Thursday 13 February 2020

বুধ - পর্ব ১৪


ম্যারিনার-১০: বুধে প্রথম অভিযান

মিশন ম্যারিনার-১০ ছিল বুধের প্রথম অভিযান। এই মিশনকে বলা যায় একের ভিতর দুই।  এই মিশনে ম্যারিনার-১০ নভোযান বুধ ও শুক্র দুটো গ্রহের পাশ দিয়েই গিয়েছে এবং দুটো গ্রহেরই ছবি তুলে পাঠিয়েছে। ম্যারিনার-১০ ছিল প্রথম নভোযান যেটা মহাকাশ অভিযানগুলোর জন্য ছিল সবচেয়ে দরকারি পদক্ষেপ। কারণ এই মিশনে পৃথিবী থেকে বুধে যাওয়ার জন্য একটি নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছিল প্রথম বারের মতো। মহাকাশে গতিপথ পরিবর্তন করার জন্য শুক্র গ্রহের অভিকর্ষ কাজে লাগানো হয়েছিল। এটা সফল হবার পর এই পদ্ধতি একটি অত্যন্ত দরকারি পদ্ধতিতে পরিণত হয়। এই প্রথম সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে নভোযানের ত্বরণের ব্যবস্থা করা হয় এবং অ্যান্টেনাকে নৌকার পালের মত ব্যবহার করে মহাকাশে গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
            দেখা যাক ম্যারিনার-১০ মিশনের লক্ষ্য কী ছিল, নভোযানে কী কী ছিল, মহাকাশে তার গতিপথ কেমন ছিল এবং বুধের কাছে গিয়ে কী কী নতুন তথ্য পাঠিয়েছিল পৃথিবীতে।
  
ম্যারিনার-১০ মিশনের লক্ষ্য

ম্যারিনার-১০ মিশনের মূল লক্ষ্য ছিল:
  • বুধ গ্রহের উপরিতলের উপাদান, বায়ুমন্ডল, পরিবেশ ও অন্যান্য ভৌত ধর্ম পরীক্ষা করে দেখা।
  • শুক্র গ্রহের বায়ুমন্ডল ও অন্যান্য ভৌত ধর্ম পরীক্ষা করে দেখা।
  • বুধ ও শুক্র গ্রহের চার পাশে জরিপ করে দেখা।
  • এক গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ বলকে কাজে লাগিয়ে নভোযান অন্য গ্রহের দিকে নিয়ে যাওয়ার পদ্ধতির কারিগরি দিকগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা।
  • X-band ট্রান্সমিটারের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখা।
  • আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি পরীক্ষা করে দেখা।

ম্যারিনার-১০ নভোযান

ম্যারিনার-১০ এর মূল যানটি ১.৩৯ মিটার চওড়া এবং ৪৬ সেন্টিমিটার উঁচু একটি আট কোণা বাক্সের মতো। এই বাক্সটির ভর ৫০৪ কেজি যার মধ্যে আছে ৮০ কেজি ভরের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি এবং ২০ কেজি ভরের হাইড্রাজিন (hydrazine) (N2H4)। হাইড্রাজিন হলো নভোযানের জ্বালানি।
            মূল যানের দুই পাশে লাগানো আছে দুইটি সোলার প্যানেল। প্রতিটি সোলার প্যানেলের দৈর্ঘ্য ২.৭ মিটার এবং প্রস্থ ১ মিটার। এই সোলার প্যানেল দুটো মহাকাশে খোলার পর ৮ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। প্রতিটি সোলার প্যানেলে ২.৫ বর্গমিটার জায়গা জুড়ে আছে সোলার সেল। নভোযানটির উপরের অ্যান্টেনা থেকে নিচের হিট শিল্ড বা তাপ নিরোধ ব্যবস্থা পর্যন্ত মোট দৈর্ঘ্য ৩.৭ মিটার।
            এছাড়াও আছে ছবি তোলার যন্ত্রপাতি, ইনফ্রারেড রেডিওমিটার আলট্রাভায়োলেট স্পেক্ট্রোমিটার বা অতিবেগুনি বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্র, দুটো ম্যাগনেটোমিটার, চার্জ পার্টিক্যাল টেলিস্কোপ ও প্লাজমা অ্যানালাইজার।
            নভোযানের তাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য উপরে ও নিচের দিকে একাধিক স্তরের তাপনিরোধক কম্বল দিয়ে মুড়ে দেয়া হয়। সূর্যের খুব কাছে যাবে বলে নভোযানকে সূর্যের প্রচন্ড তাপ ও আলো থেকে বাঁচানোর জন্য একটি শেডের ব্যবস্থাও আছে নভোযানের গায়ে।

ম্যারিনার-১০ এর বিভিন্ন অংশ

মহাকাশে ম্যারিনার-১০ এর শক্তির উৎস হলো সৌরশক্তি। সোলার প্যানেল থেকে সর্বোচ্চ ৮২০ ওয়াট পর্যন্ত ক্ষমতা পাওয়া যায়। এই নভোযান সেকেন্ডে ১১৭.৬ কিলোবিট হারে তথ্য (ডাটা) পাঠাতে পারতো। ১৯৭৩ সালে পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ কম্পিউটার প্রযুক্তির নামও শোনেননি। সেই সময়ের নভোযান প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১১৮ কিলোবিট[1] ডাটা পাঠাচ্ছে পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার দূর থেকে - কেমন আশ্চর্য লাগে না?

মহাকাশে ম্যারিনার-১০ এর গতিপথ
১৯৭৩ সালের ৩ নভেম্বর ম্যারিনার-১০ নভোযান পৃথিবী থেকে মহাকাশে উৎক্ষিপ্ত হয়। আমেরিকার ফ্লোরিডা রাজ্যের কেইপ ক্যানাভেরাল সিটিতে কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে যথাসময়ে পৃথিবী থেকে মহাশূন্যে যাত্রা করে ম্যারিনার-১০। পৃথিবী ছেড়ে যাবার পর পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে বের হয়েই পৃথিবী ও চাঁদের ছবি পাঠাতে শুরু করে। কিন্তু দশ দিন যেতে না যেতেই ভয়ানক যান্ত্রিক সমস্যা দেখা দেয়। নভোযানের গা থেকে এক চিলতে রঙ উঠে গিয়ে মহাকাশে ভাসতে থাকে। আর ম্যারিনার-১০ এর পাঠানো ছবিতে সেটাকে একটা তারার মতো মনে হয়। ফলে নভোযানে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। তারপর গতি বাড়িয়ে শুক্রের দিকে রওনা দেয়। এরমধ্যে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয় নানারকম। হাই-গেইন অ্যান্টেনা ও উচ্চতা নিয়ন্ত্রক সার্কিটে সমস্যা দেখা দেয়। পৃথিবীর কন্ট্রোল রুম থেকে সেগুলোকে রিমোট কন্ট্রোল পদ্ধতিতে সারানো হয়। ১৩ নভেম্বর ১৯৭৩ এ একবার সারানো হয়, তারপর ২১ জানুয়ারি ১৯৭৪ সালে আবার সারানো হয়।
ম্যারিনার-১০ উৎক্ষেপণ
তারপর ১৯৭৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি এটা শুক্রের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। ম্যারিনার-১০ শুক্রের ৪১৬৫টি ছবি এবং আরো অনেক বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ করে পাঠায়। এভাবে নভোযানটি শুক্রের একেবারে ৫৭৬৮ কিলোমিটার কাছে পৌঁছে যায়। তারপর শুক্রের মাধ্যাকর্ষণ বল কাজে লাগিয়ে নভোযান সূর্যের সবচেয়ে ভেতরের গ্রহ বুধের দিকে চললো। পথে আবার যান্ত্রিক সমস্যা দেখা দিলো। সেটা ঠিক করা হলো ১৬ মার্চ ১৯৭৪।       
নভোযান যতই বুধের কাছাকাছি যাচ্ছিলো ততই চাঁদের মতো শুষ্ক একটা বস্তুপিন্ড দেখা যাচ্ছিলো। বুধের উপরিতল চাঁদের পিঠের মতোই এবড়োখেবড়ো। বিশাল বিশাল গর্ত, বড় বড় উঁচুনিচু বাঁধ।
ম্যারিনার-১০ এর গতিপথ

নভোযানের ম্যাগনেটোমিটার বুধ গ্রহের ক্ষীণ একটি চৌম্বকক্ষেত্রের অস্তিত্ব প্রমাণ পায়। রেডিওমিটার বুধের তাপমাত্রা মাপে। রাতের বেলা তাপমাত্রা মাইনাস ১৮৩ ডিগ্রি এবং দিনের বেলা সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১৮৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২৯ মার্চ ১৯৭৪ ম্যারিনার-১০ বুধের একদম কাছে ৭০৩ কিলোমিটার দূরত্বে চলে আসে। সূর্যের চার পাশে এক চক্কর দিয়ে ম্যারিনার-১০ দ্বিতীয় বার বুধ গ্রহের পাশ দিয়ে উড়ে যায় ১৯৭৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। এবার কিছুটা দূর দিয়ে চলে যায়। ৪৮,০৬৯ কিলোমিটার দূরত্বে চলে আসে। ম্যারিনার-১০ এর সোলার প্যানেলে সূর্যের আলোর চাপ কাজে লাগিয়ে মহাকাশে ভেসে চলে ম্যারিনার-১০। হাই-গেইন অ্যান্টেনা কাজে লাগানো হয় উচ্চতা নিয়ন্ত্রণের জন্য। ১৯৭৫ সালের ১৬ মার্চ তৃতীয় ও শেষ বারের মতো বুধের একেবারে কাছ দিয়ে উড়ে যায় ম্যারিনার-১০। বুধ গ্রহের মাত্র ৩২৭ কিলোমিটার দূরে থেকে বুধের ছবি তোলে ম্যারিনার-১০।
            ১৯৭৫ সালের ২৪ মার্চ ম্যারিনার-১০ এর সাথে পৃথিবীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নভোযানটি এখনো হয়তো মহাকাশে ঘুরছে।

ম্যারিনার-১০ থেকে দেখা বুধ

ম্যারিনার-১০ নভোযানে ১৫০০ মিলিমিটার ফোকাস দূরত্বের লেন্স যুক্ত ক্যামেরা ছিল। এই ক্যামেরা দিয়ে অনেক দূর থেকে একের পর এক ছবি তুলতে তুলতে বুধের কাছ দিয়ে অগ্রসর হয়েছে নভোযান।
ম্যারিনার-১০ থেকে বুধ গ্রহের প্রথম ছবি

ম্যারিনার-১০ থেকে দেখা বুধের দক্ষিণ গোলার্ধ

বুধের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় ম্যারিনার-১০ থেকে তোলা ছবি 

বুধ থেকে দূরে সরে যাওয়ার সময় ম্যারিনার-১০ থেকে তোলা ছবি

ছবিগুলোর প্রতি পিক্সেল দুই কিলোমিটার থেকে চার কিলোমিটার পর্যন্ত জায়গার প্রতিনিধিত্ব করে। কোন কোন ছবি কয়েক শ কিলোমিটার জায়গা ধারণ করে, আবার কোন কোন ছবিতে মাত্র কয়েক শ মিটার জায়গা ধারণ করে।
বুধ গ্রহের কাছ দিয়ে তিন বার উড়ে গিয়ে কয়েক হাজার ছবি তুলে পাঠালেও ম্যারিনার-১০ বুধ গ্রহের মাত্র ৪৫% এলাকার ছবি তুলতে পেরেছিল। কিন্তু এই ৪৫% এলাকার ছবি এবং অন্যান্য তথ্য বিশ্লেষণ করে বুধের অনেক অজানা বিষয়
জানা যায়। বুধের তাপমাত্রা, বুধের বায়ুমন্ডল ও চৌম্বকক্ষেত্র সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা বিশেষ তথ্য পান ম্যারিনার-১০ এর পাঠানো বুধের তথ্য থেকে। বুধের অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কেও অনেক নতুন ধারণা পাওয়া যায়।
            বুধ মিশনের আগে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছিলেন যে বুধ গ্রহ পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদের মতো একটা মৃত বস্তুপিন্ড। বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল যে বুধের উপরিতলও চাঁদের মতো এবড়োখেবড়ো খানা-খন্দ-গর্ত আর ধুলোভর্তি হবে। কিন্তু যখন বুধে চৌম্বকক্ষেত্রের আভাস পাওয়া গেলো - বোঝা গেল যে বুধ আর চাঁদে মৌলিক পার্থক্য আছে।
            বুধ গ্রহের কোন উপগ্রহ বা চাঁদ নেই। সৌরজগতের গ্রহগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র বুধ ও শুক্র গ্রহের কোন উপগ্রহ নেই।
            ম্যারিনার-১০ থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও ছবি জুড়ে জুড়ে বুধের সম্পূর্ণ ম্যাপ তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বুধ গ্রহের বারো হাজার ছবি পাঠিয়েছিল ম্যারিনার-১০।
            ম্যারিনার-১০ নভোযান বুধের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় সর্বপ্রথম একটি উজ্জ্বল ক্রেইটার বা গহ্বর দেখতে পায়। পরে এই গহ্বরটির নাম রাখা হয় কুইপার। বিজ্ঞানী জেরার্ড কুইপারের (Gerard Kuiper) নামানুসারে এই নামকরণ করা হয়েছে। বুধের ক্রেইটার এবং অন্যান্য ফিচার সম্পর্কে আমরা পরে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
            পৃথিবী থেকে দেখা যায় না বুধের এমন অনেক জায়গার ছবি পাঠায় ম্যারিনার-১০। কিন্তু যেহেতু শুধুমাত্র ৪৫% জায়গা জরিপ করা সম্ভব হয়েছে তাই বুধ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা পাওয়া সম্ভব হয়নি।
            তাছাড়া ম্যারিনার-১০ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বুধ সম্পর্কে অনেক নতুন প্রশ্নেরও জন্ম দেয়। যেমন, বুধে ক্ষীণ বায়ুমন্ডল কোত্থেকে এলো? বুধের চৌম্বকক্ষেত্রের উৎস কী? বুধের কেন্দ্রে কী গলিত লোহা আছে? ঠিক কীভাবে উৎপত্তি হয়েছিল বুধের?
            এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য প্রথম অভিযানের প্রায় ত্রিশ বছর পর ২০০৪ সালে বুধ গ্রহে দ্বিতীয় বার অভিযান চালানো হয়।


[1] ১ কিলোবিট = ১০০০ বিট। ৮ বিট = ১ বাইট

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Young Scientist Gitanjali Rao

At just twelve years old and in seventh grade, Gitanjali Rao earned the title of America’s Top Young Scientist in 2017 after developing &quo...

Popular Posts