Thursday 13 February 2020

বুধ - পর্ব ১৬


মেসেঞ্জার নভোযান

বুধের বৈজ্ঞানিক মিশন মেসেঞ্জার। সূর্যের কাছের গ্রহগুলোর উৎপত্তি ও বিবর্তন সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানার জন্য এই মিশন। বুধ গ্রহকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য, বুধের কক্ষপথে যাবার জন্য একটা খুবই শক্ত ও কার্যকরী আধুনিক নভোযানের দরকার। সূর্যের এত কাছে যাবে বলে নভোযানটিকে হতে হবে খুবই তাপসহিষ্ণু, তীব্র আলোকসহিষ্ণু। সূর্যের সরাসরি আলো এবং বুধ গ্রহ থেকে প্রতিফলিত আলো এসে পড়বে নভোযানে। তাই তাকে হতে হবে দুর্দান্ত রকমের। নভোযানটিকে হতে হবে হাল্‌কা অথচ মজবুত। নভোযানের জ্বালানি বহন করার ক্ষমতা থাকতে হবে। কারণ নভোযানকে দরকার মতো গতি কমাতে হবে, বাড়াতে হবে এবং এসবের জন্য শুধুমাত্র সৌরশক্তির উপর নির্ভর করা যায় না। তাছাড়া এটার আয়তন খুব বেশি হতে পারবে না। কারণ তাতে রকেট দিয়ে উৎক্ষেপণের খরচ বেড়ে যাবে অনেক।
            মেসেঞ্জার মিশন এই সব চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে একটা চমৎকার কার্যকরী নভোযান তৈরি করেছে। ম্যারিনার-১০ শেষ হওয়ার ত্রিশ বছর পর মেসেঞ্জার মিশন। এই ত্রিশ বছরে বিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হয়েছে। কারিগরি দক্ষতা বেড়েছে অনেক গুণ। একবিংশ শতাব্দীর কম্পিউটার ও ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতা কাজে লাগিয়ে মেসেঞ্জার নভোযান অনেক বেশি মজবুত অথচ হালকা পদার্থ দিয়ে তৈরি করা হয়। নভোযান, যন্ত্রপাতি তৈরি, উৎক্ষেপণ, মিশন ব্যবস্থাপনা, তথ্য বিশ্লেষণ সব মিলিয়ে মেসেঞ্জার মিশনে মোট খরচ হয়েছে প্রায় ৪৪৬ মিলিয়ন বা ৪৪ কোটি ৬০ লক্ষ ডলার।
            নভোযানের মূল বডি ১.৪২ মিটার লম্বা, ১.৮৫ মিটার চওড়া, এবং ১.২৭ মিটার পুরু। নভোযানের বডি প্রস্তুত হয়েছে গ্রাফাইট মিশ্রিত হালকা ধাতু থেকে। খুবই মজবুত, হালকা এবং তাপসহিষ্ণু। মেসেঞ্জার নভোযানের মোট ভর ১১০৭ কেজি। এর মধ্যে ৫৯৯ কেজি হলো জ্বালানি যা ছিল নভোযানের মোট ভরের শতকরা ৫৫ ভাগ। নভোযানের জ্বালানি ছাড়াও শক্তির অন্যান্য উৎস ছিল নভোযানের গায়ে লাগানো দুটো গ্যালিয়াম আর্সেনাইড সোলার প্যানেল ও নিকেল-হাইড্রোজেন ব্যাটারি। নভোযানের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ছিল ৬৪০ ওয়াট।
            পৃথিবী থেকে সূর্যের যে দূরত্ব, বুধ থেকে সূর্যের দূরত্ব তার তিন ভাগের দুই ভাগ। সূর্যের এত কাছে বলে সূর্য থেকে পৃথিবীতে যে পরিমাণ তাপ ও আলো এসে পৌঁছায় - বুধে আলো ও তাপ আসে তার চেয়ে ১১ গুণ বেশি। ফলে বুধের নভোযানকে হতে হবে অনেক বেশি তাপ সহনীয়।
            নভোযানকে অত্যন্ত গরম হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য একাধিক ব্যবস্থা নেয়া হয়। একটা সিরামিকের সানশেড বা ছায়ার আচ্ছাদন তৈরি করা হয়। প্রচন্ড তাপ থেকে বাঁচার জন্য মেসেঞ্জার নভোযানের প্রথম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল এই তাপ নিরোধী এবং উচ্চ প্রতিফলন ক্ষমতা সম্পন্ন পর্দা। একটি টাইটানিয়াম ফ্রেমের সাথে নভোযানের সামনে লাগানো ছিল এটা। আড়াই মিটার বাই দুই মিটার বা আট ফুট বাই ছয় ফুটের এই পর্দা পাতলা হলেও তাপের বিরুদ্ধে খুবই কার্যকরী।             তাপ বিকিরণ করার জন্য অন্যান্য যন্ত্রপাতির ব্যবস্থাও করা হয়। উপরে ও নিচে নেক্সটেল সিরামিকের কাপড়। মধ্যে ক্যাপটন প্লাস্টিকের অনেকগুলি স্তর। বাইরের তাপমাত্রা যখন ৩৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস উঠে যায়, তখনো এই পর্দার কারণে ভেতরের তাপমাত্রা মাত্র ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ধরে রাখা যায়। এই কভার নভোযানের বেশিরভাগ অংশ ঢেকে রাখে।
            নভোযান থেকে তাপ সরিয়ে ফেলার জন্য একমুখি তাপীয় নল আছে যেগুলো তাপ বের করে দেয়। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালানোর জন্য সায়েন্স অরবিট বা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার কক্ষপথ এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যেন অতিরিক্ত তাপে নভোযান গরম না হয়ে পড়ে, যেন সূর্যের কাছাকাছি অনেকক্ষণ থাকতে না হয়। মেসেঞ্জার নভোযান প্রতি বারো ঘন্টায় মাত্র ২৫ মিনিট বুধের উত্তপ্ত পিঠের দিকে কাটিয়েছে।

মেসেঞ্জারের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি

মেসেঞ্জার নভোযানে আট সেট অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ছিল:

(১)        মার্কারি ডাবল ইমেজিং সিস্টেম (MDIS): ছবি তোলার যন্ত্রপাতি
(২)        গামা রে অ্যান্ড নিউট্রন স্পেকট্রোমিটার (GRNS)
(৩)        এক্স-রে স্পেকট্রোমিটার (XRS)
(৪)        ম্যাগনেটোমিটার (MAG)
(৫)        মার্কারি লেসার অ্যালটিমিটার (MLA)
(৬)        মার্কারি অ্যাটমোস্ফিয়ার অ্যান্ড সারফেস কম্পোজিশান স্পেকট্রোমিটার (MASCS)
(৭)        এনার্জেটিক পার্টিক্যল অ্যান্ড প্লাজমা স্পেকট্রোমিটার (EPPS)
(৮)        রেডিও সায়েন্স (RS)

            বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিচের সারণিতে দেয়া হলো।
সারণি: মেজেঞ্জার নভোযানের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির বর্ণনা
যন্ত্রপাতি
বর্ণনা
MDIS
১১টি ফিল্টারসহ ওয়াইড অ্যাঙ্গেল ক্যামেরা এবং একটি সিঙ্গেল চ্যানেল ন্যারো অ্যাঙ্গেল ক্যামেরা।
GRNS
বুধে মহাজাগতিক রশ্মি থেকে আসা হাইড্রোজেন, ম্যাগনেসিয়াম, সিলিকন, অক্সিজেন, আয়রন, টিন, সোডিয়াম ও ক্যালসিয়াম  এর মাত্রা পরিমাপ করার জন্য গামা রে স্পেকট্রোমিটার (GRS)।
      তেজস্ক্রিয় পটাশিয়াম, থোরিয়াম ও ইউরেনিয়াম থেকে আসা নিউট্রনের পরিমাণ হিসেব করার জন্য নিউট্রন স্পেকট্রোমিটার (NS)।
XRS
বুধের উপরিতল থেকে বিচ্ছুরিত হয়ে আসা এক্স-রে ডিটেক্ট করা এবং মাপার জন্য তিনটি গ্যাস-ফিল্ড ডিটেক্টর। আর সূর্য থেকে আসা এক্স-রে মাপার জন্য একটি সিলিকন সলিড স্টেড ডিটেক্টর।
MAG
বুধের চৌম্বকক্ষেত্রের পরিমাণ ও দিক নির্ণয় করার জন্য ম্যাগনেটোমিটার।
MLA
বুধের মাধ্যাকর্ষণ মাপার জন্য ইনফ্রারেড বা অবলোহিত লেসার ট্রান্সমিটার ও রিসিভার।
MASCS
বায়ুমন্ডলে কী কী গ্যাস আছে তা মাপার জন্য আলট্রাভায়োলেট ও ভিজিবল স্পেকট্রোমিটার।
বুধের উপরিতলের উপাদানে যেসব খনিজ পদার্থ আছে তা শনাক্ত করার জন্য ভিজিবল অ্যান্ড ইনফ্রারেড স্পেকট্রোগ্রাফ।
EPPS
চৌম্বকক্ষেত্রের কারণে যেসব চার্জিত কণা ঘুরে বেড়ায় তাদের শনাক্ত করার জন্য এনার্জেটিক পার্টিক্যল স্পেকট্রোমিটার (EPS) ও ফাস্ট ইমেজিং প্লাজমা স্পেকট্রোমিটার (FIPS)।
RS
বুধের অভিকর্ষ বল মাপার জন্য রেডিও কমিউনিকেশান সিস্টেম।

এই আট সেট বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ভর ছিল প্রায় সাড়ে ৪২ কেজি। মেসেঞ্জার নভোযানের সমস্ত সংযোগ তার, ইলেকট্রনিক্স, এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি সব একটা ছোট্ট বাক্সের মধ্যে রাখা যেটা একটা ছোট স্পোর্টস কারে রাখা যাবে। 


No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts