Tuesday, 13 November 2018

মেরি কুরির কাহিনি - ৮ম পর্ব



কুরি পরিবারে আরেকটি মৃত্যুতে আবার শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে বারো বছরের কিশোরী আইরিন। দাদুই ছিল তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। মেরি আইরিনকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছেন। এবার মেরিকেই সবদিক সামলাতে হচ্ছে। সারাদিন ব্যস্ত থাকেন সরবোনে পড়ানো, গবেষণা ইত্যাদি নানা কাজে। রেডিওঅ্যাক্টিভিটি বিষয়ক ৯৭১ পৃষ্ঠার একটি বিশাল বই লিখেছেন মেরি এই ক’বছরে।

এত কাজের মধ্যে থেকে আস্তে আস্তে শোক এবং হতাশা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছেন মেরি। শোকের পোশাক ছেড়ে কিছুটা উজ্জ্বল পোশাক পরতেও শুরু করেছেন। মেরির শারীরিক কমনীয়তা ও সৌন্দর্য আবার নতুন করে চোখে পড়তে শুরু করেছে সবার। অনেকেই বলছেন - “শোকের আগুনে পুড়ে সোনা হয়ে গেছেন মেরি।” সহকর্মী ও বন্ধু পল লাঁজেভি’র সাথে একটা সহমর্মিতার অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়েছে মেরির। পিয়েরের মৃত্যুর পর সব সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন লাঁজেভি। এখন লাঁজেভির ব্যক্তিগত দুঃসময়ে এগিয়ে এসেছেন মেরি। 

পল লাঁজেভি ছিলেন পিয়েরের ছাত্র এবং পরে ইপিসিআই-এ সহকর্মী এবং ব্যক্তিগত বন্ধু। পিয়েরের চেয়ে বয়সে ১৩ বছর এবং মেরির চেয়ে বয়সে পাঁচ বছরের ছোট লাঁজেভি কুরি পরিবারেরই একজন হয়ে উঠেছেন। প্রতিভাবান পদার্থবিজ্ঞানী লাঁজেভির সাথে বন্ধুত্ব ছিল আইনস্টাইনেরও। আইনস্টাইন মনে করতেন - লাঁজেভিই একমাত্র ফরাসি যিনি তাঁকে ঠিকমত বুঝতে পারেন। চৌম্বকত্বের ওপর ইলেকট্রনের তত্ত্ব সফলভাবে প্রয়োগ করতে সমর্থ হয়েছিলেন লাঁজেভি। ১৯০৭ সাল থেকেই মেরি আঁচ করতে পারছিলেন পারিবারিক জীবনে ভীষণ সংকটে পড়েছেন লাঁজেভি। 

লাঁজেভি বিয়ে করেছিলেন ছাব্বিশ বছর বয়সে - বাইশ বছরের তরুণী জেনিকে। জেনি ভীষণ উচ্চাভিলাসী। অর্থ-সম্পদের প্রতি খুবই লালায়িত ছিলেন তিনি। পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে স্বামীর সুনামে তিনি খুশি ঠিকই - কিন্তু সেই সুনামে যখন কোন অর্থপ্রাপ্তির চিহ্নও দেখা যায় না - তাঁর ভালো লাগে না। তিনি স্বামীকে বোঝান ইউনিভার্সিটির চাকরি ছেড়ে দিয়ে কোন ইন্ডাস্ট্রিতে যোগ দিলে অনেক বেশি অর্থোপার্জন হয়। 

লাঁজেভি যে পড়াতে এবং গবেষণা করতে ভালোবাসেন তাতে জেনির কিছুই যায় আসে না। জেনির সাথে যোগ দেন জেনির বোন ও মা। জেনির মা লাঁজেভির বাসাতেই থাকতেন। তাঁরা সবাই মিলে লাঁজেভিকে দিনরাত খোঁচাতে থাকেন।

লাঁজেভি তাঁদেরকে খুশি করার জন্য ইপিসিআই-এর চাকরির পাশাপাশি একটা মেয়েদের স্কুলে পার্ট-টাইম শিক্ষকতার কাজ নেন। ঐ স্কুলে মেরিও পড়াচ্ছেন অনেক বছর থেকে। ইতোমধ্যে লাঁজেভি দুটো ছেলে ও দুটো মেয়ের বাবা হয়েছেন।

পল ও জেনি লাঁজেভি

ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে - তাদের জন্য আরো অনেক বেশি টাকা দরকার এই অজুহাতে সারাক্ষণ খিটিমিটি করতে থাকেন জেনি। লাঁজেভির সহ্য হয় না তা। ফলে কথা কাটাকাটি হয়। বেশির ভাগ সময়েই দেখা যায় তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর কথার মধ্যে জেনির পক্ষ নিয়ে কথা বলেন জেনির বোন ও মা। লাঁজেভি আরো রেগে যান। 

পিয়েরের মৃত্যুর পর লাঁজেভি যখন মেরির পরিবারে কিছুটা বেশি সময় দিলেন কয়েকদিন, জেনি সন্দেহ করতে শুরু করলেন যে তাঁর স্বামীর সাথে মেরির সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। 

একদিন মেরি দেখলেন লাঁজেভির মাথায় মুখে হাতে আঘাতের চিহ্ন। অনেক জোর করার পর লাঁজেভি যা বললেন তা শুনে আঁৎকে উঠলেন মেরি। লাঁভেজিকে চেয়ার দিয়ে পিটিয়েছেন তাঁর স্ত্রী, শ্যালিকা ও শাশুড়ি। শুধু তাই নয় - লাঁজেভির মাথার ওপর আস্ত মদের বোতল ভেঙেছেন জেনি।

লাঁজেভির প্রতি মায়া হয় মেরির। এরকম একটা প্রাণবন্ত মায়াময় মেধাবী পদার্থবিজ্ঞানীর মূল্য বুঝতে পারছেন না তার স্ত্রী এটা দুঃখজনক। মেরির সহমর্মিতা পেয়ে লাঁজেভি তাঁর দুঃখের কথা বলতে শুরু করলেন মেরিকে। 

“আমি আর সহ্য করতে পারছি না। মাঝে মাঝে মনে হয় আত্মহত্যা করি।”
“না” - লাঁজেভির কথা শুনে প্রায় চিৎকার করে ওঠেন মেরি -“খবরদার, ওরকম চিন্তা ভুলেও মাথায় আনবে না। তোমার ছেলে-মেয়েদের কথা তো তোমাকে ভাবতে হবে।”

১৯১০ সালের জুলাই মাসে পল লাঁজেভি নিজের নাম গোপন করে সরবোন ইউনিভার্সিটির কাছে একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করলেন। ইপিসিআই ও স্কুলের কাজ শেষে যেটুকু সময় পান এই অ্যাপার্টমেন্টেই কাটান লাঁজেভি। বাসায় ফেরেন অনেক রাতে এবং মাঝে মাঝে ফেরেনও না। 

মেরির বাসা যেহেতু সরবোন থেকে অনেক দূরে - লাঞ্চটাইমে তিনি লাঁজেভির অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে লাঞ্চ করেন। মাঝে মাঝে হাতে সময় থাকলে মেরি রান্নাও করেন কিছু কিছু। লাজেঁভি অ্যাপার্টমেন্টের একটা চাবি মেরিকে দিয়েছেন যেন মেরি ইচ্ছেমত আসা-যাওয়া করতে পারেন। 

লাঁজেভির সাথে এরকম একান্তে সময় কাটানোতে যে সামাজিক সমস্যা তৈরি হতে পারে সে ব্যাপারে একটুও খেয়াল নেই মেরির। কারণ তাঁর বয়স তখন ৪৩, লাঁজেভির ৩৮, দু’জনই দায়িত্বশীল অধ্যাপক। তাঁদের ব্যক্তিগত ভালোমন্দ বোঝার এবং সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে অন্য কেউ নাক গলাতে পারে তা মেরি বা লাঁজেভি কেউই ভাবেননি। শুরুতে প্যারিসের একাডেমিক জগতের কেউই কিছু মনে করেন নি তাঁদের মেলামেশায়। কিন্তু ক্রমেই অবস্থা বদলাতে শুরু করলো। 

১৯১০ সালের মধ্য-সেপ্টেম্বরে ব্রাসেলস-এ অনুষ্ঠিতব্য ‘ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অন রেডিওলজি অ্যান্ড ইলেকট্রিসিটি’র কাজে ব্যস্ত মেরি। গবেষণাপত্র তৈরি করার জন্য এবং মেয়েদের নিয়ে গ্রীষ্মের ছুটি কাটানোর জন্য তিনি চলে গেলেন প্যারিসের বাইরে। সেখান থেকে তিনি পল লাঁজেভিকে একটা চিঠি লিখলেন। চিঠিটা পাঠিয়েছিলেন লাঁজেভির অ্যাপার্টমেন্টের ঠিকানায়। 

প্যারিসে ফিরে মেরি অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে দেখেন পল নেই সেখানে। তাঁর চিঠিটাও নেই। বিল্ডিং-এর কেয়ারটেকারের কাছ থেকে জানতে পারলেন - লাঁজেভি কিছুদিন থেকে অসুস্থ, চিঠিপত্রগুলো তাই মেইলম্যানকে বলে লাঁজেভির বাসায় পাঠাবার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। শুনে চিন্তিত হয়ে পড়লেন মেরি। 

লাঁজেভির অসুস্থতার কথা শুনে যতটা উদ্বিগ্ন তিনি, তারচেয়েও বেশি উদ্বিগ্ন হলেন চিঠিটার জন্য। চিঠিটা লাঁজেভি ছাড়া আর কারো হাতে পড়লে তো সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। চিঠিতে তিনি কিছু আবেগের কথা লিখেছেন। লাঁজেভিকে মিস করার কথা লিখেছেন, লাজেঁভির মায়াবী চোখের কথা লিখেছেন, এবং লাঁজেভিকে ‘ডার্লিং’ বলে সম্বোধন করেছেন। মেরি ভয় পাচ্ছেন যদি এ চিঠি লাঁজেভির স্ত্রী ও শাশুড়ির হাতে পড়ে - কী অবস্থা হবে? জানাজানি হয়ে গেলে অন্যরাও তো ভুল বুঝতে পারে। 

উৎকন্ঠিত হয়ে মেরি গেলেন বন্ধু অধ্যাপক জাঁ পেরির কাছে। পেরি লাঁজেভিরও বন্ধু। মেরির কাছে সবকিছু শুনে পেরি গেলেন লাঁজেভির বাড়িতে। গিয়ে দেখলেন পরিস্থিতি যতটুকু আন্দাজ করেছিলেন তারচেয়েও খারাপ। মেরির চিঠি পড়েছে জেনির হাতে। 

চিঠি পড়ে জেনির বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে তাঁর স্বামী পল এখন অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে ‘বিদেশি ডাইনি’ মেরির সাথে থাকতে শুরু করেছেন। জেনি হুমকি দিচ্ছেন, “সব কেচ্ছা আমি ফাঁস করে দেবো। আমার ভগ্নিপতি পত্রিকার সাংবাদিক। ওই বুড়ি মেরি ডাইনিকে আমি দেশছাড়া করবো। আমার সুখের সংসারে আগুন লাগাচ্ছে শয়তানি।” 

জেনি বেশি হৈ চৈ করছেন দেখে তাঁর এগারো বছর বয়সী ছেলে জাঁ লাঁজেভি মা-কে থামাতে গেলে এক ধমক দিলেন জেনি - “চুপ কর্‌ শয়তানের বাচ্চা। বাপের মত তোরও কি একটা রক্ষিতা দরকার?”

জাঁ পেরি অনেক কষ্টে জেনিকে কিছুটা শান্ত করলেন। বুঝালেন বেশি হৈ চৈ করলে তাঁরই সম্মান নষ্ট হবে।

ক’দিন পর বাড়ি ফিরতে একটু বেশি রাত হয়ে গিয়েছিল পেরির। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই পেরি দেখলেন অন্ধকারে ঝোঁপের আড়াল থেকে কেউ একজন বেরিয়ে ছুটে এলো তাঁর দিকে। কাছে আসতেই চিনতে পারলেন পেরি। মেরি! এ অবস্থায় এত রাতে! আলুথালু বেশ, জামাকাপড়ে ময়লা দাগ, ভয়ার্ত চেহারা, ঠক ঠক করে কাঁপছেন!! 

দ্রুত বাসায় নিয়ে গেলেন মেরিকে। হেনরিয়েট ছুটে এসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন মেরিকে। একটু আত্মস্থ হবার পর জানা গেলো ঘটনা।

রাস্তায় মেরিকে দেখে শারীরিকভাবে হেনস্থা করেছেন লাঁজেভির স্ত্রী ও শ্যালিকা। চুল টেনে মাটিতে ফেলে লাথি মারতে মারতে হুমকি দিয়েছেন, “আবার যদি তোকে প্যারিসে দেখি খুন করে ফেলবো কুত্তি।” ভয়ে অপমানে লজ্জায় আর ট্রেন ধরে নিজের বাসায় ফিরতে পারেননি মেরি। অন্ধকারে বসে ছিলেন পেরির ফেরার অপেক্ষায়। 

পরের দিন মেরিকে তাঁর বাসায় দিয়ে এলেন হেনরিয়েট। রাতের মধ্যে মেরি অনেকটা সুস্থির হয়ে উঠেছেন। 

ব্যক্তিগত যত সমস্যাই থাকুক বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ডে শিথিলতা নেই মেরির। মধ্য-সেপ্টেম্বরে ব্রাসেল্‌স গেলেন তিনি। ‘ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অন রেডিওলজি অ্যান্ড ইলেকট্রিসিটি’র সভায় ‘ইন্টারন্যাশনাল রেডিয়াম স্ট্যান্ডার্ড’ হিসেবে মেরি কুরির মাপকে গ্রহণ করা হলো। স্ট্যান্ডার্ড একক হিসেবে এই পরিমাপের নাম রাখা হলো ‘কুরি’। তেজষ্ক্রিয়তার আন্তর্জাতিক একক - বেকোয়ারেল (Bq) এবং ব্যবহারিক একক - কুরি (Ci)। [১ কুরি = ৩৭ বিলিয়ন বেকোয়ারেল।]

ফ্রান্সের বিজ্ঞানজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে ফ্রেঞ্চ একাডেমি অব সায়েন্সেস। একাডেমির সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কোন বিজ্ঞানীর পক্ষেই কিছু করার জো নেই ফ্রান্সে। একাডেমির সদস্যদের ক্ষমতা অনেক। বৈজ্ঞানিক প্রকল্পে আর্থিক অনুদান দেয়া ছাড়াও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের স্বীকৃতির ব্যাপারেও অনেক প্রভাব রাখে একাডেমি। সায়েন্স একাডেমির সদস্যপদ পাওয়া সহজ নয়। 

১৯১০ সালের ডিসেম্বরে একাডেমির একটা সদস্যপদ খালি হয়। এই পদ লাভের জন্য যে যোগ্যতা দরকার মেরির যোগ্যতা তারচেয়ে অনেক বেশি। মেরি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন, মেরির আবিষ্কার বিশ্বজোড়া খ্যাতিলাভ করেছে, মেরির একাডেমিক ও প্রশাসনিক দক্ষতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু মেরির সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা হচ্ছে - মেরি একজন মহিলা। ফ্রেঞ্চ একাডেমি অব সায়েন্সের ইতিহাসে তখনো পর্যন্ত কোন মহিলা সদস্যপদ লাভ করেননি। কিন্তু ইতিহাস গড়াই তো মেরির কাজ। মেরি সদস্যপদের জন্য দরখাস্ত করলেন। 

নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী গ্যাব্রিয়েল লিপম্যানসহ অনেক প্রগতিশীল বিজ্ঞানী মেরির সমর্থনে প্রচার চালাচ্ছেন। প্রভাবশালী প্রগতিশীল পত্রিকা ‘লা ফিগারো’ মেরির সদস্যপদ লাভের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। একাডেমি অব সায়েন্সের একচেটিয়া পুরুষ-রাজত্বে নারীর অধিকার কি তাহলে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে? 

কিন্তু সকল শুভ সম্ভাবনার গলাটিপে মারার জন্য ধর্মান্ধ গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠলো। মেরির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেলেন দু’জন গোঁড়া ক্যাথলিক বিজ্ঞানী এডোয়ার্ড ব্র্যানলি ও মার্সেল ব্রিলোইন। তাঁদের বৈজ্ঞানিক অর্জন মেরির তুলনায় কিছুই নয়। 

৬৬ বছর বয়সী ব্র্যানলি বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর কিছু কাজ করেছিলেন। কিন্তু আগের বছর (১৯০৯) বেতার যোগাযোগের জন্য নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছে মার্কনিকে। ব্র্যানলি তাতে খুবই অসন্তুষ্ট। এখন ফ্রেঞ্চ একাডেমি অব সায়েন্সে ‘নাস্তিক’ মেরির ‘অনুপ্রবেশের চেষ্টা’ ব্র্যানলিকে রীতিমত রাগিয়ে দিয়েছে। 

তাঁর যোগ্যতা মেরির তুলনায় কম, কিন্তু অনৈতিক যুদ্ধাস্ত্র অনেক। মেরির বিরুদ্ধে নানারকম কুৎসা রটানোর জন্য তাদের হাতে অনেক পত্রিকা। তারা প্রচার করতে শুরু করলো - মেরি ইহুদিদের হয়ে কাজ করছেন। তাঁর স্ক্লোদভস্কা পদবিতে ইহুদির গন্ধ পাওয়া যায়। যখন আরেকটি পত্রিকায় প্রকাশিত হলো মেরি জন্মসূত্রে ক্যাথলিক - পরে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে করতে মুক্তমনা হয়েছেন, তাতে ধর্মান্ধরা আরো ক্ষেপে উঠলো - বললো ফ্রান্সে নাস্তিকের স্থান নেই। 

মেরির জাতীয়তাবাদ নিয়েও প্রশ্ন উঠলো। মেরি যে জন্মসূত্রে পোলিশ তাতেও নাকি মেরির অযোগ্যতা প্রমাণিত হয়। জনপ্রিয় লেখিকা মেরি রেগনিয়ের -  যিনি নারীর অধিকার নিয়ে অনেক গল্প-উপন্যাস লিখেছেন - বিবৃতি দিলেন মেরির বিপক্ষে - বললেন মেরি যে বিজ্ঞানচর্চা করছেন তা ঠিক করছেন না। মেয়েদের আসল কাজ হলো চুলে রঙিন ফিতে বেঁধে প্রেম ভালোবাসার ভেলায় চড়ে কাঁদা হাসা। 

উগ্র জাতীয়তাবাদী পত্রিকাগুলো এমনও প্রচার করতে শুরু করলো যে মেরির নোবেল পুরষ্কার পাওয়াটা পিয়েরের করুণাতেই হয়েছে - নয়তো মেরির কোন যোগ্যতাই নেই নিজে কিছু করার। 

মেরি এসব প্রপাগান্ডার কোন উত্তর দেয়ার দরকার আছে বলেও মনে করেন না। কিছুতেই মেরিকে কাবু করতে না পেরে একাডেমির নির্বাচনের বারোদিন আগে ১৯১১ সালের ১১ জানুয়ারি শেষ অস্ত্র ছুঁড়লো ট্যাবলয়েড পত্রিকা এক্সেলসিয়র। 

প্রথম পাতায় মেরির বিশাল ছবির সাথে তাঁর হাতে লেখা চিঠির অনুলিপি ছাপিয়ে মেরি ও লাঁজেভিকে জড়িয়ে কুৎসিত প্রতিবেদন প্রকাশ করলো। সমাজের বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামে ব্যক্তিগত কুৎসা রটানো হলে কোন ধরনের যুক্তি প্রয়োগ না করেই অনেকে তা বিশ্বাস করে ফেলেন। প্যারিসের তথাকথিত ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলাদের অনেকেই মেরির নামে ছি ছি করতে শুরু করলেন। 
________
এ কাহিনি আমার "রেডিয়াম ভালোবাসা" বইতে প্রকাশিত হয়েছে।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts