Monday 4 November 2019

পৃথিবী সূর্যের তৃতীয় গ্রহ - পর্ব ৩


সূর্য ও তার গ্রহগুলোর উৎপত্তি

সাড়ে চারশ' কোটি বছর আগে আমাদের সূর্য এবং তার গ্রহগুলোর কোন অস্তিত্ব ছিলো না। কিন্তু মহাবিশ্বের উৎপত্তি হয়ে গেছে আরো এক হাজার কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে। বিগ ব্যাং এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই মহাবিশ্ব স্ফীত হতে শুরু করে এবং ইউনিফাইড ফোর্স বা সমন্বিত বল থেকে গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষ বল[1] আলাদা হয়ে যায়।
            মহাবিশ্বে তখন যে পদার্থগুলোর অস্তিত্ব ছিল তাদের বেশিরভাগই ছিল ডার্ক ম্যাটার বা কৃষ্ণ পদার্থ। ডার্ক ম্যাটার দেখা যায় না। প্রচন্ড  তাপেও এগুলো থেকে কোন আলো বের হয় না। কিন্তু পারমাণবিক পদার্থ বা প্রচলিত পদার্থ যেগুলো দেখা যায় - সেগুলো উত্তপ্ত হলে আলো বিকিরণ করে। মহাবিস্ফোরণে যে প্রচণ্ড শক্তি-প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছিলো তাতে বেশিরভাগ পদার্থ এবং কৃষ্ণ-পদার্থ দূরে দূরে সরে গেলেও সামান্য কিছু পদার্থ পরস্পরের কাছাকাছি রয়ে গিয়েছিল। এগুলো থেকেই পরবর্তীতে সব গ্যালাক্সি এবং নক্ষত্রগুলো গঠিত হয়েছে।
            মহাবিস্ফোরণের পর এক হাজার কোটি বছরে কোটি কোটি গ্যালাক্সি তৈরি হয়ে গেছে এবং সেই গ্যালাক্সিগুলোতে জন্ম নিয়েছে অসংখ্য নক্ষত্রপুঞ্জ। সেই নক্ষত্রগুলোর অনেকে আবার ধ্বংসও হয়ে গেছে সেখানে। তাদের ধ্বংসাবশেষ থেকে জন্ম নিয়েছে আরো সূর্য-গ্রহ-উপগ্রহ ইত্যাদি। বিগ-ব্যাং ছাড়া বাকি সব মহাজাগতিক ঘটনাই ঘটেছে গ্যালাক্সির ভেতর। আমাদের সূর্য যে গ্যালাক্সিতে জন্ম নিয়েছে তার নাম মিল্কিওয়ে।
            মিল্কিওয়েকে মহাকাশে বিশাল আকৃতির একটা চাকতি বলা যায় যেখানে রয়েছে কোটি কোটি নক্ষত্র। এই চাকতিটা এত বড় যে এর একদিক থেকে অন্যদিকে আলো যেতে সময় লেগে যায় প্রায় এক লক্ষ বছর। অর্থাৎ এর ব্যাস এক লক্ষ আলোকবর্ষ।[2]গ্যালাক্সির মাঝখানে ডিমের কুসুমের মতো উঁচু গোলাকার একটা জায়গা আছে যার ব্যাস তেইশ হাজার আলোকবর্ষ। গ্যালাক্সির বাইরের দিকের একটা অংশ চাকার মতো ঘুরছে। চাকাটির পুরুত্ব প্রায় এক হাজার আলোকবর্ষ। মিল্কিওয়ের ভেতর আছে কোটি কোটি নক্ষত্র যাদের বেশিরভাগই আকার আয়তনে সূর্যের মতো। কোন কোনটা সামান্য বড়, আবার কোন কোনটা সামান্য ছোট। ভেবো না যে এতগুলো নক্ষত্র গাদাগাদি করে আছে। একটা সূর্য থেকে অন্য সূর্যের মধ্যে যে দূরত্ব তাতে একটার আলো অন্যটাতে যেতে কয়েক বছর লেগে যায়।
            এই গ্যালাক্সির মাঝখানে যে দ্বীপ আছে সেখানে যেসব নক্ষত্র আছে তাদের বেশিরভাগই বুড়ো নক্ষত্র। তাদের আশেপাশে কোন গ্যাস বা নক্ষত্রের ধূলো নেই যা দিয়ে নতুন নক্ষত্র বা গ্রহ তৈরি হতে পারে। কিন্তু গ্যালাক্সির চাকতির বাইরের দিকে হলো নক্ষত্রের নার্সারি। সেখানে শিশু নক্ষত্র থেকে বয়স্ক নক্ষত্র সবাই আছে। আছে নতুন নক্ষত্র তৈরি হবার প্রচুর মাল-মসলা গ্যাস আর পুরনো নক্ষত্রের ধ্বংসাবশেষ।
            মিল্কিওয়ের সবচেয়ে বুড়ো নক্ষত্রের বয়স প্রায় বারোশ' কোটি বছর। বিগ-ব্যাং ঘটেছিলো প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ' কোটি বছর আগে। তার মানে বিগ-ব্যাং ঘটার আড়াই শ' কোটি বছরের মধ্যেই নক্ষত্র তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বিজ্ঞানীরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে হিসেব করে দেখেছেন যে সূর্য ও তার গ্রহগুলোর বয়স সাড়ে চারশ' কোটি বছরের বেশি নয়। তার মানে আমাদের সৌরজগৎ তৈরি হবার আগের সাড়ে আটশো কোটি বছরের মধ্যে আরো অনেক সূর্যের জন্ম হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে। সে হিসেবে সৌরজগৎ সৃষ্টি প্রকৃতির কোন নতুন ঘটনা নয়।
            বিগ-ব্যাং এর পর যে বিশাল কসমিক ওয়েভ বা মহাজাগতিক তরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছিল তার কিছুটা এখনো এই সাড়ে চৌদ্দ শ' কোটি বছর পরেও মহাকাশে রয়ে গেছে। এগুলোকে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশান বলা হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এসব তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে প্রমাণ পেয়েছেন যে বিগ-ব্যাং থেকে যেসব পারমাণবিক পদার্থ সৃষ্টি হয়েছিল তার শতকরা ৭৫ ভাগই ছিলো হাইড্রোজেন আর মাত্র ২৫ ভাগ ছিলো হিলিয়াম। তাছাড়া সৃষ্টি হয়েছিল বিপুল পরিমাণ ডার্ক ম্যাটার যেগুলো দেখা যায় না।
            প্রথম দিকের নক্ষত্রগুলো তৈরি হয়েছিল হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের সমন্বয়ে। পরে নক্ষত্রগুলো নিজেদের অভিকর্ষজ চাপে বিস্ফোরিত হয়েছে। প্রত্যেকটা নক্ষত্রই একেকটা পারমাণবিক চুল্লির মতো যাদের ভেতর চলে পারমাণবিক বিক্রিয়া। নক্ষত্রের বিস্ফোরণের ফলে আরো গ্যাস ও নতুন যৌগ যোগ হয় মহাকাশে। মহাকাশে সেগুলো ভাসতে থাকে বছরের পর বছর। তারপর অন্য কোন নক্ষত্রের বিস্ফোরণ ঘটলে যে তরঙ্গের সৃষ্টি হয় সেই তরঙ্গের প্রভাবে ভাসমান গ্যাস ও অন্যান্য যৌগ পরস্পরের কাছে চলে আসে। মহাকর্ষ বলের প্রভাবে তারা একে অপরের সাথে মিশে গ্যাসপিন্ডে পরিণত হয়।
            অভিকর্ষজ বলের প্রভাবে পদার্থগুলো কেন্দ্রের দিকে আকৃষ্ট হয়। ফলে পিন্ডের ভেতরের চাপ বেড়ে যায়। চাপ বাড়লে তাপও বাড়তে থাকে। এই চাপ ও তাপের ফলে ভেতরের হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো এমনভাবে একে অপরের সাথে বিক্রিয়ায় লিপ্ত হয় যে তারা পরস্পর মিশে গিয়ে হিলিয়ামে পরিণত হয়। এই পারমাণবিক প্রক্রিয়াকে নিউক্লিয়ার ফিউশান বলে। প্রচুর তাপ ও শক্তি উৎপন্ন হয় ফিউশান প্রক্রিয়ায়। এই শক্তির ফলে পিন্ড থেকে গ্যাসগুলো বাইরের দিকে চলে যেতে চায়। কিন্তু অভিকর্ষজ বল সেগুলোকে পিন্ডের কেন্দ্রের দিকে টেনে রাখে। ফলে গ্যাসপিন্ড সংকুচিত হতেও পারে না আবার বাইরের দিকে বেরিয়ে ফেটে যেতেও পারে না। এভাবে নক্ষত্র টিকে যায়। তাদের ভেতরের পারমাণবিক চুল্লি তাপ ও আলো তৈরি করতে থাকে।
            নক্ষত্রের জ্বালানি যখন শেষ হয়ে যায় - তখন ভেতরের অভিকর্ষজ বলের টানে নক্ষত্রটি ভেতরের দিকে এমন জোরে চুপসে যায় যে ফাটা বেলুনের মতো ভেতরের উপাদানগুলো বাইরে ছিটকে পড়ে। ওগুলো তখন মিল্কিওয়েতে ভাসতে থাকে। পরে কোন এক সময় এগুলো থেকে আবার নতুন নক্ষত্রের জন্ম হয়। সেই নতুন নক্ষত্রের ভেতর শুধু হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম থাকে না, তাদের চেয়ে কিছুটা ভারী পদার্থও থাকে। নক্ষত্র যত বড় হয় তত দ্রুত শেষ হয়ে যায় তাদের ভেতরের জ্বালানি এবং তত দ্রুত ধ্বংস হয়ে যায় তারা। তাদের ধ্বংস হয়ে যাবার সময় বিরাট বিস্ফোরণ ঘটে। তাতে আরো কিছু নতুন পদার্থ মিল্কিওয়েতে ছিটকে পড়ে। পরের প্রজন্মের নক্ষত্রে এই নতুন পদার্থগুলো পাওয়া যায়।
            এভাবে নক্ষত্রের সৃষ্টি ও ধ্বংসের মাধ্যমে মহাবিশ্বে তৈরি হয়েছে প্রচুর হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। হাইড্রোজেনের রাসায়নিক ক্রিয়ায় তৈরি হয়েছে আরো কিছু মৌলিক পদার্থ - কার্বন, অক্সিজেন, সিলিকন ইত্যাদি। আমাদের সৌরজগৎ তৈরি হবার আগে অসংখ্য নক্ষত্রের সৃষ্টি ও ধ্বংস হয়েছে। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে বছরে গড়ে দশ থেকে বিশটি নক্ষত্রের জন্ম ও মৃত্যু হয়। আমাদের সূর্যের জন্মের আগের আট শ' কোটি বছরে কমপক্ষে আট হাজার কোটি নক্ষত্রের সৃষ্টি ও ধ্বংস হয়েছে। এগুলো থেকে তৈরি হয়েছে বিপুল পরিমাণ নক্ষত্র-নির্মাণ-সামগ্রী যেখানে রয়েছে অনেক ভারী তেজষ্ক্রিয় মৌল। তবে বেশির ভাগ নক্ষত্রে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের প্রাধান্যই বেশি দেখা যায়। কারণ হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের মধ্যেই নিউক্লিয়ার ফিউশান তুলনামূলকভাবে বেশি ঘটে।
            সাড়ে চারশো কোটি বছর আগে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির একপাশে ভাসমান নক্ষত্র-নির্মাণ-সামগ্রীগুলোর মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হলো। অন্য নক্ষত্রের বিস্ফোরণের ফলে যে তরঙ্গ তৈরি হয়েছে তার মাধ্যমে এবং মহাকর্ষ বলের প্রভাবে পদার্থগুলো পরস্পর কাছে এসে আস্তে আস্তে ঘুরতে ঘুরতে একটা পিন্ড তৈরি হলো। এই পিন্ড ক্রমশ বড় হতে হতে তৈরি হলো আমাদের সূর্য। সূর্য তৈরি হতে এক শ' কোটি বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। সূর্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য পড়ো - অর্ক ও সূর্যমামা[3]




            আমাদের সূর্য যেখানে তৈরি হয়েছে সেই জায়গাটা মিল্কিওয়ের কেন্দ্র থেকে চাকতির প্রান্তের দূরত্বের তিন ভাগের দুই ভাগ দূরত্বে গ্যালাক্সির পুরুত্বের মাঝামাঝি অবস্থিত।
            আমাদের পুরো সৌরজগতের উপাদানগুলোর শতকরা ৭০.১ ভাগ হাইড্রোজেন, ২৭.৯ ভাগ হিলিয়াম এবং ০.৯ ভাগ অক্সিজেন। বাকি ১.১ ভাগ হলো অন্যান্য ভারী মৌলিক পদার্থ। হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের পরিমাণের তুলনায় এগুলোর পরিমাণ এত কম যে এদেরকে সরাসরি হিসেব না করে একটু অন্যভাবে হিসেব করা হয়। এখানে প্রতি ৭০টি অক্সিজেন পরমাণুর বিপরীতে আছে মাত্র ৪০টি কার্বন, ৫টি সিলিকন, ৪টি ম্যাগনেসিয়াম, ৪টি নিয়ন, ৩টি লোহা ও ২টি সালফার পরমাণু। অন্যান্য উপাদানপগুলোর পরিমাণ আরো কম। এক কোটি সালফারের পরমাণুর তুলনায় সোনার পরমাণু আছে মাত্র তিনটি। সৌরজগতে সোনার পরিমাণ এত কম বলেই হয়তো সোনার এত দাম। সূর্য ও অন্যান্য গ্রহগুলোর মধ্যে পদার্থের পরিমাণের গড় হিসেব এরকম। কিন্তু আমাদের পৃথিবীতে পদার্থের পরিমাণের ব্যাপারটা একটু ভিন্ন।
        সূর্য মিল্কিওয়ের চারপাশে ঘুরছে। একবার ঘুরে আসতে তার সাড়ে বাইশ কোটি বছর সময় লাগে। মিল্কিওয়ের চারপাশে সূর্যের বেগ সেকেন্ডে প্রায় ২২০ কিলোমিটার। তার মানে সূর্য ঘন্টায় সাত লক্ষ ৯২ হাজার কিলোমিটার বেগে ছুটছে। সূর্য নিজের অক্ষের ওপর নিজের চারপাশেও ঘুরছে। নিজের চারপাশে একবার ঘুরতে সূর্যের সময় লাগে ২৭ থেকে ৩৫ দিন।
            সূর্য তৈরি হবার সময়েই তার ঘূর্ণনের ফলে চারপাশে গ্যাস ও মহাজাগতিক ধুলোর একটা বিশাল চাকতির মতো তৈরি হয়েছে। এর উপাদানগুলোর শতকরা ৯৮ ভাগ হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম এবং বাকি সব পদার্থ মিলিয়ে শতকরা মাত্র দুই ভাগ। হিলিয়াম নিষ্ক্রিয় গ্যাস বলে অন্য কোন পদার্থের সাথে তার কোন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নেই। তাই সব হিলিয়াম গ্যাস হিসেবে রয়ে গেছে। হাইড্রোজেন অন্য মৌলের সাথে রাসায়নিক ক্রিয়া করে। ফলে তৈরি হলো পানি, মিথেন, অ্যামোনিয়া ইত্যাদি। কিন্তু আশেপাশে কার্বন, অক্সিজেন ইত্যাদি খুব বেশি নেই। ফলে বেশিরভাগ হাইড্রোজেনও গ্যাস হিসেবেই রয়ে গেলো। সূর্য তৈরি হবার সময় বেশিরভাগ হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম সূর্যের ভেতর ঢুকে গেলো। তারপরও কিছু অবশিষ্ট রয়ে গিয়েছিল। সেই অবশিষ্ট উপাদান থেকে তৈরি হয়েছে সূর্যের গ্রহগুলো।
            নতুন সূর্য তৈরি হবার পর আস্তে আস্তে উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। অভিকর্ষণ বলের পরিমাণ বাড়তে শুরু করেছে। তার ঘূর্ণনের বেগও বাড়তে শুরু করেছে। ফলে সূর্যের চারপাশে সৌরতরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছে। এই তরঙ্গের ঝড়ে সূর্যের চারপাশের হালকা গ্যাসগুলো উড়ে চলে গেলো অনেক দূরে - বলয়ের বাইরের দিকে। অপেক্ষাকৃত ভারি পদার্থগুলো রয়ে গেলো কাছাকাছি বলয়ে। সেখানে অক্সিজেন, কার্বন, নাইট্রোজেন ইত্যাদি সামান্য পরিমাণে যেগুলো আছে সেগুলো নিজেদের সাথে ক্রিয়া-বিক্রিয়া করে বিভিন্ন রকমের ছোট ছোট যৌগে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সূর্য যখন ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছিলো ভেতরের গ্যাসগুলো গরম হয়ে ক্রমশ বাইরের দিকে চলে যাচ্ছিলো এবং একটা পদার্থের স্রোত বয়ে যাচ্ছিলো সুর্যের কেন্দ্র থেকে পরিধির দিকে। বাইরের দিকে গিয়ে এই গ্যাসগুলো বড় বড় গ্যাসপিন্ডে পরিণত হলো। যার ফলে তৈরি হলো বিশাল গ্যাসীয় গ্রহগুলো - বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন।
            একটু ভারী কণাগুলো যেগুলো ভেতরের বলয়ে রয়ে গিয়েছিল তারা একে অপরের গায়ে লেগে গিয়ে এবং নিজেদের মধ্যে মহাকর্ষ বলের প্রভাবে ছোট ছোট পিন্ডে পরিণত হলো। ক্রমশ এগুলো একে অপরের সাথে মিশে বড় হতে থাকলো এবং ভারী হতে থাকলো। প্রায় এক লক্ষ বছর লাগলো এই ছোট ছোট পিন্ডগুলো মিলে এক কিলোমিটার ব্যাসের পিন্ডে পরিণত হতে। এগুলোকে গ্রহের কণা বা প্ল্যানেটেসিম্যাল (planetesimal) বলা হয়। এগুলো ঘুরতে ঘুরতে ক্রমশ বড় হয়ে গ্রহে পরিণত হয়েছে।



সূর্যের আটটি গ্রহকে কঠিন এবং গ্যাসীয় - এই দু'ভাগে ভাগ করা যায়। সূর্যের চারটি ভারী কঠিন গ্রহ হলো বুধ, শুক্র, পৃথিবী ও মঙ্গল। আর চারটি গ্যাসীয় গ্রহ হলো - বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন। আগে প্লুটোকেও সূর্যের গ্রহ হিসেবে ধরা হতো। কিন্তু প্লুটো এখন আর গ্রহের মর্যাদা পাচ্ছে না।
            গ্যাসীয় গ্রহগুলোর পরে সূর্যের চারদিকে আরেকটি বলয় দেখা যায়। খুবই ঠান্ডা একটা বলয়। এই বলয় বা বেল্টের নাম কুইপার বেল্ট (Kuiper belt)। আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেরার্ড কুইপারের নাম অনুসারে এই বেল্টের নাম রাখা হয়েছে ১৯৯০ সালে।  এই কুইপার বেল্টে গ্রহের মতো অনেক জমাট ঠান্ডা বস্তুপিন্ড ঘুরে বেড়াচ্ছে সৌরজগতের চারপাশে।

           

১৯৩০ সালে প্লুটো আবিষ্কৃত হবার পর প্লুটোকে সূর্যের নবম গ্রহ বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯৯২ সালে কুইপার বেল্টে প্লুটোর মতো অসংখ্য ছোট ছোট বস্তুপিন্ড দেখা যায়। তখন বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে এতগুলো গ্রহ একই জায়গায় একসাথে তো থাকতে পারে না। প্রশ্ন ওঠে - প্লুটোকে গ্রহ বলা হবে কিনা। ২০০৫ সালে কুইপার বেল্টে আবিষ্কৃত হয় আরেকটি বস্তুপিন্ড - যার নাম এরিস। এরিস আয়তনে প্লুটোর চেয়ে বড়। প্লুটো গ্রহ হলে এরিসকেও তো গ্রহ বলতে হয়। ২০০৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি বা আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সমিতি প্রাগে একটা জরুরি মিটিং ডাকে। সেই মিটিং-এ সিদ্ধান্ত হয় - গ্রহ হিসেবে স্বীকৃতি পাবার প্রধান শর্ত কী কী হবে। বিজ্ঞানীরা ঠিক করলেন যে গ্রহ আমরা তাদেরই বলবো -

  • যারা সূর্যের চারপাশে নিজ নিজ কক্ষপথে অবিরাম ঘুরছে।
  • যাদের কমপক্ষে এমন ভর আছে যার ফলে তাদের আকার হবে গোলকের মতো।
  • যাদের আলাদা কক্ষপথ আছে - অর্থাৎ সূর্যের চারপাশে তারা যে পথে ঘুরবে সেই পথে আর কোনকিছু থাকবে না।  

দেখা গেলো প্লুটো শেষের শর্তটি মোটেও পূরণ করতে পারছে না। ফলে প্লুটো গ্রহের মর্যাদা হারিয়ে এখন কুইপার বেল্টের অন্যান্য বস্তুরপিন্ডের মতো একটা বস্তুপিন্ড মাত্র। প্লুটোকে এখন ডোয়ার্ফ প্ল্যানেট বা বামন গ্রহও বলা হয়।  
            সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ বুধ - তার প্রথম গ্রহ। সে হিসেবে সূর্য থেকে দূরত্বের ভিত্তিতে সূর্যের তৃতীয় গ্রহ হলো পৃথিবী। আমাদের একমাত্র গ্রহ - যেখানে উদ্ভূত হয়েছে প্রাণের বাসযোগ্য আবহাওয়া, তরল পানি এবং প্রাণ।
            সৌরজগতের গ্রহগুলোর আকার, আয়তন, সূর্য থেকে দূরত্ব, ভর ইত্যাদি খুবই ভিন্ন। এদের তৈরি হতেও সময় লেগেছে সর্বনিম্ন চল্লিশ হাজার বছর থেকে এক শ' কোটি বছর পর্যন্ত। গ্রহগুলোর তুলনামূলক তথ্য নিচের সারণিতে দেয়া হলো।


বুধ
শুক্র
পৃথিবী
মঙ্গল
বৃহস্পতি
শনি
ইউরেনাস
নেপচুন
সূর্য থেকে দূরত্ব (কোটি কি.মি)


.


১০.


১৫.


২২.


৭৭.


১৪৩.


২৮৭.


৪৪৯.
তৈরি হতে সময় লেগেছে (বছর)

৮০ হাজার

৪০ হাজার

১ লাখ ১০ হাজার

২ লাখ

১০ লাখ

৯০ লাখ

৩০ কোটি

১০০ কোটি
পৃথিবীর তুলনায় ভর

.০৫৫

.৮২


.১১

৩১৭.৯৪

৯৫.১৮

১৪.৫৩

১৭.১৪
ঘনত্ব (g/cm3)
.৪৩
.২৫
.৫২
.৯৫
.৩৩
.৬৯
.২৯
.৬৪
পৃথিবীর তুলনায় ব্যাস

.৩৮

.৯৫


.৫৩

১১.

.৪৫

.০১

.৮৮
পৃথিবীর তুলনায় আয়তন

.০৫৬

.৮৬


.১৫

১২৩৬

৬৮৯

৬৩.

৫৭.
পৃথিবীর তুলনায় g এর মান *

.২৮

.৮৮


.৩৮

.৩৪

.৯৩

.৭৯

.১২
চাঁদের সংখ্যা
১৬
১৭
১৫
পৃথিবীর তুলনায় দিনের দৈর্ঘ্য

১৭৬ দিন

১১৭ দিন

১ দিন

১ দিন

.৯২ ঘন্টা

১০.৭৭ ঘন্টা

১৭.২৪ ঘন্টা

১৬.১ ঘন্টা
গড় তাপ-
মাত্রা (C)
১৭০
৪৭০
২২
-৬৩
-১৩০
-১৩০
-২০৫
-২২০
*g= অভিকর্ষজ ত্বরণ



[1] মহাকর্ষ বলের সূত্র আবিষ্কার করেন স্যার আইজাক নিউটন ১৬৮৭ সালে। মহাবিশ্বের সব গ্রহ-নক্ষত্র একে অপরকে একটা বল দ্বারা পরস্পরের কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করে। এই বলের নাম মহাকর্ষ বল। দুটো বস্তুর মধ্যে এই বলের পরিমাণ বস্তু দুটোর ভরের গুণফলের সমানুপাতিক এবং তাদের মধ্যকার দূরত্বের বর্গের বিপরীত অনুপাতিক। তার মানে বস্তু যত ভারী হবে তাদের মধ্যে মহাকর্ষ বলের পরিমাণ তত বেশি হবে। আর বস্তু দুটোর দূরত্ব যত দূরে হবে তাদের মধ্যে আকর্ষণের পরিমাণ তত কম হবে। আবার গ্রহ-উপগ্রহগুলোর সব পদার্থকে তারা তাদের অভিকর্ষজ বল দ্বারা তাদের কেন্দ্রের দিকে টেনে রাখে। সে কারণেই কোন কিছু উপর দিকে ছুঁড়ে দিলে তা কেন্দ্রের দিকে অর্থাৎ নিচের দিকে নেমে আসে।
[2] আলো এক সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার হিসেবে এক বছর সময়ে যতদূর যেতে পারে সেই দূরত্বকে এক আলোকবর্ষ বলা হয়। এক আলোকবর্ষ = ৯৪,৬০৮ কোটি কিলোমিটার।
[3] প্রদীপ দেব, অর্ক ও সূর্যমামা, ২০১৫, মীরা প্রকাশন, ঢাকা।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

বিজ্ঞানী গীতাঞ্জলি রাও

  পানি-দূষণের মাত্রা নির্ধারণের দ্রুততম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ‘টেথিস’ উদ্ভাবন করে গীতাঞ্জলি রাও যখন   ২০১৭ সালে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ তরুণ বিজ্ঞানীর শ...

Popular Posts