Monday 13 September 2021

সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্মদিনে

 


"আকাশভরা সূর্যতারা বিশ্বভরা প্রাণ,

তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান,

বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।"

রবীন্দ্রনাথের এই গান যতবারই শুনি - বিস্ময়ে ব্যাকুল হই - আকাশভরা সূর্যতারার এই মহাবিশ্বের এই অপার বিস্ময়ের কিছুই তো জানা হলো না।

রবিবিশ্বের মুগ্ধতা কাটবার নয়। সেরকমই মুগ্ধতায় বাক্যহারা হয়ে যাই - সৈয়দ মুজতবা আলীর পান্ডিত্যে, লেখার মণিমুক্তায়।

১১৭ বছর বয়স হলো তাঁর। ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯০৪ - সিলেটের করিমগঞ্জে তাঁর জন্ম। অগাধ পান্ডিত্যের ছিঁটেফোঁটাই মাত্র লিখেছেন। সেই লেখাও থেমে গেছে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ - প্রায় ৪৭ বছর আগে। কিন্তু তাঁর যেকোনো লেখা পড়লেই মনে হয় - নিত্যনতুন।

তাঁর যেসব লেখাকে আমরা 'রম্যরচনা' নাম দিয়ে হালকা ভাবার চেষ্টা করি - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেগুলি সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন - ওগুলি সব প্রবন্ধ।[1] আমাদের প্রচলিত ধারণা হলো - যেসব লেখা পন্ডিতী ফলানোর জন্য লেখা হয়, কয়েক লাইন পড়লেই ঘুম চলে আসে - সেগুলিই প্রবন্ধ। সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রবন্ধগুলি পড়তে শুরু করলে শেষ না করে রাখা যায় না -সে কারণেই কি সেগুলিকে প্রবন্ধ বলতে চাই না?

'দেশেবিদেশে' তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই। কিন্তু প্রথম লেখা নয়। দেশেবিদেশে কি শুধুই ভ্রমণকাহিনি? ইতিহাস নয়? সমাজদর্পণ নয়?

প্রাণখোলা হাসি প্রচলিত পান্ডিত্যের পরিপন্থী। যেসব পন্ডিত আমাদের সমাজে সদর্পে স্বপ্রচারে সরব, তাঁদের কেউই প্রাণখুলে হাসেন না। পাছে লোকে তাঁদের পান্ডিত্য নিয়ে সন্দেহ করে। কিন্তু সৈয়দ মুজতবা আলী পাঠককে যেভাবে হো হো করে হাসিয়ে ছাড়েন, তেমনি নিজেও হাসতে পারতেন প্রাণখুলে, মন খুলে। কিছু কিছু পন্ডিতের সাথে আমরা পরিচিত - যাদের সাক্ষাৎ এত বেশি গম্ভীর যে দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। অথচ সৈয়দ মুজতবা আলীর পান্ডিত্য ছিল ভোরের আলোর মতো স্নিগ্ধ, শরতের বাতাসের মতো নির্মল।

সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রত্যেকটি লেখায় কতো কিছু অজানা বিষয় থাকে।  অথচ একটুও মনে হয় না তিনি মাস্টারি করছেন। পাঠক মাস্টারদের তবু কোন রকমে সহ্য করতে পারেন, কিন্তু সাহিত্যে মাস্টারি অসহ্য। সৈয়দ মুজতবা আলী ব্যাপারটা খুব ভালোভাবেই জানতেন।

এত কম কথায় এত বেশি তিনি বলতে পারতেন - যা মাঝে মাঝে তাঁর গুরুদেব রবিঠাকুরের ঠিক উল্টো। রবিঠাকুরের গল্প কিংবা উপন্যাসে কম-কথার চলন খুব একটা নেই। কিন্তু সৈয়দ মুজতবা আলী কম-কথায় এক কথায় অনবদ্য। 'মুখের রঙটি যেন শিশিরে ভেজা' - পাঁচ শব্দেই  তাঁর গল্পের নায়িকার রূপ মূর্ত হয়ে  ওঠে।

প্রেমে পড়ার বয়সে তাঁর 'প্রেম' পড়ে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। প্রেমিকার গর্ভে সন্তান রেখে প্রেমিক পালিয়ে গেছে প্রতারণা করে। আদালতে বিচারক যখন প্রতারিতাকে প্রশ্ন করেন, "আচ্ছা, তুমি সেই ছেলেটার সন্ধান নিলে না কেন? তাকে বিয়ে করাতে বাধ্য করালে না কেন?"[2]

কুন্ডুলি পাকানো গোখরো সাপ যে রকম হঠাৎ ফণা তুলে দাঁড়ায়, মেয়েটা ঠিক সেই রকম বলে উঠলো, 'কী! সেই কাপুরুষ - যে আমাকে অসহায় করে ছুটে পালালো! তাকে বিয়ে করে আমার বাচ্চাকে দেব সেই কাপুরুষের, সেই পশুর নাম!'

এতটা আত্মসম্মান, আত্মশক্তি আবিষ্কার করতে পারেন যিনি - তিনিই তো সৈয়দ মুজতবা আলী।

শুভ জন্মদিন প্রিয় লেখক।



[1] সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডের ভূমিকা। মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা: লি:, কলকাতা, শ্রাবণ ১৪০৮ বাংলা।

[2] সৈয়দ মুজতবা আলী, রাজা উজীর গ্রন্থের ‘প্রেম’।


4 comments:

  1. প্রত্যেক লেখক নিয়ে তোমার অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করে জন্মদিন পালনের বিষয়টি আমার দারুণ লাগে। কিন্তু তোমাকে একবার আমি অনুরোধ করেছিলাম যে, তোমার প্রিয় গ্রন্থগুলো নিয়ে ব্লগে একটি লেখা লিখার জন্য। তুমি সম্মতও হয়েছিলে। আশা করি তোমার স্মরণে আছে।

    ReplyDelete
  2. আমার প্রিয় বই তো অনেক। একটি লেখায় সবগুলি বই নিয়ে কথা বলা যাবে না। মাঝে মাঝে কোন কোন বই নিয়ে হয়তো লেখা হবে।

    ReplyDelete
  3. আমি জানতাম তোমার প্রিয় বইয়ের সংখ্যা অনেক হবে। তবে মাঝে মাঝে কোনো কোনো বই নিয়ে লিখলে আমি খুশিই হব।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ লিখবো সময় করে। অনেক ধন্যবাদ।

      Delete

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts