Saturday 17 July 2021

ট্রাইবোলজি ও কলার খোসা

 

বিজ্ঞান আর কলার মধ্যে একটা চিরকালিন কলহের ব্যাপার আছে। আর্টিস্ট বা কলাবিদরা বিজ্ঞানীদের খুব একটা পাত্তা দেন না। আবার বিজ্ঞানীরাও কলাবিদ-বিদ্বজনদের যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলেন। এই দুই শ্রেণির মানুষের চিন্তাভাবনা আলাদা, কাজের ধরন আলাদা, এমনকি কাজের লক্ষ্যও আলাদা। বিজ্ঞানীদের মূল কাজ হলো অজানাকে জানা, প্রকৃতির জটিল বৈজ্ঞানিক রহস্য ভেদ করে তাকে সরল করে ফেলা। বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে কলাবিদরা যেখানে কল্পনার ফানুস ওড়ান, জটিল প্রকৃতির মহাকাব্য রচনা করেন - সেখানে বিজ্ঞানীরা দিনরাত গবেষণা করে মহাকাশের রহস্য উদ্ঘাটন করতে করতে প্রকৃতির জটিলতা নিরসন করেনসংক্ষেপে বলা চলে - বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য হলো জটিল ব্যাপারকে সহজ করা। আর অন্যদিকে কলাবিদদের প্রধান লক্ষ্য হলো সহজ ব্যাপারকে জটিল করা। বৃষ্টি পড়লে বিজ্ঞানীরা যেখানে বলেন, "বৃষ্টি পড়ছে", সেখানে কলাবিদরা গান ধরেন, 'বাদল বাউল বাজায় বাজায় বাজায় রে, বাজায় রে একতারা'। বিজ্ঞানীদের ব্যাপারে কলাবিদদের প্রধান অভিযোগ হলো - বিজ্ঞানীরা জীবনের সবকিছুতেই বৈজ্ঞানিক যুক্তি খোঁজেন। অভিযোগটা খুব একটা মিথ্যে নয়। কলা বললেই কলাবিদদের চোখে যেখানে শিল্পকলার নানা রূপ ফুটে উঠে, সেখানে বিজ্ঞানীরা কলা বলতে কলা-ই বোঝেন।

কলার পুষ্টিগুণ সম্পর্কে আমাদের কারো কোন সন্দেহ নেই। পুষ্টিবিজ্ঞানে কলার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু বিকিরণ পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে কলার গুরুত্ব অন্যরকম - কারণ কলায় সামান্য পরিমাণে তেজস্ক্রিয়তা আছে। কলায় তেজস্ক্রিয়তা আছে শুনেই আঁৎকে উঠার দরকার নেই। কারণ প্রাকৃতিকভাবেই কলায় কিছুটা তেজস্ক্রিয়তা আছে। এই তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ খুবই কম। 

কলার তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ বোঝানোর জন্য বিকিরণের আলাদা একটি একক তৈরি করা হয়েছে - বেনানা ইকুইভ্যালেন্ট ডোজ (BED)অর্থাৎ একটি কলায় যতটুকু তেজস্ক্রিয় বিকিরণ থাকে ততটুকু। ঠিক কতটুকু তেজস্ক্রিয় বিকিরণ থাকে একটি কলায়? গড়পড়তা একটি কলায় এক মাইক্রোসিভার্টের দশ ভাগের এক ভাগ বিকিরণ থাকে। 

শরীরের কোন অঙ্গের এক্স-রে করালে শরীরে বিকিরণ ঢোকে। একটি বুকের এক্স-রে থেকে বিশ মাইক্রোসিভার্ট বিকিরণ ঢোকে আমাদের শরীরে। তার মানে বুকের একটি এক্স-রের বিকিরণ ২০০টি কলার বিকিরণের সমান। বুকের সিটি-স্ক্যান করালে শরীরে বিকিরণ ঢোকে প্রায় সাত হাজার মাইক্রোসিভার্ট বা সাত মিলিসিভার্ট, অর্থাৎ প্রায় সত্তর হাজার কলার মোট বিকিরণের সমান। 

আমেরিকা তাদের সীমান্ত দিয়ে তেজস্ক্রিয় পদার্থের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার জন্য চেক পয়েন্টে রেডিয়েশন মনিটর বসিয়েছে। মেক্সিকো থেকে যখন ট্রাকভর্তি কলা ঢোকে - তখন রেডিয়েশন মনিটরে কলার মোট তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা দেখলে সত্যিই আঁৎকে উঠতে হবে।

কলার তেজস্ক্রিয়তার উৎস কী? কলায় পটাশিয়াম আছে। প্রতি ১০০ গ্রাম কলায় ৩৫৮ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম আছে। পটাশিয়ামের তিনটি আইসোটোপ আছে। পটাশিয়াম-৩৯, পটাশিয়াম-৪০ আর পটাশিয়াম-৪১। পটাশিয়াম-৩৯ ও পটাশিয়াম-৪১ নিউক্লিয়াস মোটামুটি স্থায়ী, অর্থাৎ তারা তেজস্ক্রিয় নয়। কিন্তু পটাশিয়াম-৪০ নিউক্লিয়াস অস্থায়ী, অর্থাৎ তেজস্ক্রিয়। কলায় পটাশিয়াম-৪০ আছে, এবং সেটাই তার তেজস্ক্রিয়তার উৎস। পটাশিয়াম-৪০ নিউক্লিয়াসের তেজস্ক্রিয়তা খুবই দীর্ঘস্থায়ী। এর হাফ-লাইফ বা অর্ধায়ু ১২৫ কোটি বছর। অর্থাৎ একটি কলার ভেতর যতটুকু পটাশিয়াম-৪০ নিউক্লিয়াস আছে, ১২৫ কোটি বছর লাগবে তার অর্ধেক পরিমাণ ক্ষয় হতে। 

আমাদের মধ্যে অনেকেরই রেডিয়েশান ফোবিয়া বা  বিকিরণ-ভীতি আছে। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের কথা শুনলেই তারা আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। তারা হয়তো বলবেন, 'কলা থেকে দূরে থাকুন'। কিন্তু কলায় যতটুকু পটাশিয়াম আছে তার চেয়ে অনেক বেশি পটাশিয়াম আছে আলুতে। প্রতি ১০০ গ্রাম আলুতে ৬৫০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম আছে। মিষ্টিকুমড়ার বিচিতে পটাশিয়াম আছে আরো বেশি - প্রতি ১০০ গ্রামে ৯১৯ মিলিগ্রাম। 

তাহলে শুধুমাত্র কলাকে আমরা তেজস্ক্রিয় বলছি কেন? আসলেই তাই, শুধু কলা নয়, আলুও প্রাকৃতিকভাবে তেজস্ক্রিয়। শুধু তাই নয়, আমাদের সবার শরীরই কমবেশি তেজস্ক্রিয়। প্রাণিকোষের শক্তির জোগান আসে সোডিয়াম-পটাশিয়াম মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে। ৭০ কিলোগ্রাম ভরের কোন মানুষের শরীরে প্রায় ১৫০ গ্রাম পরিমাণ পটাশিয়াম থাকে। আমাদের শরীর থেকে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৪৪০০ পরমাণু তেজস্ক্রিয় পটাশিয়াম-৪০ নির্গত হচ্ছে। তেজস্ক্রিয়তার ভয়ে নিজের শরীর ছেড়ে পালানোর কোন উপায় নেই আমাদের।

কলার বিজ্ঞানে ফিরে আসি। আমরা সবাই জানি কলার খোসায় পা পড়লে 'পা পিছলে আলুর দম' হবার সম্ভাবনা প্রবল। তাই কলার খোসা থেকে আমরা সাবধানে থাকি। জেনেশুনে আমরা কেউ কলার খোসায় পা দিই না। কলার খোসা প্রচন্ড পিচ্ছিল - এমন পিচ্ছিল যে গাড়ির চাকাও পিছলে যায় এর উপর। 

কলার খোসা এত পিচ্ছিল কেন? বিজ্ঞানের যে শাখায় এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে সেই শাখার নাম ট্রাইবোলজি। ট্রাইবোলজি হলো বিজ্ঞানের একটি বিশেষ শাখা যেখানে পদার্থের ঘর্ষণ, মসৃণতা ও পিচ্ছিলতা সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা করা হয়। 

মানুষের কারিগরী দক্ষতা অর্জনের শুরু থেকেই মানুষ ট্রাইবোলজির ধর্মগুলো পর্ববেক্ষণ এবং ব্যবহার করে আসছে। বরফের মসৃণ তলের উপর দিয়ে কোন ভারী মসৃণ তলের বস্তু ঠেলে দিলে খুব সহজেই তা গড়িয়ে যায়। আবার খসখসে কঠিন তলের উপর দিয়ে আরেকটি খসখসে তলের বস্তু ঠেলে নিয়ে যেতে হলে অনেক বেশি শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। 

প্রাচীন মিশরীয়রা পিরামিড তৈরি করার জন্য বিশালাকৃতির পাথর ঠেলে নিয়ে গেছে পাথরের উপর পিচ্ছিল তরল ঢেলে দিয়ে। যে কোন মেশিনে পিচ্ছিল গ্রিজ বা তেল ব্যবহার করা হয় ঘর্ষণজনিত শক্তির অপচয় রোধ করার জন্য। আবার গাড়ি চলার রাস্তায় যদি যথেষ্ট ঘর্ষণ না থাকে তাহলে গাড়ি চালানোই দুরুহ হয়ে পড়ে। 

পদার্থের মসৃণতা সংক্রান্ত ব্যাপারগুলোর বৈজ্ঞানিক হিসেবনিকাশ করার জন্য আলাদা বিজ্ঞান "ট্রাইবোলজি" প্রথম শুরু করেছিলেন ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী ডেভিড ট্যাবর ১৯৬৫ সালে। ট্রাইবোলজি শব্দটি নেয়া হয়েছে গ্রিক শব্দ "ট্রাইব" থেকে। ট্রাইব শব্দের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে - 'আমি ঘষি'।

 কলার খোসা কেন এত পিচ্ছিল এই প্রশ্নের উত্তর প্রথম জানা যায় জাপানের বিজ্ঞানী কিয়োশি মাবুচি'র গবেষণা থেকে। ২০১২ সালে কিতাসাতো বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিজ্ঞানী ও তাঁর দল ট্রাইবোলজির সাহায্যে কলার খোসার পিচ্ছিলতার পরিমাণ নির্ণয় করেন। 

কোন পদার্থ কত পিচ্ছিল তা নির্ভর করে তার 'কোএফিশিয়েন্ট অব ফ্রিকশান' বা 'ঘর্ষণাঙ্ক'র উপর। ধরা যাক বসার ঘরের সোফাটা কার্পেটের উপর দিয়ে ঠেলে সোজা করে বসাতে হবে। সোফার ভর যদি ত্রিশ কিলোগ্রাম হয়, এবং কার্পেটের উপর দিয়ে তাকে ঠেলে নিয়ে যেতে যদি ১০ কিলোগ্রামের সমতুল্য বল প্রয়োগ করতে হয় - তাহলে কার্পেটের উপর সোফার ঘর্ষণাঙ্ক হবে ১০/৩০ বা ০.৩৩। 

কার্পেটের বদলে সোফাটি যদি মসৃণ টাইলসের উপরে থাকে, তাহলে অনেক কম বল প্রয়োগ করেই সোফাটি সরানো যাবে। ধরা যাক ৩ কিলোগ্রামের সমতুল্য বল প্রয়োগ করেই সোফাটি সরানো যাবে। সেক্ষেত্রে টাইলসের উপর সোফার ঘর্ষণাঙ্ক হবে ৩/৩০ বা ০.১। দেখা যাচ্ছে দুটো তলের মধ্যে ঘর্ষণাঙ্কের মান যত কম হবে তল দুটো তত মসৃণ হবে। জমাট বরফের তলের উপর আরেকটি জমাট বরফের মধ্যে ঘর্ষণাঙ্কের মান মাত্র ০.০২। বিজ্ঞানী কিয়োশি মাবুচি পরীক্ষা করে দেখেছেন - রাবারের উপর কলার খোসার ঘর্ষণাঙ্ক মাত্র ০.০৭। এই ঘর্ষণাঙ্কের মান পিচ্ছিল গ্রিজ মাখানো ধাতব তলের উপর যে কোন ধাতুর ঘর্ষণাঙ্কের চেয়েও কম। অর্থাৎ কলার খোসা গ্রিজ মাখানো ধাতব তলের চেয়েও পিচ্ছিল। 

অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখা গেছে কলার খোসার ভেতরের দিকে অসংখ্য ছোট ছোট গুটির মত আছে - যেখানে জমা থাকে প্রচুর কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিন। (তার মানে কলার খোসাতেও উপকারি খাদ্যোপাদান আছে)। রাস্তায় কলার খোসায় যখন আমাদের পা পড়ে তখন খোসার এই গুটিগুলো থেকে কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিন বের হয়ে রাস্তা ও খোসার উপরের ত্বকের ভেতর খুবই পিচ্ছিল জেল জমা হয়ে যায় - যা রাস্তার সাথে আমাদের পায়ের ঘর্ষণাঙ্কের মান খুবই কমিয়ে দেয়। তখন পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে। 

__________

বিজ্ঞানচিন্তা আগস্ট ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত




No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts