Sunday 9 May 2021

ঠাকুরনামা - ১

 


আমাদের ছোটো নদী

রবিঠাকুরকে আমি ঠিক কখন থেকে চিনি তা সঠিকভাবে বলতে পারবো না। এই মানুষটি যে বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি, মনন, সঙ্গীত, এমনকি দর্শনের জগতের প্রায় পুরোটাই দখল করে আছেন তা জানতে আমার সময় লেগেছে অনেকের চেয়ে বেশি। স্কুলের একেবারে নিচের ক্লাসে আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পড়েছি –

 

“আমাদের ছোটো নদী

চলে বাঁকে বাঁকে

বৈশাখ মাসে তার

হাঁটু জল থাকে।

পার হয়ে যায় গোরু,

পার হয় গাড়ি,

দুই ধার উঁচু তার,

ঢালু তার পাড়ি।

 

চিক্ চিক্ করে বালি,

কোথা নাই কাদা,

একধারে কাশবন

ফুলে ফুলে সাদা।

কিচিমিচি করে সেথা

শালিকের ঝাঁক,

রাতে ওঠে থেকে থেকে

শেয়ালের হাঁক।“

 

এটুকুই ছিল আমাদের দ্বিতীয় শ্রেণির বাংলা বইতে – যে বইয়ের নাম ছিল ‘আমার সাথী’। আমাদের ক্লাসে বাংলা পড়াতেন মৌলভী ফররুখ আহম্মদ – আমরা বলতাম ‘ফারুক মলই’। প্রায় এক ফুট লম্বা সাদা দাড়ি ছিল তাঁর। দাড়ির জন্য আমরা বুঝতে পারতাম না তিনি হাসছেন না রেগে আছেন। ক্লাসে কবিতা পড়ানোর নিয়ম ছিল এরকম – তিনি এক লাইন বলবেন, আমরা চিৎকার করে সেই লাইন আবার বলবো। তিনি বই হাতে নিয়ে বলেন – আমাদের ছোটো নদী -, আমরা ক্লাস ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠি – আমাদের ছোটো নদী – এভাবে চলতে থাকে। পরেরদিন এই কবিতা আমাদের মুখস্থ বলতে হতো। মুখস্থ বলতে না পারলে এলোপাথাড়ি মার চলতো। মুখস্থ করার ব্যাপারে আমার ক্ষমতা খুবই কম। স্যারের বেতের বাড়ি আমার হাতে-পিঠে প্রায়ই পড়তো। এই কবিতার লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে একটা শব্দও কোনদিন বলেননি আমাদের স্যার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে ছিলেন না জেনেই মুখস্থ করতে হয়েছিল – আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে।

 

আরো পরে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি দেখলাম – মনে হলো তাঁর দাড়ির সাথে আমাদের ‘ফারুক মলই’র দাড়ির অনেক মিল আছে। আরো পরে পড়লাম পুরো কবিতাটি -

 

“আর-পারে আমবন তালবন চলে,

গাঁয়ের বামুন পাড়া তারি ছায়াতলে।

তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাইবার কালে

গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে।

 

সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে

আঁচল ছাঁকিয়া তারা ছোটো মাছ ধরে।

বালি দিয়ে মাজে থালা, ঘটিগুলি মাজে,

বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহকাজে।

 

আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর

মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর।

মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে,

ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে।

দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া,

বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।।“

 

মুখস্থ করার বাধ্যবাধকতা যখন চলে গেলো – ভয়টাও চলে গেলো। কবিতার কথাগুলি কত সুন্দর- আর কত পরিচিত তার দৃশ্যগুলি। এ যেন আমাদেরই গ্রামের ছবি,  কবি এঁকেছেন তাঁর কবিতার ছন্দে।

“আমাদের ছোটো নদী, চলে বাঁকে বাঁকে” – এ যেন আমাদেরই গ্রামের ছড়া – যেটা পুবের পাহাড় থেকে নেমে এসে আমাদের বাড়ির খুব কাছ দিয়ে চলে গেছে পশ্চিমে, কোথায় গিয়ে মিশেছে তখনো জানি না।

“বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে” – এই ছড়া পার হয়ে আমাকে স্কুলে যেতে হয়। ছড়ার উপর বাঁশের সাঁকো ধরে পার হবার সময় গা কাঁপে। হাতে ধরার জন্য একটা বাঁশ বাঁধা থাকতো – কিন্তু সেটার নাগাল পেতাম না। বর্ষাকালে ছড়ার পানিতে সাঁকো ডুবে যেতো অনেক সময়। তখন স্কুলে যাওয়া হতো না। কিন্তু শীতকালে ছড়ার পানি শুকিয়ে যেতো, কিছুদিন পরে বালিও শুকিয়ে যেতো। বৈশাখ মাসে হাঁটুজলও থাকতো না। তখন আমার কী মজা যে হতো। সেই বালির উপর দিয়ে হেঁটে স্কুলে যেতাম। শুকনো বালিতে আমরা দলবেঁধে ফুটবল খেলতাম। আমাদের ফুটবল আমরা নিজেরাই তৈরি করে নিতাম কুড়নো প্লাস্টিক আর কাগজ জড়ো করে সুতা দিয়ে বেঁধে। তখন সেই বালির উপর দিয়ে “পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,// দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।“ অবশ্য গাড়ি বলতে তখনো আমরা রিকশা আর ঠেলাগাড়িই বুঝতাম। আমাদের গ্রামে এই দুই প্রকারের গাড়ি ছাড়া তখনো আর কোনো গাড়ি যেতো না।

 

“চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা// একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।// - আমাদের বাড়ির কাছে কাশবন ছিল না। কিন্তু এই নদীর পাড়ে ছিল। কাশবন দেখার জন্য শীতকালে ছড়া বালির উপর দিয়েই হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম পূর্বদিকের পাহাড়ের দিকে। বাতাসে দুলতো সাদা কাশফুলের শত শত লম্বা হাত। সারা গায়ে মাথায় বালি মেখে আমি তাকিয়ে থাকতাম – আকাশের মেঘ আর নিচের কাশের বন যেন মিলেমিশে যেতো।

 

কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,/ রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক।// - শালিক পাখিকে আমরা খুব একটা পাত্তা দিতাম না। চিকন সুতার ফাঁদ পেতে খুব সহজেই আমরা ধরে ফেলতাম এই পাখিগুলিকে। এদেরকে খুব লোভী পাখি বলে মনে হতো। এক দুই দানা চালের লোভেই এরা ধরা পড়ে যেতো আমাদের হাতে। পাখি ধরার আনন্দেই পাখি ধরতাম। ধরে আবার ছেড়েও দিতাম। কারণ পাখি পোষার আবদার করলে সেই আবদার রাখার বদলে পিঠে কয়েক ঘা পড়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকতো। আর শেয়ালের হাঁক? শেয়াল আমাদের গ্রামে প্রচুর ছিল। প্রায়ই তারা মুরগি চুরি করে নিয়ে যেতো বলে শুনেছি। কিন্তু শেয়ালের হাঁক কখনো শুনিনি।

 

গ্রামে আম গাছ, তাল গাছের কমতি ছিল না। ব্রাহ্মণদের বাড়ির সামনের রাস্তায় তালগাছ, আমগাছের সারি। মনে হচ্ছে রবিঠাকুর যেন আমাদের গ্রামের জন্যই লিখেছেন - “আর-পারে আমবন তালবন চলে, গাঁয়ের বামুন পাড়া তারি ছায়াতলে।//

 

প্রথম বর্ষার বৃষ্টি হবার পর আস্তে আস্তে বালি ভিজে যেতো, পানি বাড়তে শুরু করলে দুপাড়ের বাড়িগুলি থেকে আমার বয়সী ছেলে-মেয়েরা এখানে নেমে যেতো – পানিতে দাপাদাপি করতে করতে। “তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাইবার কালে,/ গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে।// অবশ্য আমাদের নিজেদের গামছা খুব একটা ছিলো না। সুপারির খোল কেটে পানি তোলার মতো ব্যবস্থা আমরা নিজেরাই করে নিতাম।

“সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে/ আঁচল ছাঁকিয়া তারা ছোটো মাছ ধরে।// ছোট ছোট মাছগুলি যে কোত্থেকে আসতো আমরা কেউই জানতাম না। গায়ের গেঞ্জি খুলে সেই মাছগুলি  ধরতে চেষ্টা করতাম। আমার বন্ধু স্বপন ছিল খুব নির্দয় স্বভাবের। সে ছড়ার দুই পাশের ঘন বাঁশ থেকে কঞ্চি ভেঙে নিয়ে পিটিয়ে মাছ মেরে ফেলতো মাঝে মাঝে। শিশুরা যে কত নির্মম হতে পারে তা নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই দেখেছি। কোন ব্যাঙ যদি চোখে পড়তো কারো, সেই ব্যাঙ আর আস্ত থাকতো না। মাঝে মাঝে দেখতাম  আমাদের খোঁড়া বালির গর্তে জমা পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে কালো কালো ব্যাঙাচি। পানিতে হাত ডুবিয়ে হাতের তালুতে তুলে নিয়ে আসতাম পানিসহ ব্যাঙাচি। একটু পরেই হাতের তালু থেকে লাফিয়ে পড়ে যেতো পানিতে। অথচ এটুকুতেই মনে হতো পৃথিবী উঠে এসেছিলো হাতের মুঠোয়।

বাড়ির বউ আর বড় মেয়েদের দায়িত্ব থাকতো ছড়া থেকে পরিষ্কার পানি নিয়ে যাবার। আমাদের গ্রামে তখন টিউবওয়েল ছিল না বললেই চলে। এই ছড়ার বালি খুঁড়ে আমরা তুলে আনতাম পরিষ্কার পানি। কত কাকি-জেঠি-দিদি-দাদুকে যে বালি-খুঁড়ে পরিষ্কার পানি তুলে দিতাম। ছড়ার পানিতেই “বালি দিয়ে মাজে থালা, ঘটিগুলি মাজে,// বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহকাজে।“

 

বর্ষার ঢলে দুকুল প্লাবিত হয়ে ঘোলা পানি চলে আসে গ্রামের ভেতর। শুকনো ছড়ার তখন অন্য রূপ। “আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর/ মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর।// মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে,/ ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে।// দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া,/ বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।।“ – অবশ্য বরষা আমাদের জন্য উৎসব ছিল না কখনোই। বর্ষায় আমাদের বাড়ির ফুঁটো চাল দিয়ে বৃষ্টির পানি ঢুকে যেতো। গ্রামে পানি নিষ্কাশনের কোন পরিকল্পিত ব্যবস্থা ছিল না। বৃষ্টি হলেই গ্রামের সব পথ হয়ে উঠতো থিকথিকে কাদাময়। ভরা বর্ষায় বইখাতা প্লাস্টিকে মুড়ে ভিজতে স্কুলে যেতাম। দিনের পর দিন এত বৃষ্টি হতো – মনে হতো আমাদের ছোট নদীর পানি আর কখনোই শুকাবে না।

এখন সবকিছু কত বদলে গেছে। আমাদের ছোটনদীর উপর পাকা ব্রিজ হয়েছে। আমাদের ছড়ার বালি – এখন বিরাট ব্যবসায়িক সামগ্রি। খুব পাওয়ারফুল মেশিন দিয়ে খুব পাওয়ারফুল মানুষেরা এই বালির ব্যবসা করে। আমাদের ছোটনদীর সবকিছুই এখন বড় হয়ে গেছে – কেবল মনে হয় আমাদের  ছোট নদীর যে একটা আবেদন ছিল – সেটা খুব ছোট হয়ে গেছে। এত ছোট যে এখন তা আর খুঁজেই পাওয়া যায় না।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts