Monday, 4 November 2019

পৃথিবী সূর্যের তৃতীয় গ্রহ - পর্ব ১১



পর্বতমালা কীভাবে গঠিত হলো

আগে মনে করা হতো পৃথিবীপৃষ্ঠে পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবী উত্তপ্ত অবস্থা  থেকে ঠান্ডা হবার সময় পৃথিবীর উপরের স্তরের সংকোচনের ফলে। এটা যদি সত্যি হতো পাহাড়-পর্বত পৃথিবীর সব জায়গায় সমান ভাবে থাকতো। কারণ ঠান্ডা তো সব জায়গায় একই ভাবে হয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর সব জায়গায় তো পাহাড়-পর্বত সমানভাবে নেই, এমন কি সব পাহাড়ের উচ্চতাও এক রকম নয়।
            এখন আমরা জানি যে টেকটোনিক প্লেটের চলাচলের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক কারণে পর্বতমালার সৃষ্টি হয়। দেখা যাক কীভাবে হয়।
            পাহাড়-পর্বতের দিকে খেয়াল করে দেখলে দেখতে পাবে সবগুলোই মোটামুটি একই রকম। ভাঁজ ভাঁজ। আসলেই এগুলো তৈরি হয়েছে ভূত্বকের ভাঁজ থেকে। কিন্তু পৃথিবীর ত্বকে ভাঁজ পড়েছে কীভাবে? মহাদেশীয় টেকটোনিক প্লেটের ধাক্কায়। টেকটোনিক প্লেটগুলো একে অন্যকে ক্রমাগত ঠেলতে থাকে। যেহেতু এরা আয়তনে অনেক বড় - এদের ধাক্কায় বলের পরিমাণও অনেক বেশি। কিন্তু এদের চাপ ক্রমাগত একমুখী হওয়াতে ধুমধাম করে দ্রুত সব লন্ডভন্ড হয়ে যায় না এই ধাক্কায়। যখন ভূ-পৃষ্ঠ এই পার্শ্বচাপ আর সহ্য করতে পারে না, তার উপরের অংশ ভাঁজ হয়ে যায়। এই ভাঁজ তৈরি হতে সময় লাগে অনেক বছর।




প্রায় দুই কোটি বছর আগে আফ্রিকান প্লেট ইটালিকে ঠেলে ইউরোপের প্লেটে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে বিখ্যাত ইউরোপিয়ান আল্‌প্স বা ইউরোপিয়ান পর্বত-মালা। প্যাসিফিক এবং নর্থ-আমেরিকান প্লেটের সংঘর্ষে সৃষ্টি হয়েছে রকি মাউন্টেন।
            প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে বিরাট আগ্নেয়গিরির উদ্‌গীরণের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশ অন্যান্য দক্ষিণ অঞ্চল থেকে আলাদা হয়ে উত্তরের দিকে সরে যায়। সমুদ্রের ঘন তলদেশ ঠেলার চোটে ঢুকে যায় এশিয়ান প্লেটের নিচে। ফলে হালকা সমুদ্র-তল মাটিসহ সবকিছু দুটো মহাদেশের প্লেটের ফাঁক দিয়ে উপরের দিকে উঠে যায়। প্রায় এক কোটি বছর আগে হিমালয় পর্বত-মালা গড়ে ওঠে এভাবে। মাউন্ট এভারেস্ট এখনো পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত-শৃঙ্গ।
            ইউরোপিয়ান এবং হিমালয় পর্বত-মালা তুলনামূলকভাবে অনেক নতুন। কিন্তু প্রায় পচিশ কোটি বছর আগে উত্তর আমেরিকায় অনেক পর্বত মালার উৎপত্তি হয়েছে এভাবে।
            আগ্নেয়গিরির উদ্‌গীরণের ফলেও কোন কোন পর্বতের সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীতে। যেমন, জাপানের মাউন্ট ফুজি। আগ্নেয়গিরি সৃষ্টিরও মুলে আছে টেকটোনিক প্লেটের চলাচলজনিত ধাক্কার ফলে সৃষ্ট চাপ ও তাপ।





আগ্নেয়গিরি

পৃথিবীর শুরু থেকেই আগ্নেয়গিরির উৎপাত চলছে পৃথিবীতে। পৃথিবীর প্রথম দিকের আগ্নেয়গিরি হতো পৃথিবীর ভেতরে জমে যাওয়া প্রচন্ড চাপে পৃথিবীর উপরিতল ফেটে গিয়ে। ফলে ভেতর থেকে গলিত লাভার সাথে অতিরিক্ত চাপ ও তাপ বেরিয়ে আসে পৃথিবীর ভেতর থেকে।
            টেকটোনিক প্লেটগুলো একে অপরের সাথে যখন প্রচন্ড বেগে ধাক্কা খায় তখন মাঝে মাঝে একটি প্লেট অন্যটির নিচে ঢুকে যায়। ফলে যেটা নিচে ঢুকে যায় সেটা এত গরম হয় যে তার সেই অংশের সব পাথর গলে যায়। প্রচন্ড তাপে চাপ এত বেড়ে যায় যে প্রচন্ড চাপে পৃথিবীর উপরিতল ভেদ করে তা লাভার আকারে বেরিয়ে আসে। মাঝে মাঝে পুরো এলাকা সহ উপরিতল ভূ-স্তর ভেদ করে উপরের দিকে পাহাড়ের মতো উঠে যায়। মাঝে মাঝে পুরো এলাকা প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে যেতে পারে।
            ১৮৮৩ সালে ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপ ক্রাকাটাউ এর নিচে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরিত হয়। ১৬৩টি গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এই বিস্ফোরণে। প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূর থেকে শোনা গিয়েছিল এই বিস্ফোরণের শব্দ। ৫৫ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল আগ্নেয়গিরির ছাই, লাভা, ও পাথর।
            ১৯৮৫ সালে কলম্বিয়াতে ২২০০০ মানুষ মারা যায় আগ্নেয়গিরিসৃষ্ট ৪০ মিটার উচু কাদার ঢেউয়ের নিচে পড়ে। আরমেরো শহরের কাছে একটা গভীর গিরিখাদ (ক্যানিয়ন) বিস্ফোরিত হয়ে এটা হয়েছিল। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে ইন্দোনেশিয়ার মাউন্ট রাউং-এ পাঁচটি আগ্নেয়গিরি লাভা উদ্‌গীরণ করে।  
            প্রায় দুই হাজার বছর আগে ৭৯ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন পম্পেই নগরী[1] ধ্বংস হয়ে গেছে মাউন্ট ভিসুভিয়াসের উদ্‌গীরণে। আগ্নেয়গিরির ২০ মিটার পুরু জ্বলন্ত লাভা ষোল হাজার মানুষ সহ পুরো নগরী নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল।





এখনো পৃথিবীর অনেক জায়গায় অনেকগুলো সুপ্ত এবং জীবন্ত আগ্নেয়গিরি আছে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেট টেকটোনিকের চারপাশে অনেকগুলো আগ্নেয়গিরি প্রশান্ত মহাসাগরের নিচে 'রিংস অব ফায়ার' বা আগুনের মালা তৈরি করে রেখেছে। পৃথিবীর আগ্নেয়গিরির একটা মানচিত্র নিচে দেয়া হলো।





ভূমিকম্প

প্রতিবছর লক্ষাধিক ভূমিকম্প হয় পৃথিবীতে। বছরে প্রায় ১৪০০০ ভূমিকম্প হয় রিখ্‌টার স্কেলে যাদের মান চারের উপরে। প্রায় চল্লিশটি ভূমিকম্প হয় প্রতিদিন। গড়ে বছরে ১টি ভূমিকম্প হয় রিখটার স্কেলে[2] যার মান আট-এর উপর। পৃথিবীর কিছু কিছু জায়গায় সারা বছর ছোটবড় ভূমিকম্প হতেই থাকে, আবার কোন কোন জায়গায় ভূমিকম্পের পরিমাণ খুবই কম।
            টেকটোনিক প্লেটগুলো মাঝে মাঝে বিশেষ করে মহাসাগরের তলদেশে কিছু জায়গা খালি হলে একটা প্লেটের নিচে আরেকটা ঢুকে যায়। আবার মাঝে মাঝে একটার পাশ দিয়ে আরেকটা যাবার সময় একটার গায়ে আরেকটা লেগে যায়। আবার মাঝে মাঝে দুটো প্লেটের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। যখন এই বিরাট বিরাট প্লেটগুলোর মাঝে এরকম কিছু ঘটে তখন প্রচন্ড চাপ তৈরি হয়। ক্রমশ সেই চাপ বাড়তে থাকে। মাটির নিচের এই চাপের ফলে ভূপৃষ্ঠ ফেটে যায় মাঝে মাঝে। তারপর অনেকদিন পরে হঠাৎ যখন প্লেট দুটো সরে যায় এতদিনের সঞ্চিত চাপ হঠাৎ মুক্তি পায়। ফলে প্রচন্ড তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। এই তরঙ্গের শক্তি এত প্রবল যে এটা ভূমির ওপর দিয়ে যাবার সময় সবকিছু তছনছ করে ফেলে। অনেক সময় সাগরের নিচে এই তরঙ্গ সৃষ্টি হলে সুনামি হয়ে যায়। প্রবল স্রোতে ভেসে যায় ঘরবাড়ি মানুষ জনপদ। মানুষ তখন প্রকৃতির কাছে খুব অসহায় হয়ে পড়ে।



ভূমিকম্পের ফলে যে তিন ধরনের তরঙ্গের সৃষ্টি হয় এবং সেই তরঙ্গের তথ্য থেকে পৃথিবীর গঠন সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যায় তা আমরা আগেই জেনেছি। ভূমিকম্প আর আগ্নেয়গিরির মাধ্যমে পৃথিবী তার ভেতরের চাপ ও তাপ নিয়ন্ত্রণ করে।
            ভূমিকম্প পৃথিবীর একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে মানুষ উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমাতে পেরেছে।
            পৃথিবীর সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ তিনটি শহর হলো আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেস, মেক্সিকোর মেক্সিকো সিটি, এবং জাপানের টোকিও। এই শহরগুলোতে প্রায়ই ভূমিকম্প হয়। এই শহরগুলোর বেশিরভাগ স্থাপনাই ভূমিকম্প সহনীয়। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো সেরকম ভূমিকম্পের প্রস্তুতি নেই আমাদের। তাই আমাদের দেশে ছোট মাত্রার ভূমিকম্পেও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়।
            নিকট অতীতে ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল ১৫৫৬ সালে চীনের সানচি প্রদেশে। আট লাখ ত্রিশ হাজার মানুষ মারা গেছে সেই ভূমিকম্পে। ১৯২৩ সালে টোকিওর ভূমিকম্পে প্রায় দুই লাখ মানুষ প্রাণ হারান।
            পৃথিবীতে ভূমিকম্প হচ্ছে পৃথিবীর জন্মের পর থেকেই। কত লক্ষ কোটি প্রাণ গেছে ভূমিকম্পের কারণে। পৃথিবীর অনেক প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরি ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে। কিন্তু পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হয়েছিল কখন? কীভাবে?



[1] বর্তমানে ইতালির নেপল্‌স-এর কাছে

[2] ভূমিকম্পের তীব্রতা মাপার স্কেল - রিখ্‌টার স্কেল


No comments:

Post a Comment

Latest Post

R. K. Narayan's 'The Grandmother's Tale'

There are many Indian authors in English literature. Several of their books sell hundreds of thousands of copies within weeks of publication...

Popular Posts