Monday 4 November 2019

পৃথিবী সূর্যের তৃতীয় গ্রহ - পর্ব ৬


পৃথিবীর বায়ুমন্ডল

পৃথিবী, শুক্র ও মঙ্গল - সূর্যের এই তিনটি গ্রহ প্রায় কাছাকাছি সময়ে জীবন শুরু করেছিল। শুক্রের আয়তন পৃথিবীর আয়তনের প্রায় সমান। মঙ্গল পৃথিবীর তুলনায় আয়তনে সামান্য ছোট। তিনটা গ্রহই শুরু করেছিল পিঠে জলীয় বাষ্প ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিয়ে। কিন্তু হলো কী - তিনটা গ্রহই সূর্যের চারপাশে নিজ নিজ কক্ষপথে ঘুরছিল। সূর্যের তাপ যখন বাড়তে শুরু করলো - শুক্র যেহেতু সূর্যের বেশ কাছে - সেখানে সূর্যের প্রচুর তাপের ফলে তাপমাত্রা বেড়ে গেলো। শুক্রের বাইরের স্তরের গড় তাপমাত্রা প্রায় চার শ' ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে শুক্রের সবগুলো জলীয়বাষ্প উড়ে চলে গেলো। কোন পানি অবশিষ্ট রইলো না। কিন্তু মঙ্গলের দূরত্ব সূর্য থেকে বেশ দূরে হওয়াতে সেখানে সূর্যের তাপ পৌঁছায় অনেক দেরিতে। মঙ্গল গ্রহের বাইরের স্তরের গড় তাপমাত্রা মাইনাস ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। ফলে মঙ্গলে পানির উপাদান যা আছে সব বরফ হয়ে গেলো। মঙ্গলের আবহাওয়া খুবই শুষ্ক এবং জমাট বরফের পিন্ডের মতো অবস্থা মঙ্গলের। ওদিকে  শুক্রে ভীষণ গরম আর আবহাওয়া মারাত্মক অ্যাসিডিক, মানে অ্যাসিডের উপাদান ভেসে বেড়াচ্ছে শুক্রের চারপাশে। কিন্তু শুক্র ও মঙ্গলের মাঝখানে অবস্থানের কারণে পৃথিবীতে ঘটলো অন্য ঘটনা।
            পৃথিবীর তাপমাত্রা শুক্রের মতো খুব বেশি গরমও নয়, আবার মঙ্গলের মতো খুব বেশি ঠান্ডাও নয়। পৃথিবী তৈরির সময় যেসব গ্যাস ও জলীয় বাষ্প ভেতরে আটকে ছিল পৃথিবীর তাপমাত্রা কমতে শুরু করার সাথে সাথে সেগুলো ভেতর থেকে বাইরের দিকে অর্থাৎ ভূ-পৃষ্ঠের দিকে চলে আসতে শুরু করলো। গ্যাসগুলো হালকা বলে ভূপৃষ্ঠের ওপর ভাসছিল। আবার মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে একেবারে উড়ে চলেও যেতে পারছিলো না। ফলে পৃথিবী নামক গোলকটির চারপাশে একটা বায়বীয় আবরণ - যাকে আমরা বায়ুমন্ডল বলছি - তৈরি হলো। আর জলীয়বাষ্প ভেতর থেকে বাইরে এসে ঠান্ডা হয়ে পানিতে পরিণত হলো। পৃথিবীর পিঠে পানিও তৈরি হতে শুরু হলো।
            কিন্তু প্রথম দশ কোটি বছর ধরে যে বায়ুমন্ডল ও পানি তৈরি হয়েছিল, থেইয়ার সাথে প্রচন্ড সংঘর্ষে এবং চাঁদ তৈরির সময় উৎপন্ন তাপে পুরো বায়ুমন্ডল ও সব পানি ধ্বংস হয়ে গেলো। পৃথিবীর অবস্থা হয়ে পড়লো প্রচন্ড গরম - অনেকটা শুক্রের মতো। পিঠের ওপর আগ্নেয়গিরির ফুটন্ত লাভার স্রোত, বাতাসে ভয়াবহ এসিড - পুরো গ্রহটিই জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ডের মতো হয়ে রইলো কয়েক কোটি বছর।



কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তাপমাত্রা কমতে শুরু করলো। গলিত লাভাগুলো জমে পাথর হয়ে গেলো। উপরের আবরণ যতই ঠান্ডা হতে শুরু করেছে মাধ্যাকর্ষণ বলের টানে ভারী পদার্থগুলো আস্তে আস্তে ভেতরের দিকে ঢুকে গেছে। ভারী ধাতব পদার্থ যেমন লোহা ও নিকেল চলে গেছে একেবারে পৃথিবীর কেন্দ্রে। সেখানে এই ধাতুগুলো সব একে অপরের সাথে মিশে একটা বিশাল লোহার গোলকে পরিণত হয়েছে। এই গোলকটি পৃথিবীর কেন্দ্র।
            তার চারপাশে প্রচন্ড উত্তাপে গলে যাওয়া লোহা, নিকেল ও অন্যান্য ভারী পদার্থের গলিত লাভার স্রোত আস্তে আস্তে ঘুরছে। তার উপরের স্তরে ভাসছে বিশাল বিশাল পাথর। এগুলো যদিও কঠিন - কিন্তু পানিতে যেরকম বিরাট বিরাট বরফের পাহাড় ভাসতে থাকে, সেরকম উত্তপ্ত তরলের উপর ভাসমান থাকলো। তাপ পরিচলন পদ্ধতিতে ভেতরের তাপ বাইরে আসতে লাগলো। এভাবে ভেতরটা ক্রমশ কঠিন হতে শুরু করলো। পৃথিবীর ভেতরের গঠন নিয়ে একটু পরে বিস্তারিত বলছি। আগে বায়ুমন্ডলের কথাটা শেষ করি।
            বস্তুর ভর যত বেশি তার ওপর মাধ্যাকর্ষণ বলের টানও তত বেশি। ফলে বেশি ভারী পদার্থগুলো পৃথিবীর ভেতর চলে গেছে - যাবার সময় ওখানে আটকে পড়া হালকা বস্তুগুলোকে উপরের দিকে পাঠিয়ে দিয়েছে। এভাবে যেসব জলীয় বাষ্প আর গ্যাস পৃথিবীর ভেতর আটকা পড়েছিল, তারা বেরিয়ে এলো বাইরে। তাপমাত্রা কমার সাথে সাথে আস্তে আস্তে পানি ও গ্যাস বেরিয়ে এসে পৃথিবীর বায়ুমন্ডল তৈরি হলো। পানি জমতে জমতে পৃথিবীর বুকে মহাসাগর তৈরি হয়ে গেলো। পৃথিবীর উপরিতলের শতকরা সত্তর ভাগ পানির দখলে। কীভাবে  হলো তা একটু পরে বলছি।  
            শুরুতে কিন্তু পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে কোন অক্সিজেন ছিলো না। ছিল শুধু হাইড্রোজেন, মিথেন, অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন সায়ানাইড ইত্যাদি সব বিষাক্ত গ্যাস। বায়ুদূষণের চূড়ান্ত ছিল তখন। কিন্তু সূর্যের তাপে হাইড্রোজেন মহাশূন্যে চলে গেলো। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি বড় গ্যাসের অণুকে ভেঙে তৈরি করলো নাইট্রোজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মিশ্রণ। পৃথিবীর বায়মন্ডল পরিণত হলো প্রধানত নাইট্রোজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মিশ্রণ।
            অনেকে মনে করেন যে পৃথিবীতে অক্সিজেন আছে বলেই প্রাণের উদ্ভব হয়েছে এখানে। কিন্তু ব্যাপারটা হয়েছে অন্যভাবে। পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হবার পর, বিশেষ করে উদ্ভিদ আসার পর যখন থেকে সালোক-সংশ্লেষণ শুরু হয়েছে - তখন থেকে পৃথিবীর বাতাসে অক্সিজেন যোগ হতে শুরু করেছে। ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল আজ থেকে ৩৪০ কোটি বছর আগে প্রাণের অস্তিত্ব দেখা যাবার পর। তার মানে পৃথিবীর জন্ম হবার একশ দশ কোটি বছরেরও বেশি সময় ধরে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে কোন অক্সিজেন ছিল না। 
            বর্তমানে সাড়ে চারশো কোটি বছর বয়স্ক এই পৃথিবীর বাতাসে প্রচুর অক্সিজেন (২১%) কিন্তু খুব সামান্য কার্বন-ডাই-অক্সাইড। পৃথিবীর বাতাসের বর্তমান উপাদানের তালিকা নিচের ছকে দেয়া হলো।

উপাদান
শতকরা পরিমাণ
নাইট্রোজেন (N2)
৭৮.০৪৮
অক্সিজেন (O2)
২০.৯৪৬
আর্গন (Ar)
.৯৩৪
কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2)
.০৩৬
নিয়ন (Ne)
.০০১৮২
হিলিয়াম (He)
.০০০৫২৪
মিথেন (CH4)
.০০০১৫
ক্রিপ্টন (Kr)
.০০০১১৪
হাইড্রোজেন (H2)
.০০০০৫
জলীয় বাষ্প (আর্দ্র বাতাসে)
.০০







বর্তমান পৃথিবীর বায়ুমন্ডল পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ৩৬,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। ঐ উচ্চতা পর্যন্ত পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ কাজ করে। তার বাইরে পৃথিবীর আকর্ষণ শূন্য হয়ে যায়। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলকে বেশ কয়েকটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে।




ট্রপোমন্ডল বা ট্রপোস্ফিয়ার (troposphere): পৃথিবীপৃষ্ঠের সাথে লাগানো বায়ুস্তর। এটা আমাদের জন্য সবচেয়ে দরকারি স্তর। কারণ এই স্তরেই বাতাসের যাবতীয় পরিবর্তন হয় এবং আমাদের আবহাওয়ার সবকিছু ঘটে। মেরু অঞ্চলে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৭ কিলোমিটার এবং বিষুবীয় অঞ্চলে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১৬ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই স্তর। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে যতই উপরের দিকে উঠতে থাকবে - বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা ততই কমতে থাকবে। প্রতি এক কিলোমিটার উচ্চতার জন্য তাপমাত্রা সাড়ে ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যায়।  ট্রপোস্ফিয়ার যেখানে থেমে গেছে মানে পজ নিয়েছে সেখানটার নাম ট্রপোপজ। মেরু অঞ্চলে এই ট্রপোপজের তাপমাত্রা মাইনাস ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিষুব অঞ্চলে তা মাইনাস আশি ডিগ্রি। বায়ুমন্ডলের ৭৫% ভাগ গ্যাস এবং ৯৯% জলীয় বাষ্প ট্রপোস্ফিয়ারে থাকে। আকাশের সব মেঘ এই স্তরেই থাকে।

স্ট্র্যাটোমন্ডল বা স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার (stratosphere): ট্রপোপজ থেকে ৫০ কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের বিস্তার। এই স্তরটি খুবই শুষ্ক - কারণ কোন মেঘ নেই, কোন জলীয় বাষ্প নেই এখানে। এই স্তরের শুরুর ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত তাপমাত্রার খুব একটা পরিবর্তন হয় না। কিন্তু তারপর হঠাৎ তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটে। কারণ ৩০ থেকে ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে আছে ওজোন স্তর। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করে এই ওজোন স্তর। এখানকার শেষ সীমার তাপমাত্রা প্রায় শূন্য ডিগ্রির কাছাকাছি।
মেসোমন্ডল বা মেসোস্ফিয়ার (mesosphere): মেসো শব্দের অর্থ মধ্যম বা মাঝখানের। মেসোমন্ডল হলো বায়ুমন্ডলের মধ্যস্তর। ভূ-পৃষ্ঠের ৫০ থেকে ৮০ কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত ব্যাপ্তি এই স্তরের। এই স্তরে উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে তাপমাত্রা কমতে থাকে। এই স্তরের একেবারে উপরের দিকে তাপমাত্রা মাইনাস ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে।

আয়নমন্ডল বা আয়নোস্ফিয়ার (ionosphere): মেসোমন্ডলের উপরের স্তর হলো আয়নমন্ডল। ভূ-পৃষ্ঠের ৮০ কিলোমিটার থেকে ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই স্তর। বায়ুমন্ডলের সবচেয়ে পুরু অঞ্চল এই আয়নোস্ফিয়ার। এই স্তরের সবচেয়ে উপরের অংশের নাম তাপমন্ডল বা থার্মোস্ফিয়ার। এই অঞ্চলে উচ্চতার সাথে তাপমাত্রা দ্রুত বাড়তে থাকে। এই স্তরের উপরিভাগে তাপমাত্রা বেড়ে এক হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে। এখানে বায়ুমন্ডলের সব গ্যাস আয়নিত[1] অবস্থায় থাকে। পৃথিবী থেকে বেতারতরঙ্গ পাঠালে তা এই স্তরে প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে ফিরে যায়। পৃথিবীর বাইরে থেকে গ্রহাণু বা অন্য কোন পদার্থ পৃথিবীর সীমায় ঢোকার সময় এই স্তরে এলে চার্জিত গ্যাসের সাথে বিক্রিয়ায় বস্তুর গায়ে আগুন ধরে যায়। 

এক্সোস্ফিয়ার (Exosphere): এটা বায়ুমন্ডলের সবচেয়ে বাইরের স্তর। ৪০০ কিলোমিটার থেকে উপরের স্তর এক্সোস্ফিয়ার। এই স্তরে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে অবিরাম। এক্সোস্ফিয়ারের বাইরের স্তরকে ম্যাগনেটোস্ফিয়ার বলে। পৃথিবীর কেন্দ্রে চৌম্বকত্বের প্রভাবে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের শেষ স্তর পর্যন্ত পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের একটা প্রভাব-বলয় থাকে। এটাই ম্যাগনেটোস্ফিয়ার। এই স্তর সূর্যের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করে।
            পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের কারণেই দিনের বেলায় পৃথিবীর আকাশ নীল। সমুদ্রের পানি নীল দেখায় কারণ সেখানে আকাশের ছায়া পড়ে। পৃথিবী ছাড়া অন্য কোন গ্রহের আকাশ নীল নয়। আবার রাতের বেলা - যখন সূর্য থাকে না - আকাশে একটুও নীল রঙ দেখা যায় না। রাতের আকাশ কালো। এমন কি চাঁদের আলোতেও আকাশ নীল দেখায় না। এর কারণ কী?



[1] আয়নিত হওয়া মানে গ্যাসের পরমাণুতে মুক্ত ইলেকট্রন থাকা। ফ্রি ইলেকট্রন বা মুক্ত ইলেকট্রনের ব্যাপারটা কী? যে কোন পদার্থের পরমাণুতে প্রোটন ও ইলেকট্রনের সংখ্যা থাকে সমান সমান। প্রোটনে থাকে পজিটিভ চার্জ, ইলেকট্রনে থাকে নেগেটিভ চার্জ। ইলেকট্রন ও প্রোটনের সংখ্যা সমান সমান হলে তাতে পজিটিভ ও নেগেটিভ মিলে মোট চার্জের পরিমাণ হয়ে যায় শূন্য। সেই অবস্থায় কোন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে না। পরমাণু বাইরে থেকে শক্তি পেলে তার ইলেকট্রন উত্তেজিত হয়ে পরমাণু থেকে বের হয়ে আসতে পারে। তখন মুক্ত ইলেকট্রন পাওয়া যায়। আর পরমাণুটি তখন আয়নিত হয়েছে বলা হয়।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

বিজ্ঞানী গীতাঞ্জলি রাও

  পানি-দূষণের মাত্রা নির্ধারণের দ্রুততম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ‘টেথিস’ উদ্ভাবন করে গীতাঞ্জলি রাও যখন   ২০১৭ সালে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ তরুণ বিজ্ঞানীর শ...

Popular Posts