Sunday, 5 September 2021

ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ

 

নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যানের মতে আগামী দশ হাজার বছরের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বিবেচনায় নিলেও দেখা যাবে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলোর আবিষ্কারের গুরুত্ব অন্য সব আবিষ্কারের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের ভিত্তিতেই আবিষ্কৃত হয়েছে আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি, কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং টেলিকমিউনিকেশানের সমস্ত প্রযুক্তি। ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলোকে বলা হয় সর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী সমীকরণ।

জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল ছিলেন ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী। উনবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানীদের একজন ছিলেন তিনি। বিংশ শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞানের মূল ভিত্তি রচিত হয়েছে ম্যাক্সওয়েলের আবিষ্কারের ভিত্তিতে।

ম্যাক্সওয়েলের জন্ম ১৮৩১ সালের ১৩ জুন, স্কটল্যান্ডের এডিনবরায়। তাঁর বাবা ছিলেন উকিল। মাত্র আট বছর বয়সে মা-কে হারিয়ে খুব একা একা শৈশব কাটে ম্যাক্সওয়েলের। আর কোন ভাইবোনও তার ছিল না। পড়াশোনা শুরু হয় বাড়িতে। দশ বছর বয়সে ১৮৪১ সালে বিখ্যাত এডিনবরা একাডেমিতে ভর্তি করানো হয় তাকে। ম্যাক্সওয়েল এতটাই লাজুক আর আত্মমগ্ন থাকতো যে তার কোন বন্ধু ছিল না একাডেমিতে। কিন্তু তার নিজস্ব প্রতিভা প্রকাশিত হয়েছে স্কুলের গণিত ও সাহিত্যে। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তার প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র, "অন দি ডেসক্রিপসান অব ওভাল কার্ভস"। উপবৃত্ত ও অধিবৃত্তের গাণিতিক সংজ্ঞা দেন তিনি তার এই গবেষণাপত্রে। এডিনবরার রয়েল সোসাইটির বৈজ্ঞানিক সভায় এই প্রবন্ধ পঠিত হয় ১৮৪৬ সালে - তার বয়স তখন মাত্র ১৫ বছর।

১৮৫০ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন ম্যাক্সওয়েল এবং ১৮৫৪ সালে গণিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পাস করেই তিনি কেমব্রিজে গণিত পড়াতে শুরু করেন। পরের বছর ট্রিনিটি কলেজের ফেলোশিপ দেয়া হয় তাঁকে এবং ট্রিনিটি কলেজেও পড়াতে শুরু করেন। সেই সময় মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি হিসেব করে বের করেছিলেন শনি গ্রহের বলয় - শুধু একটি নয়  - অসংখ্য। তাঁর সেই ধারণা সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে ১০০ বছর পরে।

সেই সময় ম্যাক্সওয়েল মাইকেল ফ্যারাডের বৈদ্যুতিক এবং চৌম্বক বলরেখা সংক্রান্ত তত্ত্বের ব্যাপারে আগ্রহী হন। ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ইনডাকশান বা তড়িৎচৌম্বক আবেশ আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৮৩১ সালে। ফ্যারাডে দেখিয়েছিলেন  তামার তারের ভেতর দিয়ে যদি একটি চুম্বক নাড়াচাড়া করা হয় তাহলে তামার তারে বিদ্যুৎ সঞ্চালিত হয়। ম্যাক্সওয়েল ফ্যারাডে, গাউস এবং অ্যাম্পিয়ারের পরীক্ষালব্ধ ফলাফল কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ ও চৌম্বক ক্ষেত্রের গাণিতিক সমীকরণ আবিষ্কার করলেন। তিনি দেখালেন চার্জিত বস্তু বিদ্যুৎ এবং চুম্বক - উভয় ক্ষেত্র থেকেই বল অনুভব করে। ম্যাক্সওয়েল দুটো গবেষণাপত্রে তাঁর এই আবিষ্কার প্রকাশ করেন ১৮৫৫ ও ১৮৫৬ সালে। কেমব্রিজ ফিলোসফিক্যাল সোসাইটিতে এই গবেষণাপত্রদুটো পঠিত হয়।

১৮৫৬ সালে তিনি স্কটল্যান্ডে ফিরে এসে এবারডিন ইউনিভার্সিটির ফিজিক্সের প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। ১৮৬০ সালে তিনি লন্ডনের কিংস কলেজের প্রফেসর নিযুক্ত হন। লন্ডনে কাজ করার সময়েই ১৮৬৪ সালে তিনি ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভস বা তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের ধারণা দেন। তিনি ধারণা দেন যে বিদ্যুৎ ও চুম্বকত্বের সংমিশ্রণে পাওয়া যায় তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ যা আলোর বেগে চলে। আর আলোও বিদ্যুৎচৌম্বক তরঙ্গ। তিনি তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের দৃশ্যমান অংশ এবং অদৃশ্যমান অংশ সম্পর্কেও ধারণা দেন। তাঁর ধারণার পরীক্ষামূলক প্রমাণ তিনি দেখে যেতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুর পর জার্মান বিজ্ঞানী হেনরিক হার্টজ তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ পরীক্ষাগারে তৈরি করত সমর্থ হন।

ম্যাক্সওয়েল সঠিকভাবে ধারণা দিয়েছিলেন - যদি বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের পরিবর্তন ঘটে তাহলে চৌম্বক ক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়। আবার যদি চৌম্বকক্ষেত্রের পরিবর্তন ঘটে, তাহলে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়। আরো সোজাভাবে বললে বলা যায় - বিদ্যুৎ থেকে চুম্বকত্ব পাওয়া যায়, চুম্বকত্ব থেকে পাওয়া যায় বিদ্যুৎ। বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র এবং চৌম্বকক্ষেত্র পরস্পর লম্বভাবে থাকে সবসময়। ম্যাক্সওয়েল গাণিতিকভাবে হিসেব করে দেখান যে শূন্যস্থানে আলোর বেগ সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার। পরবর্তীতে আমরা দেখেছি যে আলো তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের দৃশ্যমান অংশ। কিন্তু বিশাল অদৃশ্য অংশে রয়েছে কম শক্তিসম্পন্ন বেতারতরঙ্গ, অবলোহিত রশ্মি বা ইনফ্রারেড রে, মাইক্রোওয়েভ, এবং বেশি শক্তিসম্পন্ন আলট্রাভায়োলেট রে বা অতিবেগুনি রশ্মি, এক্স-রে, গামা-রে ইত্যাদি। বিংশ শতাব্দী এবং একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিতে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের ব্যাপক ব্যবহার আমরা দেখছি ভূমি থেকে মহাকাশ, মোবাইল ফোন থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞান - সবখানে।

মহাবিশ্বের চারটি মৌলিক বলের একটি হলো তড়িৎচৌম্বক বল। এই বল পরমাণুর নিউক্লিয়াস এবং তার চারপাশের ইলেকট্রনগুলিকে ধরে রাখে। রাসায়নিক বিক্রিয়ায় চার্জিত আয়নগুলোর মধ্যে তড়িৎচৌম্বক বলের মাধ্যমেই বলের আদান-প্রদান ঘটে থাকে।

ম্যাক্সওয়েল কীভাবে পৌঁছালেন তাঁর যুগান্তকারী ধারণায়? তিনি মাইকেল ফ্যারাডের বিদ্যুৎ-চৌম্বক আবেশ সংক্রান্ত পরীক্ষালব্ধ ফলাফল বিশ্লেষণ করতে শুরু করলেন। বিদ্যুৎ ও চুম্বকের ধর্ম নিয়ে ইওরোপে পরীক্ষানিরীক্ষা চলছিলো অনেক বছর থেকে। অনেক রকম তত্ত্বও প্রচলিত ছিল। ম্যাক্সওয়েল সব তত্ত্ব ও পরীক্ষালব্ধ ফলাফলকে চারটি মাত্র গাণিতিক সমীকরণ দিয়ে প্রকাশ করে ফেললেন।

ম্যাক্সওয়েলের প্রথম সমীকরণ


প্রথম সূত্রের নাম দিলেন পদার্থবিজ্ঞানী কার্ল গাউসের নাম অনুসারে গাউসের বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের সূত্র। এই সূত্র চার্জিত বস্তু দ্বারা সৃষ্ট বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের পরিবর্তন কীভাবে হয় তার বর্ণনা দেয়। বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের কোন বিন্দুতে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের পরিবর্তনের পরিমাণ হলো ওই বিন্দুতে চার্জের ঘনত্ব (চার্জ ডেনসিটি) এবং শূন্য মাধ্যমে চার্জ কীভাবে কাজ করে তার সূচকের অনুপাতের সমান। যদি সেখানে কোন চার্জ না থাকে, তাহলে তাহলে চার্জের ঘনত্ব হবে শূন্য। তখন বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের পরিবর্তন হবে শূন্য, অর্থাৎ কোন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হবে না।


ম্যাক্সওয়েলের দ্বিতীয় সমীকরণ


ম্যাক্সওয়েলের দ্বিতীয় সূত্রও গাউসের নামে - গাউসের চৌম্বক ক্ষেত্রের সূত্র। এই সূত্রমতে কোন চৌম্বক ক্ষেত্রের সামগ্রিক পরিবর্তনের মান শূন্য। অর্থাৎ চুম্বকত্ব সবসময় এক মেরু থেকে অন্য মেরুতে প্রবাহিত হচ্ছে। যেহেতু চুম্বকত্ব সবসময় একটি এক মেরু থেকে অন্য মেরুর দিকে যাচ্ছে সেহেতু সেখানে মোট চুম্বকত্বের কোন পরিবর্তন ঘটছে না। এক মেরু বিশিষ্ট চুম্বক যে পাওয়া যায় না তা এই সূত্রে প্রতিষ্ঠিত।

ম্যাক্সওয়েলের তৃতীয় সমীকরণ


ম্যাক্সওয়েলের তৃতীয় সূত্র হচ্ছে ফ্যারাডের চৌম্বক আবেশের সূত্র। ফ্যারাডে বৈদ্যুতিক মোটর উদ্ভাবন করেছিলেন। সেই উদ্ভাবনের মূলে যে তত্ত্ব কাজ করে সেই তত্ত্বের গাণিতিক সূত্র হলো ম্যাক্সওয়েলের তৃতীয় সূত্র। এই সূত্র মতে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের ঘূর্ণন তৈরি হয় সময়ের সাথে চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তনের মাধ্যমে। বৈদ্যুতিক জেনারেটরের মূলনীতি এটাই - যেখানে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার জন্য চৌম্বকক্ষেত্রের পরিবর্তন করা হয়।

ম্যাক্সওয়েলের চতুর্থ সমীকরণ

ম্যাক্সওয়েলের চতুর্থ সূত্র হচ্ছে অ্যাম্পিয়ার-ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ। এটা তৃতীয় সূত্রের বিপরীত সূত্র। এই সূত্র মতে চৌম্বক ক্ষেত্রের ঘূর্ণন তৈরি হয় সময়ের সাথে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের পরিবর্তনের মাধ্যমে। এভাবেই তৈরি হয় বৈদ্যুতিক মোটর।

ম্যাক্সওয়েল এক্স-রে কিংবা গামা-রে আবিষ্কারের অনেক আগেই তাদের বৈশিষ্ট্য কী ধরনের হবে সে ব্যাপারে সূত্র দিয়ে গেছেন। পরে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের সব বৈশিষ্ট্য ম্যাক্সওয়েলের সূত্রের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে। এই সূত্রগুলির ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই উৎপত্তি হয়েছে কোয়ান্টাম তত্ত্বের, আইনস্টাইন পেয়েছেন আপেক্ষিকতার তত্ত্ব।

১৮৬৫ সালে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে ম্যাক্সওয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র রচনা করার কাজে মন দেয়ার জন্য। এই সময় তিনি গবেষণা করেন গ্যাসের গতিতত্ত্বের উপর। ১৮৭১ সালে তিনি আবার কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন নতুন প্রতিষ্ঠিত ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরির পরিচালক হিসেবে। বিজ্ঞানী হেনরি ক্যাভেন্ডিসের অনেক অপ্রকাশিত গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ম্যাক্সওয়েলের সম্পাদনায়।

১৮৭৯ সালের ৫ নভেম্বর মাত্র ৪৮ বছর বয়সে পাকস্থলির ক্যান্সারে মৃত্যু হয় ম্যাক্সওয়েলের।

তথ্যসূত্র: বায়োগ্রাফিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়া অব সায়েন্টিস্ট, ফেনোমেনাল ফিজিক্স। 


Acknowledgement: Thank you Tushit Maxim, for checking the equations. 

No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts