Monday, 4 November 2019

পৃথিবী সূর্যের তৃতীয় গ্রহ - পর্ব ২০


পৃথিবীর সম্পদ

মহাবিশ্বের অতিসাধারণ একটি নক্ষত্র থেকে জন্ম নেয়া অসাধারণ একটি গ্রহ আমাদের পৃথিবী। এই পৃথিবী স্বয়ংসম্পূর্ণা। পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষের খাবার আসছে এই পৃথিবীর বুক থেকেই। বাসস্থান তৈরি হচ্ছে পৃথিবীর পেট থেকে বের করা পদার্থ দিয়ে। আমাদের জ্বালানি আসছে পৃথিবীর ভেতর থেকে এবং প্রধান জ্বালানি সৌরশক্তি আসছে সূর্য থেকে। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যে বাতাস - সেটা আসছে পৃথিবীর বায়ুমন্ডল থেকে। পানি আছে আমাদের পৃথিবীর পিঠে, বাতাসে, মেঘে। মানুষসহ সব প্রাণী এবং উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জন্য যা যা দরকার তার সবই জোগান দিচ্ছে আমাদের পৃথিবী।
            খনি থেকে আমরা তুলে আনছি সোনা, রূপা, প্লাটিনাম। ভূমিস্তরের চাপে তৈরি হয়েছে হীরা এবং আরো অনেক দামী পাথর। যান্ত্রিক সভ্যতার প্রধান উপকরণ যে ধাতু সেগুলো আমরা পৃথিবী থেকেই পাচ্ছি। লোহা ও তামার খনি থেকে আমরা প্রতিনিয়তই তুলে আনছি লোহা ও তামার আকরিক। পৃথিবীতে যেসব ধাতু খুব বেশি পাওয়া যায় না - আমরা তাদের নাম দিয়েছি রেয়ার মেটাল বা দুষ্প্রাপ্য ধাতু। স্ক্যানডিয়াম ও গ্যাডোলিনিয়াম পৃথিবীতে খুব কম পরিমাণে পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা ওসব ব্যবহার করছি মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ব্যাটারি, এবং মহাকাশযান তৈরিতে।
            আমাদের দৈনন্দিন কাজে যা যা লাগে তার সবকিছুই আমরা পৃথিবীরই কোন না কোন উপাদান দিয়ে তৈরি করছি। আমাদের খাদ্যশস্যের উৎপাদনে আমরা যে সার ব্যবহার করি তার বেশিরভাগই তৈরি হচ্ছে প্রাকৃতিক কাঁচামাল দিয়ে। ইউরিয়া সার তৈরির কাঁচামাল হলো প্রাকৃতিক গ্যাস ও বাতাস।
            মানুষ লবণের ব্যবহার শুরু করেছে আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার বছর আগে। এই লবণ আসছে সমুদ্রের পানি ও খনি থেকে। ঘরবাড়ি তৈরির যে সিমেন্ট, পাথর, বালি সব আসছে পৃথিবী থেকেই।
            আধুনিক মানুষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে যে গতি অর্জন করেছে তার প্রধান সহায়ক হিসেবে এখন আছে কম্পিউটার। যে সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধ-পরিবাহী প্রযুক্তির মাধ্যমে এটা অর্জিত হয়েছে - সেই সেমিকন্ডাক্টরের একটি প্রধান উপাদান সিলিকন হলো পৃথিবীর বালি। অথচ মানুষের কাছে এখনো এক গ্রাম সোনার দাম এক গ্রাম বালির দামের চেয়ে বেশি।
            পৃথিবীর মানুষ ব্রোঞ্জের ব্যবহার শুরু করেছিল প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। ব্রোঞ্জ হলো টিন ও তামার সংকর। তিন হাজার বছর আগে শুরু করেছে লোহার ব্যবহার। মানুষ তখন থেকেই খনি থেকে লোহার আকরিক তুলতে শুরু করেছে। আজ পৃথিবীতে যে পরিমাণ ধাতু ব্যবহার করা হয় তার শতকরা ৯০ ভাগ হলো লোহা। পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের বিপরীতে প্রায় দুই টন করে লোহা ব্যবহার করা হচ্ছে বর্তমানে। বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোহা উৎপাদন করে ব্রাজিল, তারপর অস্ট্রেলিয়া।
            পৃথিবীর নিজস্ব যে সম্পদ - প্রাকৃতিক সম্পদ তা ব্যবহার করে মানুষ টিকে আছে। তার ওপর ভিত্তি করে মানুষ আবিষ্কার করছে নতুন নতুন কৃত্রিম সম্পদ। রাজনৈতিক নীতি এবং বল প্রয়োগে মানুষ পৃথিবীকে আজ বিভিন্ন ভৌগোলিক সীমারেখায় ভাগ করে নিয়েছে। যে দেশের সীমানায় যত বেশি প্রাকৃতিক সম্পদ আছে এবং যে দেশ যত বিচক্ষণতার সাথে সেই সম্পদ ব্যবহার করতে পারছে তারা তত ধনী দেশে পরিণত হচ্ছে। যেমন অস্ট্রেলিয়ায় প্রচুর খনিজ পদার্থ আছে এবং তারা সেই খনিজ পদার্থ বিক্রি করে ধনী দেশে পরিণত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ তেল বিক্রি করে ধনী হয়েছে। আবার অনেক দেশে তেমন প্রাকৃতিক সম্পদ নেই - কিন্তু তারা প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ধনী হয়েছে। যেমন জাপান। আবার অনেক জাতি প্রাকৃতিক সম্পদ থাকার পরেও বিশ্ব-রাজনীতির কারণে তেমন সুবিধা করতে পারছে না। যেমন আফ্রিকা। প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও সেখানকার দেশগুলো তুলনামূলকভাবে আমেরিকার চেয়ে কম ধনী। অথচ আফ্রিকায় আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হীরার খনি। ১৯০৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার খনিতে পাওয়া গেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হীরা। যার ওজন তিন হাজার ক্যারেটেরও বেশি (৬২১ গ্রাম)।
            আমাদের দেশে প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়া যাবার পর আমরা বেশিরভাগ ব্যবহার করে ফেলেছি আমাদের রান্নার কাজে। তার চেয়েও বেশি অপচয় করেছি গ্যাসের চুলা না নিভিয়ে। কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার পৃথিবীতে যে পরিমাণ গ্যাস এখন জমা আছে তা ২৩০০ সালের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।




জীবাশ্ম জ্বালানি ও বিকল্প শক্তি

পৃথিবীর তিনটি প্রধান জীবাশ্ম জ্বালানি হলো - কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস। পৃথিবীর মোট জ্বালানি চাহিদার ৩৪% মিটে তেল থেকে। প্রাকৃতিক গ্যাস পৃথিবীর জ্বালানি চাহিদার ২১% মেটায়। এটা তৃতীয় বৃহত্তম জ্বালানি উৎস। কয়লা জ্বালানি চাহিদার বেশিরভাগ অংশ মেটায়। এশিয়া-প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলে কয়লার চাহিদা গত পাঁচ বছরে প্রায় ৮০% বেড়ে গেছে। পৃথিবীর উপরিস্তরের ক্রমাগত বিবর্তনের ফলে ভূ-গর্ভের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন সময়ে এসব জ্বালানির উৎপত্তি হয়েছে।
            প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে ডায়নোসররা পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে গেছে। মনে করা হয় এই বিপুল পরিমাণ প্রাণিদেহ মাটিতে মিশে মাটির একটা স্তরে হাইড্রোকার্বন তৈরি করেছে। সেখান থেকে খনিজ তেল আকারে জমা আছে ভূ-গর্ভস্থ বিভিন্ন স্তরে। কিন্তু তারও অনেক আগে, কার্বনিফেরাস যুগে (৩৬ থেকে ২৯ কোটি বছর আগে) পৃথিবীপৃষ্ঠে জলাভূমি ভর্তি বড় বড় গাছ, ফার্ন আর বড় বড় পাতাযুক্ত গাছে ভর্তি ছিল। সমুদ্রের পানিভর্তি শৈবাল। ছোট ছোট সামুদ্রিক উদ্ভিদে ভর্তি ছিল জলাভূমি। গাছপালাগুলো মরে জলাভূমিতে পচেছে বছরের পর বছর। পচতে পচতে নরম কাদার মতো স্পঞ্জি স্তর সৃষ্টি হয়েছে যার নাম পিট। তার পর শত শত বছর ধরে তার ওপর জমেছে বালি কাদা এবং আরো অনেক পদার্থের স্তর। তারা জমতে জমতে একটা নতুন ধরনের শক্ত স্তরে পরিণত হয়েছে। স্তরের ওপর স্তর জমতে জমতে নিচের স্তরের ওপর চাপ বেড়ে গেছে। পিটের ওপর চাপ বাড়তে বাড়তে ওখান থেকে সব পানি বের হয়ে আসে। তারপর কোটি বছর পরে পিট স্তর - কয়লা, গ্যাস ও তেলে পরিণত হয়।




বর্তমানে যে হারে গ্যাস, তেল ও কয়লার ব্যবহার করছে মানুষ - তাতে বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন ২১৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ভূ-গর্ভস্থ সব তেল শেষ হয়ে যাবে। ২২৫০ সালের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে কয়লা এবং ২৩০০ সালের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে প্রাকৃতিক গ্যাস।
            আমাদের কি উচিত নয় একটু চিন্তাভাবনা করে এসব সম্পদের ব্যবহার করা? বিজ্ঞানীরা বসে নেই। তাঁরা ইতোমধ্যেই বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করতে শুরু করেছেন। পৃথিবীর অনেক দেশে এখন সৌরশক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে জ্বালানির কাজে। সৌরশক্তিচালিত গাড়ি আবিষ্কৃত হয়েছে। এমনকি সৌরশক্তিচালিত বিমানও উড়েছে আকাশে। সম্পূর্ণ সৌরশক্তি চালিত বিমান 'সোলার ইমপাল্‌স'[1] পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে পাড়ি দিয়েছে।




বর্তমানে পৃথিবীর জ্বালানি শক্তির শতকরা ১৬ ভাগ উৎপন্ন হচ্ছে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে যা অদূর ভবিষ্যতে শেষ হয়ে যাবার সম্ভাবনা নেই এবং যারা গ্রিনহাউজ গ্যাস উৎপাদন করে না। নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসে আছে বায়ুশক্তি, সৌরশক্তি, পানিশক্তি ইত্যাদি। নিউক্লিয়ার জ্বালানিও জীবাশ্ম জ্বালানির একটা শক্তিশালী বিকল্প। কিন্তু নিউক্লিয়ার রি-অ্যাক্টর স্থাপন করা ও চালানোর খরচ অত্যন্ত বেশি। তাছাড়া নিউক্লিয়ার বর্জ্য-ব্যবস্থাপনাও খুবই ঝামেলার ব্যাপার। নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে তার ফল খুবই মারাত্মক হতে পারে। তাই নিউক্লিয়ার জ্বালানিকে খুব একটা নিরাপদ জ্বালানি বলা যায় না।
            পৃথিবীতে প্রতিবছর বায়ুশক্তি চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ শতকরা ৩০ ভাগ হারে বেড়ে যাচ্ছে। এরকম একটা বড় টারবাইন যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে তাতে দশ হাজার বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব।





[1] সোলার ইমপাল্‌স - সুইজারল্যান্ডে নির্মিত পরীক্ষামূলক সৌরশক্তি চালিত বিমান। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে এটা প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে আকাশে ওড়ে। তারপর অনেকবার এটা আকাশে ঊড়ে বিভিন্ন দেশে গিয়েছে। এ পর্যন্ত এরকম দুটো বিমান তৈরি হয়েছে। সোলার ইমপাল্‌স-২ ২০১৫ সালে বিশ্বের বিভিন্ন বিমানবন্দর থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে সফলভাবে পৌঁছাতে পেরেছে। এই বিমানে কোন রকমের জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করা হয়নি।  বিমানের দৈর্ঘ্য ২২.৪ মিটার, পাখার দৈর্ঘ্য ৭১.৯ মিটার এবং উচ্চতা ৬.৩৭ মিটার। ভর ২৩০০ কিলোগ্রাম। ৬৩৩ কেজি ওজনের লিথিয়াম ব্যাটারি ব্যবহার করা হয় এই বিমানে। 

No comments:

Post a Comment

Latest Post

R. K. Narayan's 'The Grandmother's Tale'

There are many Indian authors in English literature. Several of their books sell hundreds of thousands of copies within weeks of publication...

Popular Posts