Thursday, 8 July 2021

অভিনেতা দিলীপ কুমার

 



অভিনেতা দিলীপ কুমারের নাম আমি প্রথম শুনেছিলাম ক্লাস নাইনে পড়ার সময়। আমাদের গ্রামের সিরাজ মিয়ার কাছে। সিরাজ মিয়া ছিলেন কবি এবং কবিরাজ – একের ভেতর দুই। তিনি বাজারে স্বরচিত কবিতা পড়তেন এবং কবিতার সরস ব্যাখ্যা করার পর স্বরচিত কবিরাজি ওষুধ বিক্রি করতেন। সেই কবিরাজিতে কোনো কাজ হতো কি না আমি জানি না, কিন্তু তাঁর কবিতার ছন্দে ছন্দে বলা রূপকথার গল্প আমি বুঁদ হয়ে শুনতাম। একদিন তিনি দিলীপ কুমারের গল্প করলেন। বোম্বাই শহরের ফুটপাতে বসে ফল বিক্রি করতো যে ছেলে – সে একদিন বোম্বাই সিনেমার এক নম্বর হিরো হয়ে যাবার কাহিনি শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আরো অনেক পরে জেনেছি সেই কাহিনিও ছিল রূপকথার গল্পের মতো অতিরঞ্জিত।

বাংলাদেশের হলে গিয়ে সিনেমা দেখার দিনগুলিতে হিন্দি সিনেমা দেখার কোন সুযোগ আমার ছিল না। দিলীপ কুমারের  ‘মুঘল-এ-আযম’ দেখি আমেরিকায় গিয়ে। ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির ফিল্ম ও জার্নালিজম লাইব্রেরিতে ভারতীয় সিনেমার অনেক ডিভিডি ছিল। মুঘল-এ-আযম’এ দীলিপ কুমারের অভিনয় দেখে আমি খুব যে মুগ্ধ হয়েছিলাম তা বলা যায় না। আমি তাঁর অভিনয়ে মনযোগ দেয়ার চেয়েও অবাক হয়ে দেখছিলাম অনেক বছর আগে দেখা দিলীপ বিশ্বাসের ‘আনারকলি’ সিনেমার সাথে ‘মুঘল-এ-আযম’ সিনেমার হুবহু মিল। মুঘল-এ-আযম ১৯৬০ সালের সিনেমা। আর আনারকলি ১৯৮১ সালের। দিলীপ বিশ্বাসের সিনেমা আমি পছন্দ করতাম। ইতিহাস-আশ্রিত ঘটনা নিয়ে সিনেমা যে কেউ তৈরি করতে পারেন। কিন্তু তাই বলে অন্য একটি সিনেমার চিত্রনাট্য দৃশ্যের পর দৃশ্য হুবহু নকল করা, এমনকি সংলাপ পর্যন্ত হিন্দি থেকে হুবহু বাংলায় অনুবাদ – মেনে নেয়া যায় না।

সে যাই হোক। পরে ইউটিউবের কল্যাণে দিলীপ কুমারের অনেক সিনেমাই দেখেছি। তাঁকে হিন্দি সিনেমার ট্র্যাজেডি কিং বলা হয় তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলির কারণে। মিলনের চেয়েও বিরহে তিনি অনেক বেশি সাবলীল। ১৯৫৫ সালে বিমল রায়ের পরিচালনায় দেবদাস সিনেমায় তিনি যেভাবে অভিনয় করেছেন তা পরবর্তীতে নির্মিত সবগুলি দেবদাসের মধ্যে সেরা বলে স্বীকার করেন প্রায় সবাই। দেবদাস দিলীপ কুমারের পার্বতী ছিলেন সুচিত্রা সেন। শাহরুখ খান বনসালীর দেবদাসে দিলীপ কুমারকেই অনুসরণ করেছেন।

দিলীপ কুমারের আসল নাম ইউসুফ খান। ১৯২২ সালের ১১ ডিসেম্বর পেশোয়ারে জন্ম তাঁর। তাঁর মা আয়েশা খান এবং বাবা সরওয়ার খানের বারো জন সন্তানের মধ্যে তিনি চতুর্থ। তাঁর বাবা সরওয়ার খান ছিলেন ফল ব্যবসায়ী। বেশ বড় ব্যবসায়ীই ছিলেন। তিনি পুরো পরিবার নিয়ে পেশোয়ার থেকে বোম্বে চলে গিয়েছিলেন। সেখানেই পড়াশোনা এবং বেড়ে ওঠা ইউসুফ খানের।

অভিনেতা হবার কোন প্ল্যানই ছিল না ইউসুফ খানের। ভেবেছিলেন পেশাদার ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলোয়াড় হবেন। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি কিছুটা অর্থনৈতিক কারণে। এত বড় সংসার, এত গুলি ভাইবোন। তাঁর ছোট আরো আট ভাইবোন সবার ভরণপোষণ করা একা বাবার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিলো না। তাই তাঁকে চাকরি করতে হয়েছে। কিছুদিন কাজ করেছিলেন পুনার আর্মি ক্যান্টিনের সহকারি হিসেবে।

কিন্তু ক্যান্টিনের চাকরিতে কোন ভবিষ্যত ছিল না। তিনি অন্য কোন চাকরি খুঁজছিলেন। তাঁর এক শিক্ষকের মাধ্যমে তিনি চাকরির জন্য যান বোম্বে টকিজ স্টুডিওতে। অভিনেত্রী দেবিকা রানি ইউসুফ খানকে চাকরি দেয়ার বদলে অভিনয় করার প্রস্তাব দেন। জীবনে কোনদিন অভিনয় করা তো দূরের কথা, একটা যুদ্ধের তথ্যচিত্র ছাড়া অন্য কোন সিনেমাও দেখেননি ইউসুফ খান। কিন্তু অভিনয় করলে কিছু টাকা পাওয়া যাবে, অভিনয়টাই তাঁর চাকরি – সুতরাং কেন নয়? কিন্তু নাম বদলাতে হলো। তখন ১৯৪৪ সাল। ভারতীয়দের মধ্যে তখন হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব অনেকটাই প্রকাশ্যে চলে এসেছে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ক্রমশ দানা বাঁধছে। নতুন নায়ক ইউসুফ খান বোম্বের সিনেমায় গ্রহণযোগ্য নয়। তাই নাম বদলে দিলীপ কুমার রাখা হলো।




১৯৪৪ সালে মুক্তি পেলো দিলীপ কুমারের প্রথম সিনেমা ‘জোয়ার ভাটা’। সিনেমাটি একটুও চলেনি। দিলীপ কুমারের রিয়েলিস্টিক অভিনয়, নিচু লয়ে সংলাপ বলা পছন্দ করেনি সমালোচকরা। তবুও ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি একেবারে ছুঁড়ে ফেলে দেয়নি দিলীপ কুমারকে। পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যেই তাঁর সিনেমা হিট হতে শুরু করে।

হিন্দি সিনেমার প্রথম যুগের নায়কদের মধ্যে হলিউডের নায়কদের অনুকরণ করার প্রবণতা ছিল। রাজকাপুর অনুকরণ করতেন চার্লি চ্যাপলিনকে। দেবানন্দ অনুকরণ করতেন গ্রেগরি পেককে। আর দিলীপ কুমার মার্লো ব্রান্ডোকে। যদিও তিনি তা স্বীকার করেননি কখনো।

দিলীপ কুমার অভিনয়ের জন্য এত বেশি পুরষ্কার অর্জন করেছেন যে গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে স্থান পেয়েছেন। দিলীপ কুমার ৮বার ফিল্ম ফেয়ার পুরষ্কার পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে। দাগ (১৯৫৩), আন্দাজ (১৯৫৫), দেবদাস (১৯৫৬), নয়া দাউর (১৯৫৭), কোহিনূর (১৯৬০), লিডার (১৯৬৪), রাম আউর শ্যাম (১৯৬৭), এবং শক্তি (১৯৮২) সিনেমার জন্য তিনি  শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরষ্কার পেয়েছেন। ১৯৯৪ সালে পেয়েছেন দাদাসাহেব ফালকে পুরষ্কার। ১৯৯১ সালে পদ্মভূষণ, ২০১৫ সালে পদ্মবিভূষণ। ২০০০ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত তিনি ছিলেন রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য।




ব্যক্তিগত জীবনে প্রেমের সম্পর্ক ছিল অনেকের সাথে। মুঘল-এ-আযম এর নায়িকা মধুবালার সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল দীর্ঘদিনের। সেটা ভেঙে গিয়ে সায়রা বানুর সাথে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। ১৯৬৬ সালে সায়রা বানুকে বিয়ে করেন তিনি। তখন তাঁর বয়স ৪৪, আর সায়রা বানুর মাত্র ২২। ১৯৮০ সালে দিলীপ কুমার গোপনে বিয়ে করেন সমাজকর্মী আসমা রেহমানকে। কিন্তু গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে যায়। ভারতীয় আইনে একই সাথে দুই স্ত্রী রাখা যায় না। কিন্তু দিলীপ কুমার মুসলিম আইনের দোহাই দিলেও সায়রা বানু এই বিয়ে মেনে নেননি। কিন্তু তিনি দিলীপ কুমারকে ছেড়েও দেননি। বরং আসমা রেহমানকেই পিছু হটতে হয়। দিলীপ কুমারের দ্বিতীয় বিয়ে ভেঙে যায়। দিলীপ কুমার – সায়রা বানু দম্পতি নিঃসন্তান। কিন্তু তাতে তাঁদের কোন দুঃখ নেই বলেই জানিয়েছেন সবাইকে। তাঁদের বৃহৎ পরিবারে ভাই-বোনদের ছেলে-মেয়েকে নিজেদের ছেলেমেয়ে ভেবেছেন তাঁরা।

দিলীপ কুমারের মৃত্যু হয় ৭ জুলাই ২০২১। ৯৮ বছরের দীর্ঘ জীবনের ৭৬ বছর কেটেছে অভিনেতা হিসেবে। শিল্পী দিলীপ কুমার বেঁচে থাকবেন সিনেমায়, সিনেমার দর্শকদের স্মৃতিতে।

 

তথ্যসূত্র: The Substance & the shadow- an autobiography, by Dilip Kumar, Hay House India, 2014. 


No comments:

Post a Comment

Latest Post

Terry Wogan's "The Little Book of Common Sense"

  What we call common sense in English is not very common at all. If common sense could be learned by reading books, then those who have re...

Popular Posts