সান্-বাঁধা
মোর আঙিনাতে
জাল
বুনেছি কালকে রাতে,
ঝুল ঝেড়ে সব সাফ করেছি বাসা।
আয় না মাছি আমার ঘরে,
আরাম পাবি বসলে পরে,
ফরাশ পাতা দেখবি কেমন খাসা!
সুকুমার রায়ের ‘মূর্খ মাছি’ কবিতায় আমরা দেখেছি মাকড়শা মাছিকে এরকম লোভ দেখিয়ে তার জালে টেনে আনছে। ‘হাওয়ায় দোলে জালের দোলা, চারদিকে তার জান্লা খোলা’ মাকড়শার জাল আমরা সবাই দেখেছি। বাড়ির আনাচে-কানাচে, ঘরের কোণে, অনেকদিন হাত না দেয়া বইয়ের তাকে – সব জায়গায়। ভালো করে খেয়াল করলে আমরা দেখতে পাবো – বিভিন্ন রকমের মাকড়শা বিভিন্ন নকশার জাল বুনে। এই মাকড়শার জাল আমরা চাইলেই খুব সহজে পরিষ্কার করে ফেলতে পারি। কিন্তু যদি বলা হয় যে মাকড়শার জাল সঠিকভাবে তুলনা করলে ইস্পাতের চেয়েও শক্ত এবং মজবুত – বিশ্বাস হবে? অবিশ্বাস্য মনে হলেও – ব্যাপারটা সত্যি।
মাকড়শা নিজের শরীর থেকে রেশমের মত সুতা বের করে জাল তৈরি করে বিভিন্ন নকশার। এই জালগুলির নির্দিষ্ট জ্যামিতিক আকার আছে, উদ্দেশ্য আছে। সাধারণ ধারণা থেকে আমরা সবাই জানি মাকড়শা এই জাল দিয়ে খাবার জোগাড় করে। তাদের জালে পোকামাকড় আটকে পড়ে, আর মাকড়শা তাদের খায়। বিজ্ঞানীরা অনেক বছর ধরে গবেষণা করে মাকড়শার জাল সম্পর্কে এমন সব বৈজ্ঞানিক তথ্য আবিষ্কার করেছেন যা অত্যন্ত চমকপ্রদ। মাকড়শার জালে রয়েছে একটুখানি জীববিজ্ঞান, একটুখানি রসায়ন এবং অনেকখানি পদার্থবিজ্ঞান।
মাকড়শার শরীরের নির্দিষ্ট গ্রন্থি থেকে জাল তৈরির তরল উপাদান বের হয়। বাতাসের সংস্পর্শে এসেই তা বিশেষ ধরণের সূক্ষ্ম সুতায় পরিণত হয় যা দিয়ে মাকড়শা জাল তৈরি করে। মাকড়শার গ্রন্থিগুলি শরীর থেকে প্রোটিন সংগ্রহ করে এই সুতার উপাদান বানায়। এই উপাদানের প্রক্রিয়াটা রসায়নের অন্তর্ভুক্ত। প্রোটিন মূলত অ্যামিনো এসিড যা কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনের রাসায়নিক শিকল। মাকড়শার জালের এই রাসায়নিক শিকল খুবই লম্বা। এই শিকল তৈরি হয় দুটো সবচেয়ে ছোট আকারের অ্যামিনো এসিড – অ্যালানিন (C3H7NO2) ও গ্লাইসিন (C2H5NO2)। অ্যালানিন কৃস্টাল আকারে একটার সাথে একটা খুব শক্তভাবে লেগে থাকে এবং জালের গঠনকে মজবুত করে। আর মাকড়শার জালের অত্যাশ্চর্য স্থিতিস্থাপকতা আসে গ্লাইসিন অণু থেকে। পরপর পাঁচটি গ্লাইসিন অণু আর তার সাথে অ্যালানিন যোগ হয়ে অনেকটা স্প্রিং-এর মতো কুন্ডলী পাকিয়ে লম্বা মজবুত জৈব-সুতা তৈরি হয়। এগুলিই মাকড়শার জালের উপাদান।
মাকড়শা তাদের জাল দিয়ে অনেক ধরনের কাজ করে। জালে আটকা পরা শিকারকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে নির্জীব করে ফেলার জন্য এক ধরনের সুতা। শিকার জালে পড়লে লাফিয়ে যেন চলে যেতে না পারে সেজন্য আরেক ধরনের সুতা, নিজের জাল থেকে নিজে যেন পড়ে না যায় সেজন্য নিরাপত্তা সুতা, জাল থেকে সুতা বেয়ে ঝুলতে ঝুলতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাবার জন্য এক ধরনের সুতা, বাসা বানানোর জন্য এক ধরনের সুতা, ডিম পাড়ার জন্য এক ধরনের সুতা, আবার বংশ-বৃদ্ধির জন্য সঙ্গীর সাথে মিলিত হবার জন্য বিশেষ ধরনের সুতা। মাকড়শা বিভিন্ন রাসায়নিক শিকলে প্রয়োজনমত অ্যামিনো এসিডের অনুপাত পরিবর্তন করে এসমস্ত বিভিন্ন ধরনের সুতা তৈরি করতে পারে। বিভিন্ন ধরনের সুতা তৈরির জন্য বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থি থাকে মাকড়শার শরীরে। শিকার ধরার জন্য যে সুতা তৈরি করে সেই সুতার স্থিতিস্থাপকতা এত বেশি যে স্বাভাবিক দৈর্ঘ্যের চেয়ে টেনে চারগুণ লম্বা করলেও এই সুতা ছিঁড়ে না। মাকড়শা জালের চারপাশে এবং মাঝখানে যে নিরাপত্তা সুতা ব্যবহার করে তাকে ড্র্যাগলাইন সিল্ক বলা হয়। মাকড়শাকে কেউ আক্রমণ করলে মাকড়শা এই মোটা সুতা বেয়ে পালায়। এই সুতাগুলিতে গ্লাইসিন অণু শিকলে পরপর আট থেকে নয় বার করে থাকে। ফলে এই সুতাগুলি টেনে শতকরা ৩০ ভাগ পর্যন্ত লম্বা করলেও ছিঁড়ে না। ইস্পাতের তারকেও টেনে এতদূর পর্যন্ত লম্বা করা যায় না। তার আগেই ইস্পাতের তার ছিঁড়ে যায়।
মাকড়শার জালের সুতা ইস্পাতের তারের চেয়েও শক্ত ও মজবুত তা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। কোন্ সুতা কত শক্ত তা হিসেব করার পদ্ধতি হলো সেটা কী পরিমাণ চাপ সহ্য করতে পারে তার উপর। এই চাপ হলো প্রতি একক ক্ষেত্রফলের উপর কী পরিমাণ বল প্রয়োগ করা হয় তার পরিমাণ। যে সুতা যত বেশি চাপ সহ্য করতে পারে সেই সুতা তত শক্ত। সবচেয়ে শক্ত ইস্পাতের তার দুই হাজার মেগা প্যাসকেল চাপ সহ্য করতে পারে। এর বেশি হলে ইস্পাতের তার ছিঁড়ে যায়। মাকড়শার জালের সুতাও এরকম বা এর চেয়ে বেশি চাপ সহ্য করতে পারে। ইস্পাত ও মাকড়শার জালের তুলনা করতে হলে আমাদের আরো কিছু ধর্মের তুলনা করতে হবে। ইস্পাতের ঘনত্ব মাকড়শার জালের ঘনত্বের চেয়ে অনেক বেশি। এক বর্গ মিলিমিটার প্রস্থচ্ছেদ বিশিষ্ট এক মিটার লম্বা স্টিলের তারের ভর প্রায় ৮ গ্রাম। অথচ একই প্রস্থচ্ছেদ ও এক মিটার লম্বা মাকড়শার জালের সুতার ভর মাত্র ১.৩ গ্রাম। ৮ গ্রাম ভরের এক মিটার লম্বা একটি স্টিলের তার ২০০০ নিউটন পর্যন্ত বল সহ্য করতে পারে। তার বেশি হলে ছিঁড়ে যায়। সেই একই পরিমাণ বল সহ্য করতে পারে মাত্র ১.৩ গ্রাম ভরের মাকড়শার জালের সুতা। এখন যদি ৮ গ্রাম ভরের মাকড়শার জাল নেয়া হয় – সেই সুতা ১২০০০ নিউটন অর্থাৎ ইস্পাতের তারের ছয়গুণ বল সহ্য করতে পারে।
মাকড়শার জালের চেয়েও বেশি শক্ত সুতা আছে। যেমন কার্বন ফাইবার প্রায় চার হাজার মেগা প্যাসকেল চাপ সহ্য করতে পারে। কিন্তু কার্বন ফাইবার শক্ত হলেও তেমন ঘাতসহ নয় বা মজবুত নয়। মজবুত বা টাফনেস মাপা হয় কীভাবে? টাফনেস হলো প্রতি একক ভরে কী পরিমাণ শক্তি শোষণ করেও টিকে থাকতে পারে। ইস্পাতের তার প্রতি কিলোগ্রামে চার হাজার জুল শক্তি শোষণ করেও টিকে থাকে থাকতে পারে। কার্বন ফাইবার প্রতি কিলোগ্রামে চল্লিশ হাজার জুল শক্তি শোষণ করে টিকে থাকতে পারে। কিন্তু মাকড়শার জাল প্রতি কিলোগ্রামে প্রায় এক লক্ষ চল্লিশ হাজার জুল শক্তি শোষণ করেও টিকে থাকতে পারে।
পরীক্ষা করে
দেখা গেছে মাকড়শার জাল অনেক উচ্চ-তাপমাত্রা (১৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) এবং অনেক নিম্ন তাপমাত্রা
(-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) সহ্য করতে পারে। বিজ্ঞানীরা আরো পরীক্ষা করে দেখেছেন যে বিভিন্ন
আকৃতির জালে বিভিন্ন ধরনের শব্দ-তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। অতিসম্প্রতি তাইওয়ানের বিজ্ঞানীরা
আবিষ্কার করেছেন যে মাকড়শার জালের উপাদান ব্যবহার করে জৈবকোষীয় লেন্স তৈরি করা সম্ভব।
জার্নাল অব অ্যাপ্লাইড ফিজিক্সে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে ট্যামক্যাং ইউনিভার্সিটি ও ইয়াং-মিং
ইউনিভার্সিটির গবেষকরা মাকড়শার জালের উপাদান থেকে লেন্স তৈরি করে সেখানে বিশেষ ধরনের
লেসার প্রয়োগ করে দেখেছেন যে এই লেন্স অত্যন্ত উচ্চ রেজ্যুলেশনের ইমেজ বা ছবি তৈরি
করতে সক্ষম। অদূর ভবিষ্যতে বিজ্ঞানের অনেক শাখায় মেকানিক্যাল ইমেজিং এর পরিবর্তে বায়োলজিক্যাল
ইমেজিং ব্যবহার করা হবে। মাকড়শার জাল থেকে তৈরি লেন্স সেখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করতে পারবে বলে আশা করা যায়। বুঝাই যাচ্ছে মাকড়শার জাল দেখতে নরম মনে হলেও
আসলে ইস্পাতের চেয়ে মজবুত, বৈজ্ঞানিকভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস।
তথ্যসূত্র:
1. Stephen D. Hudson, Vladimir Zhurov, Vojislava Grbic´, Miodrag Grbic´, and Jeffrey L. Hutter, 'Measurement of the elastic modulus of spider mite silk fibers using atomic force microscopy', J. Appl. Phys. 113, 154307 (2013); https://doi.org/10.1063/1.4800865
2. Marco Miniaci, Anastasiia Krushynska, Alexander B. Movchan, Federico Bosia, and Nicola M. Pugno, Spider web-inspired acoustic metamaterials, Appl. Phys. Lett. 109, 071905 (2016); https://doi.org/10.1063/1.4961307
3. A. Gliˇsovi´c, T. Salditt, Temperature dependent structure of spider silk by X-ray diffraction, Appl. Phys. A 87, 63–69 (2007), DOI: 10.1007/s00339-006-3849-9
4. Russ Swan, The Physics Behind, Cassell, UK, 2018. page 152-153.
_____________________
বিজ্ঞানচিন্তা আগস্ট ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত
No comments:
Post a Comment