Saturday 24 November 2018

এডেলেইডে সাত দিন - ৩য় পর্ব



বিছানায় একটু বিশ্রাম নেবার জন্য শুয়ে উঠলাম দেড় ঘন্টা পর। ঘড়িতে বাজে পাঁচটা। জিন্‌স আর টি-শার্ট পরে শুয়েছিলাম। কনফারেন্‌সে এই পোশাকে যাওয়া চলে না। যতই এদেশে পোশাক সম্পর্কে উদাসীনতা থাকুক না কেন- কনফারেন্‌সে নিশ্চয় সবাই বেশ ভদ্র পোশাকে আসবে। আমিও ইস্ত্রি করা শার্ট-প্যান্ট বের করে জুতো জোড়া আরো চকচকে করে মচমচ করে বেরুলাম।
ঠিক কোথায় যেতে হবে তা সকালে এসে চিনে গিয়েছিলাম। এর মধ্যেই ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন টার্নিং পয়েন্টে কনফারেন্সের ম্যাপ সেঁটে দেয়া হয়েছে। একজন আনাড়িও তীরচিহ্ন অনুসরণ করে পৌঁছে যেতে পারবে গন্তব্যে। আমাকে যেতে হবে ইউনিয়ন বিল্ডিংএর নিচের তলায়।


এডেলেইড ইউনিভার্সিটিটি বেশ কয়েকটি পাহাড়ের উপর অবস্থিত। ইউনিয়ন বিল্ডিংটি একটি পাহাড়ের ঢাল ঘেঁষে। ফলে নিচের তলাটা হলো পাহাড়ের নিচে। সিড়ি দিয়ে নামতে হয়। আর ইউনিয়ন বিল্ডিংএর চারতলা আর পাঁচতলায় পাহাড়ের উপর দিয়ে সরাসরি ঢোকা যায়। ফিজিক্স বিল্ডিংটা পাহাড়ের উপরে। ফলে ফিজিক্স বিল্ডিং-এর নিচের তলা ইউনিয়ন বিল্ডিং-এর ছয়তলার সমতলে।
ফিজিক্স বিল্ডিংএর দিক থেকে নিচের দিকে নামছি। প্রশস্ত লাল সিঁড়ি। মাঝপথে দেখা হয়ে গেলো মেলবোর্ন গ্রুপের সাথে। ওরে বাপুরে! সবাই দেখি হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরে চলে এসেছে। কনফারেন্‌সের পোশাকের মর্যাদা রক্ষার সমস্ত দায়দায়িত্ব দেখি আমিই ঘাড়ে তুলে নিয়েছি। তাদের হাতে কনফারেনস ব্যাগ। তার মানে তারা রেজিস্ট্রেশন ডেস্কের কাজ সেরে ফেলেছে।
পার্টিক্যাল ফিজিক্সের ছাত্রী র‍্যাছেলের চেহারার সাথে এক্স-ফাইলের স্ক্যালির চেহারার মিল আছে। সেটা আমাদের সাথে সাথে র‍্যাছেলও জানে। তাই তার চলনে বলনে একটু বেশি রকমের স্মার্টনেস দেখা যায় সব সময়। এখন সে যেটা পরে আছে সেটাকে হাফপ্যান্ট বলা চলে না, সেটা বড়জোর কোয়ার্টার প্যান্ট। আর গায়ে সেরকমই সংক্ষিপ্ত একটা গেঞ্জি। প্লেনে এসেছে এরা। এই পোশাকেই কি তারা প্লেনে বসেছিলো? কে জানে। র‍্যাছেলের সাথে চোখাচোখি হতেই সে বললো, "প্রাডিব, কফি খেতে যাবে?"
"না, আমার রেজিস্ট্রেশন করা হয়নি এখনো।"
"তাহলে তুমি নিচে যাও। সেখানেই থেকো, আমরা কফি খেয়েই চলে আসবো।"
নিচে নামতেই দেখা হলো প্রফেসর স্টুয়ার্ট টোভির সাথে। ভদ্রলোক নামকরা এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিসিস্ট। কেমব্রিজ থেকে পিএইচডি করে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে চুল পাকিয়েছেন। তিনিও দেখি হাফপ্যান্ট, গেঞ্জি আর চপ্পল পরে চলে এসেছেন। নিজেকে খুব বোকা বোকা লাগছে এখন। আর সবার পোশাক দেখেই হয়তো খুব গরম লাগতে শুরু করেছে আমার।
ইউনিয়ন বিল্ডিংএর নিচের তলায় রেজিস্ট্রেশন ডেস্ক। পেছনে কনফারেনসের ব্যাগের বিরাট পাহাড় নিয়ে বসে আছে পাঁচজন অল্পবয়সী মেয়ে - রেজিস্ট্রেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট। ডেস্ক নম্বর-ওয়ানে কাউন্টার এ থেকে ডি। ‘এ’ থেকে ‘ডি’ মানে হলো নামের পদবীর আদ্যাক্ষর। আগে আমি পদবীটাকে নামের সাথে ঝুলে থাকা অপ্রয়োজনীয় লেজ মনে করতাম। দেশের বাইরে এসে দেখি অফিসিয়ালি সবাই এই লেজ ধরেই টানাটানি করে। তবে ইনফরমালি অস্ট্রেলিয়াতে সবাই সবাইকে নাম ধরেই ডাকে। যেমন প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ডকেও মিস্টার হাওয়ার্ডের বদলে জন বা জনি বলে ডাকা যায়।
আমার কনফারেনস ব্যাগ পেয়ে গেলাম। ব্যাগের ভেতর রাজ্যের কাগজপত্র ঠাসা। নেমট্যাগ- যা বুকে লাগিয়ে রাখতে হবে কনফারেনসের সবটুকু সময় ধরে। তাতে সুবিধা এই- কাউকে আর ঘটা করে নিজের নাম, কোন্‌ ইউনিভার্সিটি থেকে এসেছি এসব বলতে হবে না।
কনফারেনস হ্যান্ডবুকে প্রত্যেকটি বক্তৃতা আর ইভেন্ট এর সময়সূচি সুনির্দিষ্টভাবে দেয়া আছে। অ্যাবস্ট্রাক্ট বুকে রয়েছে এই কনফারেনসে যতগুলো পেপার উপস্থাপন করা হবে সবগুলোর সারমর্ম। আমি অ্যাবস্ট্রাক্ট বুক খুলেই নিজের পেপারটা দেখে নি। এটা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। গ্রুপ ছবি দেখার সময় যেমন প্রত্যেকে নিজের মুখটা কোথায় আছে, কেমন আছে আগে দেখে নেয়।
ব্যাগে আরো আছে এডেলেইডের ম্যাপ। সিটি গাইড এবং একগাদা বিজ্ঞাপন। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সম্মেলনের বিজ্ঞানীদের আহবান জানাচ্ছে তাদের তৈরি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার জন্য। কিছু বিজ্ঞাপন আছে চাকরিদাতাদের। সেখানে বলা আছে তারা আকর্ষণীয় বেতন দেবে, সুযোগ-সুবিধা দেবে ইত্যাদি। বিজ্ঞানীরা যেন তাদের প্রতিষ্ঠানে কাজ করার ব্যাপারে একটু বিবেচনা করে দেখেন। একদিকে হাজার হাজার মানুষ চাকরি পাচ্ছে না, আর অন্যদিকে চাকুরীদাতারা ঘুরছে যোগ্যতমদের পেছনে। ডারউইন সাহেব ‘সার্ভাইভ্যাল অব দি ফিটেস্ট’ লেখার সময় কি এতসব বিবেচনায় এনেছিলেন?
এই সোনালি রুপালি ঝলমলে বিজ্ঞাপনগুলো ফেলে দিতে সামান্য মায়া হচ্ছিলো। কিন্তু জঞ্জাল যত আকর্ষণীয় মোড়কেই সাজুক না কেন সে তো জঞ্জালই। দেখলাম রিসাইক্লিং বিন দ্রুত ভরে যাচ্ছে এই উচ্ছিষ্ট বিজ্ঞাপনে। বিজ্ঞাপনদাতারা ঠিকই জানেন যে এগুলির এরকম পরিণতি হবে। এবং এটাও জানেন যে এর মধ্য থেকেই অনেকের টেলিফোন পাবেন তারা।
দেখতে দেখতে আমরা মেলবোর্নের গ্রুপটা বেশ বড় হয়ে গেলাম। সারা অস্ট্রেলিয়ার প্রায় সবগুলি ইউনিভার্সিটি থেকে ফিজিক্সের বিভিন্ন শাখার পিএইচডি স্টুডেন্ট, পোষ্ট ডক্টরেট ফেলো আর প্রফেসররা এসেছেন। এসেছেন নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড আর আমেরিকা থেকেও। পাকিস্তানি একটি ইউনিভার্সিটি থেকেও একজনের নাম দেখলাম। রেজিস্ট্রেশন করেছেন প্রায় সাতশ' জন পদার্থবিজ্ঞানীই।
ঠিক সাড়ে ছ'টায় শুরু হলো ওয়েলকাম ককটেল রিসেপশান। ইউনিয়ন বিন্ডিং সংলগ্ন খোলা জায়গায়। ডান পাশে পার্কিং স্পট আর রাস্তাটা পেরোলে এ্ডেলেইডের নদী টরেনস। পঁয়ত্রিশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় উষ্ণ অভ্যর্থনা। এই রিসেপশানের আয়োজক ইংল্যান্ডের ইনস্টিউট অব ফিজিক্স।
হার্ড ড্রিংকসের ফ্রি সরবরাহ থাকলে যা হয়; প্রায় সবাই বিয়ার আর মদের বোতল খালি করছে একটার পর একটা। সোমরসে অনাসক্তদের জন্য আছে অরেঞ্জ জুস। ক্যাটারাররা সবার সামনেই একের পর এক খাদ্য পাত্র তুলে ধরছে। যার যা খুশি তুলে নিচ্ছে পাত্র থেকে। এরকম খাবারের নাম হলো ফিঙ্গার ফুড। আঙুলে ধরে খাওয়া যায় বলেই হয়তো এই নাম। প্লেট লাগে না, চামচ লাগে না। দাঁড়িয়ে বা হেঁটে হেঁটে গল্প করতে করতে খাওয়া যায়। নানা রকম খাবারের সমারোহ। একটার পর একটা খাবার এসে দাঁড়াচ্ছে চোখের সামনে। খাবারের টেবিলের সামনে হেঁটে যেতে হচ্ছে না বলে কোন ধরনের লাইন দেখা যাচ্ছে না। সাদা মাংস, লাল মাংস, মাছ, চিংড়ি, কত ধরনের ফিশ-বল, মিট-বল। পার্টিক্যাল থিওরি গ্রুপের ম্যাট নিরামিষভোজী। তার জন্য শাক পাতা ভর্তি স্যালাদের ব্যবস্থাও আছে। ভাষণ আর খাওয়া একসাথে চললে যা হয়, কিছু না শুনেই হাততালি দিতে হয়। আমিও হাততালি দিলাম অনেকের সাথে। বক্তারাও জানেন এ ধরণের অনুষ্ঠানে কেমন ভাষণ দিতে হয়। কোন বক্তৃতাই তাই দু’মিনিটের বেশি দীর্ঘ নয়।
নাম ঠিকানা সবার বুকে লেখা আছে। তা দেখে দেখে অনেকেই “হ্যালো প্রাডিব, হাই প্রাডিব” করতে লাগলো। আমিও কিছুক্ষণ হাই জন, হ্যালো লিজ, হ্যাল্লো সুশান, হাই টিম করতে করতে হাত মেলালাম আর ‘নাইস টু মিট ইউ, সি ইউ এরাউন্ড’ করতে লাগলাম। এসময় সামনে এসে দাঁড়ালো একটা চায়নিজ মেয়ে। উচ্চতায় আমার চেয়ে যথেষ্ট খাটো বলে আমার নামটা পড়ছিলো গলা উঁচু করে। তার নেমট্যাগের দিকে তাকিয়ে দেখলাম জিন ওয়াং। এসেছে ইউনিভার্সিটি অব কুইনসল্যান্ড থেকে। আমিই হাত বাড়িয়ে কথা বললাম তার সাথে, "হ্যালো জিন, হাউ আর ইউ? [অস্ট্রেলীয় উচ্চারণে হাউয়াইয়া?]"
"হাই প্রাডিব"
এডেলেইডে বেশ গরম, কুইনসল্যান্ডে মোটামুটি। মেলবোর্ন তেমন গরম নয় ইত্যাদি অর্ধ-প্রয়োজনীয় ইতস্তত কথাবার্তা হলো কিছুক্ষণ। এক পর্যায়ে সে জানতে চাইলো, "মেলবোর্নে কতদিন ধরে আছো?"
"আড়াই বছর। তুমি কতদিন ধরে অস্ট্রেলিয়ায়?"
"সাড়ে তিন বছর।"
"তোমার পিএইচডি কি শেষ?"
"না, থিসিস লিখছি এখন। আশা করছি মার্চের মধ্যে শেষ হবে।"
জানা গেলো জিনের রিসার্চ অ্যারিয়া অপটিক্‌স।
"তোমার দেশ কোথায়?" এডেলেইডে আসার পর এই প্রথম কেউ জ্ঞিজ্ঞাসা করলো আমাকে।
"বাংলাদেশ। তোমার?"
"চীন। মেলবোর্নে কেমন চায়নিজ আছে?"
"অনেক।"
"তোমার দেশটি কি আফ্রিকায়?"

মোটামুটি একটা ধাক্কা খেলাম আমি। আমি কালো এটা জানি। কিন্তু আফ্রিকানদের মতো দেখতে তা এই প্রথম জানলাম। চীনালোক সহজে বাংলাদেশ চিনতে পারে না। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নামকেও তারা তাদের নিজের ভাষায় অনুবাদ করে ফেলে। গ্রিনল্যান্ডকে বাংলা অনুবাদ করে আমরা যদি সবুজ-ভূমি বলতে আরম্ভ করি তাহলে যেরকম সমস্যা হবে জিনেরও হয়তো সেরকম সমস্যা হচ্ছে। এখন বাংলাদেশের চায়নিজ অনুবাদ না বললে সে চিনতে পারবে না।
বললাম, "না, আফ্রিকায় নয়। এশিয়ায়। তোমাদের প্রতিবেশী ইন্ডিয়া আমাদেরও প্রতিবেশী। ধরতে গেলে তোমরা আমাদের প্রতিবেশীর প্রতিবেশী। আমার দেশের নামের চায়নিজ অনুবাদ পরে জানাবো তোমাকে।"
"আসলে আমি ভূগোলে খুব কাঁচা তো।"
"ওটা একটা খোঁড়া অজুহাত। বাদ দাও।"
বাদ দিতে বললেও বাদ দেয়ার কোন লক্ষণ দেখা গেলো না জিনের মধ্যে। সে একটার পর একটা প্রশ্ন করেই চলেছে ।
"তুমি কোথায় উঠেছো এখানে?"
"রয়েল এডেলেইড হাসপাতালের হোস্টেলে।"
"কি মজা! আমিও তো ওখানে। কত তলায় তুমি?"
"দশ"
"আমি এগারো। আমি তোমার উপরে! হিঃ হিঃ হিঃ।"
আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না এখানে হাসার মতো কী আছে। কিন্তু হাসি না পেলেও নাকি ভদ্রতার হাসি হাসতে হয়। হাসলাম। এমনিতেই এখানে সবাই কারণে অকারণে হাসছে। দেখতে পেলাম বিপিনরা এসে ঢুকছে। জিনকে 'এক্সকিউজ মি' বলে বিপিনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
বিপিন মানে বিপিন ধল। ধর নয়- ধল। বিহারের মানুষ। মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির পোস্টডক্টরেট ফেলো। পিএইচডি করেছেন কোলকাতা থেকে। সঙ্গে এসেছে তার বৌ রানু। সাথে আরো কয়েকজন মেলবোর্নের ফিজিসিস্ট; এরিক, জন লি, ট্যান ল্যাং, ডেভিড পেটারসন। তারা আটজন মিলে একটি গাড়ি ভাড়া করে মেলবোর্ন থেকে সোজা ড্রাইভ করে চলে এসেছে। সবে এসে পৌঁছালো, কোথায় থাকবে এখনো ঠিক করতে পারেনি। জন, ট্যান আর রানুর সাথে ‘হ্যালো, হাই’ করতে না করতেই জিন এসে হাজির। জিনকে পরিচয় করিয়ে দিলাম জন আর ট্যানের সাথে।
জন লী আর ট্যান ল্যাং দু'জনই চায়নিজ। চায়নিজ ভাষাতেই আলাপ শুরু করলো তারা। একটু পরেই জানা গেলো ড. ট্যান ল্যাং আর জিন ওয়াং দু’জনই চীনে একই ইউনিভার্সিটি থেকে অনার্স পাস করেছে এবং তাদের দু’জনেরই সুপারভাইজার ছিলেন একই ব্যক্তি। আমি তাদেরকে কথা বলতে দিয়ে এগিয়ে গেলাম ড. অঞ্জলি মুখার্জীর দিকে।
ড. মুখার্জীর সামনে যেতেই তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, "আপনি মানে তুমিই প্রদীপ? ‘তুমি’ বলছি বলে কিছু মনে করো না। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আরো বড় সড় কেউ হবে।"
খুব সহজেই আলাপ জমে গেলো। কনফারেনস ডেলিগেটদের তালিকায় তাঁর আর ড. মহানন্দা দাশগুপ্তার নাম দেখে ঠিকই ভেবেছিলাম তাঁরা বাঙালি হবেন। ভারতীয় বাঙালি। অঞ্জলি মুখার্জী কোলকাতার মেয়ে। সাহা রিসার্চ ইনস্টিউট থেকে পিএইচডি করে গত দেড়বছর যাবত অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পোস্টডক্টরেট ফেলো। তাঁর হাজবেন্ড আছেন কোলকাতায়। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বড় পদে আছেন। তাই তাঁর ছুটি নেই এখানে আসার। অঞ্জলি এর মধ্যেই দু’বার ঘুরে এসেছেন কোলকাতা থেকে। অস্ট্রেলিয়ায় মন টিকছে না তাঁর, তার ওপর ক্যানবেরার মতো সব অর্থেই ঠান্ডা একটা জায়গায়।
বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে আমাকে নিয়ে গেলেন ড. মহানন্দা দাশগুপ্তার কাছে। শার্ট আর ঘাগড়া জাতীয় একটা পোশাক পরা থাকলেও চেহারা আর গায়ের রঙের কারণে মহানন্দাকে পুরোপুরি ভারতীয় মেয়েই মনে হচ্ছে। আমি কিছু বলার আগেই তিনি হৈ হৈ করে হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে। তাঁকে খুব উচ্ছ্বসিত মনে হচ্ছে। আমার সাথে পরিচিত হচ্ছেন বলেই এ উচ্ছ্বাস নয়, তিনি এমনিতেই বেশ প্রাণবন্ত। আমার সাথে বাক্য যা বললেন সব ইংরেজিতে। ইংরেজি কায়দায় আমার হাতটা ঝাঁকিয়ে দিলেন কয়েকবার। আমি মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম বাংলায় কথা বলার জন্য। কিন্তু মনে হচ্ছে তিনি বাঙালি নন। দাশগুপ্তা পদবীতো বাঙালিদের থাকে। আমি কোন কথা না বলে ক্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম আমার ডানহাতটা তাঁর হাতে ছেড়ে দিয়ে। তিনি দু’মিনিট ঝড়ের বেগে কথা বলে, পরে আমার সাথে আরো অনেক কথা বলবেন ইত্যাদি বলে, তাঁকে এখুনি যেতে হবে বলে দুঃখ প্রকাশ করে, অনেকটা ঝড়ের বেগেই চলে গেলেন। তাঁর গতির সাথে আমি কিছুতেই গতি মেলাতে পারছিলাম না। বাঙালি মেয়ের অবয়বে তিনি একজন পুরোদস্তুর অস্ট্রেলিয়ান।
আমি অঞ্জলি মুখার্জীকে জিজ্ঞেস করলাম, "তিনি বাঙালি নন?"
"পুরোপুরি বাঙালি। এখানে আসলে আট নয় বছর ধরে আছে তো তাই।"
জানা গেলো মহানন্দা দাশগুপ্তা টাটা ইনস্টিউট থেকে পিএইচডি করে এদেশে পোষ্টডক্টরেট ফেলো হিসেবে এসেছিলেন নয় বছর আগে অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশলান ইউনিভার্সিটিতে। তারপর থেকেই আছেন ওখানে। এক্সপেরিমেন্টাল নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের কুইন এলিজাবেথ ফেলো তিনি। কুইন এলিজাবেথ ফেলোশিপ পাওয়া সহজ কথা নয়। দারুণ প্রতিভার অধিকারী না হলে এরকম ফেলোশিপ পাওয়ার কথা ভাবতেও পারে না কেউ।
একে একে লোকজন চলে যেতে শুরু করেছে। আজকের মতো আয়োজন শেষ। কাল সকাল থেকে শুরু হবে মূল কর্মযজ্ঞ। আমিও যাবার জন্য পা বাড়ালাম। এ সময় "তুমি কি হোস্টেলে ফিরে যাচ্ছো?"
জিনের প্রশ্ন। সে কখন আমার পিছু নিয়েছে আমি খেয়াল করিনি।
"হ্যাঁ"
"আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমি আসলে রাস্তা চিনি না তো।"
"কোন সমস্যা নেই। তুমি এসেছো কবে?"
"কাল বিকেলে। আজ সারাদিন বিচে ঘুরেছি। ভীষণ সুন্দর বিচ। তুমি জানো এখানের বিচ কোনদিকে?"
মেয়েটা প্রচুর কথা বলে। চায়নিজ উচ্চারণে ইংরেজি। বুঝতে হলে বেশ মনোযোগ দিতে হয়জ। আমি অর্ধ-মনোযোগ দিয়ে চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম হোস্টেলের দিকে। ব্যাগ রেখে আবার বেরোবো এরকম প্ল্যান আমার।
"তুমি রাতে আর কিছু খাবে না?"
এরকম প্রশ্নের জন্য আমি তৈরি ছিলাম না মোটেও। আমি কিছু বলার আগেই জিন বললো, "আমি ভেবেছিলাম এখানে ডিনার করাবে। তা না, কেবল টুকটাক খাওয়া।"
এই টুকটাক খাওয়া কিন্তু পরিমাণে কম নয়। আমার পেট ভর্তি হয়ে গেছে। অথচ এই পুঁচকে মেয়েটার পেটে এখনো ক্ষুধা আছে! আশ্চর্য তো। বললাম, "এর চেয়ে ভালো ডিনার এখানে আর কি করাবে। ফুল কোর্স ডিনার তো আর সব দিন করানো যাবে না।"
"আমার পেট ভরেনি। তুমি খাবারের দোকান চেন এখানে?"
"চিনি, কিন্তু আমার মনে হয় এতক্ষণে সব বন্ধ হয়ে গেছে।"
"চল না, গিয়ে দেখি। আমি একাই যেতাম। কিন্তু পথ চিনি না তো। তোমার কোন কাজ নেই তো এখন?"
জিনের কথায় কোন ধরনের ফর্মালিটির বালাই নেই। এমনভাবে কথা বলছে যেন সে জানেই আমি তার সাথে যেতে আপত্তি করবো না। আর আমার কোন কাজ থাকলেও তা ড্রপ করবো এখন। আমার আসলেই কোন কাজ নেই এখন। তাই আপত্তি করলাম না। দেখা যাক মেয়েটার খাদ্য সমস্যার কোন সমাধান করা যায় কি না। হোস্টেলে না গিয়ে সিটির দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।
খাবারের দোকানসহ শহরের প্রায় সব দোকান বিকেল পাঁচটায় বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু রেস্টুরেন্ট খোলা আছে। কিন্তু জিন সেখানে ঢুকতে রাজি নয়, কারণ ডিনারের জন্য এত বেশি খরচ সে করতে পারবে না। শেষে একটা খাবারের গাড়ি পাওয়া গেলো। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে স্যান্ডুইচ বিক্রি করছে। জিন খুশিমনে দুটো স্যান্ডুইচ কিনলো। আমিও ভদ্রতার খাতিরে একটা কিনলাম।
স্যান্ডুইচের বিশাল আকৃতি দেখে আমি ভেবেছিলাম জিন দুটো স্যান্ডুইচ শেষ করবে কীভাবে? কিন্তু আমাকে বেশিক্ষণ ভাবতে হলোনা। কিছুদূর হেঁটে পার্লামেন্ট হাউসের বারান্দায় এসে বসতে বসতেই তার একটা স্যান্ডুইচ শেষ। আমারটার মোড়কও খুলিনি তখনো।


নর্থ ট্যারেস আর কিং উইলিয়াম স্ট্রিটের কোণায় এই পার্লামেন্ট ভবন। সাউথ অস্ট্রেলিয়ার স্টেট পার্লামেন্ট হাউজ। গ্রানাইট পাথরের বিরাট বিরাট দশটি পিলার শোভা পাচ্ছে বারান্দাজুড়ে। শক্ত কালো পাথরের সিঁড়িতে বসে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম এর কারুকাজ। সিঁড়ির পাশে দেয়ালে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লেখা রয়েছে।
এই ভবনটার দুটো অংশ। পশ্চিম অংশ তৈরির কাজ শুরু হয়েছিলো ১৮৮৩ সালে, শেষ হয়েছে ১৯৩৯ সালে। আর পূর্ব অংশের কাজ শেষ হয়েছে মাত্র কয়েক বছর আগে ১৯৮৯ সালে। এতো দীর্ঘ সময় কেন লাগলো তা আমি জানি না। আর বিল্ডিংটাও এমন কিছু অসাধারণ নয় যে এতদিন লাগবে। পুরোনো পার্লামেন্ট হাউজটাও এখনো পাশেই আছে।
রাস্তার আলো জ্বলছে অনেক আগেই। এখনো দিনের আলো আছে। রাস্তাগুলো বিশাল চওড়া এখানে। রাস্তার দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছিলাম। হঠাৎ জিনের প্রশ্নে চমকে উঠলাম। এতক্ষণ জিনের অস্তিত্বও ভুলে গিয়েছিলাম আমি।
"তোমার টপিকটা কী?"
"পিএইডি টপিক নাকি এখানে কী নিয়ে বলবো সেটা?"
"দু’টোই"
এবার আমার গবেষণা সম্পর্কে কিছুক্ষণ কথা হলো। জানতে চাইলাম তার কাজ সম্পর্কে। বলতে বলতে সে জানালো অস্ট্রেলিয়াকে তার মোটেও পছন্দ নয়। কারণ তার মতে অস্ট্রেলিয়া খুব একটা গতিশীল নয়। সে গতি পছন্দ করে। যেমন রয়েছে আমেরিকার। চার সপ্তাহের জন্য সে গিয়েছিলো নিউইয়র্কে। গত বছর। পিএইচডি শেষ করে আবারো যাবার ইচ্ছা। এখন থেকেই চেষ্টা করছে। কারণ সেখানে টাকা উপার্জন করা কোন ব্যাপারই নয়। এবং আমি যদি টাকা উপার্জন করতে চাই তাহলে অবশ্যই তার কথা শোনা উচিত। অবশ্যই আমেরিকা যাওয়া উচিত।
আমি চুপ করে শুনে যাচ্ছি জিনের কথা। সে কথা বলতে ভালোবাসে, বলুক ।
"আমি ভাবছি আমার সাবজেক্ট চেঞ্জ করে ফেলবো। আইটি’র বাজার এখন খুব ভালো। তুমি কী বলো?"
এই প্রশ্ন আসলে কথা বলার একটা অংশ। আমার উত্তরে কিছু যায় আসে না। তাই চুপ করে থাকলাম। সে বলেই চলেছে, "একজন আইটি’র লোক এখন বছরে কমপক্ষে একশ' হাজার ডলার বেতন পায়। ইউএস ডলার। আর একজন ফিজিসিস্ট?"
আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। বললাম, "সব কিছুকে টাকার হিসেবে বিচার করা উচিত নয়। যারা গবেষণা করে তারা মূলত ভালো লাগে বলে করে, ভালোবাসে বলেই করে। সেখানে টাকাটা প্রয়োজনীয়, কিন্তু মুখ্য নয়।"
"ভালোবাসা সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা নেই বলেই তুমি এই কথা বলছো। ভালোবাসার মূল কথাই হচ্ছে গিভ এন্ড টেক পলিসি।"
ভালোবাসার এরকম জেনারালাইজেশান মেনে নেয়া যায় না। বললাম, "অবজেকশানস। সব ভালোবাসা গিভ এন্ড টেক পলিসি নয়। ভালোবাসার মূল কথা হচ্ছে স্যাক্রিফাইস এন্ড কমিটমেন্ট। এ দু’টো না থাকলে কোন ভালোবাসাই সম্পূর্ণ নয়।"
তর্ক লেগে যেতে দেরি হলো না। জিন মানতেই চায় না যে অনেক ভালোবাসায় রেসিপ্রোসিটির স্থান নেই। তার কথা হলো, "তুমি যা চাচ্ছো, তা যদি তোমার ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে না পাও, তাকে বদলে ফেলো। অলস লোকেরাই শুধু স্যাক্রিফাইস করে।"
সে যুক্তির কোন ধার ধারছে না। তার ভাবখানা এই, বাবা মাও যদি তার আশা পূরণ করতে না পারে তবে তাদেরকেও সে চেঞ্জ করে ফেলবে। বললাম, "যে বিষয়ে তুমি পিএইচডি করছো সে বিষয়টার বাজার দরের ভিত্তিতে তুমি কাজ করবে আর বাজার দর কমে গেলে বিষয় বদলাবে তাতো সব সময় সত্যি নয়। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তো একই রকম ব্যাপার। যাকে সত্যিকার ভালোবাসো তার জন্য সামান্য স্যাক্রিফাইস তুমি যদি না-ই করো, তাহলে কিসের ভালোবাসার কথা বলো তুমি?"
"তোমার মতো এরকম ছেলেমানুষী ভাবনা তোমার বয়সে আমিও ভাবতাম। এখন আর ভাবি না। বয়স বাড়লে তুমিও তোমার ভাবনা বদলাতে বাধ্য হবে।"
আমার মুখে আর কথা জোগালো না। চায়নিজদের বয়স সহজে বোঝা যায় না। জিনের বয়স তেইশ থেকে তেতাল্লিশ যে কোনটাই হতে পারে। কিন্তু আমাকে একেবারে ছেলেমানুষ ভাবার তো কোন কারণ নেই। মানুষের বয়সটা একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে এ সম্পর্কে আর কিছু বললাম না।
জিন বলেই চলেছে, "আমি তোমার যুক্তিগুলোর বিপরীতে যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না। কিন্তু তোমার যুক্তি আমি মেনেও নিচ্ছি না। আদর্শ ভালো জিনিস। কিন্তু শুধু আদর্শ দিয়ে জীবন চলে না।"
আমার আর তর্ক করতে ইচ্ছে করছে না। বললাম, "এবার ফেরা যাক।"
"চলো।"
ফেরার পথেও সে সারাক্ষণ বক বক করলো। আমি শুধু হ্যাঁ হুঁ করে গেছি। সে হোস্টেলের রাস্তা চেনে না বলেছিলো। কিন্তু এখন রাতের বেলাতেও দেখি সে একবারও রাস্তা সম্পর্কে কিছুই না জ্ঞিজ্ঞেস করে যেখানে বাঁক নেবার ঠিক সেখানেই বাঁক নিয়ে, যেখানে রাস্তা পেরোবার সেখানেই রাস্তা পার হয়ে হোস্টেলে ফিরেছে। দশতলার লিফট থামলে সে হাত বাড়িয়ে দিলো। আমি তার হাতটা সামান্য ঝাঁকিয়ে দিয়ে বললাম, "গুডনাইট" ।
________________
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

অলিভিয়া নিউটন-জন

  কাজের সুবাদে মাঝে মধ্যে যেতে হয় অস্টিন হাসপাতালে। ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ সেখানে ক্লিনিক্যাল কাজকর্ম শেখে, আবার অনেকেই পাস কর...

Popular Posts