স্বপ্নলোকের চাবি – ২৮
রেড বিল্ডিং-এর সিঁড়ির ধাপগুলিকে আজ আগের চেয়েও বেশি উঁচু মনে হচ্ছে। সিঁড়িতে প্রচুর ময়লা। দোতলা পর্যন্ত কিছুটা সহনীয় মাত্রায় থাকলেও – দোতলা থেকে তিন তলায় উঠার সিঁড়িতে পা দিয়েই মনে হলো এই সিঁড়ি ঝাড়ুর স্পর্শ পায়নি অনেকদিন। ময়লা সহ্য করা সম্ভবত আমাদের সংস্কৃতির অংশ। নইলে এই বিল্ডিং-এর তিন তলায় কমপক্ষে তিরিশ জন্ কলেজপড়ুয়া ছেলে থাকে – যাদের মধ্যে কমপক্ষে বিশ জন বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স করছে। দিনের মধ্যে অনেকবার তারা এই সিঁড়ি বেয়ে উঠানামা করে। তারা এই ময়লা সহ্য করে কীভাবে? আমি জানি কাউকে এব্যাপারে একটা কথা বললেই আমাকে দশটা কথা শুনিয়ে দেবে। বলবে - “এখানে কি সুইপার আছে?”
হ্যাঁ, এটা ঠিক যে কলেজের সুইপাররা দোতলা পর্যন্ত নিজেদের খেয়ালখুশি অনুযায়ী পরিষ্কার করলেও, তিন তলার দিকে ফিরেও তাকায় না। তিনতলায় ছাত্রদের থাকার জন্য অস্থায়ী ছাত্রাবাস করা হলেও সেখানে কোন ধরনের সুযোগসুবিধা নেই। নিচের তলায় বিএনসিসির অফিস, পোস্ট অফিসসহ কলেজের আরো কয়েকটি কার্যালয়। দোতলায় ভূগোল বিভাগের ক্লাস চলে। তিন তলায় এতগুলি ছাত্রের বাস। এই পুরো বিল্ডিং-এর নিচের তলায় একটিমাত্র টয়লেট। কোন বাথরুম নেই। বিল্ডিং-এর একপাশে বাইরে একটা পানির ট্যাপ লাগানো আছে। সেখানেই খোলা জায়গায় গোসল করে সবাই।
কলেজে সরকারিভাবে মানুষের অভাব নেই। কলেজের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সমিতি অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। তাদের নেতারা যখন-তখন ধর্মঘটের ডাক দেয়। অথচ তাদের কাজের কোন জবাবদিহিতা আছে বলে মনে হয় না। রেড বিল্ডিং-এর পাশেই কলেজের সরকারি জায়গায় তাদের সারি সারি কোয়ার্টার আছে। সেখানে তারা আশেপাশের আরো অনেক জায়গা দখল করে নতুন ঘর তুলে সেই ঘর ভাড়াও দিয়েছে বাইরের মানুষের কাছে।
তিন তলার ছেলেরা তাদের রুমের ভেতরটা যে যেভাবে পারে – হয়তো পরিষ্কার করে রাখে। কেউ কেউ কমন বারান্দাও হয়তো ঝাড় দেয় কোন কোনদিন স্বেচ্ছাসেবী হয়ে। কিন্তু সিঁড়ির ব্যাপারে সবাই কেমন যেন উদাসীন। এই ব্যাপারটা আমি কয়েকটা বাসাতেও দেখেছি। তিন চারতলা বাড়ি, অনেক পরিবারের বাস, প্রত্যেকের বাসার ভেতরটা কত সুন্দর পরিচ্ছন্ন পরিপাটি। কিন্তু সিঁড়িতে দেখা যায় – সিগারেটের টুকরো, পানের পিক, জমাট থুতু। আধুনিক মানুষ শ্রেণিভেদের বিরুদ্ধে কত সুন্দর সুন্দর কথা বলে। অথচ ময়লা পরিষ্কার করার ব্যাপার এলে সবাই ঝাড়ুদারশ্রেণির লোক খোঁজে।
“আঁহ্, হরি- হরি-“– একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাসের সাথে ইষ্টনাম
জপ করার শব্দ শুনে পিছন ফিরে তাকালাম। সিঁড়ির নিচের ধাপে পানিভর্তি বালতি হাতে একজন
মানুষ। পায়ের কাছে আরেকটি বালতি রাখা। বোঝাই যাচ্ছে মানুষটি দুই বালতি পানি নিয়ে উপরে
উঠছেন। উপর থেকে নিচের দিকে তাকালে মানুষের উচ্চতা ঠিক বোঝা যায় না। তবুও মনে হলো মানুষটি
অনেক লম্বা। মুখ-মাথা চাদরে ঢাকা। পরনের লুঙ্গি প্রায় হাঁটু পর্যন্ত উঠে গেছে। অনেক
লম্বা মানুষের জন্য উপযুক্ত লুঙ্গি মনে হয় পাওয়া যায় না সহজে। হঠাৎ মনে হলো - প্রাণেশদা
না কি? ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। এখনো সকালের অন্ধকার ঠিকমতো কাটেনি। সূর্য উঠে গেছে
– কিন্তু কুয়াশার আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে পুবাকাশের নিচের দিকে কোথাও। এত সকালে এখানে এসেছি
প্রাণেশদার খোঁজে। আর প্রাণেশদা সিঁড়িতে পানির বালতি হাতে আমার পেছনে পেছনে তিন তলায়
উঠছেন! এরকম কিছু কল্পনা করতে গিয়েই মনে হলো – প্রাণেশদা ‘হরি হরি’ বলার লোক নন। খুব
বেশি হলে তিনি ভগবান বুদ্ধের নাম নিতে পারেন।
আরো ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলাম। মানুষটি অনেক বয়স্ক। পাতলা শরীরে
শক্তি খুব বেশি নেই তা বোঝা যাচ্ছে। দুই হাতে দুইটি পানিভর্তি বালতি নিয়ে এই খাড়া সিঁড়ি
বেয়ে দোতলা পর্যন্ত উঠে আসতে গিয়ে তিনি হাঁপাচ্ছেন। এখন সিঁড়িতে বালতি রেখে একটু জিরিয়ে
নিচ্ছেন। আরো এক তলা উঠতে হবে তাঁকে।
দ্রুত কয়েক ধাপ নিচে নেমে তাঁর কাছে গিয়ে বললাম, “উপরে উঠবেন
তো? আমাকে দেন, আমি তুলে দিচ্ছি আপনার বালতি।“
অ্যালুমিনিয়ামের পুরনো বালতি। বালতির লোহার হ্যান্ডেল এতই
চিকন যে পানির ভরের কারণে মাধ্যাকর্ষণের যে টান তৈরি হয় – তার সবটুকুই হাতের তালুতে
লাগে। ফলে বেশি কষ্ট হয়। ফিজিক্সের কত সিম্পল সূত্রের প্রয়োগ এখানে। এই হ্যান্ডেলটা
যদি অনেক মোটা করে দেয়া হতো – তাহলে এক হাতে দশ লিটার করে দুই হাতে বিশ লিটার পানি
তোলা কোন কষ্টের ব্যাপার হতো না।
ভদ্রলোক আসলেই খুব কাহিল হয়ে গিয়েছিলেন। নইলে আমি বালতি দুটো
হাতে নেয়ার সময় কিছুটা হলেও বাধা দিতেন। তাঁর পিছু পিছু তিন তলায় উঠার পর তাঁকে অনুসরণ
করে যে রুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম – পৌনে তিন বছর আগে আমি সেই রুমে থাকতাম। ভদ্রলোক
হাত বাড়িয়ে বালতি দুটো নিয়ে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। একটা শব্দও ব্যয় করলেন
না আমার জন্য।
বারান্দায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শীতের সকাল বলেই হয়তো এখনো
তেমন কেউ উঠেনি ঘুম থেকে। পুরনো ব্রিটিশ আমলের তৈরি বিল্ডিং – তিন তলা হলেও এখনকার
প্রায় পাঁচ তলার সমান। কলেজের দিকে তাকালাম – কুয়াশার কারণে তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে
না। নিচে আইয়ুব খানের আমলের ‘A-K’ ডিজাইনের গেটের কাছে পূবালী ব্যাংকের একতলা ভবনের
সামনে মাটিতে কিছু ময়লা জমিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখান থেকে ধোঁয়া উঠছে আর কাগজ-পোড়া
গন্ধ এসে নাকে লাগছে। আলোর কণাকে ফোটন বলে, শব্দের কণাকে নাকি বলে ফোনন, গন্ধের কণাকে
কী বলে? কিন্তু গন্ধ তো একটা অনুভূতি। অনুভূতির কণা কীভাবে হবে? কণা তো পদার্থ। তবে
শব্দের কণা কীভাবে হয়? ব্যাপারটা গোলমেলে ঠেকছে।
কিন্তু এসব আজগুবি ব্যাপার নিয়ে ভাবার অনেক সময় পরে পাওয়া
যাবে। যে কাজের জন্য এখানে এসেছি সেই আসল কাজটা আগে সেরে নিতে হবে। আমি যতদূর জানি,
প্রাণেশদা থাকেন দক্ষিণ-পশ্চিমদিকের কোণার রুমে। এখানে রুম নম্বর বলে কিছুই নেই।
সেই যে পরের দিন ফেরত দেবেন বলে আমার নোট নিয়ে এসেছিলেন
– এরপর দশ দিন চলে গেছে। এখনো আমার নোট ফিরে পাইনি। পরিবহন ধর্মঘটের কারণে এতদিন শহর
এলাকার বাস চলেনি। কিন্তু গতকাল থেকে তো সবকিছু চলছে। এতদিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার
পর আজ যতটুকু সকালে আসা যায় এসেছি – যেন রুমেই পাই তাঁকে।
শীতকালে ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলতে হলে সবাই বিরক্ত
হয়। এখন যে দরজা খুললো তার চোখেমুখেও ভীষণ বিরক্তি। মাঝারি সাইজের দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে
প্রায় সমান একজন ছেলে – যাকে আমি আগে কখনো দেখিনি – দরজার একটি পাল্লা ফুটখানেক ফাঁক
করে চোখ পিটপিট করে বিরক্ত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড।
“প্রাণেশদা আছেন?”
“এখানে থাকে না।“ – বলেই ধাম করে দরজা বন্ধ করে দিলো। কেমন
যেন লাগলো হঠাৎ। পরিচিত জায়গায় অপরিচিত ব্যবহার পেলে হয়তো এরকমই হয়। কিন্তু সেই ব্যাপারের
চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো – প্রাণেশদা কোথায়? তিনি কি এই রুমে থাকেন না, নাকি এই
হোস্টেলেই থাকেন না! যদি শেষেরটা হয়, তাহলে তো বারোটা বাজবে আমার।
আমার প্ল্যান ছিল প্রাণেশদার কাছ থেকে নোটগুলি নিয়ে তারপর
অজিতের সাথে একটু দেখা করেই চলে যাবো। কিন্তু প্ল্যানে কিছু রদবদল করতে হলো। সিঁড়ি
দিয়ে উঠেই বামদিকের রুমে অজিত থাকে। সেই রুমে নক করলাম। প্রায় তিরিশ সেকেন্ড পরে ভেতর
থেকে স্যান্ডেলের শব্দ পাওয়া গেল।
“কি রে এত সকালে তুই এখানে কী করিস? তোর না পরীক্ষা?” – দরজা
খুলেই অজিত বকাবকি শুরু করলো। কেন যেন সে বিশ্বাস করে আজেবাজে কাজে সময় নষ্ট না করে
পড়াশোনাটা ঠিকমতো করলে আমি পরীক্ষায় অনেক ভালো রেজাল্ট করতে পারতাম।
তাকে দেখে বুঝতে পারছি তার সকাল হয়েছে আরো অনেক আগে। তার
থার্ড ইয়ারের পরীক্ষার এখনো অনেক দেরি – কিন্তু সে এর মধ্যেই পরীক্ষার পড়া শুরু করে
দিয়েছে। তাই খুব ভোরে উঠে পড়তে বসে যায়। এখনো তাই করছিলো।
“প্রাণেশদা কোন্ রুমে থাকে?”
“এদিকের সেকেন্ড রুমে। তোর নোট নিয়ে এসেছে নাকি?” – অজিত
উৎকন্ঠিত হয়ে ওঠে। প্রাণেশদা এই হোস্টেলেই আছেন এখনো – তাতেই আমি আনন্দিত।
এত সকালে দরজা খুলে আমাকে দেখবেন এটা যে প্রাণেশদা কখনো ভাবেননি
তা তাঁর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখ দেখে বুঝতে পারলাম। কেন এতদিন আমার নোট ফেরৎ দেননি
ইত্যাদি জিজ্ঞেস করার কোন মানে হয় না। মানুষের অজুহাতের অভাব হয় না কোনদিন। অন্য কোনকিছু
না বলে আমি সরাসরি বললাম, “আমার নোটগুলি ফেরৎ দেন।“
“আমি আসলে আজকেই যেতাম তোমার ওখানে।“
“তাহলে তো আপনার সময় বেচে গেলো। আর যেতে হবে না। নোটগুলি
দেন।“
শেলফের এখানে ওখানে বিভিন্ন জায়গায় হাত দিয়ে নানারকম খাতাপত্র
নেড়েচেড়ে শেষ পর্যন্ত বিছানার তোশকের নিচ থেকে বের হলো আমার নোটের ফাইল। তোশকের নিচেও
যে খাতাপত্র রাখা যায় আগে জানতাম না। শুনেছি অনেকে পরীক্ষার আগে বই মাথায় দিয়ে শোয়।
তাদের বিশ্বাস ম্যাগনেটিক ইন্ডাকশানের মতো কোন অদৃশ্য পদ্ধতিতে বই থেকে বিদ্যা মাথায়
ঢুকে যাবে। সেভাবে তোশকের নিচে নোট রেখে তার উপর ঘুমালে সারাদেহ বিদ্যাময় হয়ে যেতে
পারে। যাদের ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু’ তাদের ক্ষেত্রে কতকিছুই তো হতে পারে!
ফাইলে ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সের একটা চ্যাপ্টার নেই। প্রাণেশদা
বললেন ওই চ্যাপ্টারটা আমি তাঁকে দিইনি। অথচ আমি জানি – দিয়েছি। কিন্তু কী আর করা। আমার
কাছে তো কোন প্রমাণ নেই। যা পেলাম তা নিয়ে চলে এলাম অজিতের রুমে।
“তুই একটা বুকা” – অজিত সরু গোঁফের ফাঁকে হাসতে হাসতে বললো।
সে চোরকে ‘চুর’ বলে, বোকাকে ‘বুকা’ বলে – শুনতে বেশ মজাই লাগে আমার। আমাদের বন্ধু বেবির
বোন বুলাকে সে ডাকে ‘বোলা’ বলে। তাতে অবশ্য বুলা খুব রেগে যায়। তো আমি যে ‘বুকা’ তা
সম্ভবত কিছুটা বুঝতে পারছি।
আটটা বেজে গেছে। কুয়াশা কেটে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। সকালের
নাস্তা না খাইয়ে ছাড়বে না অজিত। নাস্তা খাওয়া মানে হলো রেস্টুরেন্টে যাওয়া। রুম থেকে
বের হতেই দেখা হয়ে গেল তপনদার সাথে।
“কী রে তুই কখন এলি?” – মুখে ব্রাশ গুঁজে একগাল ফেনা নিয়ে
প্রশ্ন করলেন তপনদা। কয়েক ফোঁটা শ্বেত-থুতুকণিকা ছড়িয়ে পড়লো ফ্লোরে। এব্যাপারে তপনদার
কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। দেখলাম শুধু তপনদা নয়, অনেকেই দাঁত ব্রাশ করতে করতে বারান্দায় হাঁটছেন।
কেউ কেউ রেলিং-এ দাঁড়িয়ে অবলীলায় নিচে নিক্ষেপ করছেন মুখনিসৃত ফেনা। এসব কান্ড দেখে
এদের কান্ডজ্ঞান সম্পর্কে কী ধারণা হয় তা বলাই বাহুল্য।
“নাস্তা খেতে যাচ্ছিস? আমাকে ফেলে যাস না। দুই মিনিটে আসছি।“
– সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নেমে গেলেন তপনদা।
তপনদা আমার বড়ভাইয়ের বন্ধু। একই ব্যাচের। ড্রপ করতে করতে
আমার ব্যাচে চলে এসেছেন। শুনলাম এবার আমারও জুনিয়র হতে চলেছেন। তিনি যখন দেখে ফেলেছেন,
এবার তাঁর জন্য অপেক্ষা না করে উপায় নেই। কারণ তিলকে তাল করার ব্যাপারে তিনি ওস্তাদ
লোক। তাঁকে ফেলে রেস্টুরেন্টে চলে গেলে তিনি সেখানে গিয়ে উচ্চস্বরে জানান দেবেন যে
তিনি আমার কত আপনার – আজ কলেজ ছেড়ে ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছি বলে নিজেকে অনেক বড় ভাবছি।
নিজের বড়ভাইয়ের যে আপন বন্ধু – সে নিজের বড়ভাইয়ের মতো - তাকে এভাবে ফেলে রেস্টুরেন্টে
চলে আসতে পেরেছি। আবেগের চোটে তাঁর চোখে পানিও চলে আসতে পারে। কারণ কথায় কথায় তিনি
কাঁদতেও পারেন।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করলাম বুড়ো ভদ্রলোকের কথা
– যিনি পানি নিয়ে উঠছিলেন। একটু বলতেই অজিত বুঝতে পারলো। জানা গেলো – হোস্টেলের একজন
ছেলের বাবা তিনি। ছেলে এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। হোস্টেলে যে যার মতো রান্না
করে খায়। এই বৃদ্ধ বাবা এসেছেন ছেলেকে রান্না করে দিতে, ছেলের দেখাশোনা করতে। মা-বাবারা
ছেলে-মেয়েদের জন্য যা যা করেন, ছেলে-মেয়েরা যদি তার সবকিছু মনে রাখতে পারতো!
সিঁড়ির গোড়ায় তপনদার সাথে দেখা। তিনি ট্যাপের পানিতে মুখ
ধুয়ে উপরে উঠতে যাচ্ছেন। তিনি কিছু বলার আগেই বললাম, “আমরা অপেক্ষা করছি এখানে। আপনি
তাড়াতাড়ি আসেন।“
বিল্ডিং-এর নিচের তলার দেয়ালে শুধুমাত্র সাইনবোর্ডগুলি ছাড়া
বাকি সব জায়গায় দেলোয়ার হোসেন সাইদীর মাহফিলের পোস্টার। এই মাহফিলগুলিতে প্রকাশ্যে
সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেয়া হয়। দেশের প্রগতিশীল মানুষদের নামে কুৎসা রটনা করা হয়। এগুলি
বন্ধ করার জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় আদালতে মামলা করা হয়েছিল। কিন্তু কোন কাজ হয়নি।
চট্টগ্রামেও মামলা করা হয়েছিল। এতবছর ধরে কলেজিয়েট স্কুলের মাঠে অনুষ্ঠিত হতো এই মাহফিল।
আদালত সেখানে মাহফিল করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হয়েছে।
কলেজিয়েট স্কুলের মাঠ থেকে দেলোয়ার হোসেন সাইদীর মাহফিল উঠে এসেছে প্যারেড মাঠে। চট্টগ্রাম
কলেজ আর মুহসিন কলেজ ছাত্রশিবিরের শক্ত ঘাঁটি। এখানে মহা আড়ম্বরে আরো জমজমাটভাবে অনুষ্ঠিত
হয়েছে এই মাহফিল। তখন দেশজুড়ে পরিবহন ধর্মঘট চলছিলো। অথচ চট্টগ্রামের প্রায় সব মাদ্রাসা
থেকে কয়েক শত বাস ভাড়া করে মানুষ এসেছে এই মাহফিলে। আমাদের বিল্ডিং থেকে অনেকেই এসেছিল
এই মাহফিলে। অনেক রাতে মাহফিল থেকে ফিরে গিয়ে তারা আমার রুমের সামনে হৈচৈও করেছে।
তপনদা এলেন দৌড়তে দৌড়তে। লুঙ্গির সাথে একটা জ্যাকেট পরেছেন।
আমি এত সকালে কেন এসেছি, পরীক্ষার আর মাত্র তেরো দিন বাকি – এসময় আমি এভাবে সময় নষ্ট
করছি কেন ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি নানা কথা বলছেন তিনি। বড়দের এরকম উপদেশ চলাকালীন আমার শ্রবণেন্দ্রীয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
রেডবিল্ডিং থেকে বের হয়ে কলেজের গেট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কাজেম
আলি স্কুল পার হয়ে গণি বেকারির কাছে একটা রেস্টুরেন্টে আমরা আগে নিয়মিত নাস্তা করতাম।
আজও সেখানে ঢুকলাম। অজিত সম্ভবত এখানে নিয়মিত আসে না। এখানকার কোন খাবারই তার পছন্দ
হচ্ছে না। এখানকার খাবারের মান যে খুব ভালো তা নয়। আমরা আসতাম আশেপাশে আর কোন রেস্টুরেন্ট
ছিল না বলে। একবার তো সুমনের মাংসের বাটিতে একটা গোটা তেলাপোকা পাওয়া গিয়েছিল। অজিতকে
সেটা বললে সে এখনি বমি করে দেবে। তপনদা এখানকার ওয়েটারদের নামও জানেন। একজনের নাম ধরে
ডাক দিলেন।
রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে অজিত আর তপনদার কাছ থেকে বিদায়
নিলাম। তপনদা বললেন, “তুই ওদিকে কোথায় যাবি? চকবাজার থেকে তিন নম্বর বাসে উঠে যা –
সোজা ফতেয়াবাদ চলে যাবি।“
“আমাকে একটু পাবলিক লাইব্রেরিতে যেতে হবে।“
তাদের বিদায় দিয়ে আমি হাঁটতে শুরু করলাম রহমতগঞ্জের দিকে।
বিভাগীয় পাবলিক লাইব্রেরি খোলে সকাল ন’টায়। হেঁটে যেতে যেতে খুলে যাবে। আমাকে আজ সারাদিন
শহরে থাকতে হবে, বিকেলে শিল্পকলা একাডেমিতে যেতে হবে শুনলে অজিত নির্ঘাৎ ভাববে আমি
পাগল হয়ে গেছি। এখন ফতেয়াবাদ চলে গিয়ে আবার বিকেলে আসতে পারতাম। কিন্তু তার চেয়ে এখন
পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে কিছুক্ষণ পড়াশোনা করলে দু’বার যাতায়াতের সময়টা বেঁচে যায়। মনে
হচ্ছে সময়ের ব্যাপারে আমি কতই না হিসেবী!
পাবলিক লাইব্রেরিতে কোন ধরনের ব্যাগ বা বই নিয়ে ঢোকা যায়
না। সাথের জিনিসপত্র নিচের তলায় গেটের কাছেই কাউন্টারে রেখে যাওয়া যায়। এই লাইব্রেরিটা
আমার খুব ভালো লাগে। তেমন কোন ভীড় থাকে না এখানে। দোতলায় নিউজপেপার সেকশানে কিছুটা
ভীড় থাকলেও তিন তলার জেনারেল রিডিং সেকশানে কোন ভীড় থাকে না। চার তলার রেফারেন্স সেকশানে
একটুও ভীড় থাকে না।
দোতলায় একটু উঁকি দিয়ে দেখলাম। এখনো তেমন কেউ আসেনি। ঢাকার
পেপারগুলি আসে বিকেলে। সকালে চট্টগ্রামের স্থানীয় পেপার – আজাদী, নয়াবাংলা আর পূর্বকোণ।
প্রশস্ত টেবিলের এক কোণে সেগুলি ভাঁজ করা আছে। আজাদী হাতে নিয়েই শিউরে উঠলাম। গতকাল
টিভি দেখিনি, রেডিও’র খবরও শুনিনি। বাংলাদেশের সবচেয়ে মর্মান্তিক ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে
গেছে গতকাল সকালে। টঙ্গির কাছে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী উর্মি অরুণার সাথে মুখোমুখি
সংঘর্ষ হয়েছে ঢাকাগামী চট্টগ্রাম মেইলের। ঘটনাস্থলেই মারা গেছে শতাধিক মানুষ, মারাত্মকভাবে
আহত হয়েছেন আরো তিন শতাধিক মানুষ। হায়রে জীবন! সরকার সেনাবাহিনীর সাহায্যে উদ্ধারকাজ
চালিয়েছে। নিহতদের জন্য এক লাখ টাকা করে এবং স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে গেছেন যারা তাদের
জন্য আশি হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেবে বলেছে। কিন্তু এভাবে যে ক্ষতিটা হয় – তা কোনোকিছু
দিয়েই কি পূরণ করা সম্ভব?
মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। দুটো ট্রেন একই সময়ে একই লাইনে মুখোমুখি
চলে আসে কীভাবে? কারো না কারো গাফেলতিতেই তো এরকম ব্যাপার ঘটে। কিন্তু কেউই কোনদিন
দায় স্বীকার করে না।
চারতলার রেফারেন্স রুমে গিয়ে নোট খুলে বসলাম। চারপাশের দেয়ালজুড়ে
বই আর বই। মাঝখানে কী সুন্দর ঝকঝকে কাঠের চেয়ার-টেবিল। বিনাখরচে পড়াশোনার এত সুন্দর
ব্যবস্থা। অথচ তেমন কেউই এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে না। আশ্চর্য। মনে হচ্ছে প্রতিদিন
এখানে চলে এলেই পড়াশোনা ভালো হবে।
দুপুর দুটোর দিকে বের হলাম। শিল্পকলা একাডেমিতে যেতে হবে
সাড়ে তিনটার মধ্যে। শহীদ মিনার থেকে বাম দিকে গিয়ে ছোট্ট গলির ভেতর দিয়ে চলে এলাম ফুলকির
কাছে। সেখান থেকে সোজা হেঁটে বামে বৌদ্ধমন্দির আর ডানে ডিসি হিল রেখে লাভ লেইনে ঢুকলাম।
এখানে রাস্তার মোড়ে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। দুপুরের ভাত এখানেই খেয়ে নিলাম।
আবার হাঁটতে শুরু করলাম। শহরের রাস্তায় রাস্তায় একা একা হেঁটে
বেড়াতে আমার কেন এত ভালো লাগে জানি না। কত কিছু যে দেখার আছে চারদিকে। হাঁটতে হাঁটতে
আউটার স্টেডিয়াম। ক্রিকেট খেলা চলছে সেখানে। আরো সামনে গিয়ে সার্কিট হাউজের খোলা মাঠ।
আরো এগিয়ে যাবার পর রাস্তার ডান দিকে আলমাস আর দিনার সিনেমা হল।
সিনেমা হলের সামনে দিয়ে যাবার সময় সেখানে কী সিনেমা চলছে
তা ঠিকমতো দেখবো না তা কি হয়? এখানে কতবার যে সিনেমা দেখেছি তার ইয়ত্তা নেই। দিনারে
বেশিরভাগ সময় ইংরেজি সিনেমা চলে। এখন বিদ্ঘুটে নামের একটা কুংফু মুভি চলছে। তপনদা এধরনের
ছবি খুব পছন্দ করেন। হঠাৎ তপনদার কথা মনে হতেই দ্রুত বের হয়ে এলাম হলের বারান্দা-শো
থেকে। তপনদা যদি কোনভাবে আমাকে এখন এখানে দেখে ঝামেলা করবে।
আলমাসের সামনে থেকে শিল্পকলা একাডেমিতে যাবার অনেকগুলি রাস্তা
আছে। মেহেদীবাগের ভেতর দিয়ে যাওয়া যায়। ওয়াসার সামনে দিয়ে যাওয়া যায়। হাতে এখনো কিছুটা
সময় আছে। সবচেয়ে দীর্ঘ পথ ধরে হাঁটা দিলাম।
পরীক্ষার আগে এভাবে আমি শিল্পকলা একাডেমিতে যাচ্ছি নাটকের
দলে কাজ করার জন্য – এটা জানতে পারলে আমার দিদি আমাকে মাটিতে পুঁতে ফেলবে। আমি যে সিনেমা
দেখতে দেখতে মেডিকেলে চান্স পাইনি এই শোক সে এখনো ভুলতে পারেনি। এখন সে ফার্স্ট ইয়ারের
মার্কস মুখস্থ করে বসে আছে। সেকেন্ড ইয়ারে যদি তার একটুও কম পাই – সে আমাকে তুলোধুনা
করবে। এখন যে পথে হাঁটছি – সেই পথে তার আসার কোন সম্ভাবনা নেই।
শিল্পকলা একাডেমিতে পৌঁছে দেখলাম হাতে এখনো কিছু সময় আছে।
তীর্যক নাট্যগোষ্ঠীর পোস্টার দেখা যাচ্ছে হলের সামনে – বার্টোল্ট ব্রেশ্ট এর নাটকের
অনুবাদ ‘সমাধান’ মঞ্চস্থ হচ্ছে আগামীকাল। আজ আমি আনুষ্ঠানিকভাবে এই নাট্যগোষ্ঠীর সদস্য
হবো। কেমন যেন একটু উত্তেজনা অনুভব করছি।
গ্রুপ থিয়েটারে কীভাবে যোগ দিতে হয় জানতাম না। গত আগস্টে
এখানে নাটক দেখতে এসে দেখলাম তির্যকে নতুন সদস্য হবার জন্য ফরম বিক্রি করা হচ্ছে। পাঁচ
টাকা দিয়ে একটা ফরম কিনে সেখানেই ভর্তি করে জমা দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম – এত সহজেই হয়ে
গেলো! কিন্তু না – বলা হলো পরীক্ষা নেয়া হবে। কোন ভর্তি পরীক্ষাতেই আমি তেমন ভালো করতে
পারি না। আর্টস ফ্যাকাল্টিতে স্পোকেন ইংলিশ কোর্সে ভর্তি হবার জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম
সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর। টিকিনি। অথচ ফারুক, হাফিজসহ বন্ধুদের অনেকেই টিকেছে। গ্রুপ
থিয়েটারে ভর্তি হতে গেলে আবার কী পরীক্ষা দিতে হয় কে জানে। কয়েক মাসেও যখন কোন খবর
পেলাম না, ভেবেছিলাম প্রাথমিক বাছাইতেই হয়তো বাদ দিয়েছে। কিন্তু গত নভেম্বরে হঠাৎ চিঠি
দিয়ে জানানো হলো যে মৌখিক পরীক্ষায় হাজির হতে হবে। গত মাসের শুরুতে মৌখিক পরীক্ষা দিলাম।
রীতিমত চার জনের ইন্টারভিউ বোর্ড। ভেবেছিলাম অভিনয় করে দেখাতে
বলবে। কিন্তু জিজ্ঞেস করা হলো কঠিন কঠিন তাত্ত্বিক প্রশ্ন। সংস্কৃতি বলতে কী বুঝি,
অপসংস্কৃতি কী জিনিস? আমি হঠাৎ বলে বসলাম, অপসংস্কৃতি কোন জিনিস নয়। জিনিস হতে গেলে
তার ভর থাকতে হয়, ভর না থাকলে তা জিনিস মানে পদার্থ নয়। সুতরাং অপসংস্কৃতি অপদার্থ।
আমি কোন হাসির কথা বলিনি – কিন্তু বোর্ডের সদস্যরা জোরে হেসে উঠেছিলেন। হাসি থামিয়ে
একজন জিজ্ঞেস করলেন – আমি যদি ব্যান্ডের বাজনার সাথে রবীন্দ্রসংগীত গাই, সেটা কি অপসংস্কৃতি
হবে? ট্রিক কোয়েশ্চেন। আমি যেভাবেই উত্তর দিই – প্যাঁচাতে থাকবে। গ্রুপ থিয়েটারের সদস্য
হতে গেলে এত সব জানতে হয় জানলে তো আসতাম না। আমি বললাম – আমি তো সংগীতের কিছুই বুঝি
না। এবার প্রশ্ন করা হলো – “বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?”
বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার সম্পর্কে আমার ধারণা খুব ভালো ছিল।
নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক কামালুদ্দীন নীলু এই থিয়েটার গঠন করেছেন। নাট্যকলা বিভাগের
ছেলেমেয়েরাই বেশিরভাগ এই দলের সদস্য। জিয়া হায়দারের লেখা একটি নাটক ইতোমধ্যেই মঞ্চস্থ
করে ফেলেছে তারা। তাদের নতুন নাটক ‘একাত্তরের গাথা’য় অভিনয় করার জন্য অডিশন দিতে গিয়েছিলাম।
কামালুদ্দীন নীলু স্যারকে টেলিভিশনের নাটকে অভিনয় করতে দেখি। আর্টস ফ্যাকাল্টির নাট্যকলা
বিভাগের একটা রুমে অডিশনের জন্য বসানো হলো আমাদের। আধঘন্টা ধরে তিনি তাঁর বিভাগের ছেলে-মেয়েদের
উদ্দেশ্যে ‘একাত্তরের গাথা’য় কার কী ভূমিকা তা বর্ণনা করলেন। অডিশন সম্পর্কে কোন কথাই
বললেন না। আমি পাশে বসা একজন সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম – অডিশান কখন হবে? তিনি উত্তর
দিলেন – হবে না, নাটকে যতজন দরকার, ততজন হয়ে গেছে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটারের উপর
আমার ক্ষোভ থাকতে পারতো। কিন্তু তারা এই শিবিরের রাজত্বেও মুক্তিযুদ্ধের নাটক করার
পরিকল্পনা করছে – তাই বললাম – বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার খুব সাহসী নাট্যদল। কিন্তু আমার
উত্তর বোর্ডের সদস্যদের পছন্দ হলো না। তাঁরা এবার বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটারের চৌদ্দ গোষ্ঠী
উদ্ধার করতে শুরু করলেন। আমি জানতাম না যে গ্রুপ থিয়েটারগুলি আসলেই কতটা গ্রুপে বিভক্ত।
ভেবেছিলাম আমার থিয়েটারের লোক হওয়া আর হলো না। কিন্তু না,
কিছুদিন পর চিঠি দিয়ে জানানো হলো আমি গ্রুপের প্রাথমিক সদস্যপদ পাওয়ার উপযুক্ত। সম্ভবত
খুব বেশি দরখাস্ত তারা পায়নি, তাই যারাই দরখাস্ত করেছে – সবাইকেই নিয়ে নিয়েছে। ইন্টারভিউটা
জাস্ট একটা ফর্মালিটি ছিল। চিঠি দিয়েই জানানো হয়েছে আজ আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাথমিক
সদস্যপদ দেয়া হবে এবং এরপর ‘সমাধান’ নাটকের রিহার্সাল দেখানো হবে।
একাডেমির হলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি পরিচিত কাউকে দেখতে পাই
কি না। সাড়ে তিনটা বাজতে এখনো কয়েক মিনিট বাকি আছে। দু’চার জনের জটলা দেখা যাচ্ছে এখানে
ওখানে। দুটো মেয়ে আলাদা আলাদাভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ইন্টারভিউ যখন হয়েছিল – তখন এদের কাউকে
দেখেছি কি না মনে করতে পারছি না। এরা সবাই কি তির্যকের নতুন সদস্য? পুরনো সদস্যরা কোথায়?
আমার চোখ বারবার চলে যাচ্ছে হলুদ কামিজের মেয়েটির দিকে। তাকে কেমন যেন নতুন নায়িকা
দিতির মতো লাগছে।
“হেই ব্যাটা, হা করে কী দ্যাখস?” বলেই আমার পিঠে একটা থাপ্পড়
বসিয়ে দিলো টিপু। সে এখানে কেন এসেছে বুঝতে পারছি না। তার সাথে দুজন মেয়ে।
“তোর না দু’দিন পরে পরীক্ষা? এখানে কী করছ? তিজ্জক?” –
টিপুর প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে হলো না। সে পরিচয় করিয়ে দিলো – নাজু আর মুন্নি। মুন্নি
পড়ে ক্লাস টেনে, আর নাজু ইলেভেনে। এরা দু’জন বোন – না বলে দিলে বোঝার কোন উপায় নেই।
চেহারায় কোন মিল নেই দুজনের। জানা গেলো নাজু-মুন্নি তীর্যকের পাওয়ারফুল মেম্বার মিরনভাইয়ের
বোন। আর টিপু তাদের পরিবারের একজন সদস্যের মতো। সে হিসেবে সে তির্যকেরও সদস্য। আগে
জানলে তো আমিও টিপুর বন্ধু হিসেবে সদস্যপদ দাবি করতে পারতাম।
আমার চোখ বারবার হলুদ ড্রেসের দিকে চলে যাচ্ছিলো তা চোখ এড়ালো
না টিপুর। সে সোজা এগিয়ে গেল মেয়েটির দিকে। কী যেন বললো তাকে – শুনতে পেলাম না। টিপুর
এই ক্ষমতার কথা আগে জানা ছিল না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মেয়েটি চলে এলো আমাদের কাছে।
‘হাই, আমি মান্না সরকার।‘
তার গলার স্বর অদ্ভুত মিষ্টি।
No comments:
Post a Comment