Sunday 11 November 2018

মেরি কুরির কাহিনি - ৬ষ্ঠ পর্ব



শেষ পর্যন্ত উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মেরি ও পিয়েরকে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় যে জায়গাটি কাজ করার জন্য দিতে সম্মত হলো তা একটা পরিত্যক্ত শেড - যা মেডিকেল ফ্যাকাল্টির মর্গ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এখন তার ছাদ ফুটো, মেঝে ভাঙা। গরমের দিনে উত্তপ্ত চুলা হয়ে ওঠে ঘরটি আর শীতে পানি জমে বরফ হয়ে হয়ে। অনন্যোপায় হয়ে সেখানেই কাজ শুরু করলেন মেরি ও পিয়ের। 

গ্রীষ্মের প্রচন্ড গরমে সিদ্ধ হতে হতে, শীতে প্রচন্ড ঠান্ডায় বরফ হতে হতে মেরি আর পিয়ের কাজ করতে লাগলেন। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। এক খাবলা পিচব্লেন্ড নিয়ে সোডার দ্রবণে মিশিয়ে সিদ্ধ করার পর পানিতে দ্রবণীয় এবং অদ্রবণীয় অংশ পৃথক করেন। পরে অদ্রবণীয় অংশকে এসিডে দ্রবীভূত করেন। তার সাথে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে অনাকাঙ্খিত বস্তুকে একটার পর একটা আলাদা করে ফেলে দেন। এইভাবে বিরামহীন মিশ্রণ, দ্রবীভূতকরণ, তাপন, ছাঁকন, বিশুদ্ধীকরণ, কেলাসন চলতে থাকলো। যে কোন মৌল আলাদা করার পর পিয়ের তাঁর ইলেকট্রোমিটারে তেজষ্ক্রিয়তার মাত্রা মেপে দেখেন। পরীক্ষণীয় পিচব্লেন্ডের অবশেষ যতই কমতে থাকে তেজষ্ক্রিয়তার পরিমাণ ততই বাড়তে থাকে। বস্তা বস্তা পিচব্লেন্ড ছেঁকে তাঁরা বিন্দু বিন্দু রেডিয়াম সংগ্রহ করতে লাগলেন। 

এদিকে বাসায় আইরিন বড় হচ্ছে তার দাদুর কোলে। সন্ধ্যায় ডিনারের জন্য যখন বাসায় আসেন মেরি ও পিয়ের - আইরিন ছুটে এসে মেরির কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মেরি তখন কিছু সময়ের জন্য হলেও ভুলে যান তাঁর রেডিয়ামের কথা। কিন্তু পিয়েরের তর সয় না। তিনি ছটফট করতে থাকেন কখন ফিরে যাবেন কাজের শেডে। 

আইরিনকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে ঘুম পাড়ান মেরি। তারপর ঘুমন্ত মেয়েকে শ্বশুরের কোলে দিয়ে স্বামীর হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে ফিরে আসেন পরিত্যক্ত মর্গে - তাঁদের গবেষণাগারে। কিছুক্ষণ আলো না জ্বালিয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখেন - তাঁদের তিল তিল করে জমানো রেডিয়াম থেকে নীলাভ দ্যোতি বেরুচ্ছে।


গবেষণারত পিয়ের ও মেরি কুরি

১৮৯৯ সালে কাজ শুরু করেছিলেন তাঁরা। ১৯০২ সালে দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ মাস পর কুরি দম্পতি এক ডেসিগ্রাম (এক গ্রামের দশ ভাগের এক ভাগ) পরিমাণ বিশুদ্ধ রেডিয়াম সংগ্রহ করতে সমর্থ হলেন। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা আশ্চর্য হয়ে গেলেন এই অত্যাশ্চর্য শক্তিশালী তেজষ্ক্রিয় মৌলের আবিষ্কারে। রেডিয়ামের উজ্জ্বল নীলাভ আলোর মতই আলোকিত হয়ে উঠলেন মেরি ও পিয়ের কুরি। 

ডক্টরাল থিসিস লেখার কাজ চলছে মেরির। ইতোমধ্যে তাঁরা রেডিয়াম ও রেডিও-অ্যাক্টিভিটি সংক্রান্ত বেশ কিছু যুগান্তকারী গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন পিয়ের ও মেরির যুগল নামে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক সমাজ মনে হচ্ছে মেরির চেয়ে পিয়েরকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে পিয়েরকে। 

১৯০৩ সালে মেরির থিসিস যখন প্রায় কমপ্লিট - তখন ইংল্যান্ডে রয়েল সোসাইটিতে রেডিয়াম সংক্রান্ত বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমন্ত্রিত হলেন পিয়ের। মেরিও সাথে গেলেন তাঁর। 

পিয়েরের বক্তৃতা শোনার জন্য লন্ডনের সব বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীই উপস্থিত হলেন। মেরি বসেছেন সামনের সারিতে লর্ড কেলভিনের পাশে। বক্তৃতায় পিয়ের মেরির অবদানের কথা খোলাখুলিভাবে বর্ণনা করলেন। মেরির চোখ বার বার চলে যাচ্ছিলো বক্তৃতা শুনতে আসা সালংকারা প্রসাধনচর্চিত ব্রিটিশ মহিলাদের গায়ের ভারী ভারী দামী অলংকারের দিকে। মেরি ভাবছিলেন - কী পরিহাস জগতের। এরকম একটা গয়না বিক্রি করলে তাঁদের প্রয়োজনীয় ল্যাবোরেটরি তৈরি করে ফেলা যায়। মেরি অস্বস্তির সাথে এটাও খেয়াল করলেন যে সবাই তাঁর দিকে এমন ভাবে তাকাচ্ছেন যেন ভিন গ্রহের কোন প্রাণী দেখছেন - যিনি মহিলা হলেও বিজ্ঞানচর্চা করেন এবং যিনি এত দরিদ্র যে গায়ে একটাও অলংকার নেই! বক্তৃতাশেষে পিয়ের ও মেরিকে ১৯০৩ সালের ড্যাভি মেডেল প্রদান করা হলো। 

জীবকোষের ওপর রেডিয়ামের প্রভাব চোখে পড়তে শুরু করেছে বিজ্ঞানীদের। পিয়ের নিজের বাহুতে রেডিয়াম চেপে ধরে দেখেছেন তাঁর চামড়া পুড়ে গেছে। ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার কাজে যে রেডিয়াম বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে তা বোঝা যাচ্ছে। 

আমেরিকান ইঞ্জিনিয়াররা রেডিয়াম তৈরির পদ্ধতি জানতে চেয়ে চিঠি লিখেছেন পিয়েরের কাছে। রেডিয়ামের প্যাটেন্টের জন্য বিরাট অংকের টাকা অফার করছেন তারা। মেরির সাথে দীর্ঘ আলোচনা করলেন পিয়ের।

রেডিয়াম আবিষ্কারের স্বত্ব নিজেদের নামে করে নিলে ঘরে বসেই কোটি কোটি টাকা উপার্জন করতে পারবেন তাঁরা। গবেষণা করার জন্য একটা ল্যাবোরেটরি নেই তাঁদের। রেডিয়ামের টাকাতেই তাঁরা তৈরি করতে পারবেন অত্যাধুনিক গবেষণাগার। আইরিনের ভবিষ্যত অনেক বেশি সুরক্ষিত হবে যদি তাঁদের টাকা থাকে। 

কিন্তু দু’জনের কারোরই মন সাঁয় দিচ্ছে না বিজ্ঞানকে অর্থোপার্জনের হাতিয়ার করতে। তাঁরা বিশ্বাস করেন - বিজ্ঞান হবে মুক্ত। প্রকৃতিতেই আছে যে পদার্থ - তা খুঁজে পেলেই আমার নিজের বলে রেজিস্ট্রি করে নেবো - তা কীভাবে হয়? অনেক পরিশ্রম করে যে রেডিয়াম তাঁরা আবিষ্কার করেছেন - তা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন। কোন ধরনের প্যাটেন্ট করালেন না তাঁরা। এর আগে উইলহেল্‌ম রন্টগেনও এক্স-রে আবিষ্কারের কোন প্যাটেন্ট নেন নি। পিয়ের আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ারদের জানিয়ে দিলেন কীভাবে রেডিয়াম সংগ্রহ করতে হবে। 

সরবোন ইউনিভার্সিটিতে ডক্টরাল থিসিস জমা দিলেন মেরি কুরি। ১৯০৩ সালের ১২ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার গ্যালারি কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেলো মেরির থিসিস বক্তৃতা শোনার জন্য। ব্রোনিয়ারা ফ্রান্স ছেড়ে পোল্যান্ডে চলে গেছেন। তাঁরা পোল্যান্ড থেকে এসেছেন মেরির বক্তৃতা শোনার জন্য। পিয়েরের বাবাও এসেছেন, বসেছেন পিয়েরের পাশে। পিয়েরের বন্ধু অধ্যাপক জাঁ পেরি ও পল লাঁজেভি এবং পিয়ের ও মেরির অনেক ছাত্র-ছাত্রীর সাথে সরবোনের অধ্যাপকরা। 

বক্তৃতা ও প্রশ্নোত্তর শেষে পরীক্ষকদের সর্বসম্মতিক্রমে প্রফেসর লিপম্যান মেরিকে ডক্টরেট ঘোষণা করলেন। বিজ্ঞানের ইতিহাসে নতুন মাইলফলক স্থাপন করলেন মেরি কুরি - শুধু সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় নয় - পুরো ইউরোপের প্রথম নারী ডক্টরেট হয়ে। 

অতি-পরিশ্রম, খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম ও শরীরের প্রতি অযত্নের প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে শুরু করলো। পিয়ের ও মেরি উভয়েরই শরীর খুব খারাপ হয়ে গেছে। ওজন কমে গিয়ে কংকালসার হয়ে গেছেন দু’জনই। বন্ধু ও সহকর্মীরা সবাই খুব চিন্তিত তাঁদের ব্যাপারে। অত্যধিক তেজষ্ক্রিয়তা শরীরের ভেতরটা ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে তাঁদের। কিন্তু তাঁরা তা বুঝতে পারছেন না। 

ইতোমধ্যে মেরি দ্বিতীয়বার গর্ভধারণ করেছেন। কিন্তু যেটুকু যত্ন নিজের নেয়া উচিত তা তিনি নিচ্ছেন না। পাঁচ মাসের গর্ভবতী অবস্থায় সাইকেলে চড়তে গিয়ে মারাত্মক রকমের আহত হন মেরি। অতিরিক্ত অন্তঃক্ষরণে তাঁর মিসক্যারেজ হয়ে যায়। খুবই মুষড়ে পড়েন তিনি।

এত কষ্টের মধ্যেও আনন্দের সংবাদ আসে সুইডেনের নোবেল কমিটির কাছ থেকে। ১৯০৩ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন যৌথভাবে হেনরি বেকোয়ারেল, পিয়ের এবং মেরি কুরি।

পিয়ের অনেক বেশি খুশি হন এই সংবাদে। কারণ এর কিছুদিন আগে নোবেল কমিটির এক সদস্য সুইডেনের গণিতবিদ ম্যাগনাস মিট্যাগ-লেফ্‌লার পিয়েরকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন যে নোবেল কমিটি নোবেল পুরষ্কারের জন্য বিবেচনা করছে বেকোয়ারেল ও পিয়েরের নাম। মেরি কুরির নাম নেই কোথাও। মিট্যাগ-লেফ্‌লার বিজ্ঞানে মেয়েদের অংশগ্রহণের পক্ষে কাজ করেন। তিনি মেরির যোগ্য পুরষ্কার থেকে মেরিকে বঞ্চিত করার চেষ্টা সহজে মেনে নিতে পারেননি। পিয়ের তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন তেজষ্ক্রিয়তার কাজের জন্য নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্য হলে তা পিয়ের ও মেরি দু’জনেরই প্রাপ্য। নোবেল কমিটি পিয়েরের চিঠিকে গুরুত্ব দিয়েছে। 

১৯০৩ সালের জন্য মেরি কুরির নাম প্রস্তাব করেননি কেউ। অথচ ১৯০১ ও ১৯০২ সালে তাঁর নাম প্রস্তাবিত হয়েছিল। সেখান থেকে একটি প্রস্তাবকে কাজে লাগিয়ে ১৯০৩ সালে মেরি কুরিকে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হলো। বিজ্ঞানের ইতিহাসে আরেকটি মাইলফলক স্থাপন করলেন মেরি কুরি। তিনিই হলেন প্রথম নারী নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী। 

নোবেল পুরষ্কার পাবার পর রাতারাতি প্রচার-মাধ্যমের নজরে চলে এলেন মেরি ও পিয়ের। সাক্ষাৎকার নেবার জন্য সাংবাদিকেরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। পিয়ের ও মেরি ভীষণ বিরক্ত। তাঁদের স্বাভাবিক কাজকর্ম ভীষণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। দিন-রাত নানারকম অনুষ্ঠান সংবর্ধনা ভোজ-সভায় যোগ দিতে হচ্ছে অনিচ্ছাসত্ত্বেও। 

প্রতিদিন শত শত চিঠি আসছে মেরি আর পিয়েরের ঠিকানায়। ডিনারের পর চিঠির স্তূপ সামনে নিয়ে বসেন মেরি - সবগুলো চিঠি খুলে খুলে পড়েন। যেগুলোর উত্তর দিতে হবে মনে করেন - আলাদা করে রাখেন। তবে সেরকম চিঠির সংখ্যা খুবই কম। বেশির ভাগ চিঠিই অভিনন্দন বার্তা, প্রশংসা আর কিছু কিছু একেবারেই অর্থহীন বিরক্তিকর। যেমন আমেরিকা থেকে একজন চিঠি লিখে জানাচ্ছেন তিনি তাঁর রেসের ঘোড়ার নাম রেখেছেন ‘কুরি’। পিয়ের বিরক্ত হয়ে উঠছেন - কারণ নোবেল পুরষ্কার পাবার পর থেকে গবেষণা করারই সময় পাচ্ছেন না তাঁরা। কিছুটা বিরক্ত হয়ে তিনি মেরিকে বলেন - “এসব চিঠি পড়ার কি কোন দরকার আছে মেরি?”
“অবশ্যই আছে। ধরো পৃথিবীর কোন এক প্রান্ত থেকে কেউ একজন এমন কিছু বৈজ্ঞানিক তথ্য জানতে চাচ্ছেন যা পেলে তাঁর গবেষণার উন্নতি হবে। বিজ্ঞানের উন্নতি মানে তো সবারই উন্নতি। তার জন্য এতটুকু কষ্টতো আমাদের করতেই হবে পিয়ের।”


মেরি ও পিয়েরের সাথে কন্যা আইরিন

সাংবাদিকরা দিনরাত মেরি আর পিয়েরের খবর পাবার জন্য ঘুরছে। বাসায় এসে তাঁদেরকে না পেয়ে ছয় বছরের শিশু আইরিনকেও নানা-রকম প্রশ্ন করে। ডিনারে তারা কী খায়, মেরি রান্না করেন কিনা, কখন ঘুমান এই জাতীয় সব ব্যক্তিগত তথ্যের প্রতিই বেশি আগ্রহ সাংবাদিকদের। প্যারিসের সংবাদপত্রে নানারকম সংবাদ বেরোতে থাকে মেরি-পিয়েরের সম্পর্কে।

সবগুলো সংবাদপত্রে ফ্রান্সের ‘মেধাবী সন্তান’ পিয়েরের ভূয়সী প্রশংসার পাশে মেরির উল্লেখ এমন যেন মেরি পিয়েরের কাজে সামান্য কিছু সাহায্য করেছেন মাত্র। অনেক কাগজে মেরির কোন উল্লেখই নেই। আবার কয়েকটা কাগজে মেরির কড়া সমালোচনা - মেরি সংসারের প্রতি অমনযোগী। শিশু সন্তানের প্রতিও তাঁর মনযোগ নেই। শিশু সন্তানকে একা একা খাবার খেতে হয়। মেরি যে পোল্যান্ড থেকে আগত বিদেশিনী, ফ্রান্সের কেউ নন - তাও প্রচার করে অনেক রিপোর্টার। 

মেরি অবশ্য এসবে তেমন গুরুত্ব দেন না। তাঁর দুঃখ - এত অর্জনের পরেও পিয়ের বা তাঁর একাডেমিক স্বীকৃতি নেই। পিয়ের নোবেল পুরষ্কার পাবার পরেও ইপিসিআই’র ‘অধ্যাপক’ নন - একজন ল্যাবোরেটরি টেকনিশিয়ান মাত্র। আর মেরি কুরি একটা মেয়েদের হাইস্কুলের ফিজিক্সের শিক্ষক। 

এদিকে সারাপৃথিবীর প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত হয়ে চলেছে মেরি ও পিয়েরের অর্জনের খবর। তার চেয়েও বেশি প্রচারিত হচ্ছে এই যে তাঁরা কীরকম কষ্ট করে একটা ভাঙা শেডের মধ্যে গবেষণাকাজ চালিয়েছেন।

ইপিসিআই কর্তৃপক্ষ পিয়ের কুরিকে দ্রুত প্রফেসর পদে প্রমোশন দিল। ফরাসি সরকার নিজেদের লজ্জা ঢাকার জন্য পিয়েরকে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর পদে নিয়োগের প্রস্তাব দিলেন। পিয়ের সেই প্রস্তাবে রাজি হবার আগে শর্ত দিলেন - তাঁর ল্যাবোরেটরি লাগবে। সরকার শর্ত মেনে নিল। সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটো পদ তৈরি হলো পিয়ের কুরির জন্য অধ্যাপক পদ আর মেরি কুরির জন্য তাঁর গবেষণা সহকারির পদ। 

সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য নানারকম কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন পিয়ের। মেরি তাঁকে বুঝিয়ে রাজি করালেন ইপিসিআই’র পদটি ছেড়ে দিতে। পিয়ের তাই করলেন। মেরি তাঁর স্কুলের চাকরিটি ছাড়লেন না। সরবোনের গবেষণা সহকারির চাকরি আর স্কুলের চাকরি দুটোই রইলো তাঁর।   

নোবেল পুরষ্কার নিতে মেরি বা পিয়ের কেউই স্টকহোমে যেতে পারেননি শারীরিক অসুস্থতার কারণে।

সরকার কথা দিলেও পিয়েরের ল্যাবোরেটরি তৈরির সরকারী আদেশ আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতার ফাঁসে আটকা পড়ে আছে। এরমধ্যে ফরাসি সরকার পিয়েরকে রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘লিজিয়ন অব অনার’ দিতে চাইলে পিয়ের তা প্রত্যাখান করে বলেন, “আমাদের এখন এরকম অলংকারের চেয়েও বেশি দরকার গবেষণা করার ল্যাবোরেটরি। দয়া করে তার ব্যবস্থা করেন।” 

১৯০৪ সালের ৬ই ডিসেম্বর মেরি ও পিয়েরের দ্বিতীয় কন্যা ইভ কুরির জন্ম হয়। আইরিন ও ইভকে নিয়ে বৃদ্ধ ইউজিন কুরির আনন্দে সময় কাটে। মেরি ও পিয়ের একাডেমিক ও বৈজ্ঞানিক কাজকর্মে ব্যস্ত। নোবেল পুরষ্কারের টাকার একটা অংশ দিয়ে তাঁরা একটা গবেষণা-কেন্দ্র গড়ে তোলার কাজে হাত দিয়েছেন। সরবোনে তেজষ্ক্রিয়তা সংক্রান্ত নতুন কোর্স তৈরি করছেন পিয়ের। মেরিও চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁর রেডিয়ামের ভবিষ্যৎ ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করছেন, গবেষণাপত্র রচনা করছেন। 
____________
এ কাহিনি আমার "রেডিয়াম ভালোবাসা" বইতে প্রকাশিত হয়েছে।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

বিজ্ঞানী গীতাঞ্জলি রাও

  পানি-দূষণের মাত্রা নির্ধারণের দ্রুততম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ‘টেথিস’ উদ্ভাবন করে গীতাঞ্জলি রাও যখন   ২০১৭ সালে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ তরুণ বিজ্ঞানীর শ...

Popular Posts