#স্বপ্নলোকের_চাবি_৪৪
ট্রেন থেকে নামার পর সবকিছু কেমন যেন অচেনা লাগছে। প্লাটফরমে
ঘাস গজিয়ে গেছে। কাদায় থিক থিক করছে পুরো প্লাটফরম। প্লাটফরমের ছাদের বেশিরভাগ টিনই
ঘূর্ণিঝড়ে উড়ে গেছে। ট্রেন থামতে না থামতেই এক-ট্রেন চঞ্চল শিক্ষার্থী হুড়মুড় করে নেমে
পড়েছে প্লাটফরমের কাদায়।
মাঝখানের খোলা সিঁড়ি দিয়ে উপরে রাস্তায় উঠে এলাম। সবকিছু
কেমন যেন ফাঁকা-ফাঁকা হয়ে গেছে এদিকে। রাস্তার পাশের বড় বড় গাছগুলির যেকটা এখনো দাঁড়িয়ে
আছে তাদের বিধ্বস্ত চেহারা। ছোট ছোট দোকানপাট যেগুলি ছিল – সেগুলির কোনটাই এখনো খোলার
মতো অবস্থায় নেই। দীর্ঘ পাঁচ মাস ইউনিভার্সিটি বন্ধ। তাতে তাদের ব্যবসার এমনিতেই বারোটা
বেজে গিয়েছিল। তার উপর ঘূর্ণিঝড় একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছে তাদের।
রেলগেইট রাস্তা বরাবর বন্ধ। পাশের ছোট গেট দিয়ে হেঁটে হেঁটে
ঢুকতে হলো। বিবর্ণ খাকি ড্রেস পরা কয়েকজন প্রহরী
গেটের কাছে ছোট্ট ঘরে বসে-দাঁড়িয়ে গল্প করছে। সেই ঘরের পেছনে রেলস্টেশনের মূল ভবন
– যা এখন পুলিশের দখলে। এখানে পুলিশফাঁড়ি বসানো হয়েছে সেই ১৯৮৬ সালে – শিবিরের উত্থানের
পর পর। তারপর পাঁচ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় পুলিশ পুষছে। কিন্তু তাতে আমাদের কী লাভ হচ্ছে
জানি না। গত ডিসেম্বরে ছাত্রশিবিরের গুন্ডারা আমাদের শিক্ষকদের ধরে পিটিয়েছে এখানে
এই রাস্তায় - পুলিশ-ফাঁড়ি থেকে যার দূরত্ব পঞ্চাশ ফুটও হবে না। শিবিরের গুলিতে মরেছে
আমাদের সতীর্থ ফারুকুজ্জামান। মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে অনেকে – যাদের মধ্যে আমাদের বন্ধু
শরীফও আছে। তখন ফাঁড়ির পুলিশ কী করছিলো কেউ জানে না।
স্টেশনের কাছের কটেজগুলির মেরামতকাজ চলছে। যারা হলে থাকার
সুযোগ পায় না, তাদের অনেকেই এসব কটেজে থাকে। এই কটেজগুলি ব্যক্তি-মালিকানাধীন। বিশ্ববিদ্যালয়
কর্তৃপক্ষের সাথে তাদের কীরকম চুক্তি থাকে জানি না। কটেজের নামগুলি বেশ অর্থবহ। শাহজালাল
হলের সামনে আছে ‘হোয়াইট হাইজ’ আর ‘ক্রেমলিন’। শনের ছাউনি বেড়ার ঘর ‘ক্রেমলিন’ এখন ঝড়ে
বিধ্বস্ত হয়ে মাটিতে শুয়ে আছে।
হলের সামনের রেস্টুরেন্টগুলির কিছু কিছু খুলেছে। সোহরাওয়ার্দীর
সামনের রাস্তায় বিশাল শিরিষগাছের মোটা ডাল ভেঙে পড়ে আছে রাস্তার উপর। কিছুটা কেটে সরানো
হয়েছে। বাস চলছে তার পাশ দিয়ে। ক্যাম্পাসেও অনেক গাছ উপড়ে পড়ে আছে, যেগুলি দাঁড়িয়ে
আছে সেগুলিও প্রায়-ন্যাড়া।
“কী রে দোস্ত, বেঁচে আছিস?” - চাকসু ক্যাফেটোরিয়ার সামনে
বাস থেকে নামতেই জড়িয়ে ধরলো আহসান হাবীব দীপক। ঘূর্ণিঝড়ে ভোলা, হাত্যা, সন্দ্বীপ, বাঁশখালী
লন্ডভন্ড হয়ে যাবার খবরে সে উদ্বিগ্ন ছিল। যে লক্ষাধিক মানুষ মারা গেছে – তাদের মধ্যে
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীও আছে। দুর্যোগ যাদের উপর দিয়ে যায় – শুধু তারাই
জানে কতটা যায়।
দীর্ঘদিন পর ক্লাস শুরু হলে যা হয়। সবকিছুই কেমন যেন নতুন
নতুন লাগছে। লাস্ট ক্লাস হয়েছিল গতবছর ডিসেম্বরে মাত্র কয়েকদিন। এই পাঁচ মাসে ভুলেই
গিয়েছি কী পড়ানো হয়েছিল। কী কারণে বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে এতদিন লাগলো আমরা কেউ জানি না।
স্যার-ম্যাডামরা এমন ভাব করছেন যেন কিছুই হয়নি। শিক্ষাবর্ষ থেকে এত এত দিন, মাস, বছর
যে নিষ্ফলভাবে কেটে যায় – তাতে কি শিক্ষকদের কিছুই যায় আসে না? কিছুই করার থাকে না?
বিশ্ববিদ্যালয় তো স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। স্বায়ত্বশাসনের অর্থ কী?
“তোমাদের ক্লাস হলো কি হলো না, তোমরা কিছু শিখলে কি শিখলে
না তাতে কারোরই কিছু যায় আসে না। বছরের পর বছর ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকলেও শিক্ষকদের
কোন অসুবিধা হয় না। আমরা আমাদের বেতন পাই। প্রতি বছর আমাদের বেতন বাড়তে থাকে। প্রমোশনও
আটকে থাকে না।“ – এরকম তিক্ত স্বীকারোক্তি প্রামাণিকস্যার ছাড়া আর কেউই করেননি কখনও।
আজও কোয়ান্টাম মেকানিক্স ক্লাসের শুরুতে তিনি তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করলেন – কেন এতদিন
ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকলো, কেন একটা রাজনৈতিক দলের হাতে বিশ্ববিদ্যালয় জিম্মি হয়ে থাকবে,
কেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-সমিতির কোন ক্ষমতা নেই? কেন নির্বাচিত চাকসু নেতারা পদ পাওয়ার
পরপরই নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলো?
এসব আমাদের অনেকেরই মনের কথা, জানা কথা। কিন্তু আমরা এটাও
জানি যে যারা সোজাসাপ্টা ন্যায্য কথা বলেন তাদের হাতে তেমন কোন ক্ষমতা থাকে না, আর
যাদের হাতে ক্ষমতা থাকে – তারা এসব সত্যবাদীদের পছন্দ করেন না।
প্রামাণিকস্যারের ক্লাসের পর সোবহানস্যারের ক্লাস। তিনি ইলেকট্রনিক্স
পড়াচ্ছেন। মাস্টার্সে ইলেকট্রনিক্স কী কারণে আবশ্যিক বিষয় করা হয়েছে আমি জানি না। সাবজেক্টের
নাম ইলেকট্রনিক্স ও নিউক্লিয়ার ইন্সট্রুমেন্টেশান হলেও তার সিলেবাসে নিউক্লিয়ার ইন্সট্রুমেন্ট
কিছুই নেই। সাবজেক্ট ম্যাটেরিয়েলগুলি – যেমন মাইক্রোওয়েভ, স্যাটেলাইট কমিউনিকেশান,
টেলিভিশন, র্যাডার, সেমিকন্ডাক্টর ইত্যাদি খুবই ইন্টারেস্টিং হতে পারতো। কিন্তু টিচারের
কারণেই সাবজেক্টের প্রতি আগ্রহ হারায় শিক্ষার্থীরা। এখানেও তাই হলো। বিষয়বস্তু শেখার
চেয়েও পরীক্ষায় পাস করাটাই মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে উঠলো।
আমাদের ক্লাসরুমে এখন জায়গার সংকট দেখা দিয়েছে। এক বেঞ্চে
পাঁচ-ছয়জন বসতে হচ্ছে। এতে আমাদের সহপাঠীদের কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে এমন কিছু মন্তব্য
করছে যা সহ্য করা যায় না। ক্লাসের পর বারান্দায় বের হয়ে একজন বললো, “পিলু আর কলুদের
জ্বালায় তো ক্লাসে বসা যাচ্ছে না।”
পিলু আর কলু শব্দ দুটো ইউনিভার্সিটির মাস্টার্স ক্লাসে খুব
প্রচলিত। দুটোই তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত আপত্তিকর শব্দ। প্রিলিমিনারি পাস করে যারা মাস্টার্সে
ভর্তি হয়েছে তাদেরকে পিলু, আর যারা কলেজ থেকে অনার্স পাস করে এসেছে তাদেরকে বলা হয়
কলু। যারা ইউনিভার্সিটিতে অনার্স পড়ে মাস্টার্সে এসেছে তারাই এই শব্দদুটো তৈরি করেছে।
ভালো কিছুর উত্তরাধিকার আমরা ধরে রাখতে না পারলেও খারাপ সবকিছু সযতনে বাড়িয়ে চলি। আমার
যে সহপাঠী এই শব্দদুটো ব্যবহার করে নিজেকে কিছুটা উন্নত প্রজাতির বলে মনে করছে তার
কোন ধারণাই নেই যে কতটা অন্তসারশূন্য এসব তুলনা।
আমাদের সাথে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ, সিলেট এমসি কলেজ,
আর চট্টগ্রাম কলেজ থেকে যারা অনার্স পাস করেছে তারা সবাই মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে এখানে।
শফিক, দিলারা, ঝিনুক, নাজমুল, খায়ের, অসীম, উৎপল, শাহেদা, বিউটি, বাসনা, অশোক, রাহুল
– অনেক নতুন বন্ধু হয়েছে আমাদের। মাস্টার্সে এতজন নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হয় প্রতিবছর,
সেজন্য আরো বড় ক্লাসরুমের দরকার - এই ব্যাপারে জোর না দিয়ে – আমাদের অনেকের মধ্যে এই
ধারণা জন্মেছে যেন এরা এসেছে বলেই আমাদের বসার জায়গার অভাব হচ্ছে। আমাদের চিন্তাভাবনার
সংকীর্ণতা থেকে আমরা বের হতে পারছি না কেন জানি না।
ভেবেছিলাম ইউনিভার্সিটি এবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে আস্তে আস্তে।
নির্বাচনের আগে স্বপ্ন দেখেছিলাম – নির্বাচনের পর নতুন সরকার এলে ছাত্রশিবিরের হাত
থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মুক্ত হবে। সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে। জামায়াত-শিবির এখন সরকারেরই অংশ।
তবুও যদি কোনরকমে ভালোয় ভালোয় পাস করে বের হয়ে যেতে পারি। ইতোমধ্যেই অনার্সের তিন বছরের
জায়গায় পাঁচ বছর চলে গেছে। মাস্টার্সের এক বছর চলে যাচ্ছে কোন কিছু ছাড়াই। এখন যেভাবে
চলছে সেভাবে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চললেও হবে।
কিন্তু না, হলো না। পনের দিনের মধ্যেই ছাত্রশিবির আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের
সবগুলি গেটে তালা লাগিয়ে দিলো। জুনের ২ তারিখ থেকে লাগাতার অবরোধ। তাদের দাবিদাওয়া
কী, কার বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ কিছুই বোঝার উপায় নেই। হতে পারে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে
তাদের নেতার মার খাওয়ার শোধ আমাদের উপর নিচ্ছে। ক’দিন আগে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এক বৈঠকে
যোগ দিতে গিয়েছিলেন জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী। ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা পিটিয়ে
রক্তাক্ত করেছে নিজামীকে। ওসব কেবল ঢাকা ইউনিভার্সিটিতেই সম্ভব।
আমাদের ক্যাম্পাসে, হলগুলিতে নির্বাচিত চাকসু প্রতিনিধি থাকলেও
তারা একদিনও কোন কাজ করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। তেজস্ক্রিয় পদার্থ যেমন নিজের শক্তি
বিকীর্ণ করতে করতে ভেঙে যায় – সেরকম আমাদের দেশের নেতারাও এত বেশি তেজস্ক্রিয় যে বেশিদিন
ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে না। চাকসু নির্বাচনের আগে যে ছাত্রঐক্য হয়েছিল – সেই ঐক্য ভেঙে
গেছে অনেকদিন আগে। চাকসুর নেতাদের কাউকে এখন দুরবিন দিয়েও দেখা যায় না ক্যাম্পাসে।
ছাত্রশিবিরকে যদি এতই ভয় – তাহলে পদত্যাগ করলেই তো হয়। পদ-পদবি নিয়ে পদাবলি গাইবে,
কিন্তু বিপদ দেখলে পালাবে – এই হলো আমাদের নির্বাচিত নেতা!
কেমন যেন হতাশ লাগছে সবকিছু। আমার বন্ধুদের অনেকেই বিভিন্ন
জায়গায় চাকরির দরখাস্ত করতে শুরু করেছে। আমি কী করবো এখনো জানি না। অনার্স পাস করেছি,
বিসিএস পরীক্ষা দেয়া যায়। কিন্তু প্রশাসনিক কাজের প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই। শিক্ষকতা
কিংবা কারিগরি যেসব পদ আছে – সেগুলিতে মাস্টার্স লাগবে। যীশুরা কম্পিউটার প্রোগ্রামিং
শিখছে। আমাদের বন্ধু দেবাশিস, মহিউদ্দিন এরা কম্পিউটার শেখানোর স্কুল খুলে ফেলেছে আগ্রাবাদে।
অনেকেই অনেক কিছু করে ফেলছে – আর আমি আক্ষরিক অর্থেই রাস্তায় রাস্তায় হাঁটছি।
মাঝে মাঝে শিল্পকলা একাডেমিতে যাই। নাটকের গ্রুপেও অনিয়মিত
হয়ে গিয়েছি। এখন সেখানে গেলে নিজেকে কেমন যেন অতিথি অতিথি মনে হয়। মাঝে মাঝে পাবলিক
লাইব্রেরিতে যাই। পাশে মুসলিম হলে মহিউদ্দিন চৌধুরির নেতৃত্বে বন্যার্তদের সাহাযার্থে
ত্রাণশিবির খোলা হয়েছে। ওখানে গিয়ে কিছুটা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে আসি।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার সমাধানে কারোরই কোন মাথাব্যথা
আছে বলে মনে হয় না। ডিসেম্বরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যস্ত ছিল নির্বাচন নিয়ে। তারপর
নতুন সরকার ব্যস্ত থাকলো সরকার গঠন নিয়ে। এখন ব্যস্ত সরকার-পদ্ধতি ঠিক করা নিয়ে। বর্তমান
রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে যেতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।
সে ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই সংসদের প্রথম অধিবেশন শেষ হয়ে গেছে। এখন তোড়জোড় চলছে
সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে আসা নিয়ে। রাষ্ট্রের এত বড় বড় সমস্যার সমাধান হচ্ছে যেখানে –
সেখানে আমাদের ইউনিভার্সিটি খোলা থাকলো কি বন্ধ থাকলো তাতে কারো কিছু যায় আসে না। প্রামাণিকস্যার
ঠিকই বলেন – আমরা শিক্ষিত হলে সরকারের কোন লাভ নেই।
চট্টগ্রামের আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা একটা বিকল্প সিদ্ধান্ত
দিয়েছেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে। তেমন কোনও কার্যকরী সিদ্ধান্ত নয়, প্রতিবাদী
সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৫ জুন থেকে এমইএস কলেজে শুরু হলো ইউনিভার্সিটির ক্লাস।
এমইএস কলেজ সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি এতদিন। এই কলেজ নাকি
ছাত্রলীগের দুর্জয় ঘাঁটি। দুর্জয় শব্দের মধ্যে একটা যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব আছে। এই কলেজ সম্পর্কে
যা শুনেছি তার সবগুলিই যুদ্ধং দেহি মারপিটের কাহিনি।
প্রচন্ড বৃষ্টি উপেক্ষা করে সকালবেলা কলেজে এলাম। শহরে যারা
থাকে তাদের অনেকেই এসেছে। যারা এসেছে সবাই জামায়াত-শিবিরবিরোধী তা বলা যাচ্ছে না। ছাত্রদের
মধ্যে কয়েকজনের দেখা পেলাম – যারা আমার জানামতে শিবিরের নিরব সমর্থক। তাতে অবশ্য আমার
কিছু যায় আসে না। ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করলে স্বাধীনতাবিরোধীদের স্বাধীনতায়ও বিশ্বাস
করতে হয়। তারা এসেছে ইনফরমার হিসেবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমার অভিজ্ঞতায় এপর্যন্ত
ছাত্রলীগ আর ছাত্রশিবিরের প্রধান পার্থক্য হলো – ছাত্রলীগ প্রচুর গর্জন করে, বর্ষণ
করে অতি সামান্য; কিন্তু ছাত্রশিবির বিনাগর্জনেই কাজ সেরে ফেলে।
আমাদের ক্লাসের অনেকেই এসেছে। হল থেকেও এসেছে কেউ কেউ। জামায়াত-শিবির-বিএনপি
সমর্থন করেন না এমন অনেক শিক্ষক আছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে – যাঁরা শহরে থাকেন।
তাঁদের অনেকেই এলেন এমইএস কলেজে ক্লাস নিতে। আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে ক্যাম্পাস
থেকে পাবলিক বাসে চড়ে এখানে ক্লাস নিতে চলে এসেছেন প্রামাণিকস্যার। এই মানুষটার কি
ভয়-ডর কিছুই নেই?
প্রামাণিকস্যার আমাদের ক্লাস নিলেন। সম্পূর্ণ-সিলেবাসবহির্ভূত
ক্লাস, মুক্তচিন্তার ক্লাস। মুক্তচিন্তা ধর্মচিন্তার পরিপন্থি। ক্লাসে বিতর্ক শুরু
হয়ে গেল। ফারুক ডাক্তার মরিস বুকাইলির বই থেকে ধর্ম ও বিজ্ঞান সম্পর্কে যা যা যুক্তি
শিখেছে সব প্রয়োগ করে প্রামাণিকস্যারকে ঘায়েল করার চেষ্টা করলো, কিন্তু তেমন সুবিধা
করতে পারলো না। আমি প্রামাণিকস্যারের ধৈর্য দেখে অবাক হয়ে গেলাম। পান্ডিত্য যে মানুষকে
বিনীত করে, পরমতসহিষ্ণু করে তা প্রামাণিকস্যারকে এভাবে না দেখলে বুঝতে পারতাম না।
প্রামাণিকস্যার দ্বিতীয় দিন থেকে সিলেবাসের কোয়ান্টাম মেকানিক্স
পড়িয়েছেন। অনেককিছুই পড়িয়েছেন। যাক কিছুটা লাভ তো হলো। এমইএস কলেজের শিক্ষার্থীদের
লেখাপড়া বন্ধ রেখে আমাদের জন্য এতগুলি রুম ছেড়ে দেয়া তো দীর্ঘদিন সম্ভব নয়। তাই পরপর
চার দিন প্রতিবাদী ক্লাসের পর ক্লাস বন্ধ হয়ে গেল।
কোরবানের পর জুলাই মাসের শুরুতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিশাসিত
সরকার থেকে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় ফিরে আসার ব্যাপারে বিএনপি সম্মত হলো। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে শিবিরের অবরোধমুক্ত
করার ব্যাপারে কিছুই করা হলো না। ১৫ জুলাই চট্টগ্রামে হরতাল পালন করা হলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে
শিবিরের হাত থেকে রক্ষা করার দাবিতে। এরশাদের পদত্যাগের পর এই প্রথম হরতাল হলো দেশে।
তাতে কাজ হলো। ছাত্রশিবির কেন্দ্রীয় নির্দেশে তাদের অবরোধ তুলে নিলো। কিন্তু ক’দিন
পরেই যে আবার সবকিছু বন্ধ করে দেবে না তার কোন গ্যারান্টি নেই।
আমাদের ক্লাসের শুরুতেই ক্লাসের ভেতর গন্ডগোল লেগে গেল। শিবিরের প্ররোচনায় ক্লাসের কেউ কেউ দাবি করছে - এমইএস কলেজে প্রামাণিকস্যার কোয়ান্টাম মেকানিক্স যা পড়িয়েছেন তা অবৈধ। আমি বোকার মতো প্রশ্ন করলাম - কোয়ান্টাম মেকানিক্স কীভাবে অবৈধ হয়?
একজন খুব ঠান্ডাভাবে উত্তর দিলো, 'কীভাবে হয় সময়মতো বুঝবা।'
মনে হলো সে আমাকে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিলো।
No comments:
Post a Comment