাহিত্য-মূল্যও অনেক। জগদীশচন্দ্র বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতিও ছিলেন কয়েক বছর। বাংলায় বিজ্ঞান-সাহিত্যে জগদীশচন্দ্রের অবদান ঐতিহাসিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন জগদীশচন্দ্রের খুবই কাছের বন্ধু।  জগদীশচন্দ্র বসুকে দেশের মানুষের কাছে সম্মানের আসনে তুলে ধরার জন্য সবচেয়ে বেশি চেষ্টা যিনি করেছিলেন তিনি রবীন্দ্রনাথ। বিদেশে জগদীশচন্দ্রের বৈজ্ঞানিক সম্মানকে রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন বিদেশীদের বিরুদ্ধে পরাধীন ভারতবর্ষের জয় হিসেবে।
          ভারতীয় বিজ্ঞানের জয়গাথা বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর সারাজীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে গড়ে তুলেছেন 'বসু বিজ্ঞান মন্দির'। এই বিজ্ঞান মন্দির এখন 'বোস রিসার্চ ইনস্টিটিউট' নামে একটি প্রথম সারির গবেষণা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
          বাঙালি স্বভাবতই আবেগপ্রবণ। তাই আমরা যাদের সম্মানের আসনে বসাই - অনেকটা অন্ধভাবেই তা করি। নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের থাকে না। তাই গত এক শতাব্দী ধরে জগদীশচন্দ্র বসু সম্পর্কে যত লেখা প্রকাশিত হয়েছে সেখানে শুধু জগদীশচন্দ্র বসুর গুণগানই করা হয়েছে। 'বিজ্ঞানী' জগদীশ বসুর চেয়েও প্রধান হয়ে উঠেছেন 'আচার্য' জগদীশ বসু। ভালোবাসার আবেগে দেবতা বানাতে গিয়ে আমরা খেয়াল করি না যে জগদীশবসু তাঁর বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধগুলোর কোনটাতেই তাঁর সহকর্মীদের কারো নাম প্রকাশ করেননি বা সামান্যতম কৃতজ্ঞতাস্বীকারও করেননি। তাঁর জীবদ্দশায় সি ভি রামন কলকাতায় বসেই গবেষণা করে 'রামন ইফেক্ট' আবিষ্কার করেছেন এবং সেজন্য নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। অথচ জগদীশচন্দ্র ভারতীয় বিজ্ঞানের প্রসারে তাঁর নিজের চেষ্টা ও আগ্রহের ব্যাপারে সোচ্চার হলেও কখনো সি ভি রামন সম্পর্কে প্রশংসা তো দূরের কথা, সামান্য উল্লেখ পর্যন্ত করেননি কোথাও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও জগদীশচন্দ্রের ব্যাপারে এতটা উচ্ছ্বসিত, কিন্তু রামনের ব্যাপারে একেবারেই নিরব। সিস্টার নিবেদিতার সাথে খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল জগদীশচন্দ্র বসুর। নিবেদিতা জগদীশচন্দ্র বসুর অনেক গবেষণাপত্র লিখে দিয়েছেন, কয়েকটা বইও সম্পাদনা করেছেন। কিন্তু জগদীশচন্দ্র সেটাও কখনো সরাসরি প্রকাশ্যে স্বীকার করেননি।
          জগদীশচন্দ্র বসুর জীবন ও তাঁর বিজ্ঞান-গবেষণা সম্পর্কে একটা সামগ্রিক ধারণা দেয়ার লক্ষ্যেই এই বইটা লিখেছি। মীরা প্রকাশন 'বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানী' সিরিজ বের করছে বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চা বেগবান করার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। তাঁদের উদ্দেশ্য সফল হবে বলেই আমার বিশ্বাস।

জানুয়ারি ২০১৬                                                               প্রদীপ দেব
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া                              pradipdeb2006@gmail.com

No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts