Friday 23 November 2018

এডেলেইডে সাত দিন - ২য় পর্ব


মেলবোর্ন আর এডেলেইডের সময়ের পার্থক্য আধঘন্টা আমার হাতঘড়ির সময় আধঘন্টা পিছিয়ে দিতে হলো বাস থামলো সেন্ট্রাল বাস স্টেশনে এখানেই গ্রে-হাইন্ড বাস টার্মিনাল স্ট্রিটের নাম ফ্রাংকলিন স্ট্রিট মজার ব্যাপার হলো মেলবোর্নেও গ্রে-হাউন্ড বাস টার্মিনাল ফ্রাংকলিন স্ট্রিটে স্যার জন ফ্রাংকলিনের নামে বেশ কয়েকটা জায়গার নামও আছে অস্ট্রেলিয়ার এখানে সেখানে ফ্রাংকলিন সাহেব ১৮৩৭ সাল থেকে ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত তাসমানিয়ার গভর্নর ছিলেন
            
বাস থেকে নেমেই চোখে পড়লো রাস্তার মাঝখানে বেশ কিছু নারী-পুরুষ হাতে প্লাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এত সকালে কোন মিছিল টিছিল নাকি? না, প্লাকার্ডে বিভিন্ন হোটেল, লজ আর ইয়থ হোস্টেলের নাম লেখা তাদের পেছনে রাখা বিভিন্ন রঙের বিজ্ঞাপন সজ্জিত বেশ কিছু মাইক্রোবাস চোখে পড়লো এডেলেইডে যারা নতুন তাদের জন্য বেশ ভালোই অভ্যর্থনার আয়োজন অবশ্য পুরো ব্যাপারটাই ব্যবসায়িক আমার থাকার ব্যবস্থা আগে থেকেই ঠিক করা আছে তাই এখানে কারো সাথে কথা বলার দরকার নেই আমার
            
স্থানীয় সময় সকাল সোয়া সাতটা রবিবার ছুটির দিনের সকাল শহর জাগবে আরো অনেক পরে আমাকে যেতে হবে রয়েল এডেলেইড হসপিটালের আবাসিক এলাকায়, হোস্টেলে সেখানেই আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে বাস টার্মিনাল থেকে বেরোনোর আগে একটা ম্যাপ নিলে ভালো হতো কিন্তু আবার টার্মিনালের ভেতর গিয়ে ম্যাপ নিয়ে আসতে আলস্য লাগছে বুঝতে পারছি না এখান থেকে ঠিক কত দূরে রয়েল এডেলেইড হসপিটাল ট্যাক্সিতে চাপার ইচ্ছে হলো
            
ট্যাক্সির রঙ সাদা হোয়াইট ক্যাব আমার ট্যাক্সির ড্রাইভারের গায়ের রঙ আমার মতোই পরিচয়পত্র গাড়ির ভেতর লাগানো আছে কোথাও, এখন দেখতে ইচ্ছে করছে না ভারতীয় বা শ্রীলংকান হতে পারে তিনি বয়স পঞ্চাশের ওদিকে অনেকদিন আছেন হয়তো এডেলেইডে আমার গন্তব্য শুনেই ঝড়ের বেগে গাড়ি ছুটালেন মনে হচ্ছে অনেক দূরের পথ
            
দিক সম্পর্কে আমার ধারণা সব সময়েই কাঁচা। সুতরাং কোনদিকে যাচ্ছি তা ভেবে সময় নষ্ট করার মানে হয় না জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছি রাস্তাগুলো বেশ চওড়া মেলবোর্ন সিটির রাস্তার চেয়েও বড় কয়েকটা বহুতল ভবন ছাড়া সবগুলো বিল্ডিংই পুরনো স্থাপত্যের দেখে মনে হচ্ছে দেড়শো-দু বছরের পুরনো কোন শহরে এসে পড়েছি অবশ্য জানি এই পুরনো ভবনগুলোকে এরকমপুরনোকরে রাখার জন্য লক্ষ লক্ষ ডলার খরচ করা হয় প্রতি বছর
            
প্রায় বিশ মিনিট পরে ট্যাক্সি থামলো বিশাল এক ভবনের সামনে এসে গেছি রয়েল এডেলেইড হসপিটালের আবাসিক এলাকায় বিশাল হোস্টেল ট্যাক্সির মিটার বলছেআট ডলার পঁয়ত্রিশ সেন্ট অস্ট্রেলিয়াতে টিপস দেয়াটা খুব একটা প্রচলিত নয় ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে রিসেপশানের দিকে এগিয়ে গেলাম
            
ভেবেছিলাম রিসেপশানে কেউ থাকবে না এত সকালে কিন্তু না, চব্বিশ ঘন্টা খোলা থাকে এই কাউন্টার নাম বলতেই ভদ্রমহিলা আই পি কনফারেন্সলেখা মোটা একটা খাতা বের করলে কম্পিউটারের বদলে খাতার ব্যবহার দেখে একটু অবাক হলাম দুমিনিটের ভেতর রুমের চাবি আর একটা ফোন্ডার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, "ডান দিকের লিফ্‌ ধরে সোজা দশতলায় উঠে যান। ১০৩২ নম্বর ঘরে থাকবেন আপনি হ্যাভ নাইস স্টে"
            
রয়েল এডেলেইড হসপিটালের রেসিডেন্সিয়াল ব্লক

এই বিল্ডিংটা বারোতলা দশতলায় লিফট থেকে বেরিয়ে ডান দিকের অংশ বা রাইট উইংস-এর বাম দিকের সারির দ্বিতীয় ঘরটা আমার ধবধবে সাদা বিছানা জানালার ভারী পর্দা সরাতেই সূর্য যেন ঘরে ঢুকে পড়লো বুঝলাম এটা পূর্বদিক আধঘন্টা আগে যে সূর্য কোমল সোনালি ছিলো এর মধ্যেই সে তেতে আগুন হয়ে উঠেছে এই সকালবেলাতেই যে হারে গরম পড়ছে, সারাদিনে তাপমাত্রা কত উঠবে কে জানে
            
পিঠটা ব্যাথা করছে ব্যাগটা অন্যায় রকমের ভারী হয়েছে কনফারেন্সে বক্তৃতার ঠেলায় কিছু বইপত্র আনতে হয়েছে সাথে আর বুকের ডান পাশেও কিঞ্চিৎ ব্যাথা জেনির মাথাটাতো কম শক্ত নয় বিছানায় শুয়ে একটু দোল খেয়ে নিলাম এই খাটের স্প্রিংগুলোর স্প্রিং-কনস্ট্যান্ট নিশ্চয় খুব বেশি আচ্ছা স্প্রিং-কনস্ট্যান্ট বেশি হলে ইলাস্টিসিটি বাড়ে না কম হলে বাড়ে? না, এই ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্সের ভূত আমাকে ছাড়বে না দেখছি
            
শুয়ে শুয়ে রিসেপশান থেকে দেয়া ফোল্ডারটা খুললাম হোস্টেলের কিছু নিয়মকানুন লেখা আছে এই আবাসিক হোস্টেলের পুরোটাই ধূমপানমুক্ত এলাকা প্রত্যেক রুমে স্মোক অ্যালার্ম লাগানো ছে। অ্যালার্ম বাজলে সাথে সাথে ফায়ার ব্রিগেডে খবর চলে যাবে আর তারা ঘন্টা বাজাতে বাজাতে চলে আসবে ধূমপানজনিত কারণে ধোঁয়ার উৎপত্তি বুঝতে পারলে ৩২০ ডলার ফাইন ফাইনটা তিনশ' বা সাড়ে তিনশ' না হয়ে ৩২০ হলো কেন কে জানে রাত বারোটা পনেরো মিনিটে মেইন গেট বন্ধ হয়ে যায় তবে ফোন করে যে কোন সময় দরজা খোলার ব্যবস্থা করা যাবে এরপরে কিচেন, টিভিলাউঞ্জ ইত্যাদি ব্যবহারের নিয়ম কানুন এতকিছু পড়ার ধৈর্য আমার নেই রেখে দিলাম ফোল্ডা বিপদে না পড়লে এই ফোল্ডার আর খুলে দেখা হবে না
            
স্নানটা সেরে ফেলা দরকার তারপর বেরিয়ে পড়া উচি বিকেল চারটায় কনফারেন্স রেজিস্ট্রেশ তার আগে হাতের সময়টাকে যতটা সম্ভব কাজে লাগানো উচিত আমার রুমের ঠিক পাশের রুমটা হলো কিচেন বেশ বড়; ফ্রিজ, কুকার, মাইক্রোওভেন ইত্যাদি সব আধুনিক গ্যাজেটে ভর্তি কিচেনের পাশের রুমটা টয়লেট বাথরুম ডানপাশে একসারি টয়লেট, বামপাশে একসারি বাথরুম, সামনে পরপর তিনটি বেসিন সবকিছু ঝকঝকে পরিষ্কার দুটো বাথটাবও দেখা যাচ্ছে আর কী চাই!
            
বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে মুখে শেভিং ফোম লাগাতে লাগাতে আপন মনে গুন গুন করছি হঠাৎ সামনের আয়নায় দেখা গেলো এক নারীমূর্তি শরীরের বসন যা আছে তা না থাকারই সমতুল্য আমি তো কাঠ হয়ে গেছি ভুল করে মেয়েদের বাথরুমে ঢুকে পড়লাম না তো? কিন্তু দরজায় তো কোন ধরনের লেখা বা চিহ্ন চোখে পড়েনি
            
অস্ট্রেলীয় তরুণীটির কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই আমাকে যেন দেখতেই পায়নি সে অথচ আমার হাতছোঁয়া দূরত্বে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করছে আমি কী করবো ঠিক বুঝতে পারছি না এরকম বিপদে তো আগে কখনো পড়িনি শেভ করার এই মাঝপথে বেরোনোরও কোন উপায় নেই আবার যন্ত্রের মতো দাঁড়িয়ে থাকলেও তো কোন কাজ হবে না আয়নায় মেয়েটির সাথে চোখাচোখি হতে সে মুখে ব্রাশ গোঁজা অবস্থাতেই হাসলো একটু আমি হাসবো কি - রীতিমতো কান্না পাচ্ছে আমার তবুও সারামুখে ফোম লাগানো বলে মেয়েটি আমার মুখের অবস্থা দেখতে পাচ্ছে না
            
এসময় আরেকজন পুরুষ মানুষকে ঢুকতে দেখে শরীরে প্রাণ ফিরে পেলাম এই বাথরুম তাহলে পুরুষ মহিলা সবার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় পর্যন্ত যেখানেই গিয়েছি পাবলিক প্লেসে পুরুষ মহিলাদের জন্য আলাদা আলাদা বাথরুম টয়লেটের ব্যবস্থা দেখেছি এই প্রথম দেখলাম বাথরুমেরও লৈঙ্গিক বিভাজন উঠে যেতে এটা ভালো কি মন্দ তা বলতে পারবো না তবে অপরিচিত একজন প্রায় নগ্ন তরুণীর পাশে দাঁড়িয়ে শেভ করতে আমার ভীষণ সংকোচ লাগছিলো
            
নিচে নেমে লাউঞ্জেই পেয়ে গেলাম এডেলেইডের ম্যাপ সাউথ অস্ট্রেলিয়ার ম্যাপ আকর্ষণীয় স্থানের বিবরণ কখন কোথায় কিভাবে যেতে হবে ইত্যাদির খুঁটিনাটি হোস্টেল থেকে বেরোতেই কাঠের বেড়া দেয়া একটা ঘর চোখে পড়লো গাড়ি পার্কিং-এর মাঝখানে ভাবলাম গাড়ির পার্কিং টিকেট দেয়া হয় হয়তো কিন্তু না, ওটা আসলেস্মোকারস বিড়িখেকোদের জন্য পাঁচটি ঘরের টা একটি এরকম ঘরে বসে চোরের মত লুকিয়ে বিড়ি ফুঁকতে হবে ভাবলেই তো বিড়ি খাওয়া ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করবে কিন্তু যারা বিড়ি খায়, বিড়ি খাওয়ার ব্যাপারে তাদের মান অভিমান জ্ঞান অতটা কড়া নয়
            
হাসপাতালের গেট দিয়ে বেরোতেই বাম দিকে রয়েল বোটানিক্যাল গার্ডেন রবিবারেও সারাদিন খোলা থাকে অবশ্য পার্ক আর দর্শনীয় স্থানগুলো সাপ্তাহিক ছুটির দিনে খোলা থাকাটাই নিয়ম ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনটা ঘুরে দেখলাম
   
বোটানিক্যাল গার্ডেনে 

        
বেশ বড়, অনেক প্রজাতির গাছে ভর্তি গাছের সাথে পরিচিতিমূলক তথ্য দেয়া আছে ফার্ণজাতীয় উদ্ভিদের বিপুল সমাবেশ এখানে একটি কাচের ঘর বা গ্রিন হাউসে রাখা আছে সব উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে যে সব গাছের নাম রাত জেগে মুখস্থ করে সকালবেলা ভুলে গিয়েছি - সেসব বিরল প্রজাতির সব ফার্ণই আছে এখানে আহা- যদি সে সময় চোখে দেখতে পেতাম এগুলো- তাহলে হয়তো ভুলতাম না, আর কাজেও লাগতো
            
পতঙ্গভূক উদ্ভিদ


পতঙ্গভুক উদ্ভিদ রাখা আছে লোহার গারদে ঢেকে সেখানে লেখা আছেডোন্ট ডিস্টার্ব বিশাল এলাকা জুড়ে গোলাপ চাষের নানারক পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে কিছু কিছু গোলাপের সাইজ বড় হতে হতে পদ্মফুলের আকার ধারণ করেছে বিশাল বিশাল স্টিল কাচের পাত লাগিয়ে কৃত্রিম রেইন ফরেষ্ট তৈরি করা হয়েছে এটার নাম বাইসেন্টেনিয়াল কনজারভেটরি খোলার সময় দুপুর বারোটা বারোটা বাজেনি এখনো ভেতরে ঢোকা হলো না আর বাইরে জানালা দিয়ে যতটুকু দেখা গেলো তাতে গভীর অরণ্যের আভাস গহিন অরণ্যে যাবার সুযোগ বা সাহস যাদের নেই তাদের জন্য অরণ্যকেই ধরে এনে খাঁচায় পোরা হয়েছে এখানে


বাইসেন্টেনিয়াল কনজারভেটরি

            
বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে বেরিয়ে সামনের রাস্তাটার নাম দেখলাম নর্থ ট্যারেস এবারে এডেলেইড সিটি ম্যাপটা খুলে দেখলাম কোথায় আছি এখন ইউনিভার্সিটিটা ঘুরে আসা দরকার কনফারেন্সে স্থানটা চেনা থাকলে ভালো এডেলেইড ইউনিভার্সিটি একদম কাছে আট দশ মিনিটের হাঁটা পথ এখান থেকে আমার হোস্টেল থেকে বড়জোর পাঁচ মিনিট লাগবে ফ্রোম রোডের পূর্ব পাশে এডেলেইড হাসপাতাল আর ছোট্ট রাস্তাটার পশ্চিম পাশেই ইউনিভার্সিটি একই ক্যাম্পাসের ভিতর পাশাপাশি দুটো ইউনিভার্সিটি ইউনিভার্সিটি অব সাউথ অস্ট্রেলিয়া আর ইউনিভার্সিটি অব এডেলেইড
            
কনফারেন্সে বক্তৃতাগুলো হবে এডেলেই ইউনিভার্সিটির আটটি অডিটোরিয়ামে আমি প্লেনারি সেশান আর নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের সেশানগুলোতে অ্যটেন্ড করবো ওগুলো হবে যথাক্রমে বনিথন হল আর ফিজিক্স বিল্ডিং-
            
এডেলেইড ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস আমাদের মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির পার্কভিল ক্যাম্পাসের চেয়ে অনেক ছোট ক্যাম্পাসে একচক্কর দিতে পনেরো মিনিটের বেশি লাগলো না হয়তো আরো অনেক জায়গা এদের আছে যা আমি চিনি না এখনো
    
আর্ট গ্যালারি অব সাউথ অস্ট্রেলিয়া
     
ইউনিভার্সিটির ঠিক পাশেই আর্ট গ্যালারি অব সাউথ অস্ট্রেলিয়া এই আর্ট গ্যালারি সপ্তাহের সাত দিনই খোলা থাকে সকাল দশটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত কোন প্রবেশ মুল্য লাগে না এখানে ঢোকার মুখেই সাদা মার্বেলের তৈরি বেশ কয়েকটি মূর্তি গ্রিক ভাস্কর্য নারী মূর্তির সংখ্যাই বেশি রিসেপশানে ব্যাগ রেখে যাওয়াই নিয়ম আমার কাঁধের ব্যাগের আকৃতি খুব একটা বড় না হওয়াতে ব্যাগ নিয়েই ভেতরে ঢুকে যেতে অনুরোধ করলেন রিসেপশনিস্ট
            
বেশ উঁচু ছাদ পরপর গ্যালারিগুলো সাজানো গ্যালারি- থেকে শুরু করে গ্যালারি-২০ পর্যন্ত আছে দেশ বিদেশের বিখ্যাত অনেক চিত্রকর্ম, শিল্পকর্ম রাখা আছে এখানে নিয়ন্ত্রিত তাপ বৈদ্যুতিক আলো ছাড়াও কয়েকটা রুমে প্রাকৃতিক আলোও প্রবেশ করছে এই রুমগুলোর ছাঁদ স্বচ্ছ সেলুলয়েডের তৈরি ফলে আকাশ দেখা যায় ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে প্রতিফলিত আকাশের একটা প্রভাব পড়ছে দেয়ালে লাগানো পেইন্টিংসের পর
            
আর্ট গ্যালারি ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য সকাল এগারটা থেকে প্রতি ঘন্টায় গাইডের ব্যবস্থা আছে এদের ভাষায় 'গাইডেড ট্যুর' আমি ঢোকার সময়ে একটি গ্রুপকে নিয়ে গাইড ভেতরে ঢুকছিলেন আমিও তাদের সাথে গ্যালারির প্রথম কক্ষে ঢুকলাম গাইড ভদ্রমহিলা যে শিল্পকলা সম্পর্কে প্রচুর জানেন তা বোঝা গেলো তাঁর বর্ণনা থেকে প্রতিটি শিল্পকর্মের খুঁটিনাটি বর্ণনা দিচ্ছিলেন তিনি শিল্পকলার আমি বাইরের স্তরের সমঝদার, যাকে বলে সারফেস লেভেলের লাভার উপরের আবরণের একটুও ভেতরে যাবার মতো বোধ বা ধৈর্য বা অধ্যবসায় এরকম আরো যা যা লাগে তার কোনকিছুই নেই আমার সুতরাং গাইডকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলাম পুরো গ্যালারি 
            
কিছু কিছু দুষ্প্রাপ্য পেইন্টিং-এর ছবি তুলে নেয়ার প্রচন্ড ইচ্ছে হচ্ছিলো যে কোন আর্ট গ্যালারিতে সাধারণত ছবি তোলা নিষিদ্ধ ক্যামেরা নিয়ে ঢুকতেও দেয়া হয় না এখানে আমার ব্যাগে ক্যামেরা আছে, তারা চেক করেনি চাইলে ছবি তুলতে পারি, কিন্তু জেনে শুনে একটা অন্যায় কেন করবো? তাছাড়া আমি তো জানি কেন ছবি তোলা বারণ এখানে প্রথমত শিল্পীর কপিরাইট লঙ্ঘন করা হবে দ্বিতীয়ত, প্রত্যেকটি শিল্পকর্ম তাপ আলোক নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় সংরক্ষণ করা আছে ক্যামেরার ফ্লাশের তীব্র আলো শিল্পকর্মের জন্য ক্ষতিকর আইন প্রয়োগ করার পরে তা মানানোর জন্য যদি লাঠিয়ালেরও ব্যবস্থা করতে হয় সর্বত্র, তাহলে চলবে কীভাবে?
            
সবকিছু খুঁটিয়ে দেখতে গেলে পুরোদিন লাগবে আমার হাতে তত সময় নেই দেখার পালা দ্রুত শেষ করে বেরোবার সময় দেখলাম গাইডেড ট্যুর গ্যালারি- শেষ করে গ্যালারি- তে ঢুকছে আমার ইচ্ছে করছিলো গাইডকে গিয়ে একটা বিশেষ ছবি সম্পর্কে জ্ঞিজ্ঞাসা করতে ছবিটা শেষের দিকের একটা গ্যালারিতে রাখা আছে একটা ১মিটার X মিটার কাঠের বোর্ড; সম্পূর্ণ কালো, চারপাশে লাল রঙের বর্ডার দেয়া আর কিছু নেই কোথাও বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি স্কুল কলেজে এরকম ব্ল্যাকবোর্ড ব্যবহার করা হয় কেবল লাল পাড়টি ছাড়া এত যত্ন করে এই বোর্ড এখানে রাখার কোন মানে নিশ্চয় আছে মানেটা কী? শিল্পকর্ম হয়তো কারণেই দুর্বোধ্য


সাউথ অস্ট্রেলিয়ান মিউজিয়াম
          
আর্ট গ্যালারি থেকে বেরিয়েই চোখে পড়লো সাউথ অস্ট্রেলিয়ান মিউজিয়াম হালকা হলুদ রঙের বিশাল চারতলা বিল্ডিং পুরনো ধাঁচের স্থাপত্য স্থাপত্যবিদ্যায় ধরনের স্থাপত্যের নিশ্চয় কোন গালভরা নাম আছে মিউজিয়ামের নিচের তলায় ঢুকতেই চোখে পড়ে বিরাট এক তিমি মাছের ঙ্কা রিসেপশানের ঠিক পাশেই কেন এই কঙ্কালটা রাখা হয়েছে কে জানে কঙ্কালের সাইজ দেখে মনে হচ্ছে মাংসসহ তিমিটা একটা ছোটখাটো পর্বতের সাইজের ছিলো
            
গলায় প্রজাপতি টাই লাগানো সুদর্শন তরুণ অভ্যর্থনা জানালো সাউথ অস্ট্রেলিয়ান মিউজিয়ামে এই মিউজিয়ামেও কোন প্রবেশ মুল্য লাগে না মূল্য তথ্যভান্ডারকে এরা আক্ষরিক অর্থেই -ল্যে সরবরাহ করছে নিচতলায় বাম দিকে তাসমানিয়ান টাইগারের একটা স্লাইড প্রদর্শনী চলছে দেখতে অনেকটা শেয়ালের মতো এই প্রজাতিটি এখন বিলুপ্ত ডান দিকের ঘরে রয়েছে ওয়ার্ল্ড ম্যামাল পৃথিবীর ভৌগোলিক অঞ্চল ভিত্তিক প্রাণিগুলোর নানা প্রজাতির নমুনা স্টাফ করে রাখা আছে এখানে প্রায় সব বিশিষ্ট প্রাণি আছে দেখলাম কিন্তু আমাদের রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে দেখলাম না কোথাও তার বদলে কিছু ইন্ডিয়ান দুর্বল বাঘের নমুনা রাখা আছে
            
ম্যামালের জগতের ঠিক পাশেই প্রদর্শিত হচ্ছে খনি থেকে পাওয়া পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহতম স্বর্ণখন্ড ডিসেম্বরের ৩১ তারিখের পরে এটা সরিয়ে ফেলা হবে এখান থেকে রেখে দেয়া হবে সিকিউরিটি ভল্টে এই সোনার খন্ডটির ভর সাড়ে পঁচিশ কেজি চল্লিশ মিলিয়ন বা চার কোটি বছরের পুরোনো এই খাঁটি সোনার কাছে দাঁড়ালেই ভেতরটা সোনা হয়ে যাওয়া উচিত কিন্তু আমার সেরকম কিছু হলো না
            
পুরো দোতলা জুড়ে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড আর পাপুয়া নিউগিনির আদিবাসিদের বিভিন্ন ঐতিহ্যের স্বাক্ষর বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরেও এরকম কিছু সংগ্রহ আছে আমাদের উপজাতীয়দের ব্যবহৃত জিনিসপত্রের সাথে এখানকার আদিবাসিদের জিনিসপত্রের অনেক সাদৃশ্য দেখা যাচ্ছে তিনতলায় অস্ট্রেলিয়ান মাছ পাখির নমুনা একটাও জীবন্ত প্রাণী নেই এখানে, সব স্টাফ করা চারতলায় রয়েছে খনিজ সম্পদ আর প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতার নিদর্শন
            
জাদুঘরের দোতলা থেকে একটা নিচু সিড়ি বেয়ে আলাদা একটা ভবনে যাওয়া যায় এখানে অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসিদের সাংস্কৃতিক গ্যালারি অত্যন্ত আধুনিক উপায়ে সংরক্ষিত সাংস্কৃতিক উপাদানের সাথে তাদের ইতিহাস প্রত্যেকটি সংগ্রহ শ্রেণি সাথে দেয়ালে লাগানো আছে ফ্ল্যাট প্যানেল ডিজিটাল ডিসপ্লে সামনে গেলেই মনিটরে ভেসে উঠছে একজন আদিবাসি নারী বা পুরুষের মুখ তারা ভিডিওতে তাদের নিজেদের সংস্কৃতি সম্পর্কে বলতে থাকে, সাংস্কৃতিক বিবর্তনের কথাও
            
দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের চলচ্চিত্র ভিডিওতে ধারণ করা হয়েছে ইনফ্রারেড রে দ্বারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যায় সমস্ত ভিডিও, পর্দার সামনে গেলেই এরকম একটা জাদুঘরে যে কেউ কিছুটা সময় কাটিয়ে বেরোনোর সময় দেখা যাবে নিজের অজান্তেই অনেক জ্ঞান সাথে নিয়ে বেরোচ্ছে।
            
আমার আশ্চর্য লাগে, যে সাদা অস্ট্রেলিয়ানরা এখন মরিয়া হয়ে কালোদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য ব্যস্ত হয়েছে- এই তারাই একশ' বছর আগে এই আদিবাসিদের মেরে সাফ করে দিতে চেয়েছিল কুকুরের মতো গুলি করে মেরেছে আদিবাসি দেখলেই শেষে গুলির খরচ আর সময় বাঁচানোর জন্য আদিবাসিদের খাবারের লোভ দেখিয়ে বন্দি করে খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে দিয়েছে দিনের পর দিন সুখের দিনে দুঃখের অতীত মনে করতে নেই কিন্তু সুখের দিনেই তোদুঃখের বাতাস বুকের কপাট নাড়ায় এই আদিবাসি সহজ সরল মানুষগুলোর জন্য কষ্ট হয় কিন্তু সমস্ত সভ্যতাই তো মানুষের কষ্ট দিয়ে তৈরি
            
মিঊজিয়ামের পাশেই রয়েছে সাউথ অস্ট্রেলিয়ান পাবলিক লাইব্রেরি হাতে সময় কম আর পেটের ক্ষিধে বেশি হওয়াতে লাইব্রেরিতে ঢোকা হলো না এবেলা রাস্তার ঠিক ওপারেই শপিং মল। নাম রান্ডল মল মায়আর, ডেভিড জোনস প্রভৃতি নামী দামী ডিপার্টমেন্ট স্টোরস আর ভূনিম্নস্থ ফুড-কোর্ট ফুড-কোর্টে পৃথিবীর নানা দেশের খাবার সাজানো আর প্রচন্ড ভিড় মেক্সিকান খাবার চেখে দেখতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু প্রচন্ড ভিড় সেখানে তাই ম্যাকডোনালডস নিয়ে বসে পড়লাম একদিকের একটা সিংগল টেবিলে যে কোন দোকান থেকে খাবার কিনে যে কোন জায়গায় বসে খাওয়া যায় এখানে প্রচুর চেয়ারটেবিল সাজানো রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হবার কারণে সিট খালি পেতে একটু সময় লাগছে এখন
            
শপিং মল থেকে একটা অ্যাস্‌কেলেটার ধরে উপরে উঠে রাস্তায় বেরোলাম কিং উইলিয়াম স্ট্রিট তৎকালীন রাজা চতুর্থ উইলিয়ামের নামানুসারে এই কিং উইলিয়াম স্ট্রিট; এডেলেইড সিটিকে পূর্ব পশ্চিম দুভাগে ভাগ করে সোজা উত্তর দক্ষিণ বরাবর চলে গেছে এডেলেইড সিটির নামটাও রাখা হয়েছে এই কিং উইলিয়ামের স্ত্রী কুইন এডেলেইডের নামে
            
এডেলেইড সিটিটা ছোট উত্তর দক্ষিণ বরাবর চারটে স্ট্রিট আর পূর্ব-পশ্চিম বরাবর ছয়টি স্ট্রিট নিয়ে মূল সি-বি-ডি বা সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট বা মূল সিটি হাঁটতে হাঁটতে সোজা টাউন হল পেরিয়ে দেখি ফ্রাংকলিন স্ট্রিট একটু হাঁটতেই চোখে পড়লো বাস টার্মিনাল - গ্রেহাউন্ড এর কাউন্টার এত দূরে চলে এসেছি! ম্যাপ খুলে দেখলাম মোটেও দূরে নয় একদম কাছে স্বাভাবিক গতিতে হেঁটে গেলে মিনিট পনেরো লাগবে এডেলেইড হাসপাতালের কমপাউন্ডে পৌঁছাতে ট্যাক্সিওয়ালা তাহলে পুরো শহর ঘুরিয়ে নিয়েছে সকালে! কথায় আছেবাঙালিকে বাঙালি না মারিলে আর কে মারিবে’! কিন্তু ট্যাক্সিওয়ালা কি বাঙালি ছিলো?         
            
ঘড়িতে বাজে তিনটা রুমে চলে এলাম টার্মিনাল থেকে হেঁটে আসতে মোট সময় লাগলো সতের মিনিট সকালে ট্যাক্সিতে লেগেছিলো বিশ মিনিট

[তৃতীয় পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন এখানে]
________________

এই কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ছবিগুলো বইতে প্রকাশিত হয়নি।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

বিজ্ঞানী গীতাঞ্জলি রাও

  পানি-দূষণের মাত্রা নির্ধারণের দ্রুততম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ‘টেথিস’ উদ্ভাবন করে গীতাঞ্জলি রাও যখন   ২০১৭ সালে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ তরুণ বিজ্ঞানীর শ...

Popular Posts