Saturday 11 September 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৩৭

 


স্বপ্নলোকের চাবি – ৩৭

“অ্যাই ছেলে, তুমি মেয়েদের মাঝখানে বসে আছো কেন? এদিকে চলে আসো।“ – 

ভুঁইয়াস্যারের ধমকের সাথে সাথেই ক্লাসের পরিবেশ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠলো। এতক্ষণ বেশ ভালোই চলছিল। ভুঁইয়াস্যার ক্লাসে এসে অপ্‌টিক্স পড়াতে পড়াতে কীভাবে যেন চলে গিয়েছিলেন বেহেশ্‌ত-দোজখের কথায়। যেসব পুরুষ বেহেশ্‌তে যাবে তাদের প্রত্যেকের জন্য অনেকগুলি হুরের ব্যবস্থা থাকবে - এসব আলোচনা স্যার বেশ হাসিমুখেই করছিলেন। 

ফিজিক্সের ক্লাসে স্যার এগুলি কেন বলেন জানি না। তবে এসব আলোচনায় স্যার যে খুব উৎসাহ পান তা বোঝা যায়। গতকালও স্যার বলছিলেন, “স্বামী-স্ত্রীর মিলনের সময় গায়ের উপর কমপক্ষে একটা চাদর থাকা উচিত।“

“কেন স্যার?” – তাস-বাবুল হঠাৎ প্রশ্ন করে উঠেছিল। 

আমাদের ক্লাসে দু’জন বাবুল আছে। একজন আবুল হোসেন খান বাবুল – যাকে আমরা খান-বাবুল বলি। অন্য বাবুল শাটল-ট্রেনে, কমনরুমে – যেখানেই সময় পায় তাস খেলতে বসে। তাই তার নাম তাস-বাবুল। 

ভেবেছিলাম তাস-বাবুলের কথায় স্যার রেগে যাবেন। কিন্তু স্যার হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিলেন – “চাদর থাকলে ফেরেশতারা দেখবে না আর কী। এসব কাজে গোপনীয়তার দরকার আছে না?” 

স্যারের হাসি দেখে বাবুলের সাহস বেড়ে গিয়েছিল। সে পাল্টা প্রশ্ন করে বসলো, “ফেরেশতারা নাকি পৃথিবীর কোথায় কী হচ্ছে সবকিছু দেখতে পান? তাহলে চাদর কাজ করে কীভাবে?”

স্যার কোন উত্তর না দিয়ে হাসি-হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়েছিলেন। 

আজকেও গতকালের মতো আলোচনা চলছিল। বেহেশতে পুরুষদের জন্য হুরের ব্যবস্থা থাকবে শুনে দীলিপ প্রশ্ন করলো, “মেয়েদের জন্য কী ব্যবস্থা থাকবে স্যার?”

স্যার সম্ভবত এরকম প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি থতমত খেয়ে উত্তর দিলেন, “মেয়েরা তাদের হাজব্যান্ডকে আবার পাবে।“ 

“হায় হায়! দুনিয়াতেও জ্বালাবে, বেহেশতেও জ্বালাবে!” – মেয়েদের দিক থেকে খুব নিচুস্বরে কেউ একজন বললো। কে বললো ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমরা সবাই হেসে উঠলাম। কিন্তু স্যার হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। দীলিপের দিকে তাকিয়ে হিসহিস করে বললেন, “তোমার তো বেহেশতের চিন্তা করে লাভ নেই। কাফেরদের জন্য তো বেহেশ্‌ত না।“ 

এটুকু বলেই স্যারের চোখ গেল মেয়েদের বেঞ্চের দিকে। হয়তো একটু আগে মেয়েদের মধ্যে কে মন্তব্য করেছে তা দেখতে চাচ্ছিলেন। তারপরই হঠাৎ ধমক দিয়ে উঠলেন, “অ্যাই ছেলে, তুমি মেয়েদের মাঝখানে বসে আছো কেন? এদিকে চলে আসো।“ 

তাকিয়ে দেখলাম মেয়েদের মাঝখানে নয়, মেয়েদের সারির পেছনের বেঞ্চে সুপর্ণার পাশে বসে আছে হাফিজ। অনার্স থার্ড ইয়ারের ক্লাসে এটা কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। কিন্তু স্যার রেগে গেলেন কেন বুঝতে পারছি না। 

“ক্লাসের মধ্যে এসব বরদাশ্‌ত করা হবে না। ছেলেমেয়েদের এধরনের ঘনিষ্ঠতার কারণেই পৃথিবীতে যতসব গন্ডগোল হচ্ছে। তোমরা কি জানো যে ইউনিভার্সিটির প্রক্টরের প্রধান দায়িত্ব কী ছিল? কেন প্রক্টর পোস্ট তৈরি করা হয়েছিল? ক্যাম্পাসে ছেলে আর মেয়েদের মধ্যে মেলামেশা বন্ধ করার জন্য। আগেকার দিনে ক্যাম্পাসে একটা ছেলে একটা মেয়ের সাথে কথা বলার জন্য প্রক্টরের পারমিশান নিতে হতো।“ 

স্যারের এসব কথায় সুপর্ণা উঠে দাঁড়িয়ে সরাসরি বললো, “স্যার, ক্লাসে সবাই তো ক্লাসমেট। সে আমার পাশে বসলে আমার তো কোন সমস্যা হচ্ছে না।“ 

সুপর্ণার সাহসের তারিফ করতেই হয়। কোনো স্যারের মুখের উপর কথা বলার সাহস আমার এখনো হয়নি। কিন্তু সুপর্ণা সে সাহস দেখিয়েছে। আর হাফিজ – স্যারের কথা যেন তার কানেই যায়নি। সে কোনো-কিছুতেই-কিছু-যায়-আসে-না ভাবে বসে রইলো। 

“একদিন বুঝবে সমস্যা কী জিনিস।“ – বলে স্যার ক্লাস থেকে চলে গেলেন। 

স্যারের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে ক্যাম্পাসে ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেয়াল তুলে দেয়ার শিবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়নের দায়িত্ব স্যার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। ক্যাম্পাস দখল করার পর থেকে শিবির বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল উদারনীতি বিলুপ্ত করে ফেলার জন্য। শাটল ট্রেনে মেয়েদের জন্য আলাদা বগির দাবি করছে তারা অনেকদিন থেকে। না, মেয়েদের জন্য রিজার্ভ বগি নয়, তারা দাবি করছে – ছেলে এবং মেয়ে একসাথে কোন বগিতে উঠতে পারবে না। ছেলেদের বগি আলাদা থাকবে, মেয়েদের বগি আলাদা থাকবে। শাটল ট্রেনে যারা আসে – তারা শিবিরের এই দাবিকে এখনোপর্যন্ত একটুও পাত্তা দেয়নি। শিবির তাদের এই দাবি এখনো ছাড়েনি। চাকসু নির্বাচনে তাদের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে ছাত্রীদের জন্য আলাদা বগি, আলাদা বাস এসবের ব্যবস্থা করবে বলে প্রচার শুরু করেছে। মেয়েদের মধ্যে শিবিরের সমর্থন এতে বাড়বে কি না জানি না। 

দুই সপ্তাহেরও বেশি শীতকালীন ছুটির শেষে জানুয়ারির ১৬ তারিখ থেকে ক্লাস আবার শুরু হয়েছে। ক্লাস প্র্যাকটিক্যাল সবকিছু হবার কথা থাকলেও বেশিরভাগ ক্লাস হচ্ছে না। চাকসু নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেছে। ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে সব দল এক হয়ে ছাত্রঐক্য পরিষদ গঠন করেছে। অনেক বছর পর ক্যাম্পাসে প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলি মিছিল করার সুযোগ পেয়েছে। 

ছাত্রশিবির সহজে এসব মেনে নেয়নি। যখন দেখেছে ভিসি আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিনের উপর তাদের প্রভাব খুব একটা খাটছে না, তখন তারা বিভিন্নভাবে হামলা চালাচ্ছে মিছিলের উপর। 

গতকাল ছাত্রইউনিয়নের মিছিলে গিয়েছিলাম। মিছিলের সাথে সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে ঢোকার সময় সিঁড়ির কাছে ভুঁইয়া স্যারের সাথে চোখাচোখি হয়েছিল। হাফিজও ছিল মিছিলে। সেই কারণেই কি আজ ক্লাসে হাফিজের উপর রেগে গিয়েছিলেন স্যার? মেয়েদের পাশে বসেছে – এটা অজুহাত, মূল কারণ নয়। 

সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। ১৯৯০ সালটা একটা নতুন উদ্দীপনা নিয়ে এসেছে আমার ভেতর। এ বছর অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে যাবে। মার্চের আট তারিখ থেকে আমাদের পরীক্ষার ডেট দিয়েছে। সেকেন্ড ইয়ারে আমরা এক ডেটে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কিন্তু এবারও সেরকম কিছু করার ব্যাপারে আমাদের কারোরই কোন আগ্রহ নেই। পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন করারও দরকার নেই। কারণ আমাদের বিশ্বাস পরীক্ষা এমনিতেই পিছিয়ে যাবে। আমাদের আগের ব্যাচের অনেক সাবজেক্টের এখনো রেজাল্ট দেয়া হয়নি। তাছাড়া এখন ইলেকশানের হাওয়া। ইলেকশানে শিবিরকে হারানো কি এত সহজ হবে? আর শিবির হারলেও কি হলের দখল রাতারাতি ছেড়ে দেবে? 

এসব চিন্তা ছাপিয়েও পরীক্ষার জন্য টেনশান হচ্ছে। পরীক্ষা পেছালেও আর কতটুকু পেছাবে? আরো দুই মাস পিছিয়ে ঈদের পরেও যদি পরীক্ষা হয় – তাহলেও হাতে সময় আছে মাত্র চার মাস। প্রতি পেপারের জন্য পনেরো দিন করেও সময় নেই। অথচ আমার কোনো পেপারেরই পড়াশোনা হয়নি এখনো। 

জানুয়ারির ১৫ পর্যন্ত শীতকালীন ছুটি ছিল। ছুটি হবার আগে পরিকল্পনা করেছিলাম ছুটিতে খুব সিরিয়াসলি পড়াশোনা করবো। রুম থেকেই বের হবো না, বাড়িতে যাবার তো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু দেখা গেলো মুকিতভাই বাড়ি চলে গেলেন ডিসেম্বরের শেষে। আমিও পরের দিনই বাড়িতে রওনা হলাম। 

বাড়িতে যাবার সময় কোয়ান্টাম মেকানিক্স বই নিয়ে গিয়েছিলাম। অথচ ব্যাগ থেকে বেরও করিনি। তার বদলে পনেরো দিন ধরে অনেকগুলি গল্প-উপন্যাস পড়লাম। পরীক্ষার আগে গল্প-উপন্যাসের স্বাদ বেড়ে যায়। মৈত্রেয়ী দেবীর ‘ন হন্যতে’ পড়তে পড়তে মনে হলো ভালোবাসা নামক স্নায়বিক আবেগীয় ব্যাপারটাকে আরো নতুনভাবে চিনতে পারছি -  “ভালোবাসার জন্যে কোন আত্মীয় সম্পর্ক প্রয়োজন হয় না। ভালোবাসা আলোর মতো – তা সবাইকে উজ্জ্বল করে।“ 

আচ্ছা, গল্প-উপন্যাস পড়তে যেরকম ভালো লাগে – ফিজিক্সের বইগুলি পড়তে যদি সেরকম ভালো লাগতো – তাহলে নিশ্চয় এত ঝামেলা হতো না। নাকি পড়ার পরে পরীক্ষা দিতে হয় বলেই এত কঠিন লাগে? ন হন্যতে পড়ে পরীক্ষা দিতে হলেও মনে হয় একই ঝামেলা হবে। 

ভেবেছিলাম বাড়ি থেকে আসার পর পড়াশোনায় নিয়মিত হবো। কিন্তু এখন ক্যাম্পাসে নিয়মিত মিছিলে যাচ্ছি। এই মিছিল স্বতস্ফূর্ত। একটাই আশা – ছাত্রশিবিরের দাপটের অবসান। প্রায় প্রতিদিনই মিছিল হচ্ছে ক্যাম্পাসে। ছাত্রঐক্যের ২২ তারিখের মিছিলে পেছন দিক থেকে আক্রমণ করেছে ছাত্রশিবিরের গুন্ডারা। সারাদেশের সব শিবির-ক্যাডার এখন হলে চলে এসেছে নির্বাচন উপলক্ষে। আমি ঐ মিছিলে সামনের দিকে ছিলাম বলে ইট-পাটকেল খাইনি। 

আমাদের বিল্ডিং-এও অনেকগুলি নতুন মুখ দেখা যাচ্ছে। হয়তো নির্বাচন উপলক্ষে শিবিরের ক্যাডার। আশার পাশাপাশি কিছুটা আশংকাও লাগছে – নির্বাচন ঠিকমতো হতে দেবে কি না। 

সেলিমভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছে ক্যাম্পাসে, মিছিলে। আপাতত তিনি আমাদের বিল্ডিং-এ থাকছেন না। নির্বাচন নিয়ে খুবই ব্যস্ত তিনি। কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে সারাক্ষণ যোগাযোগ করতে হচ্ছে। ঐক্যের স্বার্থে সবাই অনেক ছাড় দিয়েছেন এবার। সেলিমভাইরা যারা বড় বড় দলের বড় বড় পদে আছেন তাঁরা নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন না। ঐক্যের কেন্দ্রীয় কমিটির জন্য নাজিম-আজিম পরিষদ গঠন করা হয়েছে। নাজিম-আজিম বাকশাল আর বাসদের নেতা। 

২৫শে জানুয়ারি আমাদের ক্যাম্পাসে প্রথমবারের মতো এলেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। আর্টস ফ্যাকাল্টির সামনে বিশাল মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। সাজেদা চৌধুরি, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরি, ডাকসুর ভিপি সুলতান মনসুর, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবীবসহ আরো অনেক নেতা এসেছিলেন শেখ হাসিনার সাথে। সেলিমভাই সভা পরিচালনা করেছিলেন। ক্যাম্পাসের চেহারাই বদলে গিয়েছিল সেদিন। 

“দোস্ত, এবার দেখবি – শিবির একটা সিটও পাবে না।“ – সমাবেশে আবেগে ধরে রাখতে পারছে না আহসান হাবীব দীপক। আমাদের সবার আশাই সেরকম। 

এই সময় ক্যাম্পাস ছেড়ে এক দিনের জন্যও কোথাও যেতে ইচ্ছে করছিলো না। কিন্তু জানুয়ারির ৩০ তারিখ বাড়িতে যেতে হলো। দাদার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ বিয়ে। বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের আনাগোনা বেড়ে গেছে। আমার তেমন কোন ভূমিকা না থাকলেও অন্যদের কাজকর্ম দেখতে মজাই লাগছিল। কোথায় যেন পড়েছিলাম – বিয়ে করার পর পুরুষের স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তি কিছুদিনের জন্য একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। তখন মোরগদের মতো মাথার ঝুঁটি নাচিয়ে আর গলা ফুলিয়ে নিজের বাহাদুরি দেখাবার একটা অদম্য খেয়াল মাথায় চেপে বসে। কিন্তু আমার দাদার কাজকর্ম দেখে মনে হচ্ছে – তার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বিয়ের কিছুদিন আগে থেকেই ঘটতে শুরু করেছে। 

চট্টগ্রামে বিয়ের অনুষ্ঠানে কন্যাপক্ষের উপর সবচেয়ে বড় অত্যাচার হয় খাওয়া-দাওয়ার মধ্য দিয়ে। যে বরপক্ষের আত্মীয়স্বজনের সংখ্যা পঞ্চাশজনও হবে না, তারাও দাবি করে পাঁচশ বরযাত্রী নিয়ে বিয়ে করতে আসবে – সবাইকে খাওয়াতে হবে। দেখা যায় বরপক্ষের নিমন্ত্রিত শতকরা আশিজন হয়তো বরকেই চেনে না। বরের ভাইয়ের বন্ধু, তাদের বন্ধুর বন্ধু, বোনের শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজন, তাদের আত্মীয়দের আত্মীয়, তাদের বন্ধুবান্ধব সবাই নিমন্ত্রিত। আর যাদের নিমন্ত্রণ করা হয় – তাদের জন্যও তো প্রচন্ড ঝামেলা। বিয়েতে অ্যাটেন্ড করার জন্য কতকিছু সামলাতে হয়। আমি এসবের ঘোর বিরোধী। এসব নিয়ে আমার বাবার সাথে আমার প্রায় ঝগড়া লেগে যাবার অবস্থা। আমি বলে দিয়েছি – আমার কোন বন্ধুবান্ধবকে আমি বলছি না। আমার বন্ধুবান্ধবকে আমার ভাইয়ের শ্বশুর কী কারণে খাওয়াবেন? তবুও আমার দাদার অনুরোধে তার সাথে আমার বন্ধুদের যে ক’জনের পরিচয় ছিল – তাদেরকে বলতে হয়েছে। প্রদীপনাথ, যীশু, সুমন, বিপ্লব আর মুকিতভাই – এই পাঁচজন। 

বিয়ের অনুষ্ঠান শহরে। বরযাত্রীর সঙ্গে শহরে আসতে হলো, আবার পরদিন সবার সঙ্গে বাড়িতে। সেখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ইত্যাদি করতে করতে চার-পাঁচদিন নির্বাচনী আবহাওয়া থেকে দূরে থাকতে হলো। 

ভোটের আগেরদিন বাড়ি থেকে আসার সময় গাড়িতেই অসুস্থ হয়ে পড়লাম। কয়েকদিন আগে থেকেই জ্বর আসছিলো। এসব অনুষ্ঠানের ভেতর বাড়িতে কীভাবে যেন পায়ে একটা কাঁটা ঢুকে গিয়েছিল। সেটার যন্ত্রণায় জ্বর এসে গেছে। বাড়িতে এটা কাউকে বললে আমার আর আসা হতো না। 

ফেব্রুয়ারির আট তারিখ চাকসু নির্বাচনে ভোট দিলাম। আমার জীবনের প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগ করলাম। তারপর কোন রকমে রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। প্রচন্ড জ্বর নিয়ে বিছানায় বেহুশের মতো ঘুমালাম। 

পরদিন নির্বাচনের ফলাফল জানাতে রুমে এলো বিপ্লব আর প্রদীপনাথ। এফ রহমান হল ছাড়া চাকসুর কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সবগুলি হলের সবগুলি পদেই ছাত্রঐক্যের প্রার্থীরা জয়লাভ করেছে। শুধুমাত্র এফ রহমান হলের বারোটি পদের মধ্যে এগারোটি পদে শিবির জয়লাভ করেছে। পুরো নির্বাচনে ৮৪টি পদের মধ্যে ৭৩টি পদে ছাত্রশিবির হেরে গেছে। আমি আনন্দে বিছানায় উঠে বসলাম। মনে হলো আমার গা-ভর্তি জ্বর হঠাৎ উবে গেল। 

কিছু কিছু সময় আসে – একটু একটু করে পৃথিবীটা বদলে যেতে থাকে। ১৯৯০-এর ফেব্রুয়ারি সেরকম একটা সময়। 

এই সময়ের সমসাময়িক ঘটনাগুলিই এক সময় ইতিহাস হয়। পরিবর্তনের হাওয়া চলছে বিশ্বজুড়ে। দীর্ঘ সাতাশ বছর কারাগারে থাকার পর ১১ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পেয়েছেন আফ্রিকার কালোমানুষের মুক্তির সংগ্রামের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের স্বপ্ন এবার সফল হবে। নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে তারা নিশ্চয় তাদের অধিকার ফিরে পাবে। 

আমিও স্বপ্ন দেখছি আমাদের ক্যাম্পাসও এবার নির্বাচিত ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে শিবিরমুক্ত হবে। ক্যাম্পাসে ফিরে আসবে মুক্তবুদ্ধির চর্চার পরিবেশ।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts