Saturday 16 October 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৪২

 


#স্বপ্নলোকের_চাবি_৪২


“পলিটিক্স শব্দের অর্থ কী জানিস?” 

ডাক্তারদাদুর প্রশ্নে আমি একটু অবাক হলেও দ্রুত উত্তর দিলাম - “রাজনীতি।”

“সেটা তো লোকদেখানো। আসল অর্থ তো জানিস না। হাহাহা।“ হাসার সময় চোখদুটো ছোট হয়ে যায় ডাক্তারদাদুর। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাই তাঁর দিকে। তাঁর জন্য দোকান থেকে একখিলি পান নিয়ে আসা হয়েছে। তিনি যত্ন করে পান ভাঁজ করে মুখে দিয়ে চিবুচ্ছেন। 

ডাক্তার আওরঙ্গজেব – আমাদের ডাক্তারদাদু আমার বাবার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। প্রাইমারি স্কুলে আমার বাবা তাঁর সাথে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছিলেন। এরপর বাবার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আর তিনি এলএমএফ ডাক্তার হয়েছেন। ডাক্তার হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি তাঁর বাল্যবন্ধুকে ভুলে যাননি। সরকারি চাকরির সূত্রে এতদিন অন্য জায়গায় ছিলেন। অবসর নিয়ে এখন নিজের গ্রামে ফিরে এসেছেন। বাজারে চেম্বার খুলে বসেছেন। রোগী খুব একটা হয় না। তাই তিনি প্রায়ই আমার বাবার দোকানে চলে আসেন আড্ডা মারার জন্য। বাবার সাথে কীভাবে যেন তাঁর চাচা-ভাতিজা সম্পর্ক। সে হিসেবে আমরা তাঁর নাতি। আজও দুপুরবেলা বাবার সাথে গল্প করতে এসে আমাকে পেয়ে কথার ঝাঁপি খুলে বসেছেন।

ডাক্তারদাদুকে আমার খুব ভালো লাগে। আমার বাবা্র মুখে তাঁর এই বন্ধুটির গল্প শুনতে শুনতে আমরা বড় হয়েছি। ১৯৪৭-এর দাঙ্গার সময় তিনি নিজের মাথার টুপি খুলে আমার বাবার মাথায় পরিয়ে দিয়ে আমার বাবার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। 

“পলিটিক্স তো ইংরেজি শব্দ। পলি অর্থ কী? অনেক। আর টিক্‌স হলো এক ধরনের রক্তচোষা পরজীবী পোকা। এখন বুঝতে পারছিস পলিটিক্স মানে কী? পলিটিক্স হলো অনেকগুলি রক্তচোষা পরজীবী প্রাণী – যারা জনগণের রক্ত চুষে খেয়ে বেঁচে থাকে।“ 

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি এই মানুষটির দিকে। পলিটিক্সের এরকম অর্থ হতে পারে আমি কখনো ভাবিনি। কিন্তু এই অর্থ যে কতটা অর্থবহ তা আমাদের দেশের পলিটিক্স দেখলেই বোঝা যায়।  

“এখন তুই এই ইলেকশানে যাকেই ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসাবি – সে-ই তোর রক্ত খাবে।“ বলে ডাক্তারদাদু চলে গেলেন। আমি এখনো মানতে চাচ্ছি না যে আমরা যাকেই ভোট দেবো সে-ই জোঁক হয়ে রক্ত চুষবে। কিন্তু একেবারে উড়িয়েও দিতে পারছি না। 

নির্বাচনী তপশিল ঘোষণা করার পর ১৯৯১ সালের শুরুর দিন থেকেই দেশে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। অবশ্য হাওয়া না বলে ঘূর্ণিঝড় বলা উচিত। কারণ দেশের বিভিন্নস্থানে খুবই তীব্র এবং ভয়ানকভাবে এই নির্বাচনী প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। মানুষের মুখে মুখে এখন নির্বাচনের কথা। শেখ হাসিনা কী বললেন, খালেদা জিয়া কী বললেন এসব নিয়েই আলোচনা চলছে সব জায়গায়। শেখা হাসিনা বলেছেন নির্বাচনে জিততে পারলে তাঁরা বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাবেন। খালেদা জিয়া পরিষ্কার বলে দিয়েছেন বাহাত্তরের সংবিধানে তারা ফিরে যাবেন না। মজার ব্যাপার হলো বাহাত্তরের সংবিধানে কী ছিল – সে সম্পর্কে তো ভোটারদের কোন ধারণা নেই। ভোটারদের বোঝানো হচ্ছে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া মানে বাহাত্তর তিয়াত্তরে দেশের যে যুদ্ধবিধ্বস্ত ভয়ানক অবস্থা ছিল – সেই অবস্থায় ফিরে যাওয়া। 

প্রায় দু’মাস হয়ে গেল আমাদের ইউনিভার্সিটি বন্ধ। আমার ধারণা ছিল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ জামায়াত-শিবিরকে কড়া ধমক দিয়ে আমাদের ইউনিভার্সিটি খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু না, এখন দেশে নির্বাচন সম্পন্ন করাই প্রধান কাজ, অন্য সবকিছু গৌণ। তাই অপেক্ষা করছি ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনটা হয়ে যাবার। 

কিন্তু নির্বাচনে খুব ভালো কিছু হবে আশা করা যাচ্ছে না। এরশাদকে হঠানোর জন্য যে রাজনৈতিক দলগুলি একজোট হয়েছিল – তাদের মধ্যে যে প্রগতিশীল জোটের প্রতি সবচেয়ে বেশি আস্থা ছিল, দেখা যাচ্ছে নির্বাচনে প্রার্থী দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের ভেতরই সবচেয়ে বেশি হট্টগোল হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী সারাদেশে প্রার্থী দিয়েছে কোন ঝামেলা ছাড়াই।  যে জাতীয়পার্টিকে ক্ষমতা থেকে আন্দোলনের মাধ্যমে উৎখাত করা হয়েছে, তাদের নেতা এরশাদ জেলে থাকার পরেও তারা কোন রকমের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ছাড়াই প্রার্থী দিতে পেরেছে। বিএনপিতেও তেমন কোন ঝামেলা নেই। কিন্ত আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ যে দলগুলি ছিল তাদের আচরণ দেখে  মনে হচ্ছে সবাই এখনই ক্ষমতায় চলে গেছে। 

কেউ কেউ বলছে নির্বাচন হয়ে যাবার আগেই নাকি তারা কে কোন্‌ মন্ত্রী হবে তা নিয়ে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ যেখানে যেখানে যেখানে প্রার্থী দিয়েছে – সেখানে একই ধরনের আদর্শ নিয়ে বাকশালও প্রার্থী দিয়েছে, বামদলগুলিও প্রার্থী দিয়েছে। আওয়ামী লীগের ভোটগুলি যে সব ভাগ হয়ে যাবে তা আমরা যেখানে বুঝতে পারছি – নেতারা না বুঝতে পারার কথা নয়। কিন্তু তাঁদের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে জনগণ তাঁদেরকে ভোট দেয়ার জন্য তিন দিন আগে থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। 

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর বিশটি বছর চলে গেছে। এখন যারা নতুন ভোটার হয়েছে – সবারই জন্ম একাত্তরের পর এবং বেড়ে ওঠা মিলিটারিদের শাসনের ভেতর। এই নব্যভোটারদের জন্য কোন ধরনের আয়োজন নেই আওয়ামী লীগের মধ্যে। অথচ বিএনপির পক্ষে নতুন ভোটারদের দলে ভেড়ানোর কাজটি করছেন যায়যায়দিনের শফিক রেহমান এবং তাঁর অনুসারীরা। 

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা লেখা আছে – যা সহজে বোঝা যায় না। কিন্তু বিএনপির ইশতেহারে সরাসরি লেখা না থাকলেও তাদের নেতারা সরাসরি বলছেন আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে বাংলাদেশ ভারতের অংশ হয়ে যাবে। যে জনগণ যে ভাষা বোঝে তাদের সেই ভাষায় বোঝানোর দক্ষতা না থাকলে তো জননেতা হওয়া যায় না। কিন্তু জনগণের মনের ভাষা কী? চটকদার কথা, নাকি ওজনদার কথা? 

২৭ ফেব্রুয়ারি সংসদ নির্বাচন হয়ে গেল। অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন হলো। এরজন্য প্রেসিডেন্ট শাহাবুদ্দিন এবং তাঁর নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে অবশ্যই অভিনন্দন ও ধন্যবাদ। 

বিএনপি জামায়াতের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করলো। আমাদের ইউনিভার্সিটি শিবিরমুক্ত হবার আশা দুরাশা হয়ে গেলো। 

আওয়ামী লীগ দেশের মানুষের মন কিংবা নির্বাচনের কৌশল ঠিকমতো বুঝতে পারেনি। খালেদা জিয়া পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পাঁচটিতে জিতেছেন। এরশাদ কারাগারে থেকেও পাঁচটি আসনে জিতেছেন। কিন্তু শেখ হাসিনা তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র একটিতে জিতেছেন। পরাজিত হবার পরেই শুরু হয়ে গেলো দলের ভেতর দোষারোপের পালা। আওয়ামী লীগের নির্বাচনের মুখ্য সমন্বয়ক ডক্টর কামাল হোসেন দলের সভায় খোলাচিঠি লিখে জানালেন, ‘অতিবিশ্বাস, আত্মম্ভরিতা এবং কর্মবিমুখতা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের কারণ।‘

আমি খুব আশা করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জয় হবে। হয়নি। বিএনপি নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের দল বলে প্রচার করে থাকে। কিন্তু তাদের সাথে এখন জামায়াতের সংসদীয় সখ্য তৈরি হয়েছে। এখন কি তবে জামায়াতে ইসলামীও দু’দিন পর নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে প্রচার করতে শুরু করবে? 

বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার এক মাস পরেও আমাদের ইউনিভার্সিটি খোলার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। 

নির্বাচনের পর বাড়ি থেকে শহরে এলাম। বন্ধুদের কারো কারো সাথে দেখা হলো। যীশু আর প্রদীপ নাথ কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শিখছে। আমাদের বন্ধু দেবাশিস আর মহিউদ্দিন নিজেরাই কম্পিউটার সেন্টার খুলে বসেছে আগ্রাবাদে। তারা কথায় কথায় কম্পিউটারের জার্গন ব্যবহার করছে। র‍্যাম, রোম, সিপিইউ, ডস – কত নতুন নতুন শব্দ বলছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি তাদের দিকে, কিন্তু এই শব্দগুলির প্রতি, কিংবা কম্পিউটারের প্রতি আমার কোন আগ্রহ তৈরি হয় না। 

অবশেষে ঘোষণা এলো – এপ্রিলের চব্বিশ তারিখ ইউনিভার্সিটি খুলবে। ১৯৯০’র ফেব্রুয়ারিতে চাকসু নির্বাচনে ছাত্রঐক্য জেতার পর খুব খুশি হয়ে ভেবেছিলাম ক্যাম্পাসে মুক্ত-বাতাস বইবে। কিন্তু কিছুই হয়নি। দিনের পর দিন ক্যাম্পাস অবরুদ্ধ থেকেছে শিবিরের হাতে। এরপর এরশাদের পতনের পর ভেবেছিলাম এবার আসবে সেই মুক্তি। কিন্তু আরো রুদ্ধ হয়ে গেলো সব মুক্তির দ্বার। ডিসেম্বরের শেষে শিবিরের তান্ডবে ফারুকুজ্জামান ফারুক মারা গেলো। শরীফসহ আরো অনেকে আহত হয়ে কোন রকমে প্রাণে বেঁচেছে। শরীফ এখন কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠছে। 

সংসদ নির্বাচনের আগে আশা করেছিলাম নির্বাচনের পরে গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হলে ক্যাম্পাস শিবিরমুক্ত হবে। কিন্তু জামায়াত সরকারের অংশ হয়ে গেল। ছাত্রশিবির তো এখন সরকারি দল। তাদের দাপটের কাছে এবার আরো কেঁচো হয়ে থাকতে হবে সবাইকে। 

ইউনিভার্সিটিতে যাবার জন্য রেডি হবার পর জানতে পারলাম ইউনিভার্সিটি অনিবার্য কারণবশত আজ খুলছে না। আরো দশদিন পরে খুলবে। সুনির্দিষ্টভাবে কারণ জানতে না পারলেও কিছু কিছু খবর কানে আসছে। ছাত্রশিবির চাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার আগেই যেন ভিসি আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিনকে সরিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু সে ব্যাপারে সরকার এখনো কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। তাই খোলার আগেই ছাত্রশিবির ক্যাম্পাস অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। 

সিলেবাসের পড়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে সেই ডিসেম্বরের পর থেকে। ডিসেম্বরে  মাত্র এক সপ্তাহ ক্লাস করতে পেরেছিলাম। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের দুটো ক্লাস নিয়েছিলেন অরুণস্যার, আর ইলেকট্রনিক্সের ক্লাস নিয়েছিলেন সোবহানস্যার। নিউক্লিয়ার ফিজিক্স আর সলিড স্টেট ফিজিক্স কে পড়াবেন সেটাও জানি না এখনো। অথচ অনার্স পাস করেছি পাঁচ মাস হয়ে গেলো। 

এত দীর্ঘদিন ইউনিভার্সিটি বন্ধ হয়ে থাকবে জানলে আওরঙ্গজেব ডাক্তারদাদুর কম্পাউন্ডার হয়ে যাবার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যেতাম। তিনি বলেছিলেন এক মাসের মধ্যে আমাকে ডাক্তারি শিখিয়ে ফেলবেন। কিছুই করতে হবে না, তাঁর সহকারী হিসেবে কাজ করলে দেখতে দেখতে ডাক্তারি শিখে ফেলতে পারবো। বাহ্‌ কত সোজা! লোকে শুধু শুধু এত বছর ধরে এত মোটা মোটা বই পড়ে কয়েক হাজার ছোটবড় পরীক্ষা দিয়ে ডাক্তারি পাস করে। 

না, এখন তো আর সেদিকে যাওয়া যাবে না। অনার্স পাস করে ফেলেছি। এবার মাস্টার্সটা তো পাস করতে হবে। কিন্তু ইউনিভার্সিটিই তো খুলছে না। 

এসময় আমার রুমের দরজায় টোকা দিলো কেউ। দরজা খুলে দেখি একজন লিকলিকে চিকন একজন মানুষ। 

“আপনি প্রদীপ দেব?” – মানুষটির দাঁত অনেকটা খরগোসের মতো। 

“জ্বি।“

“রেডি হোন, রেডি হোন, চলেন আমার সাথে।“

“আপনার সাথে? কেন? কোথায়?”

“জানতে পারবেন, সব জানতে পারবেন, দেরি হয়ে যাচ্ছে, রিকশায় যেতে যেতে বলবো।“

“আপনি কে, কী বৃত্তান্ত না বললে আমি কেন যাবো আপনার সাথে?”

“হ্যাঁ, তাই তো। আপনাকে তো আমার পরিচয়ই দিইনি। রুমে ঢুকে বলি।“ 

রুমে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে বললেন, “আমার নাম নাছের। আমি ফতেয়াবাদ হাইস্কুলের টিচার। পলিটিক্যাল সায়েন্সের অনার্স মাস্টার্স। আপনার তো অনেক বই।“

“আমার কাছে কী দরকার?”

“ও হ্যাঁ, আমাকে পাঠিয়েছেন ফতেয়াবাদ স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব।“

“উনি আমাকে কীভাবে চেনেন?”

“আপনাকে চেনেন না। নাম শুনেছেন। ডেকেছেন আপনাকে মাস্টারি দেয়ার জন্য।“

আমার বেশ কৌতূহল হচ্ছে। লোকে কত চেষ্টা করে হাইস্কুলের মাস্টারির জন্য। আর আমাকে হেডমাস্টার মাস্টার পাঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন মাস্টারি দেয়ার জন্য! এরচেয়ে ভালো ব্যাপার আর কী হতে পারে! 

“আপনার অনার্সের সার্টিফিকেট তো দেয়নি মনে হয় এখনো। মার্কশিটটা সাথে নেন।“ 

আমি তো নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে চাকরি হয়ে যাচ্ছে। সার্টিফিকেট-মার্কশিটের ফাইলটা সাথে নিলাম। 

“পাসপোর্ট সাইজের ছবি তো নেই।“ 

“ছবি পরে দিলেও হবে।“

নাছেরসাহেব সাথে করে রিকশা নিয়ে এসেছিলেন। রিকশায় যেতে যেতে বললেন, “খানসাহেব আপনাকে কিছু বলেননি?”

“কী ব্যাপারে?”

“হেডমাস্টারের ব্যাপারে?”

“না তো।“

“কোন অসুবিধা নেই।“

ফতেয়াবাদ স্কুলের গেটের সামনে দিয়ে গত চার বছরে হাজারবার যাতায়াত করেছি। কিন্তু একবারও গেটের ভেতরে ঢুকিনি। আজ ঢুকলাম। বিশাল জায়গা ভেতরে। বিরাট পুকুরের পাড় দিয়ে হেঁটে অনেক দূর যাওয়ার পর হেডমাস্টারের কোয়ার্টার। সম্ভবত স্কুল ছুটি হয়ে গেছে অনেক আগে। কোন ছাত্র নেই কোথাও। 

হেডমাস্টারসাহেব দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক। হাইস্কুলের হেডমাস্টার বললে যেরকম একটা জুবুথুবু বৃদ্ধের চেহারা ভেসে ওঠে সেরকম নন ইনি। এঁকে হেডমাস্টারের চেয়েও আর্মি অফিসার বলে মনে হচ্ছে বেশি। খুবই স্মার্ট ভঙ্গিতে হ্যান্ডশেক করলেন আমার সাথে। 

ইন্টারভিউ শুরু হলো। বাড়ি কোথায় ইত্যাদি। আমি ফাইলটা দেখিয়ে বললাম, “এখানে সব রেকর্ড আছে।“

“সব লাগবে না, আপনার অনার্সের মার্কশিট বা সার্টিফিকেটটা দেখান।“

“সার্টিফিকেট এখনো দেয় নাই স্যার। মার্কশিট আছে।“ – নাছেরসাহেব আমার হয়ে বললেন। 

আমি ফাইল খুলে মার্কশিটটা এগিয়ে দিলাম। হেডমাস্টার মার্কশিটটা নিয়ে একটু দেখেই ফেরত দিলেন। 

"আপনার ভবিষ্যত প্ল্যান কী? আই মিন হোয়াট ডু ইউ ড্রিম ফর?"

এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে এখনো নেই। ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা এখনো সেভাবে শুরু করিনি।

“আপনাকে কিছুদিন মাস্টারি করতে হবে।“

আমি তো খুশি। এত বড় স্কুলে মাস্টারি। কিন্তু ইউনিভার্সিটি খুলে গেলে ক্লাস করে এখানে মাস্টারি কীভাবে করবো? সে কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। দেখা যাক না সপ্তাহে কয়টা ক্লাস নিতে হয়। মনে মনে দ্রুত চিন্তা করে ফেললাম। 

“সজল, সজল, এদিকে এসো তো।“ 

তিন-চার বছরের একটা বাচ্চা এগিয়ে এসে হেডমাস্টারের কোলে উঠে গেলো। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম – আমাকে কী মাস্টারি করতে হবে। এই চারবছরের বাচ্চাকে পড়ানোর জন্য আমার ফাইলপত্র চেক করতে হলো? মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। 

“আদাব স্যার।“ এক সুদর্শন কিশোর এসে সালাম দিলো আমাকে। হেডমাস্টারসাহেব বললেন, “ও সজল। আমার ব্রাদার-ইন-ল। ইউনিভার্সিটি কলেজের ফার্স্টবয়। এবার এইচএসসি দেবে। টেস্টে ফিজিক্সে মার্কস একটু কম পেয়েছে। আপনি তাকে এক্টু ফিজিক্স দেখিয়ে দেবেন। পরীক্ষার তো আর বেশিদিন নেই।“

তবুও ভালো। উচ্চমাধ্যমিকের ফিজিক্স পড়াতে হবে। ভালো ছাত্রদের পড়াতে খুব আরাম। তেমন কিছু করতে হয় না। মাস্টার সামনে থাকলে তাদের মন অন্যদিকে যায় না বলেই মাস্টার রাখে। কিন্তু বলছে ফিজিক্সে কম পেয়েছে। কত পেয়েছে জেনে নিতে হবে। কিন্তু একটা টিউশনি দেবার জন্য আমার মার্কশিট চেক করতে হলো!

“ঠিক আছে, আপনি তার সাথে বসে ঠিক করে নেন কোন্‌দিন পড়াবেন ইত্যাদি।“

“আমার সাথে আসেন স্যার।“ 

বিশাল কোয়ার্টার। সজলের স্টাডিরুমটাও বেশ বড়। 

“তুমি ফিজিক্সে কত পেয়েছ?”

“স্যার সাতাশি। থিওরি পরীক্ষাটা খারাপ হয়ে গেল।“

সাতাশি খারাপ মার্ক! কী যন্ত্রণা রে বাবা! আমি ফিজিক্স বোঝাতে পারবো হয়তো। কিন্তু পরীক্ষায় নম্বর কীভাবে পেতে হয় সেটা তো আমি জানি না। আমি নিজে অনেককিছু ভালো বুঝেও ভালো নম্বর পাইনি। 

কয়েকদিনের মধ্যেই সজলের সাথে আমার একটা বোঝাপড়া হয়ে গেল। বিকেলে ঘন্টাখানেক বসি তার সাথে। সে নিজেই রুটিন মেনে চলে। আমাকে তেমন কিছু করতে হয় না। 

এপ্রিলের ২৯ তারিখ সকাল থেকে আকাশে মেঘ। গুটি গুটি বৃষ্টি হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দেয়া হচ্ছে রেডিওতে। কিন্তু কেউই খুব একটা বিচলিত নয়। দুপুরের মধ্যেই ছয় নম্বর বিপদ সংকেত দেয়া হলো। তাতেও খুব একটা হেলদোল হলো না কারো। দুপুরে এই সিগনালের মধ্যেই চৌধুরীহাটে গিয়ে শ্মশানেশ্বরী পাইচ হোটেলে ভাত খেয়ে এসেছি। 

সন্ধ্যার মধ্যেই সিগনাল দশ নম্বরে উঠে গেলো। সজলকে পড়াতে যাবার প্রশ্নই উঠে না। রাত দশটার পর থেকে বাড়তে শুরু করলো বাতাসের বেগ। জানি না কী ঘটতে চলেছে পরবর্তী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। 

No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts