Thursday 13 February 2020

বুধ - পর্ব ২০


বুধের উপরিতলের চেহারা

বুধের উপরিতল খুবই অসমতল এবড়োখেবড়ো বিরাট বিরাট গর্তে ভরা। বুধের চেহারা অনেকটাই পৃথিবীর চাঁদের মতো। আকারে চাঁদের চেয়ে সামান্য বড়। কিন্তু বয়সে চাঁদের চেয়ে বেশি। বুধের বয়স পৃথিবীর বয়সের প্রায় সমান। প্রায় সাড়ে চার শ কোটি বছর ধরে সৌরজগতের সবগুলো গ্রহ সূর্যের চার পাশ ঘুরছে অবিরাম।
            াড়ে চার শ কোটি বছর ধরে উত্তপ্ত ও ঠান্ডা হতে হতে বুধের উপরের তলে অনেক খাঁজ আর খাদের সৃষ্টি হয়েছে। চাঁদের গায়ের মতো কিছু পাহাড়ও আছে সেখানে। বুধের উৎপত্তির কিছু সময় পরেই প্রচুর গ্রহাণু এসে পড়েছিল এবং তার ফলে বিশাল বিশাল গর্ত হয়ে গেছে। পরে সেগুলো শুকিয়ে গেছে।
            একদিকে যখন বড় বড় গ্রহাণু আঘাত করেছে - তার শক ওয়েভ বা আঘাতজনিত তরঙ্গের প্রভাবে অন্যদিকে সংকোচন ঘটেছে, কুঁচকে গেছে, খাঁজ পড়েছে।

 
বুধের পিঠে গ্রহাণুর আঘাতের ফলে উৎপন্ন শক ওয়েভের প্রভাবে বুধের উপরের স্তরে অসংখ্য খাঁজের সৃষ্টি হয়েছে।


বুধের কেন্দ্রের সংকোচনের ফলে উপরের তলে ভাঁজ তৈরি হয়েছে

বুধ গ্রহ জন্মের পর এক শ কোটি বছর ধরে ঠান্ডা হবার সময় কেন্দ্র বা কোর ঠান্ডা হয়ে প্রায় চার কিলোমিটার পর্যন্ত সংকুচিত হয়ে যায়। ফলে উপরিতল সংকুচিত হয়ে বিভিন্ন স্থানে বড় বড় খাঁজ এবং পাহাড়ের সৃষ্টি হয়েছে।
            বুধের উপরিতলের ভাঁজগুলো তৈরি হয়েছে আরো একটি কারণে। শুরুতে বুধ অনেক দ্রুত ঘুরছিলো নিজের অক্ষের ওপর। আসলে সেভাবে ঘুরতে ঘুরতে গ্রহটি এত নিখুঁতভাবে গোলাকার হয়েছে। পরে ওটা যখন ঠান্ডা হতে হতে গতি হ্রাস পেতে থাকে তখন চামড়ায় ভাঁজ পড়তে থাকে
            বুধের মোট ক্ষেত্রফলের শতকরা মাত্র ২৭ ভাগ মসৃণ, বাকি ৭৩ ভাগই এবড়োখেবড়ো যার মধ্যে শতকরা ষাট ভাগ গহ্বর বা গর্ত। বাতাস না থাকাতে গর্তগুলোর কোন পরিবর্তন হবার সুযোগ হয়নি।  বুধের জন্মের পর প্রথম একশ কোটি বছরে যা পরিবর্তন হওয়ার হয়েছে, তারপর আর পরিবর্তন ঘটেনি। চাঁদের মতো বুধও একটি মৃত গ্রহ।
            খুব পাতলা বায়ুমন্ডল থাকার কারণে বুধের পিঠে যেসব গ্রহাণু ধেয়ে আসে - সেগুলো বাধা পায় না। যেমন ধরো পৃথিবীর দিকে যদি কোন গ্রহাণু ধেয়ে আসে তাহলে সেটা পৃথিবীর বিরাট পুরু আবহাওয়ামন্ডলের সাথে সংঘর্ষে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। এভাবে আমাদের পৃথিবী রক্ষা পাচ্ছে। কিন্তু বুধের সেরকম কোন সুযোগ নেই। তাই বুধের গায়ে অসংখ্য গর্ত সব গ্রহাণুর আঘাতে সৃষ্টি হয়েছে।

বুধের বুকে বিশাল গহ্বর। মেসেঞ্জার নভোযানের ক্যামেরা থেকে দেখতে অনেকটা মিকি মাউসের মতো লাগছে। বুধের দক্ষিণ দিকে এই গহ্বরের অবস্থান। ২০১২ সালের ৩ জুন এই ছবি তোলা হয়েছিল। 

            চাঁদে যেরকম শুকিয়ে যাওয়া লাভার হ্রদ আছে বুধেও সেরকম আছে। মনে করা হচ্ছে কোন এক সময় প্রচন্ড সংকোচন ও প্রসারণের ফলে বুধের ভেতর থেকে প্রচন্ড বিস্ফোরণে আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোত বেরিয়ে এসেছিল।
            বুধে অনেক গর্তের পাশাপাশি - অনেক খাড়া বাঁধ ও উপত্যকাও আছে। কিছু কিছু বাঁধের উচ্চতা কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এগুলো সৃষ্টি হয়েছিল বুধের গহ্বরগুলো তৈরি হবার সময়েই প্রচন্ড চাপের ফলে।
            বুধে কোন পানি নেই। কিন্তু গভীর গর্ত বিশেষ করে মেরুর দিকে গর্তগুলোতে কিছু বরফের অংশবিশেষ থাকতে পারে - কারণ সেখানে কখনোই সূর্যের তাপ পৌঁছায় না।

বুধের উত্তর মেরুর ছবি। উত্তপ্ত অংশের রঙ লাল এবং ঠান্ডা অংশের রঙ নীল। মেরুর এই নীল রঙের জায়গাগুলোতে সূর্যালোক পৌঁছায় না বলেই সেখানে এত ঠান্ডা। মেসেঞ্জার মিশনের একেবারে শেষের দিকে ২০১৫ সালের ১৬ মার্চ এই ছবি প্রকাশ করা হয়েছে।

দক্ষিণ মেরু অঞ্চলেও সূর্যের আলো পড়ে না। ফলে এখানে তীব্র ঠান্ডা। র‍্যাডারের সাহায্যে বিজ্ঞানীরা এই অঞ্চল পরীক্ষা করে ধারণা করছেন এখানে জমাট বরফ থাকতে পারে। তবে এ ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কারণ সালফারও একই রকমভাবে থাকতে পারে।  
            বুধের বড় বড় শুকনো অববাহিকা, গহ্বর, উপত্যকা, বিশাল বিশাল চ্যাপ্টা পাহাড়ের মতো ফাঁপা জায়গা - সবগুলোর নাম দেয়া হয়েছে পৃথিবীর বিখ্যাত সব শিল্পীদের নামে। পরের একটি অধ্যায়ে আমরা কয়েকজন বিখ্যাত শিল্পীর নামে দেয়া বুধের কিছু জায়গার সাথে পরিচিত হবো।
            বুধের সবচেয়ে বড় অববাহিকা ক্যারোলিস বেসিন - যার ব্যাস প্রায় ১৫০০ কিলোমিটার। বাংলাদেশের সমান বারোটি দেশের ক্ষেত্রফলের সমান এই অববাহিকা। এটা সৃষ্টি হয়েছিল প্রায় ৩৬০ কোটি বছর আগে যখন ১০০ কিলোমিটার ব্যাসের একটা বিশাল গ্রহাণু বা মহাকাশের পাথর (স্পেস রক) বুধের পিঠে আছড়ে পড়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে যে সেটা এত বেশি বিধ্বংসী ছিল যে আশেপাশের গ্রহগুলোও সব কেঁপে উঠেছিল সেই তরঙ্গে। প্রায় এক মিলিয়ন টন হাইড্রোজেন বোমার সমান শক্তি উৎপন্ন হয়েছিল তখন। এর শক ওয়েভে চারপাশে সৃষ্টি হয়েছে উঁচু পর্বতমালা।

ক্যারোলিস অববাহিকা


মেসেঞ্জার মিশন বুধের পিঠে নতুন ধরনের কিছু ফুলে উঠা জায়গার সন্ধানও পায়। এগুলোকে ইংরেজিতে hollows বলা হয়। 

No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts