Wednesday 28 July 2021

মহাবিশ্ব - নোবেল পদার্থবিজ্ঞান পুরষ্কার ২০১৯

 *


মহাবিশ্ব কত বড় সে সম্পর্কে ধারণা করতে গেলে আমাদের কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়। কারণ আমাদের চোখ এই মহাবিশ্বের খুব সামান্য অংশই দেখতে পায়। মহাবিশ্বে কমপক্ষে ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি গ্যালাক্সি আছে। প্রত্যেকটি গ্যালাক্সিতে আছে কমপক্ষে ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি নক্ষত্র।  এই নক্ষত্রগুলোর প্রত্যেকটিকে ঘুরছে তাদের নিজেদের গ্রহ এবং উপগ্রহগুলি। এরকম খুবই সাধারণ একটি নক্ষত্র হলো আমাদের সূর্য। আমাদের সৌরজগতের যে আয়তন -সেটাই আমরা ঠিকমত ধারণা করতে পারি না, সেরকম কোটি কোটি সৌরজগতের আয়তন যোগ করলে হবে মহাবিশ্বের আয়তন। এই বিশাল মহাবিশ্বের অতিক্ষুদ্র একটি অংশ হলো আমাদের পৃথিবী। এই পৃথিবীর মানুষ আজ একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান ও কারিগরী দক্ষতায় পৌঁছে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। আমরা আজ মহাকাশযান পাঠাচ্ছি সৌরজগৎ ছাড়িয়ে অন্য নক্ষত্রলোকে, অসম্ভব শক্তিশালী টেলিস্কোপের সাহায্যে আমরা প্রত্যক্ষ করছি অন্য গ্যালাক্সির কার্যক্রম। আমরা আজ জানি যে সময়ের সাথে সাথে এই মহাবিশ্ব বিশাল থেকে বিশালতর হচ্ছে। কিন্তু একটা মৌলিক প্রশ্ন থেকেই যায় - এই মহাবিশ্বের শুরু কোথায়, আর শেষই বা কোথায়? 

সেই আদিযুগ থেকেই মানুষ মহাবিশ্বের গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করছে। শুরুতে কোন ধরনের যন্ত্রপাতি ছাড়াই শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মানুষ চন্দ্র-সূর্য এবং অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রের ধর্মাবলি সম্পর্কে জেনেছে। বলা চলে পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে পুরনো শাখা হলো জ্যোতির্বিদ্যা বা অ্যাস্ট্রোনমি - যা গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি সংক্রান্ত বিজ্ঞান। কিন্তু মানুষ আরো গভীরে গিয়ে যখন থেকে প্রশ্ন করতে শিখেছে - এই যে সৌরজগত এবং আকাশজুড়ে অসংখ্য নক্ষত্রপুঞ্জ তাদের মধ্যে সম্পর্ক কী? কোন্‌ বৃহৎ কাঠামোয় সব এক সুতোয় বাঁধা? সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য গড়ে উঠেছে কসমোলজি - মহাবিশ্বের বিজ্ঞান।

আধুনিক কসমোলজি মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও ক্রমবিবর্তন বুঝতে সাহায্য করার পাশাপাশি পদার্থ ও শক্তির নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে পর্যবেক্ষণ  বা অরজারভেশনাল কসমোলজির বিকাশ শুরু হতে থাকে টেলিস্কোপের সাহায্যে মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দক্ষতা বৃদ্ধির সাথে সাথে টেলিস্কোপের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে, মানুষ মহাকাশযান পাঠিয়েছে মহাকাশে, এবং প্রচুর উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। এই উপাত্তগুলোকে তত্ত্বীয় কাঠামোয় বিশ্লেষণ করার জন্য গড়ে উঠলো ভৌত বা ফিজিক্যাল কসমোলজি। ফিজিক্যাল কসমোলজির অন্যতম স্থপতি অধ্যাপক জেমস পিবলস - এবছরে পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার পুরষ্কার পেয়েছেন। পুরষ্কারে অর্থমূল্যের অর্ধেক পাবেন তিনি। তাঁর জন্ম ১৯৩৫ সালে কানাডার উইনিপেগ  শহরে। ১৯৬২ সালে তিনি পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন আমেরিকার প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে। বর্তমানে তিনি সেখানকার আলবার্ট আইনস্টাইন প্রফেসর অব সায়েন্স।


২০১৯ সালের নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী জেমস পিবল্‌স, ডিডিয়ের কুলে এবং মিশেল মেয়র। (ছবি বিবিসির সৌজন্যে)


আমাদের সৌরজগতের বাইরেও অন্যান্য নক্ষত্রগুলোকে ঘিরে রয়েছে তাদের নিজেদের গ্রহ-উপগ্রহগুলো। আমাদের সৌরজগতের বাইরে অন্যান্য নক্ষত্রগুলোর গ্রহকে বলা হয় এক্সোপ্লেনেট। ১৯৯৫ সালের ৬ অক্টোবর সুইজারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব জেনিভার দু'জন জ্যোতির্বিজ্ঞানী মিশেল মেয়র এবং ডিডিয়ের কুলে (Queloz) আবিষ্কার করলেন প্রথম এক্সোপ্লেনেট। তাঁরা যার নাম দিয়েছিলেন - ৫১ পেগাসি বি। ২০১৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন এই গ্রহটির নাম দেয় ডিমিডিয়াম (Dimidium)। ল্যাটিন শব্দ ডিমিডিয়াম-এর অর্থ - অর্ধেক। ৫১ পেগাসি বি গ্রহের ভর বৃহস্পতি গ্রহের ভরের অর্ধেক বলেই এই নাম দেয়া হয়েছে। মিশেল মেয়র ও ডিডিয়ের কুলে'র প্রথম এক্সোপ্লেনেট আবিষ্কারের পর জ্যোতির্বিজ্ঞানে নতুন বিপ্লব ঘটে যায়। একের পর এক এক্সোপ্লেনেট আবিষ্কৃত হতে থাকে। এপর্যন্ত আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কিওয়েতে আবিষ্কৃত হয়েছে চার হাজারেরও বেশি এক্সোপ্লেনেট। প্রথম এক্সোপ্লেনেট আবিষ্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ এবছরের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন মিশেল মেয়র ও ডিডিয়ের কুলে। পুরষ্কারের মোট অর্থের ৫০% এর সমান অংশীদার তাঁরা। মিশেল মেয়রের জন্ম ১৯৪২ সালে সুইজারল্যান্ডের লুসানে। ১৯৭১ সালে ইউনিভার্সিটি অব জেনিভা থেকে পিএইচডি করেছেন। বর্তমানে সেখানকার অধ্যাপক। ডিডিয়ের কুলের জন্ম ১৯৬৬ সালে। ১৯৯৫ সালে পিএইচডি করেছেন ইউনিভার্সিটি অব জেনিভা থেকে। এখন তিনি সেখানকার প্রফেসর, আবার কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিরও প্রফেসর।

কসমোলজির তত্ত্বীয় ভিত্তি গড়ে উঠেছে জেমস পিবলের হাত দিয়ে। ১৯৬০এর দশকে তিনি গবেষণা শুরু করেছিলেন। তারপর গত ৫৯ বছর ধরে তিনি নিরলস গবেষণা চালিয়ে গেছেন এই বিষয়ে। ১৯৭১ সালে তাঁর ফিজিক্যাল কসমোলজি বই প্রকাশিত হবার পর অনেকেই এই বিষয়ে তত্ত্বীয় এবং পরীক্ষণ গবেষণায় উদ্বুদ্ধ হন। ১৯২০ সালের আগে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন যে মহাবিশ্ব স্থির। অর্থাৎ যে মহাবিশ্ব আমরা গতকাল দেখেছি, আজকেও তা দেখছি, আগামীকালও তাই দেখবো। কিন্তু ১৯২০ সালের পর বিজ্ঞানীরা যখন আবিষ্কার করলেন যে গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর দূরে সরে যাচ্ছে - স্থির মহাবিশ্বের ধারণা বদলে গেলো। এখন আমরা জানি - যে মহাবিশ্বকে আজ দেখছি, আগামীকাল তা বদলে যাবে। জেমস পিবল কসমোলজিতে একটি সমন্বিত গাণিতিক মডেল দাঁড় করিয়েছেন যেটা দিয়ে মহাবিশ্বের শুরু থেকে বর্তমান এবং বর্তমান থেকে ভবিষ্যৎ পর্যন্ত সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।

১৯১৬ সালে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব বা জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটিই এখন মহাবিশ্বের বৃহৎ কাঠামোর হিসাব-নিকাশের মূল ভিত্তি। আধুনিক কসমোলজিতে মহাবিশ্বের শুরু বিগ ব্যাং থেকে। বিগ ব্যাং-এর শুরুতে মহাবিশ্ব ছিল প্রচন্ড উত্তপ্ত এবং ঘনত্ব ছিল অত্যন্ত বেশি। প্রচন্ড তাপমাত্রায় পুরো মহাবিশ্বের গঠন ছিল তরল ঘন স্যুপের মত - যেখানে সমস্ত কণা বিচ্ছিন্নভাবে লাফালাফি করছিল। চার লক্ষ বছর ধরে ঠান্ডা হতে হতে তাপমাত্রা তিন হাজার ডিগ্রি কেলভিনে নেমে এলো। তখন ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে তৈরি হলো পরমাণু। শুরুতে হলো হাইড্রোজেন হিলিয়াম ইত্যাদি, পরে আরো ভারী পরমাণু। কোন চার্জিত কণা অবশিষ্ট রইলো না। অচার্জিত কণা ফোটন রয়ে গেলো আলাদা হয়ে। আলোর কণা ফোটন কোন বাধা ছাড়াই মহাবিশ্বের সবখানে ছুটে বেড়াতে লাগলো। এই আলো মহাবিশ্বের সবখানে ছড়িয়ে পড়লো। মহাবিশ্ব যখন প্রসারিত হলো আলোর তরঙ্গও প্রসারিত হয়ে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে গেলো, শক্তি গেলো কমে। ফলে দৃশ্যমান আলো হয়ে গেলো অদৃশ্য মাইক্রোওয়েভ। কসমোলজিতে এই আলোক-বিকিরণ কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে পরিচিত।

এই কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড সর্বপ্রথম শনাক্ত করেন দুজন আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্নো পেনজিয়াস ও রবার্ট উইলসন ১৯৬৪ সালে। এই আবিষ্কারের জন্য তাঁরা দু'জন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন ১৯৭৮ সালে। পেনজিয়াস ও উইলসন তাঁদের আবিষ্কারের তত্ত্বীয় ভিত্তির জন্য নির্ভর করেছিলেন এবছরের নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী জেমস পিবলের পেপারের উপর। জেমস পিবল সেই সময় এই ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশানের তত্ত্বীয় হিসাব করেছিলেন। পিবল অনুধাবন করলেন যে ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশানের তাপমাত্রা থেকে বিগ-ব্যাং-এ কী পরিমাণ পদার্থ সৃষ্টি হয়েছিল তা বের করা যায়। শুধু তাই নয়, এটাও বুঝতে পারলেন যে এই কসমিক লাইট গ্যালাক্সিগুলো সৃষ্টির সময় ভূমিকা রেখেছে। মহাবিশ্বে মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশান আবিষ্কার আধুনিক কসমোলজির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করলো। এর সাহায্যে হিসেব করা গেলো মহাবিশ্বের বয়স, মহাবিশ্বের ভবিষ্যত, মহাবিশ্বে কী পরিমাণ পদার্থ ও শক্তি আছে ইত্যাদি।

মহাবিশ্বের কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড খুঁজে বের করার লক্ষ্যে  ১৯৮৯ সালের ১৮ নভেম্বর পৃথিবীর কক্ষপথে পাঠানো হয় কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড এক্সপ্লোরার (COBE) স্যাটেলাইট। ১৯৯২ পর্যন্ত ডাটা সংগ্রহ করে এই স্যাটেলাইট। ১৯৯২ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত হয় COBE স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশান থেকে তৈরি আদি মহাবিশ্বের ছবি। এই আবিষ্কারের জন্য COBE প্রকল্পের বিজ্ঞানী জন মাথির ও জর্জ স্মুট পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ২০০৬ সালে। কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশানের তাপমাত্রা মাপার লক্ষ্যে ২০০১ সালের ৩০ জুন মহাকাশে পাঠানো হয় আরেকটি স্যাটেলাইট উইলকিনসন মাইক্রোওয়েভ অ্যানাইসোট্রপি প্রোব (WMAP)। ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মহাকাশে মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশানের তাপমাত্রার পার্থক্য মাপে এই স্যাটেলাইট। এই তাপমাত্রার পার্থক্য এক ডিগ্রি কেলভিনের এক লক্ষ ভাগের একভাগ। এখান থেকে মহাবিশ্বের মোট শক্তি ও পদার্থের পরিমাণ হিসেব করে দেখা যাচ্ছে যে মহাবিশ্বের শতকরা ৯৫ ভাগ শক্তি ও পদার্থ আমরা দেখতে পাই না। এই শক্তি ও পদার্থ হলো ডার্ক এনার্জি ও ডার্ক ম্যাটার।

ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি কসমোলজির জন্য এখনো সবচেয়ে বড় রহস্য। বিজ্ঞানীরা অনেকদিন থেকে বিশ্বাস করে আসছিলেন যে নিউট্রিনোগুলো হয়তো ডার্ক ম্যাটার বহন করছে। কিন্তু কম-ভরের নিউট্রিনোগুলোর গতি প্রায় আলোর গতির সমান - এবং এই গতিতে ডার্ক ম্যাটার ধরে রাখা সম্ভব নয়। ১৯৮২ সালে জেমস পিবল প্রস্তাব করলেন ভারী এবং ধীর গতিসম্পন্ন ঠান্ডা ডার্ক ম্যাটারের কণা এই রহস্যের সমাধান করতে পারে। তিনি হিসেব করে দেখিয়েছেন মহাবিশ্বের প্রায় ২৬% এই ঠান্ডা ডার্ক ম্যাটারের কণার দখলে। কিন্তু এখনো এই কণার সন্ধান মেলেনি। এখন সারাপৃথিবীতে অনেকগুলো বৈজ্ঞানিক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে ডার্ক ম্যাটার খুঁজে বের করার লক্ষ্যে।

যদিও মাত্র শতকরা ৫% পদার্থ ও শক্তির সন্ধান আমরা পেয়েছি বিগ বিং-এর হিসেব অনুসারে, তবুও বিজ্ঞানীরা একমত যে মহাবিশ্বের শুরু হয়েছে বিগ ব্যাং-এর মধ্য দিয়ে। সৌরজগতে সূর্যের চারপাশে যেরকম গ্রহগুলো ঘুরছে - সেরকম গ্যালাক্সির আরো দশ হাজার কোটি নক্ষত্রের প্রত্যেককে কেন্দ্র করে ঘুরছে তাদের গ্রহগুলো - যারা আমাদের এক্সোপ্লেনেট। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এখন একের পর এক নতুন নতুন  এক্সোপ্লেনেট আবিষ্কার করছেন। এপর্যন্ত চার হাজারেরও বেশি এক্সোপ্লেনেট আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু ১৯৯৫ সালের মিশেল মেয়র এবং ডিডিয়ের কুলে যখন প্রথম এক্সোপ্লেনেট  ৫১ পেগাসি বি আবিষ্কার করলেন - কেউ বিশ্বাসই করতে চাইলেন না। কারণ গ্রহটি অনেক বেশি বড় এবং খুব নক্ষত্রের খুব বেশি কাছে।

১৯৯৫ সালের ৬ অক্টোবর ইতালির ফ্লোরেন্সে এক কনফারেন্সে মিশেল মেয়র ও ডিডিয়ের কুলে ঘোষণা করলেন যে তাঁরা একটি এক্সোপ্লেনেট আবিষ্কার করেছেন। সৌরজগতের বাইরে ওটাই প্রথম গ্রহ। নাম দেয়া হয়েছে - ৫১ পেগাসি বি। নক্ষত্র ৫১ পেগাসির চারপাশে ঘুরছে বলেই এই নাম দেয়া হয়েছে। পৃথিবী থেকে এই গ্রহের দূরত্ব ৫০ আলোকবর্ষ। তার মানে ওখান থেকে আলো পৃথিবীতে আসতে সময় লাগে ৫০ বছর। মাত্র চারদিনে এই গ্রহটি তার নক্ষত্রের চারপাশে একবার ঘুরে আসে। তার মানে সেই গ্রহের এক বছর হলো পৃথিবীর চার দিনের সমান। গ্রহটি তার নক্ষত্র থেকে মাত্র ৮০ লক্ষ কিলোমিটার দূরে। নক্ষত্রের এত কাছে বলে গ্রহটির তাপমাত্রা প্রায় ১০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই গ্রহটির আয়তন বিশাল। আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতি। ৫১ পেগাসি বি আয়তনে বৃহস্পতি গ্রহের দ্বিগুণ। এত বড় একটা গ্রহ নক্ষত্রের এত কাছে! এতদিন ধারণা ছিল বড় গ্রহগুলো সূর্য থেকে দূরে উৎপন্ন হয় এবং দূরেই থাকে। কিন্তু ৫১ পেগাসি বি সে ধারণা অনেকটা বদলে দেয়। এখন বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে বড় গ্রহগুলো দূরে উৎপন্ন হওয়ার পরেও কোটি বছর পর কালের পরিক্রমায় কাছে চলে আসতে পারে।

 

৫১ পেগাসি-বি'র অবস্থান (ছবি - spokesman.com)

অবিশ্বাস্য মনে হলেও আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী পল বাটলার ও জেফ্রি মারসি তাঁদের টেলিস্কোপ তাক করলেন ৫১ পেগাসি বি-এর দিকে এবং তারাও দেখতে পেলেন। এতদিন বিজ্ঞানীরা চিন্তাও করেননি যে নক্ষত্রের এত কাছে গ্রহ থাকবে। অচিরেই একের পর এক এক্সোপ্লেনেট আবিষ্কার হতে লাগলো। এখন শুধুমাত্র পৃথিবীর টেলিস্কোপ থেকে নতুন গ্রহ আবিষ্কৃত হচ্ছে তা নয়, স্যাটেলাইট থেকেও আবিষ্কৃত হচ্ছে নতুন গ্রহ। ২০০৯ সালের ৭ মার্চ মহাকাশে এক্সোপ্লেনেট খুঁজে বের করার জন্য পাঠানো হয়েছিল কেপলার স্পেস টেলিস্কোপ। ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে ২,৩০০ এক্সোপ্লেনেট আবিষ্কার করেছে এই টেলিস্কোপ। ২০১৮ সালের ১৮ এপ্রিল মহাকাশে পাঠানো হয়েছে ট্রানজিটিং এক্সোপ্লেনেট সার্ভে স্যাটেলাইট (TESS)। আমাদের গ্যালাক্সির দুই লক্ষাধিক নক্ষত্রের দিকে চোখ রাখছে এই স্যাটেলাইট নতুন গ্রহের সন্ধানে। সৌরজগতের বাইরের গ্রহগুলোর আকার, আকৃতি, কক্ষপথ বিভিন্ন রকমের। এখন বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে এই এক্সোপ্লেনেটগুলোতে প্রাণের সন্ধান করার জন্য।

এবছরের নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানীরা মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণা বদলে দিতে সাহায্য করেছেন। জেমস পিবলস তাঁর তত্ত্বীয় গবেষণার সাহায্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন বিগ ব্যাং-এর পর মহাবিশ্ব কীভাবে বর্তমান রূপ লাভ করেছে তা বুঝতে। মিশেল মেয়র ও ডিডিয়ের কুলে আমাদের গ্যালাক্সির অন্যান্য নক্ষত্রজগত জরিপ করে নতুন গ্রহ আবিষ্কারের পথ দেখিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছেন। 

___________________

* এই ছবিটি নেয়া হয়েছে ক্রিয়েটিভ কমন্‌স লাইসেন্স এর আওতাভুক্ত pixabay.com ওয়েবসাইট থেকে।
 ____________________

বিজ্ঞানচিন্তা অক্টোবর ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত






No comments:

Post a Comment

Latest Post

অলিভিয়া নিউটন-জন

  কাজের সুবাদে মাঝে মধ্যে যেতে হয় অস্টিন হাসপাতালে। ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ সেখানে ক্লিনিক্যাল কাজকর্ম শেখে, আবার অনেকেই পাস কর...

Popular Posts