Saturday, 1 May 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ১৮

 





স্বপ্নলোকের চাবি – ১৮

 

অনেকক্ষণ থেকে দরজার কড়া নাড়ছে কেউ। মাথার উপর থেকে লেপ সরিয়ে চোখ খুলে দেখলাম এখনো অন্ধকার কাটেনি। আমার রুমের উত্তর-পূর্ব কোণের দেয়ালজুড়ে জানালা। কাচের পাল্লায় পাতলা নীল পর্দা লাগিয়েছি কিছুদিন আগে। কিন্তু পর্দা এতটাই পাতলা যে পর্দার ভেতর দিয়ে বাইরের আলো তো আসেই, কুয়াশাও দেখা যায়। বিছানায় পাশ ফিরতেই দেখলাম উত্তরদিকের জানালাজুড়ে কুয়াশার আস্তরণ। জানালার ঠান্ডা কাচে পাতলা কুয়াশার প্রলেপ; ছুঁয়ে দিলে আঙুল ভিজে যাবে। এত সকালে কে আসতে পারে? সম্ভবত খান সাহেব। প্রতি মাসের এক তারিখ খুব সকালে এসে তিনি ঘরভাড়া নিয়ে যান। এ মাসে আসেননি। আজ মাসের চার তারিখ। হয়তো আজ এসেছেন। কিন্তু এত সকালে উঠতে ইচ্ছে করছে না। সাড়া না পেলে নিশ্চয় অন্য কারো কাছে যাবেন। সবার ভাড়া আদায় করে আবার আসতে আসতে আমি আরো এক ঘুম দিয়ে উঠতে পারবো। কড়া নাড়ার কড়া শব্দ বন্ধ হয়ে গেছে। আমি আবার লেপের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে ফেললাম।

 

শীতকাল এখনো অফিসিয়ালি শুরু হয়নি। কিন্তু এই নভেম্বর মাসেই রাতে কুয়াশা পড়ে, ভোরে আপাদমস্তক লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমানো যায়। এই আরামের ঘুম ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না সকাল বেলা। স্কুলে থাকতে প্রতিদিন সকালেই আমার বাবার একটা নীতিশ্লোক শুনতে হতো – “সকালে শয়ন আর সকালে উত্থান, এই দুই আচরণ সুখের নিদান।“ সুখে থাকার জন্য যে দুটো আচরণের কথা বলা হয়েছে তার কোনটাই আমি পালন করি না। আমি দেরিতে ঘুমাই, দেরিতে উঠি। তাই সুখ যে আমার কপালে নেই তা বুঝতে পারছি।

 

আবার ঠুকঠুক শব্দ শুরু হলো। মনে হচ্ছে দরজার পাল্লায় তবলা বাজাচ্ছে কেউ। কিন্তু শব্দটা এত কাছে শোনা যাচ্ছে কেন? চোখ খুলতেই মনে হলো জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে কেউ। জানালার কাচে তালে তালে টোকা দিচ্ছে লম্বা একটা হাত। বিছানায় উঠে বসলাম। মশারির ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে জানালার পর্দা সরাতেই চোখাচোখি হলো এখলাসের সাথে। দরজার কড়া নেড়ে আমাকে তুলতে না পেরে সে বিল্ডিং-এর পেছন দিকে চলে এসেছে জানালার কাছে।

“এখলাস, এত সকালে তুমি?”

“সকাল কোথায়? আমি টিউশনি শেষ করে এলাম। উঠ।“

উঠে দরজা খুলতে খুলতে এখলাস চলে এসেছে - “তুমি কি আজকে বা কালকে কোথাও যাবে?”

“ক্যাম্পাসে যাবো।“

“বাড়ি-টাড়ি তো যাবে না।“

“না।“

“আমি এখনই একটু বাড়ি যাবো। পরশু আসবো। তুমি খান সাহেবকে আমার ভাড়াটা দিয়ে দেবে।“ – এখলাস একটা খাম এগিয়ে দিয়ে বললো।

“ঠিক আছে। খান সাহেব এলে দিয়ে দেবো।“

“তুমি মনে হয় শুনেছো, খান সাহেব আমার উপর রেগে আছেন।“

“কেন? কিছু হয়েছে?”

“তেমন কিছু না। আমি ফিরে এসে বলবো। আর তোমার ছোট ব্যাগটা দাও।“

এখলাস ব্যাগ নিয়ে দ্রুত চলে গেলো। খান সাহেব তার উপর কেন রেগে থাকবেন জানি না। এখলাসের উপর কেউ রাগ করতে পারে সেটাই তো অভাবনীয়। এখলাস খুব সিরিয়াস বিষয় নিয়েও হাসিঠাট্টা করতে পারে। যাদের সেন্স অব হিউমার কম – তারা অনেকসময় তাকে ভুল বুঝতে পারে। খান সাহেবের সেন্স অব হিউমার কেমন – আমি এখনো জানি না।

 

দেরি করে ঘুম থেকে উঠার অন্তত একটা সুফল আমি পাই। বাথরুম খালি পাওয়া যায়। নিচের তলায় সবাই ফজরের আজানের সাথে সাথে উঠে যায়, কিংবা উঠতে বাধ্য হয়। প্রতিদিন ভোরে জোরে জোরে দরজা ধাক্কানো এবং জোরে জোরে ডাক দিয়ে অমুক ভাই উঠেন, তমুক ভাই উঠেন বলে ঘুম ভাঙানো হয়। একেকদিন হয়তো একেকজনের দায়িত্ব থাকে সবাইকে তুলে দেয়ার। বাথরুমের সাথে লাগানো রুম হওয়াতে নামাজের সময় হলে আমার রুমের সামনের বারান্দায় ভীড় হয়ে যায়। আমার রুমের দরজাতেও ঘা দেয় অনেকে। তখন আমার ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু আবার ঘুমিয়ে পড়তে অসুবিধা হয় না।

 

আমার রুমের দরজা খুললেই  দক্ষিণের দেয়ালের সাথে লাগানো টয়লেট। এই বিল্ডিং-এর নিচের তলার ১৫-১৬ জন বাসিন্দার জন্য একমাত্র টয়লেট। টয়লেট আর বাথরুম একসাথে। আটফুট বাই পাঁচ ফুটের একটি রুমের মাঝখানে পাঁচইঞ্চি দেয়াল দিয়ে টয়লেট আর বাথরুম আলাদা করা হয়েছে। টয়লেটের দরজা একটা আছে, কিন্তু বাথরুমের দরজা নেই। কেউ টয়লেটে গেলে উন্মুক্ত বাথরুমে যেন কেউ ঢুকে না পড়ে সেজন্য পেট খালি করার সাথে সাথে ঘন ঘন সশব্দে গলা পরিষ্কার করার আবশ্যকতাও দেখা দেয়। বাথরুমে দেয়ালে লাগানো একটা পানির ট্যাপ আর শাওয়ার আছে। কেউ শাওয়ার নিলে মুক্তদ্বারেই নিতে হবে। এখানে হাত-মুখ ধোয় সবাই, কিন্তু শাওয়ার নিতে দেখা যায় না কাউকে। রাস্তার ওপাশে মসজিদের পুকুরে গিয়ে গোসল করে সবাই। আমিও ওখানেই যাই।

 

বাথরুমের ট্যাপ থেকে টিপ-টিপ করে পানি পড়ছে। খান সাহেবকে বলে পুরনো ট্যাপ বদলানোর ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু সেই ট্যাপ দুদিনেই আবার আগের মতো হয়ে গেছে। সারাক্ষণই ভেজা থাকে বাথরুমের ফ্লোর। সিমেন্টের ফ্লোরে গর্ত হয়ে গেছে অনেক জায়গায়। সেই ফ্লোর থেকে দুই ধাপ উপরে টয়লেটের কমোড। কমোডের পাশে আরেকটি ট্যাপ আছে।

প্রথম যখন এসেছিলাম – কী যে অবস্থা ছিল এই টয়লেটের। একটা ময়লা ট্যাপ-পড়া অ্যালুমিনিয়ামের বদনা ছিল। বদনা আর ট্যাপ দুটোই ছিদ্রযুক্ত। বাথরুম-টয়লেট পরিষ্কার করার কোন লোক নেই এখানে। পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে বাসিন্দাদেরও কারো কোন মাথাব্যথা দেখি না। টয়লেটের এক কোণায় অনেকগুলি ছোট ছোট মাটির ঢেলা স্তূপ হয়ে আছে। মনে হচ্ছে উঁই পোকার ঢিবি। প্রশ্রাবের তীব্র গন্ধ আসছে সেখান থেকে। কমোড থাকার পরেও কি সেখানে প্রশ্রাব করে এরা? পরে অবশ্য এখলাসের কাছে জেনেছি এই মাটির ঢেলার রহস্য। বুঝতে পেরেছিলাম টয়লেটের গন্ধ এদের কাউকেই বিচলিত করতে পারে না। কী এক জাদুবলে টয়লেটে ঢুকলে এদের অলফ্যাক্টরি নার্ভ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।

 

টয়লেটের সবচেয়ে কাছের রুমটা আমার বলেই হয়তো আমার সমস্যা বেশি। উপরের তলার বাথরুমের কী অবস্থা চেক করে দেখেছি। সেখানেও ১২-১৩ জনের জন্য একটাই টয়লেট। সেই টয়লেটের গঠন বেশ মজবুত। শক্ত কাঠের দরজা, গর্তহীন পাকা মেঝে। কিন্তু পরিচ্ছন্নতার মান তথৈবচ। কোন এক অদৃশ্য কারণে সংসারে আমাদের সবচেয়ে দরকারি যে দুটো রুম – বাথরুম আর কিচেন, সেই দুটো রুমই থাকে সবচেয়ে অপরিচ্ছন্ন। এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই।

 

আমি প্রথম সপ্তাহেই টয়লেটের জন্য হারপিক, ব্রাশ, বদনা এসব কিনে এনে ঘন্টাখানেক পরিশ্রম করে কিছুটা সহনীয় মাত্রায় নিয়ে এসেছিলাম। টয়লেটের কোণার মাটির ঢেলার স্তূপ সরানোর জন্য কেয়ারটেকার মাহমুদ মিয়ার পরামর্শ চাইলে তিনি কুদ্দুসকে পাঠিয়ে ছিলেন সেই কাজ করার জন্য। দশ-এগারো বছরের হাড়-জিরজিরে বাচ্চা ছেলে কুদ্দুস একটা ঝাঁটা নিয়ে হাজির। ঢেলার স্তূপে ঝাঁটা মারতে উদ্যত হয়ে বললো, “অম্মারেম্মা – মুইত্তেদে মুইত্তেদে, মুতি মুতি টালাই ফালাইয়ে।“ কুদ্দুসের কথায় আমি হেসে উঠি।

“এগুন এডে গাতত ফালাই দিয়ম নে বদ্দা?”

কুদ্দুসের প্রশ্ন শুনে আমি আঁৎকে উঠি। সে জিজ্ঞেস করছে সবগুলি মাটির ঢেলা কমোডের গর্তে ফেলে দেবে কি না। তার ধারণাই নেই টয়লেটের কমোডে এতগুলি মাটির ঢেলা একসাথে ঢেলে দিলে কী অবস্থা হবে। পরে কুদ্দুস বালতি নিয়ে এসে ওগুলি বাইরে ফেলে দিয়ে এসেছিল। কোথায় ফেলেছে কে জানে। এরপর পরিচ্ছন্নতার সব সরঞ্জাম টয়লেটে থাকা সত্ত্বেও খেয়াল করলাম পরিচ্ছন্নতার কাজটি আর কেউ করছে না। আবারো টয়লেটের কোণায় মাটির ঢেলা জমতে থাকে, টয়লেটের সাদা কমোড ক্রমশ হলদে হতে থাকে। এই টয়লেট আমাকেও ব্যবহার করতে হয়। ফলে একে পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্বও আমার। অন্যরা কেউ দায়িত্ব পালন করছে না বলে আমিও দায়িত্ব পালন করবো না – এই যুক্তিতে আমি বিশ্বাস করি না। কিছুদিন পরপর কুদ্দুসকে ডেকে আনি মাটির ঢেলা অপসারণ করার জন্য।

 

টয়লেটের দেয়ালের ওপাশেই আমার রুম। টয়লেট সারাক্ষণ ভেজা থাকে বলে আমার রুমের এদিকের দেয়ালটাও সারাক্ষণই স্যাঁতস্যাঁতে থাকে। আমার রুমের বইপত্রে এর মধ্যেই স্যাঁতা পড়ে গেছে। বইয়ের বাঁধাই খুলে যাচ্ছে নিরবে। এই দেয়ালটার ব্যাপারে খান সাহেবকে বলতে হবে। ভেতরের দিকে ভালো করে প্লাস্টার এবং রং করানো দরকার। কিন্তু খান সাহেব আমার কথা শুনবেন কি? ভাড়াটেদের কথা শুনলে নাকি বাড়িওয়ালাদের মান থাকে না। দেখা যাক খান সাহেবের মানের মান কী রকম।

 

বাথরুম থেকে বের হয়ে রুমে ঢুকেই দেখলাম খান সাহেব আমার রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর দৃষ্টি আমার বুকশেল্‌ফের দিকে। খান সাহেবের পরনে সবসময়েই ধবধবে পরিষ্কার জামাকাপড় থাকে। আজ পরেছেন সাদা ফুল শার্টের উপর কালো হাতকাটা সোয়েটার। সাদা চেক লুঙ্গিটাও মনে হচ্ছে যত্ন করে ইস্ত্রী করা হয়েছে।

 

‘স্লামালাইকুম’

খান সাহেব ধীরেসুস্থে আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি কমিউনিস্ট পার্টি করেন?”

খান সাহেবের গলার স্বর খুবই ফ্যাসফ্যাসে। শুনেছি আগে তিনি খুব জোরালো কন্ঠের অধিকারী ছিলেন। কয়েক বছর আগে কোন এক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় তাঁর গলার স্বর বদলে গেছে। সম্প্রতি তাঁর বাড়িতে আমার যাতাযাত শুরু হয়েছে। কিন্তু বাড়িতে তাঁর সাথে আমার কোন কথাবার্তা হয় না। আমার সম্পর্কে তিনি তেমন কিছুই জানেন না। হঠাৎ আমাকে কমিউনিস্ট পার্টি করি কি না প্রশ্ন করার কারণ কী? বুকশেল্‌ফ-এ প্রগতি প্রকাশনের সমাজতান্ত্রিক বইপত্র দেখেই কি এই প্রশ্ন? আমি চেয়ারটা তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, “আপনি বসেন।“

খান সাহেব বসলেন। আমি এখলাসের দেয়া খামটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, “এটা এখলাস দিয়েছে আপনাকে দেয়ার জন্য। তার ভাড়া।“

 

খান সাহেব খামটা নিয়ে ভেতর থেকে টাকা বের করে গুণতে শুরু করলেন। আমি আমার ভাড়ার টাকা বের করে ছোট্ট খাতাটি বের করলাম। ঘর ভাড়ার কোন রশিদ তিনি আমাকে দেন না। আমি একটা ছোট খাতা বানিয়েছি। সেখানে প্রতি মাসে তাঁকে ভাড়া দেয়ার কথাটা লিখে তাঁর দস্তখত নিই। আজ লিখলাম “১৯৮৭ সালের নভেম্বর মাসের ঘর ভাড়া বাবত ১৫০ টাকা নগদ গ্রহণ করলাম।“ তারপর টাকা আর খাতাটা তাঁর দিকে এগিয়ে দিলাম। তিনি টাকাটা পকেটে রেখে সাইন করে খাতাটা ফেরত দিলেন। আমি ভেজা দেয়ালের কথা বলার আগেই তিনি বললেন, “জানুয়ারি মাস থেকে বিদ্যুতের দাম বাড়বে। ঘরভাড়াও বাড়বে।“

“অবশ্যই বাড়বে। আপনাকেও তো চলতে হবে। তবে আমার এই দেয়ালটা দেখেন – পুরাই ভিজা। এতে কিন্তু আপনার বিল্ডিং-এরই ক্ষতি। এদিকে কি একটু প্লাস্টার আর রং করে দেবেন?”

“ঠিক আছে। আমি মিস্ত্রী নিয়ে আসবো।“

এত সহজেই তিনি রাজি হয়ে যাবেন আমি ভাবিনি। এরপর আমার আর কোন কথা নেই। তিনি বের হলেই আমি ইউনিভার্সিটিতে যাবো। কিন্তু তিনি উঠার কোন লক্ষণ দেখাচ্ছেন না।

“আপনাদের কমরেড ফরহাদ তো মারা গেছেন।“ – খান সাহেব মনে হচ্ছে ধরেই নিয়েছেন আমি সিপিবি’র সদস্য। সিপিবি’র সভাপতি কমরেড ফরহাদ মারা গেছেন অক্টোবরের নয় তারিখ। মস্কোতে গিয়েছিলেন চিকিৎসা করাতে। সেখানেই মারা গেছেন।

 

“গর্বাচেভ তো মনে হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ফেলবেন।“ – খান সাহেব নিঃসন্দেহে রাজনীতিসচেতন মানুষ। কিন্তু বুঝতে পারছি না তিনি বামপন্থী নাকি ডানপন্থী। বাংলাদেশে মিলিটারি এরশাদ যে তান্ডব চালাচ্ছে সে সম্পর্কে কিছু না বলে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করছেন খান সাহেব। এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতে ইচ্ছে করছে না আমার। ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া দরকার।  কিন্তু খান সাহেব উঠার কোন লক্ষণ দেখাচ্ছেন না।

 

“আমার কী মনে হয় জানেন? গর্বাচেভকে প্রেসিডেন্ট রিগ্যান প্রচুর টাকা-পয়সা দিয়েছে।“ – খান সাহেব খুব আস্তে আস্তে কথা বলেন। মনযোগ দিয়ে না শুনলে বোঝা যায় না তিনি কী বলছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট রিগ্যান কী করছেন তা জানতে আমার খুব একটা আগ্রহ হচ্ছে না। ভদ্রতার দায় অনেক। নিজের অসুবিধার ব্যাপারটাও এমনভাবে বলতে হয় যেন অন্যে কিছু মনে না করেন। কিন্তু আমি ওরকম ভদ্রতার ব্যাপারে এখনো দক্ষ হয়ে উঠিনি। বললাম, “আমাকে এখনই ইউনিভার্সিটিতে যেতে হবে। প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের কথা পরে শুনবো।“

 

ক্যাম্পাস বেশ থমথমে। শিবিরের রাজত্ব শুরু হবার পর থেকে ক্যাম্পাস অনেকটাই নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে। আজ আরো বেশি নিষ্প্রাণ মনে হচ্ছে। আমাদের সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস কখন শুরু হবে কেউ জানে না। আমাদের আগের ব্যাচের সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস এখনো শেষ হয়নি। আমাদের পরের ব্যাচের ক্লাস শুরু হয়েছে অনেক দিন হয়ে গেলো। ডিপার্টমেন্টে আমাদের ব্যাচের তেমন কাউকেই পেলাম না। শাহজালাল হলে গেলাম। মৃণালের রুমে গিয়ে দেখলাম সে খুব মন খারাপ করে বসে আছে। শোনা যাচ্ছে আবার অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইউনিভার্সিটির খবর হলে থাকলে বেশি পাওয়া যায়। সাথে দেশের রাজনীতির খবরও পাওয়া যায়।

 

দেশের রাজনৈতিক অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে। এরশাদের তল্পিবাহী ফ্রিডমপার্টি এবং তাদের সমমনা কয়েকটি দল ছাড়া বাকি সব বিরোধীদল এক হয়ে নভেম্বরের দশ তারিখ ঢাকা অবরোধের ডাক দিয়েছে। শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া এক সাথে বসে মিটিং করে একমত হয়েছেন ঢাকা অবরোধের ব্যাপারে। এরশাদ একটার পর একটা আইন করে এবং ধরপাকড় করে বিরোধীদের দমাতে চেষ্টা করছেন। ঘেরাও-অবরোধ বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু মনে হচ্ছে দেশের মানুষ এসব কালো আইন মানবে না।

 

হল থেকে বের হয়ে শুনলাম ক্যাম্পাসে শিবিরের তান্ডব চলছে। রাঙ্গুনীয়ায় নাকি শিবিরের কোন্‌ কর্মীর উপর হামলা হয়েছে। সেজন্য ক্যাম্পাসে সবকিছু বন্ধ করে দিয়েছে তারা একটু আগে। ক্যাম্পাসের সব বাস চলে গেছে। ট্রেনও চলে গেছে। ভয়ে রিকশা ট্যাক্সিও আসছে না এদিকে। এখন হেঁটে হেঁটে এক নম্বর গেটে যেতে হবে। এতগুলি ছেলে-মেয়েকে এভাবে কষ্ট দিতে পারার মধ্যেই তো ক্ষমতার বাহাদুরি। শিক্ষার্থীদের উপকার করলে তো ক্ষমতা দেখানো হলো না। ছাত্ররাজনীতি থেকে শুরু করে সব ধরনের রাজনীতিই তো এখন ক্ষমতা প্রদর্শন কিংবা ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা।

 

ট্রেন স্টেশনে শত শত ছাত্র-ছাত্রী উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছে ট্রেনের জন্য। কেউ বলতে পারছে না শিবিরের অবরোধ কতক্ষণ চলবে, ট্রেন আদৌ আসবে কি না। রাঙ্গুনিয়ায় যারা শিবিরের কর্মীকে মেরেছে – তাদের সাথে কি এই ক্যাম্পাসের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কোন রকমের যোগ আছে? যদি না থাকে, তাহলে এখানে এভাবে অবরোধের অর্থ কী? এই প্রশ্ন নিজেই নিজেকে করছি। শিবিরের কাউকে করলে আমার জিভ কেটে নেবে।

 

একটা শিক্ষক-বাস দেখা গেলো শহরের দিকে যাচ্ছে। প্রায় খালি বাস। রেলস্টেশনের কাছে গতি কমালে অনেকের সাথে আমিও উঠে পড়লাম। শুধুমাত্র একজন শিক্ষক আছেন বাসে। তিনি একাই একটি বাস শহরে নিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা উঠাতে তিনি ভীষণ রেগে গেলেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে শিক্ষক হয়েছেন বেশিদিন হয়নি। যিনি ক’দিন আগেও ছাত্র ছিলেন, এখন শিক্ষক হবার সাথে সাথেই এভাবে বদলে গেলেন? খালি একটা বাসে শিক্ষার্থীরা উঠাতে তাঁর নিজের তো ক্ষতি কিছু হচ্ছে না। তাহলে তিনি ক্ষেপে গেলেন কেন? তিনি ড্রাইভারকে খুব কর্কশভাবে নির্দেশ দিলেন, “অই ড্রাইভার, খবরদার। একটা স্টুডেন্টও যদি বাসে থাকে আমি যাবো না। কোন টিচার ছাড়া তো তুমি শহরে যেতে পারবে না। গাড়ি ঘুরাও। আমি যাবো না। বেয়াদব কতগুলা!” বিশ্ববিদ্যালয়ের এরকম কিছু কিছু শিক্ষক নিজেদেরকে কী কারণে রাজা-বাদশা মনে করেন, সেই প্রশ্নের উত্তর আমি এখনো পেলাম না। ড্রাইভার বাস ঘুরিয়ে আবার ক্যাম্পাসের দিকে চলে যাচ্ছে দেখে আমরা সবাই নেমে গেলাম। ঐ শিক্ষক বাস নিয়ে আবার চলে গেলেন ক্যাম্পাসে। এতে তাঁর কী লাভ হলো আমি জানি না। ছাত্রছাত্রীরা বলাবলি করছিলো, “উনি শিবিরের ক্যাডার। এখন টিচার হয়েছেন।“

 

পরের কয়েকদিনের ভেতর সারাদেশে চরম অস্থিরতা শুরু হলো। ঢাকার সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হলো। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকলেও একাডেমিক কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো। ঢাকার বাইরের মানুষ যেন ঢাকায় না যেতে পারে সেজন্য ঢাকামুখী ট্রেনও বন্ধ করে দেয়া হলো। ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হলো। কিন্তু হাজার হাজার গণতন্ত্রকামী মানুষ ১০ নভেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল করলো, ঢাকাকে অবরুদ্ধ করে ফেললো। পুলিশ সেই মিছিলে গুলি চালালো। অনেক হতাহত হলো। ১১ তারিখ সকালে পেপারের প্রথম পৃষ্ঠায় দেখলাম শহীদ নূর হোসেনের ছবি যাঁর বুকে-পিঠে লেখা আছে “স্বৈরাচার নীপাত যাক” “গণতন্ত্র মুক্তি পাক।“ গণতন্ত্র কবে মুক্তি পাবে আমরা কেউ জানি না। 



পরের পর্ব >>>>>>>>>>>>>>>>>

<<<<<<<<<<<<<< আগের পর্ব

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Terry Wogan's "The Little Book of Common Sense"

  What we call common sense in English is not very common at all. If common sense could be learned by reading books, then those who have re...

Popular Posts