Thursday 23 September 2021

মেলবোর্নের লজ্জা

 

করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চমৎকার পারদর্শিতা দেখিয়ে বিশ্বে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বের প্রধান বিশেষজ্ঞদের অনেকেই করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে অস্ট্রেলিয়াকে অনুসরণ করার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন এই সেদিনও। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহের চিত্র দেখলে যে কারোরই মনে প্রশ্ন জাগবে এত দীর্ঘদিন ধরে, এত কঠোর লকডাউন, আর কারফিউর মধ্যেও সংক্রমণ দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে কেন?

আজকের (২৩/৯/২০২১) অস্ট্রেলিয়ান কোভিড পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায় – পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে ভেবে আত্মতৃপ্তি পাবার মতো অবস্থা নেই এখন। গত ২৪ ঘন্টায় অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় ১৭০০ নতুন সংক্রমণ ঘটেছে। যার মধ্যে ৫১০ জনের সংক্রমণ কীভাবে ঘটেছে তা অনিশ্চিত। এখনো প্রায় বিশ হাজার জনের শরীরে নিশ্চিতভাবে করোনা ভাইরাস আছে। দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি। অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় সংক্রমণের শতকরা হার হয়তো অনেক কম। কিন্তু বিশাল মহাদেশের সমান এই দেশে যেখানে মাত্র দুই কোটি চল্লিশ লাখ মানুষের বাস, সেখানে তো নিয়মকানুন মেনে চললে একটা সংক্রমণও হবার কথা ছিল না।


অস্ট্রেলিয়ার করোনা-চিত্র (২৩/৯/২০২১)

করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে অস্ট্রেলিয়ার ছয়টি স্টেট আর দুইটি টেরিটরির মধ্যে সবচেয়ে কঠোর নিয়মকানুন বলবত আছে ভিক্টোরিয়া রাজ্যে। মেলবোর্ন যার রাজধানী। পরপর সাত বছর এই মেলবোর্ন শহর পৃথিবীর সবচেয়ে বাসযোগ্য শহর ছিল। কিন্তু মেলবোর্ন তার সেই অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি। এখনো বিশ্বের প্রথম দশটি বাসযোগ্য শহরের একটি – মেলবোর্ন। কিন্তু সেই অবস্থানও কতদিন থাকবে জানি না। 

এক বছরেরও বেশি হয়ে গেল আমরা মেলবোর্নে লকডাউনে আছি। কয়েক সপ্তাহ আগে আমাদের সংক্রমণ শূন্যে নেমে এসেছিল। কিন্তু তারপর থেকে সংক্রমণ হঠাৎ বাড়তে শুরু করে। জানা গেলো কিছু মানুষ গোপনে গোপনে একে অন্যের বাসায় গিয়েছে, বাজারে গিয়েছে, কোভিডের লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও তা গোপন করে নিজেদের পরিবারে, বন্ধুদের পরিবারে এবং কমিউনিটিতে ছড়িয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যারা সংক্রমণের শিকার হয়েছে তারা সবাই শিশু। মোট সংক্রমিত মানুষের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি শিশু। যাদের বয়স ১৫ বছরের কম। যদিও তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি, কিন্তু স্কুল বন্ধ রাখতে হয়েছে। কিছুদিনের জন্য পার্ক, শিশুদের খেলার জায়গা সব বন্ধ করে দিতে হয়েছে।

বিধিনিষেধ না মানলে পাঁচ হাজার ডলারেরও বেশি জরিমানা করেও সংক্রমণ কমানো যাচ্ছে না। আজকের  (২৩/৯/২০২১)  ভিক্টোরিয়া রাজ্যের সংক্রমণের পরিসংখ্যান দেখা যাক।


ভিক্টোরিয়া রাজ্যের কোভিডচিত্র (২৩/৯/২০২১)

গত চব্বিশ ঘন্টায় ৭৬৬ জন মানুষ সংক্রমিত হয়েছে। অথচ কঠোর লকডাউন এবং কারফিউ চলছে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে। বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটারের বাইরে যাবার অনুমতি নেই, বাড়ির দরজার বাইরে যেতেও মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক।

শুধু বিধিনিষেধ আছে, তা তো নয়। আর্থিক সাহায্যও আছে – ঘরে বসে থাকার জন্য। কোভিড টেস্ট করালে ৪৫০ ডলার দেয়া হচ্ছে – রেজাল্ট পাবার আগপর্যন্ত বাসায় থাকার জন্য। তারপরও সংক্রমণ বাড়ছে কেন?

দেখা গেলো নির্মাণশ্রমিকরা তাদের সুযোগের অপব্যবহার করছে। যত সংক্রমণ হচ্ছে তার অর্ধেকেরও বেশি হচ্ছে নির্মাণ শ্রমিকদের মধ্যে। সংক্রমণ একেবারে শূন্যে নামিয়ে আনা আর কিছুতেই সম্ভব নয়। আগের মতো স্বাভাবিক জীবনে আর কখনোই ফিরে যাওয়া যাবে না। এখন যেটা হবে – সেটা হবে নতুন স্বাভাবিক। নতুন স্বাভাবিকে যাবার জন্য দরকার কমপক্ষে শতকরা আশি ভাগ মানুষের টিকা নিয়ে ফেলা। সেজন্য কাজে যাবার শর্ত হিসেবে টিকা নেয়া বাধ্যতামূলক করা খুবই গ্রহণযোগ্য একটা সিদ্ধান্ত।

কিন্তু কিছু কিছু মানুষ অতিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তারা দাবি করতে শুরু করেছে, “আমার শরীর আমার সিদ্ধান্ত”। খুবই ভালো কথা। কিন্তু তোমার পারমিশান নিয়ে তো ভাইরাস তোমার শরীরে ঢুকছে না। তুমি যখন আরেকজনের শরীরে ভাইরাস ঢুকতে সাহায্য করছো – তা কী তোমার সিদ্ধান্ত? তুমি যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হবে – তখন তোমার চিকিৎসার কী হবে?

নির্মাণশ্রমিকদের জন্য টিকা বাধ্যতামূলক করার সাথে সাথেই তারা ধুন্ধুমার লাগিয়ে দিয়েছে। তাদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে ঘোষণা দিলো – তারা টিকা নেবে না, মাস্কও পরবে না। যা খুশি তাই করবে, কে কী করতে পারবে?

দু’দিন আগে তারা মেলবোর্ন শহরের প্রাণকেন্দ্রে শ্রমিকদের সংগঠনের প্রধান কার্যালয় ভাঙচুর করেছে। রাস্তা দখল করে ইচ্ছেমতো গাড়ি ভেঙেছে। পুলিশের উপর আক্রমণ করেছে।


স্রাইন অব রিমেম্বারেন্সে প্রতিবাদের নামে তান্ডব চালাচ্ছে

 
গতকাল তারা শ্রাইন অব রিমেম্বারেন্স – যুদ্ধে শহীদদের সম্মানে যেটাকে আমাদের দেশের শহীদ মিনারের মতো সম্মান দেয়া হয় – তাতে উঠে প্রতিবাদের নামে ইচ্ছেমতো ময়লা ঢেলেছে। এই শহীদ বেদীর দেয়ালে প্রশ্রাব করেছে। মেলবোর্নের জন্য এর চেয়ে লজ্জাকর আর কী হতে পারে?

আজ এরা চড়াও হয়েছে স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর। কমপক্ষে দুইটি টিকাকেন্দ্রে এরা আক্রমণ করেছে। কর্তব্যরত নার্সদের অপমান করেছে, থুতু ছিটিয়েছে। টিকাকেন্দ্রদুটো সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে হয়েছে। 

আমি ভাবতাম রাষ্ট্র যখন একজন নাগরিককে তার মৌলিক চাহিদাগুলি মিটিয়ে অন্যান্য যৌগিক চাহিদাগুলিও মেটাতে সক্ষম হয়, তখন নাগরিকও তার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করে। কিন্তু মানুষের চাহিদা এমন একটা ব্যাপার – যেটা কেবল বাড়তেই থাকে। এখানেও তা দেখলাম।

স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনার নিন্দা করছে সবাই। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো – এরকম মানসিকতা তৈরি হলো কীভাবে এদের? এটা কি এদেশে গুরু পাপে লঘু দন্ড দেয়া হয় সেজন্য?

দেখা যাক – এই পরিস্থিতির শেষ কীভাবে হয়। 


No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts