Saturday 6 November 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৪৫

 



#স্বপ্নলোকের_চাবি_৪৫

বেশ জোরেসোরে চলছে আমাদের ক্লাস। থিওরি ক্লাস কোনটাই মিস দিচ্ছি না। থিসিস করবো – তাই প্র্যাকটিক্যাল করছি না। থিওরি ক্লাসে মনযোগ দেয়ার চেষ্টা করছি, বুঝতে চেষ্টা করছি – পদার্থবিজ্ঞানের সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলি কীভাবে ঘটে। ব্ল্যাকবোর্ডে যেসব জটিল সমীকরণ স্যাররা লিখছেন তা কোত্থেকে আসছে, কীভাবে ঘটছে। কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারছি না। আমার অবস্থা হয়েছে সেই নাপিতের মতো – যে অ্যানাটমি-ফিজিওলজি সম্পর্কে কিছু না জেনেই বড় বড় ফোঁড়া কেটে ফেলতে পারতো। কিন্তু যখন তাকে শরীরের কলকব্জার জটিলতা সম্পর্কে কিছু ধারণা দেয়া হলো – সে আর চোখ বন্ধ করে ফোঁড়া কাটতে পারে না, ভয় পায় পাছে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কেটে ফেলে। অনার্সে খুবই সাজেস্টিভ পড়াশোনা করে মাস্টার্সে উঠে গেছি। এখন কেমন যেন একটা দায়িত্ববোধ ঘাড়ে এসে পড়েছে। আগের মতো কেয়ারফ্রি হতে পারছি না। এখন কোনোকিছু না বুঝলে সামনের দিকে এগোতেও পারছি না। কেমন যেন একটা চাপা অস্বস্তি হচ্ছে ভেতরে ভেতরে। 

কেউ কেউ বলে থাকেন – বার বার পড়লে দুর্বোধ্য জিনিসও সহজ হয়ে যায়। কিন্তু সেই ব্যাপারটা এখানে খাটছে না। চায়নিজ ভাষার কিছুই না জেনে একটা চীনা গান বার বার শুনলে হয়তো গানটি মুখস্থ হয়ে যাবে – কিন্তু মূল ভাবটি অবোধ্যই থেকে যাবে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরো সত্য। এই যে প্রামাণিকস্যার ক্লাসের ব্ল্যাকবোর্ডে ‘ম্যাট্রিক্স ফর্মুলেশন অব কোয়ান্টাম মেকানিক্স’ চ্যাপ্টারের সমীকরণগুলি একটার পর একটা দ্বিতীয়বারের মতো লিখছেন – কিছুই তো ঢুকছে না মাথায়। এই চ্যাপ্টারটা প্রামাণিকস্যার এমইএস কলেজে যে ক’দিন ক্লাস নিয়েছিলেন – সেখানে পড়িয়েছিলেন। এখন ছাত্রদের দাবি মেনে নিয়ে আবার পড়াচ্ছেন। সমীকরণগুলি আগের ক্লাসনোটের সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে – তাই আবার লিখছি না। কেবল আগের লেখার সাথে মিলিয়ে নিচ্ছি। স্যার এই ব্যাপারটা কীভাবে করছেন জানি না। মনে হচ্ছে রেকর্ডের মতো হুবহু আগের ক্লাসই হচ্ছে। ঠিক আগের মতোই ব্যাখ্যা, আগের মতোই দুর্বোধ্য। 

জ্ঞানার্জনের প্রধান উপায় নাকি প্রশ্ন করা। প্রামাণিকস্যারই অনেকবার বলেছেন – প্রশ্ন না করলে জানতে পারবে না। যেখানে প্রশ্ন করা নিষেধ, সেখানে জ্ঞানার্জনের পথ বন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয় হলো প্রশ্ন করার জায়গা। কিন্তু প্রধান সমস্যা হলো – প্রশ্ন করার জন্য যেটুকু সাহস দরকার – সেটুকু তো নেই। কারণ সেই সাহসটা আমাদের ভেতর জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব তো আমাদের শিক্ষকদের। প্রামাণিকস্যার আমাদের প্রশ্ন করতে বলেন – সেটা ঠিক আছে। কিন্তু সাথে সাথে এটাও বলেন যে – প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার দায়িত্বও তোমার। যেমন এই মুহূর্তে আমার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে – স্টেট ভেক্টর আসলে কী? কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একেবারে মৌলিক জিনিস। কিন্তু এই মৌলিক জিনিসটাই তো বুঝি না। 

স্যার এই চ্যাপ্টারটা পড়াচ্ছেন শিফ্‌ এর বই থেকে। অঞ্জনের সাথে শিফ্‌ নামটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো ক’দিন আগে। আমি বলছিলাম Schiff এর উচ্চারণ হওয়া উচিত স্কিফ। কিন্তু অঞ্জন বললো – না, ওটা হবে শিফ্‌। অঞ্জন কোন কিছু না জেনে কথা বলার মানুষ নয়। এল আই শিফ্‌ এর কোয়ান্টাম মেকানিক্স বইটা যে প্রথম ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, তাঁর পুরো নাম যে লিওনার্ড শিফ্‌ এসব জেনেছি অঞ্জনের কাছে। এজাতীয় অপ্রয়োজনীয় তথ্যগুলি খুব সহজেই বুঝতে পারি, মনেও থাকে – অথচ দরকারি মূল ব্যাপারগুলি মাথায় ঢোকে না। 

প্রামাণিকস্যার বোর্ডে সমীকরণের পর সমীকরণ লিখে যাচ্ছেন, ক্লাসের প্রায় সবাই তা হুবহু খাতায় তুলে নিচ্ছে। আমি এমইএস কলেজের ক্লাসে লিখেছিলাম – তাই এখন আর লিখছি না। মনে প্রশ্ন জাগছে যে সমীকরণগুলি বইতে ছাপানো আছে – সেগুলি না বুঝে এভাবে দেখে দেখে লেখার উপকারিতা কী? বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসগুলি কি অন্যরকম হতে পারতো না? পদার্থবিজ্ঞানের ভাষা হচ্ছে এই সমীকরণগুলি। বিষয়বস্তু ঠিকমতো বুঝতে পারলে এই সমীকরণগুলি তো আমরা নিজেরাই তৈরি করতে পারতাম। 

“স্যার – “ হঠাৎ চমকে উঠলাম। এতক্ষণ ধরে ব্ল্যাকবোর্ডের সাথে চকের মিথস্ক্রিয়ার শব্দ ছাড়া অন্য কোন শব্দ ছিল না। তাই হঠাৎ সবাই সচকিত হয়ে তাকালো প্রশ্নকর্তার দিকে। স্যারও লেখা থামিয়ে ফিরে তাকালেন। ফার্স্টবেঞ্চ থেকে হাত তুলে দাঁড়িয়েছে নাজমুল। 

“স্যার, আমার একটা প্রশ্ন ছিল।“ – নাজমুলের গলার স্বর কিছুটা উচ্চ-কম্পাঙ্কের। হঠাৎ শুনলে মেয়েদের গলা বলে মনে হয়। সিলেটের এমসি কলেজ থেকে আসা নাজমুল প্রশ্ন করতে ভয় পায় না, কোন জড়তাও নেই তার। 

“বলো, কী প্রশ্ন তোমার।“ – প্রামাণিকস্যার নাজমুলকে প্রশ্ন করার সুযোগ দেন।

“স্যার, এই ইকুয়েশনগুলি সব উল্টো করে লিখলে কী হবে?”

“মানে কী? উল্টো করে লিখবে কেন?”

“না স্যার, মানে এই ইকুয়েশনগুলির স্পেস ইনভারশান ও টাইম-রিভার্সাল কী হবে? ইনভারশান ও রিভার্সাল তো স্যার উল্টো…”

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি নাজমুলের দিকে। এই ব্যাটা তো ঘাগু পাবলিক। কোয়ান্টাম মেকানিক্স গুলে খেয়ে ক্লাসে এসেছে মনে হচ্ছে। স্পেস ইনভারশান ও টাইম-রিভার্সাল যে উল্টো – সেই ব্যাপারটাই তো মাথায় আসেনি এতদিন। 

প্রামাণিকস্যারের কপালে কয়েকটা ভাঁজ দেখা গেলো। তিনি চিন্তা করছেন নাজমুলের প্রশ্নের কী উত্তর দেবেন। 

“খুব ভালো প্রশ্ন করেছো তুমি। এই ব্যাপারগুলি আমরা সিমেট্রি চ্যাপ্টারে আলোচনা করবো। এর মধ্যে তুমি ইকোয়েশানগুলিকে রিভার্স করে লিখে দেখো কী দাঁড়ায়।“

“ঠিক আছে স্যার।“ – নাজমুল খুশি হয়ে বসে পড়লো। দূর থেকে দেখলাম সে খসখস করে সমীকরণ উল্টাতে শুরু করেছে। প্রামাণিকস্যার ক্লাস থেকে বের হবার পর আমরা সবাই অভ্যাসমতো ডানদিকের করিডোরে কিংবা বাম দিকের বেলকনিতে বের হয়ে গেলাম। কিন্তু নাজমুল ধ্যানমগ্ন সন্নাসীর মতো সমীকরণ লিখছে। 

করিডোরের রেলিং-এর দেয়ালে বসে ঝিনুককে জিজ্ঞেস করলাম নাজমুলের ব্যাপারে। ঝিনুক নাজমুলকে খুব ভালো করে চেনে। জানা গেলো নাজমুল খুবই জ্ঞান-পিপাসু মানুষ। বই থেকে লব্ধ জ্ঞান বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগ করে দেখে ঠিকমতো কাজ করছে কি না। এসব করতে গিয়ে মাঝে মাঝে ঝামেলাও লাগে। নাজমুলের ভাইয়ের মেয়ের চোখে কিছু একটা সমস্যা দেখা দিলে নাজমুল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার বদলে নিজেই তার চশমার ব্যবস্থা করে। লেন্স যেহেতু পদার্থবিজ্ঞানের বিষয় – সেহেতু সে নিজে নিজে অনেক ডাক্তারি করে তার ভাইয়ের মেয়েকে গিনিপিগ বানিয়ে। তাতে মেয়েটা প্রায় অন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল। 

এখানে ক্যাম্পাসে এসেও সে অনেক কাজ করে ফেলেছে। জামাল নজরুল ইসলামস্যারের সাথে দেখা করে মহাবিশ্বের সব সমীকরণকে উল্টা করে লিখলে মহাবিশ্ব প্রসারিত হবার বদলে সংকুচিত হতে শুরু করবে কি না – এ বিষয়ে অনেকক্ষণ তর্ক করেছে। জামালস্যার তার অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। 

ঝিনুকের কথায় মনে হচ্ছে নাজমুলকে যারা অনেকদিন থেকে চেনে তারা নাজমুলের মেধায় অবাক হবার চেয়ে নাজমুলের ক্ষ্যাপামিতে মজা পায়।

পরদিন সকালে ক্লাসে ঢুকতেই দেখি নাজমুল বসে আছে ফার্স্ট বেঞ্চে। সে প্রতিদিনই ফার্স্টবেঞ্চের কোণায় বসে। এজন্য সে অনেক আগে আসে ক্লাসে। কিন্তু সে অনেক পরে এলেও ফার্স্টবেঞ্চে বসতে কোন অসুবিধা হতো না। কারণ ফার্স্টবেঞ্চে আমরা কেউই বসতে চাই না। 

“প্রদীপ, তুমি একটু দাঁড়াও। তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।“ – নাজমুলের কথাবার্তা খুবই ফর্মাল। 

“বলো।“

“তুমি কি এই ইকুয়েশানটা ঠিক আছে কি না বলতে পারবে? টাইম ডেরিভেটিভ নেগেটিভ হলে ইনভ্যারিয়েন্ট হবে কি?”

আমার তো মাথা ঘুরে যাবার অবস্থা। তার খাতাভর্তি সমীকরণ। সে যে সমীকরণের কথা বলছে তার মাথামুন্ডু কিছুই আমার জানা নেই। 

“ভাইরে, আমি তো এগুলি কিছুই বুঝতে পারছি না।“

“কিছুই হয়নি বলছো?”

“না না তা বলছি না। আমি এই সমীকরণগুলির মেকানিজমই বুঝতে পারছি না। আমি এগুলি সত্যিই বুঝি না।“

“আমি শুনেছি তুমি ফার্স্ট হয়েছো? এগুলি না বুঝেই ফার্স্ট হয়েছো?”

এরকম সত্যিকথন সহ্য করা কঠিন। আমার ভীষণ লজ্জা লাগছিল। ধরণী দ্বিধা হও – অবস্থা আমার। কিন্তু ধরণী দ্বিধা হতো সেই রামায়ণের যুগের সীতার কথায়। আজকাল ধরণী কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সমীকরণের কারণে দ্বিধা হয় না, দ্বিধাহীন ঘুরতে থাকে। 

সেকেন্ড পিরিয়ডে আদম শফিউল্লাহস্যারের ক্লাসে একটু অন্যরকম ঘটনা ঘটলো। আদম শফিউল্লাহস্যার রাফ অ্যান্ড টাফ মানুষ। বোর্ডে খুব বেশি লেখেন না। কম পড়ান, তবে যেটুকু পড়ান বোঝাতে চেষ্টা করেন। আমরা তাঁর ক্লাস পছন্দ করি, স্যারের স্টাইলের কারণে যতটা, তার চেয়েও বেশি হলো – স্যার ক্লাসে যা পড়ান, পরীক্ষাতে সেখান থেকেই প্রশ্ন করেন। সলিড স্টেট ফিজিক্সের ব্যান্ড থিওরি অব সলিড পড়াচ্ছেন। স্যার যখন বোঝান তখন মাঝখানে কেউ কথা বললে তাঁর কনসেন্ট্রেশান নষ্ট হয়ে যায়। তাই তিনি বলে দিয়েছেন তাঁর ক্লাসে ঢোকার সময় কাউকে কোন পারমিশান নিতে হবে না। কারণ ‘মে আই কাম ইন স্যার’ বললেও তাঁর পড়ানোয় বিঘ্ন ঘটে। তিনি সিগারেট টানতে টানতে খুব সিরিয়াসলি বোঝান যেটুকু বোঝান। 

নাজমুল হয়তো স্যারের এই ব্যাপারটা জানে না, কিংবা জানলেও তার জানার আকাঙ্খা চেপে রাখতে পারেনি। সলিডের ভেতর ইলেকট্রনের ত্রিমাত্রিক গতি বোঝাচ্ছিলেন আদম শফিউল্লাহস্যার। এমন সময় নাজমুল উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে বললো, ‘স্যার, আমার একটা প্রশ্ন আছে।“

আদম শফিউল্লাহস্যার হঠাৎ চমকে উঠে থেমে গেলেন। নাজমুলকে প্রশ্ন করার সুযোগ দিলেন – “বলো, তোমার কী প্রশ্ন?”

“স্যার, ইলেকট্রনগুলির মোশান যদি রিভার্স করে দেয়া হয় – কী হবে?”

“হোয়াট ডু ইউ মিন?”

“রিভার্স মানে ইলেকট্রনের গতিপথ উল্টা করে দিলে কী হবে স্যার?”

নাজমুলের সব প্রশ্নের ভেতর একটা মিল আছে। সে সবকিছুকে উল্টা করে দেখতে চায়। এর কোন মনস্তাত্ত্বিক কারণ হয়তো থাকতে পারে, কিন্তু আদম শফিউল্লাহস্যার সেসব মনস্তত্ত্বের দিকে গেলেন না। তিনি বললেন, “কোন গতিপথ উল্টোনোর দরকার নেই। ইলেকট্রনগুলিকে তাদের নিজেদের মতো কাজ করতে দাও। কী হয় দেখো।“

“না স্যার, উল্টালে কী হবে স্যার?”

“কিছুই হবে না। তুমি বস।“

“ইলেকট্রনের কী হবে স্যার?”

“ওহ্‌ ইউ শাট আপ।“ – গর্জে উঠলেন আদম শফিউল্লাহ স্যার। স্যারের এরকম গর্জন আমরা ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে একবার প্র্যাকটিক্যাল রুমে শুনেছিলাম। এতবছর পর আবার ক্লাসরুমে শুনলাম। কিন্তু স্যারের গর্জনেও নাজমুল বিচলিত হলো না। সে তার মেয়েলি কন্ঠে আবার জিজ্ঞেস করলো, “স্যার ইলেকট্রনের স্পিন যদি অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ হয়…”

“ড্যাম ইওর অ্যান্টিক্লক – ইউ গেট আউট অব মাই ক্লাস। আউট …”

নাজমুলকে স্যার ক্লাস থেকে বের করে দিলেন। ফার্স্ট বেঞ্চের কোণা থেকে দরজার দূরত্ব এক মিটারও হবে না। সেটুকু দূরত্ব পার হতে নাজমুলের অনেকক্ষণ সময় লাগলো। 

অপমান যে করে সে বোঝে না অপমানিতের কেমন লাগে। আদম শফিউল্লাহস্যার ভালো পড়ান সেটা ঠিক আছে। কিন্তু উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করলেই ক্লাস থেকে বের করে দিতে হবে একজন ছাত্রকে? আর নাজমুলের প্রশ্ন কি একেবারেই অবান্তর ছিল? অবান্তর হলে সেটা কেন অবান্তর তা বুঝিয়ে দিলেই হতো। এরপর ক্লাসে চুপ করে বসেছিলাম ঠিকই, কিন্তু মন বসেনি। 

নাজমুল এর পরের ক্লাসগুলিতেও আর আসেনি সেদিন। তার জন্য মনটা খুব খারাপ হয়ে ছিল সারাদিন। সে কোন্‌ হলে থাকে খুঁজে বের করে দেখা করতে যাবো ভেবেছিলাম, কিন্তু হয়নি। 

নাজমুলের সাথে দেখা হলো আরো কয়েকদিন পর। জাতীয় সংসদে সংবিধানের একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী বিল পাশ হয়েছে। একাদশ সংশোধনী অনুসারে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাংবিধানিক বৈধতা দেয়া হয়। আর দ্বাদশ সংশোধনী অনুসারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার থেকে সংসদীয় সরকারপদ্ধতিতে ফিরে আসে। এ উপলক্ষে একদিনের সরকারি ছুটিও ঘোষণা করা হয়। আমাদের ক্লাসে একটা গতি ফিরে এসেছিল। সেই গতি আবার বাধাপ্রাপ্ত হলো। 

ইতোমধ্যে ক্যাম্পাসে আবার উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর স্মরণে ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠান করার প্রস্তুতি নিয়েছিল ছাত্রলীগ। কিন্তু শিবির তা কিছুতেই হতে দেয়নি। ক্যাম্পাসেই ঢুকতে পারেনি ছাত্রলীগ। রাতে হলে গোলাগুলি হয়েছে। পরের দিন ছাত্রলীগ ফতেয়াবাদ স্টেশনে ট্রেন আটকে দিয়েছে। তাতে শিবিরের কোন ক্ষতি হয়নি, ক্ষতি যা হয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরই হয়েছে। আবার এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে অবরোধ পাল্টা-অবরোধ চললো। এসব কর্মকান্ডে নাজমুলের রিভার্সাল প্রশ্নগুলিকে খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। এক পক্ষ যা করছে অন্য পক্ষ তা করলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে? আসলে লাভ কি কারো হবে? উভয় ক্ষেত্রেই তো সাধারণ শিক্ষার্থীরাই ভুগবে। 

দশদিন পর আগস্টের শেষে আবার ক্লাস শুরু হলো। ট্রেন চালু হলো। একদিন শহর থেকে বিকেলের ট্রেনে ফিরছি – ট্রেনের কম্পার্টমেন্টেই দেখা হয়ে গেল নাজমুলের সাথে। দেখলাম একটা সিটে বসে মনযোগ দিয়ে একটা বই পড়ছে সে। তার সামনের সিটে গিয়ে বসলাম। 

“কী খবর নাজমুল, কেমন আছো তুমি? অনেকদিন তোমার সাথে দেখা হয়নি।“

“একটা বিশেষ বিষয়ে স্টাডি করছি।“

“কী বিষয়?”

“এই বিষয় – দেখো।“ – নাজমুল তার হাতের চটিবই তুলে দেখালো। 

হায় হায়, নাজমুল এরকম ট্রেনে বসে সবার সামনে নির্বিকারভাবে পর্নোগ্রাফি পড়ছে!”  

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts