Monday, 4 November 2019

পৃথিবী সূর্যের তৃতীয় গ্রহ - পর্ব ১৮



আবহাওয়ার পরিবর্তন

পৃথিবীর আবহাওয়া ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে প্রতিদিন প্রতিঘন্টায়। এর মূল কারণ সূর্যের সাথে পৃথিবীর সম্পর্ক। সূর্য পৃথিবীকে একটি সৌরশক্তি চালিত তাপ-ইঞ্জিনে পরিণত করেছে। সুর্যের তাপে পৃথিবীর পিঠের বাতাস গরম হয়ে হালকা হয়ে উপরের দিকে উঠে যায়, উপরের ঠান্ডা হাওয়া নিচে চলে আসে - এভাবে বায়ুপ্রবাহের সৃষ্টি হয়।
                পৃথিবীকে কোন রকম নাড়াচাড়া না করলে এর বায়ুপ্রবাহও যেমন আছে তেমন থাকতো। কোথাও কোন সমস্যা হতো না। কিন্তু এটাকে তো তাপমাত্রা ও চাপের পরিবর্তন না করে রাখা যায় না। পৃথিবী নিজের অক্ষে ঘুরে। এর দিন-রাত্রি হয়। বাতাস ঠান্ডা গরম হয়। বায়ু প্রবাহ হয়। সেই প্রবাহ পাহাড়ে  বা অন্য কোথাও বাধা পেয়ে ক্ষেপে ওঠে। সবকিছু মিলিয়ে সারাক্ষণ বিশৃঙ্খলা চলছেই। ফলে পৃথিবীতে দমকা হাওয়া, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো এগুলো দেখা যায়। এগুলো পৃথিবীর চেহারা বদলে দেয়।






পানি চক্র

আমাদের জানামতে পৃথিবী হলো একমাত্র গ্রহ যেখানে কঠিন, তরল ও বাষ্প এই তিন অবস্থাতেই পানি আছে। এখানে কঠিন বরফ আছে, তরল পানি আছে, উষ্ণ জলীয় বাষ্প আছে। পানি পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে, সূর্যের তাপ এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পরিচলন করে। পানি পৃথিবীর চেহারা বদলে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। পানির ফলে মেঘ হচ্ছে, বৃষ্টি হচ্ছে, নদী ভাঙছে, চর জাগছে। পৃথিবীর আবহাওয়া পরিবর্তনের মূল ভূমিকা পালন করে  বাতাস ও পানি।   






জলীয় বাষ্প, মেঘ  ও কুয়াশা

পৃথিবীর বাতাসে গড়ে শতকরা এক ভাগ জলীয় বাষ্প আছে। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে প্রায় দশ কিলোমিটার পর্যন্ত জলীয় বাষ্প পাওয়া যায়। সূর্যের তাপে পৃথিবীর উপরিতলে যেখানে যেখানে পানি আছে - পুকুর নদী হ্রদ সাগর মহাসাগর - সবখান থেকে পানি বাষ্প হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ায়। তাছাড়া উদ্ভিদ - বিশেষ করে গাছের পাতা ও ঘাস নিজেদের গা থেকে জলীয় বাষ্প বের করে দেয়। সেগুলোও বাতাসে মিশে। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে গেলে আর্দ্রতা বেড়ে যায়। সে সময় আমাদের শরীর থেকে ঘাম শুকাতে চায় না। ভেজা জামাকাপড় শুকায় না। এমনকি ঘরের দেয়াল পর্যন্ত ঘেমে যায়। পৃথিবীর বাতাসে যে পরিমাণ জলীয় বাষ্প ভেসে বেড়াচ্ছে তার সবগুলোকে পানিতে পরিণত করলে পুরো পৃথিবী আড়াই মিটার (আট ফুটের বেশি) পানিতে ডুবে যাবে।
            সাগরের উপর দিয়ে উষ্ণ বাতাস যাবার সময় জলীয় বাষ্প টেনে নেয়। তারপর মাটির উপর দিয়ে যাবার সময় সেই বাতাস ঠান্ডা হয়। পাহাড়ের মাঝ দিয়ে যাবার সময়ও গরম বাতাস ঠান্ডা হয়ে যায়। তখন বাতাসের জলীয় বাষ্পের ঘনত্ব বেড়ে গিয়ে তারা মেঘ হয়। মেঘে খুবই ক্ষুদ্রাকৃতির অসংখ্য পানির অণু এবং বরফের কণা থাকে। কিন্তু তারা এত ছোট যে বাতাসের তুলনায় তাদের ওজন অনেক কম থাকে। তাই তারা বাতাসে ভেসে বেড়ায়।



কুয়াশাও এক ধরনের মেঘ তবে মেঘের চেয়ে কিছুটা ভারী। কোটি কোটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পানির অণু দ্বারা তৈরি। ভেজা মাটি থেকে যখন অনেকগুলো পানির অণু একসাথে হালকা হয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করে তখন কুয়াশার সৃষ্টি হয়। বাতাসের প্রবাহ খুব ধীর হলে এগুলো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দ্রুত যেতে পারে না। অনেক সময় বাতাসের তাপমাত্রা হঠাৎ কমে গেলে ভূমির কাছের জলীয় বাষ্প জমে গিয়ে কুয়াশার সৃষ্টি করে। কুয়াশার ভেতর দিয়ে বেশিদূর দেখা যায় না।



বৃষ্টি

মেঘ যখন বাতাসে ভেসে বেড়ায় তখন সেখানে যে পানির অণুগুলো থাকে সেগুলো প্রায় বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকে। কিন্তু মেঘ যদি কোন কারণে চলাচলে বাধা পায় - যেমন পাহাড়ের গায়ে লেগে বা নিচের দিক থেকে আসা বাতাসের কারণে - তখন পানির অণুগুলো একটা অন্যটার সাথে লেগে গিয়ে বাতাসের চেয়ে ভারী হয়ে যায়। তখন তারা বৃষ্টির আকারে নিচের দিকে ঝরে পড়তে শুরু করে। তোমরা নিশ্চয় খেয়াল করে দেখেছো - যখন হালকা বৃষ্টি বা গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হয় - তখন বৃষ্টির ফোঁটার আকার খুবই ছোট থাকে। হালকা বৃষ্টির ফোঁটার ব্যাস এক মিলিমিটারের অর্ধেকের বেশি হয় না। কিন্তু যখন জোরে বৃষ্টি হয় তখন বৃষ্টির ফোঁটার ব্যাস দুই মিলিমিটার পর্যন্ত হয়ে যায়। যখন বজ্রপাত সহ বৃষ্টি হয় - তখন ফোঁটার ব্যাস পাঁচ মিলিমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
            উষ্ণ বিষুবীয় অঞ্চলে তাপমাত্রা খুব একটা কমে না। সেখানে বৃষ্টি হয় মেঘের সাথে মেঘের সংঘর্ষের ফলে। কিন্তু যেখানে খুব শীত পড়ে সেখানে মেঘের পানির অণুগুলো জমে বরফ হতে শুরু করে। তখন ভারী হয়ে বৃষ্টির আকারে পড়ে যায়। অনেক সময় ছোট ছোট বরফের টুকরোও নেমে আসে বৃষ্টির সাথে। আমরা তাকে শিলাবৃষ্টি বলি।
            পৃথিবীতে অনেক জায়গা আছে যেখানে সারাবছরই বৃষ্টি হয়। যেমন হাওয়াই দ্বীপের ওয়াই-অ্যালি-অ্যালি পাহাড়ে বছরে ৩৬৫ দিন বৃষ্টি হয়। আবার কলম্বিয়ায় লোরো নামে একটা জায়গা আছে যেখানে বছরে ১৩০০ সেন্টিমিটার[1] বৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়। সাধারণত পাহাড়ি অঞ্চলে বেশি বৃষ্টিপাত হয় কারণ সেখানে মেঘ শীতল হবার সুযোগ বেশি থাকে।
            বর্তমান পৃথিবীতে শিল্প-কারখানার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। বাতাসে সালফার কার্বন-ডাই-অক্সাইড সহ আরো অনেক ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মিশে যাচ্ছে। সেগুলো মেঘের গায়ে লাগছে - ফলে বৃষ্টির সময় সেগুলো দ্রবীভূত আকারে পৃথিবীতে নেমে আসছে। বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে বৃষ্টি সামান্য অ্যাসিডিক হয়ে যায়। তখন অ্যাসিড বৃষ্টি হয়। এই অ্যাসিড রাসায়নিক বিক্রিয়া করে পৃথিবীর পরিবেশ বদলে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।





পৃথিবীর মানুষ পানির জন্য বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে বেশিরভাগ সময়। কারণ সমুদ্রের পানি লবণাক্ত বলে কৃষিকাজে এবং প্রাত্যাহিক ব্যবহারের জন্য সমুদ্রের পানি ব্যবহার করা যায় না। তাই বৃষ্টি অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের বড় বন্ধু। কিন্তু অনিয়মিত বৃষ্টি এবং পানি নিষ্কাশনে সঠিক পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের অভাবে বন্যা হয়ে যায়। আমাদের দেশে প্রতিবছরই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় অসংখ্য মানুষ। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে এখন সামান্য বৃষ্টিতেই রাস্তাঘাট ডুবে যায়। আবার অন্যচিত্রও আছে। শুষ্ক মৌসুমে মাসের পর মাস অনাবৃষ্টির ফলে খরা দেখা দেয়। অনেক কৃষক তখন অসহায় হয়ে পড়েন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পিছিয়েপড়া জাতি বড় বেশি প্রকৃতিনির্ভর। ফলে তারা প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না খুব বেশি। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত জাতিকে প্রাকৃতিক শক্তির কাছে সহজে মাথা নত করতে হয় না।





বজ্রপাত

কোন জায়গার বাতাস যখন গরম হয়ে ওঠে তখন তা হালকা হয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করে খুব দ্রুত। সেই বাতাসের জায়গা দখল করার জন্য ঠান্ডা বাতাস বেশ দ্রুত চলে আসে নিচের দিকে। ফলে উপরের দিকে যে গরম বাতাস উঠছে তার বেগ আরো বেড়ে যায়। বায়ুমন্ডল তখন ভারসাম্য হারায়। ভূমি থেকে উপরের মেঘের দিকে তখন একটা বাতাসের স্তম্ভ তৈরি হয়। মেঘের ভেতরের পানির কণা ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বরফের কণার ওপর গরম বাতাসের ঘর্ষণে বৈদ্যুতিক চার্জ তৈরি হতে থাকে। ফলে মেঘের ভেতর প্রচুর স্থির বিদ্যুৎ জমা হয়। মেঘের ভেতরে ঋণাত্মক চার্জ জমে এবং মেঘের উপরের দিকে ধনাত্মক চার্জ জমে। ধনাত্মক চার্জ ঋণাত্মক চার্জকে আকর্ষণ করে। এই প্রচন্ড আকর্ষণের ফলে তারা যখন মিলিত হয় তখন প্রচুর স্থির বিদ্যুৎ হঠাৎ মুক্ত হয়ে পড়ে। প্রচন্ড শক্তির বিদ্যুৎ ঝলক দেখা দেয় তখন - আমরা এই বিদ্যুৎ ঝলককে বজ্র-বিদ্যুৎ বলি।



একটা বজ্রবিদ্যুতে প্রায় এক কোটি ওয়াট বিদ্যুৎ শক্তি থাকতে পারে। খুব কম সময়ের জন্য যে আলো আমরা দেখি সেই আলোর উজ্জ্বলতা কেমন ধারণা করতে পারো? কোন জায়গায় যদি ২০ লক্ষটি  ১০০ ওয়াটের বাল্ব জ্বালাও যেরকম উজ্জ্বলতা হবে সেরকম উজ্জ্বলতা একটি বজ্রবিদ্যুৎচমকে।
            বিদ্যুৎচমকের কয়েক সেকেন্ড পরে যে আমরা প্রচন্ড শব্দ শুনি সেটা কোত্থেকে আসে? বিদ্যুৎচমকের আলোর সাথে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। যেখানে বজ্র উৎপন্ন হয় সেখানে সেই সময় তাপমাত্রা উঠে যেতে পারে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রায় বাতাস হঠাৎ এত বেশি সম্প্রসারিত হয় যে বাতাসের তরঙ্গের ধাক্কায় প্রচন্ড শব্দ হয়। যেটা বজ্রপাতের শব্দ। আলো এবং শব্দ প্রায় একই সময়ে উৎপন্ন হয়। কিন্তু শব্দের গতি আলোর গতির চেয়ে অনেক কম বলে আমরা শব্দটা দেরিতে শুনতে পাই।
            পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১০০ টা বজ্রপাত হচ্ছে কোথাও না কোথাও। প্রতিদিন গড়ে ৮৬ লক্ষ বজ্রপাত হয় পৃথিবীতে।



টর্নেডো

বজ্রবিদ্যুৎপূর্ণ মেঘের নিচে মাঝে মাঝে দেখা যায় হঠাৎ একটা বিশাল বাতাসের ঘূর্ণি ঘুরতে ঘুরতে আকাশের দিকে টানেলের মতো উঠে যাচ্ছে। তারপর এই ঘূর্ণিটি যেদিকে যায় সেদিকে নিমেষে সবকিছু তছনছ করে উড়িয়ে নিয়ে যায়। এগুলো টর্নেডো। এদের গতিবেগ ঘন্টায় ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এরা নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারে পুরো এলাকা।




কীভাবে উৎপন্ন হয় এসব টর্নেডো? কীভাবেই বা এত দ্রুত শেষও হয়ে যায়? বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে অনেকটাই বুঝে ফেলেছেন টর্নেডোর গতিপ্রকৃতি - কিন্তু এটাকে থামানোর বা অনেক আগে এটার ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া এখনো সম্ভব হচ্ছে না।
            টর্নেডো সৃষ্টি হয় দুই ধরনের বায়ুপ্রবাহের মিশ্রণের ফলে। দুটো ভিন্ন গতির বায়ুপ্রবাহ যখন একে অপরের মুখোমুখি হয় বা ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় চলে আসে তখন টর্নেডো সৃষ্টি হতে পারে। ধরা যাক মেঘের মধ্যে অনেক উপরে বাতাস চলাচল করছে ঘন্টায় চল্লিশ কিলোমিটার বেগে। নিচের ভারী বাতাস চলছে ঘন্টায় ৮ কিলোমিটার বেগে। বজ্রপাতের মাধ্যমে যদি এই দুই বায়ুপ্রবাহের সংযোগ ঘটে তখন তাদের মাঝে একটা টানেলের সৃষ্টি হয়। বৃষ্টিপাত হলে সেই টানেলের এক মুখ ভূমি স্পর্শ করে। তখন সেই মুখে যা পড়ে তাই নিমেষে শূন্যে উড়িয়ে নিয়ে যায়। অনেক সময় এই টানেলের মুখ ঘুরতে পারে প্রায় ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে। তার মানে এই পুরো এলাকাটি লন্ডভন্ড হয়ে যায় কয়েক মিনিটের মধ্যে।
            আমেরিকার ওকলাহোমা ও ক্যানসাস রাজ্যে বছরে প্রায় এক হাজারটি টর্নেডো হয়। সেখানে মানুষজন নিজেদের বাড়ির নিচে ভূ-গর্ভস্থ বাংকার তৈরি করে। টর্নেডোর সংকেত পেলে তারা ওই ভূগর্ভের ঘরে ঢুকে যায়। টর্নেডো চলে যাবার পর বেরিয়ে হয়তো দেখতে পায় যে তাদের ভূমির উপরের ঘর কোথাও উড়ে চলে গেছে বা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। ১৯৯০ সালে ক্যানসাসে এক টর্নেডো ৮৮টি বগি সহ একটা ট্রেন উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল।






সাইক্লোন

ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের সাথে আমরা সবাই পরিচিত। সমুদ্রে নিম্নচাপ হলে সাইক্লোনের আশঙ্কা দেখা দেয়। তখন সমুদ্রের উপকুলে সতর্ক সংকেত দেয়া হয়। আবহাওয়া দপ্তর একটু পরপর জানিয়ে দেয় নিম্নচাপটি কোনদিকে যাচ্ছে এবং সমুদ্রে সাইক্লোন তৈরি হচ্ছে কিনা। বাংলাদেশের ইতিহাসে বেশ কয়েকবার মারাত্মক সাইক্লোন বয়ে গেছে আমাদের দেশের ওপর দিয়ে। মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রতিবারই। সাইক্লোনের ফলে সমুদ্রের ঢেউ ফুঁসে উঠে। উপকুল ভেসে যায় বন্যার পানিতে। পৃথিবীতে এপর্যন্ত যত সাইক্লোন হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সাইক্লোনে। সাইক্লোনের প্রভাবে সৃষ্ট বন্যায় সেই বছর দুই লাখ ৬৬ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। ১৯৯১ সালেও বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে এক প্রকান্ড সাইক্লোনে লক্ষাধিক মানুষ মারা গেছে। অন্যান্য সম্পদেরও ক্ষতি হয়েছে ভীষণ।
            প্রায়ই শোনা যায় পৃথিবীর কোথাও না কোথাও সাইক্লোনের সৃষ্টি হয়েছে। মাঝে মাঝে শোনা যায় হারিক্যান, আবার মাঝে মাঝে শোনা যায় টাইফুন। আসলে সাইক্লোন, হারিক্যান, আর টাইফুন একই জিনিসের ভিন্ন ভিন্ন নাম। আটলান্টিক ও উত্তর-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্টি হলে সেই ঘূর্ণিঝড়ের নাম হয় হারিক্যান। উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে (এশিয়ার দিকে) তার নাম টাইফুন, আর আমাদের দেশসহ ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের নাম সাইক্লোন। তবে সাধারণত ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ঘন্টায় ১১৯ কিলোমিটার বা ৭৪ মাইলের বেশি হলেই তাকে সাইক্লোন বা টাইফুন বা হারিক্যান বলা হয়।


সাইক্লোন কীভাবে সৃষ্টি হয় তার একটা ধারণা পাওয়া যাবে উপরের ছবি থেকে। একটা সাইক্লোনকে মাঝখানে কাটতে পারলে এই ছবির মতো দেখা যেতো। সাগরের পানি যখন গরম হতে থাকে তখন সেই জায়গার বাতাস গরম হয়ে জলীয় বাষ্প সহ উপরের দিকে উঠে যেতে থাকে। সেই বাতাসের খালি জায়গা দখল করতে ছুটে আসে আশেপাশের ঠান্ডা বাতাস। ফলে একদিকে গরম বাতাস উপরে উঠে যাচ্ছে - অন্যদিক থেকে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে। এভাবে একটা বাতাসের চক্র তৈরি হয়। ছবিতে লাল চক্রাকার চিহ্ন খেয়াল করো। বাতাসগুলো যখন ঘুরতে থাকে - যেই জায়গাকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে - তাকে সাইক্লোনের চোখ বা আই অব দি স্টর্ম বলে। বাতাসগুলো যখন দ্রুত উপরের দিকে উঠতে থাকে তখন নিচের তলের কাছে খুব বেশি বাতাস থাকে না - ফলে সেখানে বাতাসের চাপ কমে যায় বা নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। তখন আশেপাশের বাতাসের বেগ বেড়ে যায় - খালি জায়গায় আসার জন্য। তখন বাতাসের ধাক্কাধাক্কিতে তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এবং তাপমাত্রার সাথে সাথে বাতাসে জলীয়বাষ্পও বেড়ে যায়। এই গরম বাতাসগুলো উপরের দিকে উঠতে উঠতে ঠান্ডা হয়ে মেঘ তৈরি করে।
            এই প্রক্রিয়াটি যতক্ষণ চলে ততক্ষণ ঘূর্ণিঝড়ের চোখের চারপাশে বাতাসের বেগ বাড়তে থাকে। বাতাসের বেগ বাড়তে বাড়তে যখন ঘন্টায় ১১৯ কিলোমিটার বা তার চেয়ে বেশি হয়ে যায় তখন উৎপত্তির স্থলভেদে তার নাম হয়ে যায় সাইক্লোন বা টাইফুন বা হারিক্যান। বাতাস ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গার দিকে চলে যেতে পারে। এভাবে তাদের গতিবেগ কমে যেতে পারে - আবার অনেক সময় কিছু সময়ের জন্য গতিবেগ দ্রুত বেড়েও যেতে পারে। গতিবেগ বেড়ে এটা যেদিকে যায় সেদিকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
সাইক্লোন তৈরি হবার প্রক্রিয়া গড়ে ৩ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত চলতে পারে। উত্তর গোলার্ধে যে সব ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয় সেগুলো ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘুরে। আর যেগুলো দক্ষিণ গোলার্ধে সৃষ্টি হয় সেগুলো ঘড়ির কাঁটা যেদিকে ঘুরে সেদিকে ঘুরে। পৃথিবীর অক্ষের ওপর ঘূর্ণনের ফলেই এরকম হয়।
            বর্তমানে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পৃথিবীর আবহাওয়ার ওপর নজর রাখা হচ্ছে সবসময়। কোথাও সাইক্লোন সৃষ্টির লক্ষণ দেখা দিলেই মানুষকে সতর্ক করে দেয়া সম্ভব হচ্ছে। তখন সেই সাইক্লোনের চোখের ওপর চোখ রাখা হয় প্রতি সেকেন্ডে। লক্ষ্য করা হয় তার গতিবিধি এবং সে অনুসারে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। সেজন্যই বর্তমানে সাইক্লোনের ক্ষয়ক্ষতি আগের চেয়ে অনেক কম হয়। এবং এটা আবারো সত্যি যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত দেশে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অনুন্নত দেশের চেয়ে কম হয়।



[1] বৃষ্টিপাত মাপার জন্য ২০৩ মিলিমিটার (প্রায় ৮ ইঞ্চি) ব্যাসের একটি গোলাকার ফানেল একটা সিলিন্ডারের ওপর ভূমি থেকে ৩০ সেন্টিমিটার উপরে রেখে দেয়া হয়। সিলিন্ডারে বৃষ্টির পানি যতটুকু জমে সেটার উচ্চতাকে ততটুকু বৃষ্টিপাত হয়েছে ধরে নেয়া হয়। সিলিন্ডারে কমপক্ষে  এক মিলিমিটারের পাঁচ ভাগের এক ভাগ বৃষ্টি জমা হলে তা মাপা যায়।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

James Watson – an extraordinary scientist, but an intolerable racist and misogynist man

  The “Eagle” pub on the Cambridge campus has become as famous as Cambridge University itself, having witnessed hundreds of discoveries, inn...

Popular Posts