Saturday 11 September 2021

এগারো সেপ্টেম্বর

 

নিউইয়র্ক শহরে টুইন টাওয়ারের ঘটনাস্থলে নিহতদের স্মরণে আলোকস্তম্ভ। [ছবি: pxfuel.com]

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর – আমেরিকানদের তারিখ লেখার পদ্ধতি অনুসারে নাইন-ইলেভেন। এইদিনের পর থেকে গত বিশ বছরে পৃথিবীর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক আর সর্বোপরি ধর্মীয় বিভাজন প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু আমেরিকা নয়, পুরো বিশ্বকে বদলে দিয়েছে এই একটি তারিখ।

আমেরিকায় নাইন-ইলেভেনের সকালে এই ঘটনা যখন ঘটছে তখন মেলবোর্নে ১২ তারিখের ভোররাত। আমি তখন থাকতাম ফিলের অ্যাপার্টমেন্টের একটা রুম ভাড়া নিয়ে। আমার টেলিভিশন ছিল না। ফিল একটা বারো ইঞ্চি সাদা-কালো অ্যানালগ টেলিভিশন আমার রুমে এনে দিয়েছিল। তখন ডিটিজাল টেলিভিশন আসতে শুরু করেছে। লোকে পুরনো অ্যানালগ টেলিভিশনগুলি ফেলে দিচ্ছিলো। ফিল সেরকই কোন পরিত্যক্ত টেলিভিশন ফুটপাত থেকে তুলে এনে আমার রুমে ঢুকিয়ে দিয়েছে। শুয়ে শুয়ে ওটা দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ভোররাতে ঘুম ভাঙার পর দেখি টিভিতে টুইন টাওয়ারের ঘটনা দেখানো হচ্ছে। প্রথমে বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম কোন মুভি চলছে। কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারলাম – কোন সিনেমার দৃশ্য নয়, সরাসরি দেখানো হচ্ছে আমেরিকায় তখন কী হচ্ছে। 

এরপর পরের দিনই সবাই জেনে গিয়েছে কী কী হয়েছিল সেখানে। আল্‌ কায়েদার ১৯জন জঙ্গী চার গ্রুপে বিভক্ত হয়ে চারটি যাত্রীবাহী প্লেন হাইজ্যাক করেছে প্রায় একই সময়ে। দুটি প্লেন উড়ে গিয়ে আঘাত করেছে টুইন টাওয়ারের দুই টাওয়ারে। তৃতীয় প্লেনটি আছড়ে ফেলেছে পেন্টাগনের উপর। আর চতুর্থ প্লেনটি বিধ্বস্ত হয়েছে পেনসিলভেনিয়ার শ্যাংকসভিলের মাঠে। তিন হাজারেরও বেশি সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই। সন্ত্রাসী জঙ্গিরা ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে বিভৎসভাবে খুন করেছে এতগুলি মানুষ – নারী, পুরুষ, শিশু। 


টুইন টাওয়ার জ্বলছে। [ছবি: skeptic.com]

১১ সেপ্টেম্বর ২০০১, নিউইয়র্ক সময় সকাল ৮টা ৪৫। মঙ্গলবার সকালের ঝকঝকে রোদে জেগে উঠেছে ম্যানহাটানের অফিসপাড়া। আমেরিকান এয়ারলাইনসের বোয়িং ৭৬৭ প্লেনটি উড়ে গিয়ে টুইন টাওয়ারের উত্তরের দিকের টাওয়ারের ৮০ তলায় ঢুকে গেল। বিশ হাজার গ্যালন জ্বালানি তেলের আগুন ছড়িয়ে পড়লো মুহূর্তেই। দমকলবাহিনি সর্বোচ্চ চেষ্টায় যখন মানুষের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত, টেলিভিশন ক্যামেরাগুলি যখন সরাসরি এই ঘটনা দেখাতে শুরু করেছে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে – তখনি – প্রথম আঘাতের আঠারো মিনিট পর আরেকটি বোয়িং ৭৬৭ – ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স ফ্লাইট ১৭৫ উড়ে এসে আছড়ে পড়লো দক্ষিণের টাওয়ারের ৬০ তলায়।  তখনি বোঝা গেল – এগুলি দুর্ঘটনা নয়, সরাসরি আক্রমণ। 

পনেরো মিনিটের মধ্যেই দক্ষিণ টাওয়ারের পুরোটাই ধ্বসে পড়লো। সাড়ে দশটার মধ্যে উত্তরের টাওয়ারও মিশে গেল মাটির সাথে। ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়লো আড়াই হাজারেরও বেশি মানুষ। 


পেন্টাগনে আক্রমণ [ছবি Flickr]


লক্ষ লক্ষ আমেরিকান যখন টুইন টাওয়ার আক্রমণের ঘটনা টিভিতে সরাসরি দেখছিলো – তখন আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির ডাউনটাউনের আকাশে ঘুরছিল আমেরিকান এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ৭৭। সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে সেটা আছড়ে পড়লো আমেরিকান মিলিটারি হেড কোয়ার্টার – পেন্টাগনের উপর। বিশাল বিল্ডিং-এর একটা অংশ ধ্বসে পড়লো।  প্লেনের ৬৪জন যাত্রী এবং ১২৫জন মিলিটারি অফিসারের জীবনাবসান হলো কয়েক মিনিটের মধ্যেই। 

চতুর্থ প্লেন ইউনাইটেড ফ্লাইট-৯৩ ৪৪জন যাত্রী নিয়ে নিউজার্সি থেকে ক্যালিফোর্নিয়া যাচ্ছিলো। উড়াল দেয়ার চল্লিশ মিনিটের মাথায় ওই প্লেনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় যাত্রীবেশী সন্ত্রাসীরা। ইতোমধ্যে যাত্রীদের অনেকেই এবং ক্যাপ্টেন ও ক্রুরা জেনে গেছে টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনের ঘটনা। তারা বুঝতে পারে তাদের কেউই আর বাঁচবে না। মরার আগে অসহায়ভাবে মরার চেয়ে কিছু একটা করে মরার চেষ্টায় তারা হাইজ্যাককারী জঙ্গিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। যাত্রীদের কয়েকজন তাদের পরিবারের কাছে সেলফোনে বার্তা পাঠিয়ে বিদায় নিয়ে নেয়। যাত্রীরা ককপিটে সন্ত্রাসীদের উপর আক্রমণ চালায়। প্লেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সকাল ১০টা ১০-এ আছড়ে পড়ে পেনসিলভেনিয়ার একটি মাঠে। সবার মৃত্যু ঘটে। যাত্রীরা ওভাবে বাধা না দিলে এই প্লেনটি হয়তো আছড়ে পড়তো হোয়াইট হাউজে কিংবা ক্যাপিটল হিলে। 

পরে, আরো অনেক পরে জানা যায় এই আক্রমণের মূল পরিকল্পনাকারী আল্‌ কায়েদার ওসামা বিন লাদেন এবং তার দল। ১৯জন জঙ্গীর মধ্যে অনেকেই আমেরিকায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বিমান চালনার প্রশিক্ষণ নিয়েছে। এক বছরেরও বেশি ধরে আমেরিকায় থেকে পরিকল্পনা করেছে আমেরিকাকে ধ্বংস করার। এয়ারপোর্টের নিরাপত্তারক্ষীদের মধ্যেও আল-কায়েদার লোক ছিল। তাদের সহযোগিতায় জঙ্গীরা প্লেনে ছুরি নিয়ে উঠেছিল। অন্য কোন অস্ত্র ছাড়াই প্লেনের জ্বালানিসহ পুরো প্লেনকেই ব্যবহার করেছে বিশাল আকৃতির মিজাইল হিসেবে। 

২,৯৯৬ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এই নাইন-ইলেভেনের আক্রমণে। আক্রান্ত মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন ৩৪৩ জন ফায়ার-ফাইটার ও চিকিৎসাকর্মী, ৬০ জন পুলিশ। 

এরপর গত বিশ বছর ধরে চলছে এই ঘটনার প্রতি-ঘটনা। সারাপৃথিবীর বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটির জন্ম হয়েছে। এর আদলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের এয়ারপোর্টের নিরাপত্তাও হয়ে গেছে বাড়াবাড়ি রকমের ব্যয়বহুল ও বিরক্তিকর। 

এর বাইরেও সবচেয়ে যেটা বেশি ঘটেছে তা হলো মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ভেঙে গেছে। নাইন-ইলেভেনের কয়েক দিনের মধ্যেই আমাকে একাধিকবার একই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে – “আর ইউ অ্যা মুসলিম?” তার মানে – মুসলিম হলেই বিপজ্জনক ব্যক্তি? মুসলিম হলেই তাকে আর বিশ্বাস করা যায় না? 

২০০১ এর অক্টোবরে আমি নিউজিল্যান্ড গিয়েছিলাম। নাইন-ইলেভেনের ধকল যে কী জিনিস তা এয়ারপোর্টে দেখতে হয়েছে। ২০০২ এর এপ্রিলে গেলাম আমেরিকায়। চার-পাঁচ ঘন্টা লাগলো শুধুমাত্র সিকিউরিটি গেট পার হতে। আর অবিশ্বাস, সন্দেহ আর ঘৃণার দৃষ্টি তো আছেই। ২০০৩ এর ফেব্রুয়ারিতে গিয়েছিলাম টুইন-টাওয়ারের গ্রাউন্ড জিরোতে। কিছু ধর্মান্ধ জঙ্গীর কৃতকর্মের চিহ্ন রয়েছে সেখানে। আর আছে তিন সহস্র পরিবারের কান্না। 

যুগে যুগে এরকমই ঘটে আসছে। গুটিকয় খারাপ মানুষের কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হয় সবাইকে। 

No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts