Sunday, 2 May 2021

সত্যজিৎ রায় - ১



১৯২১ সালের ২ মে সত্যজিৎ রায়ের জন্ম। আজ তাঁর জন্মশতবার্ষিকী।

কিছু কিছু মানুষ থাকেন – যাঁরা নিজেদের কাজের মধ্য দিয়ে একাই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে ওঠেন। তখন তাঁদের নামের সাথে অন্য কোন বিশেষণ যোগ করতে হয় না। আইনস্টাইন বললে যেমন আর কিছুর দরকার হয় না, চার্লি চ্যাপলিনেরও যেমন দরকার নেই আলাদা কোন পরিচয়ের, তেমনি আমাদের সত্যজিৎ রায় – একাই একটি প্রতিষ্ঠান। মানুষ যখন বড় হতে হতে সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যান, তখন স্বভাবতই তিনি একা হয়ে যান। অনেকসময় তাঁর প্রশ্রয়ে নানাধরনের স্তাবকেরা ঘিরে রাখে তাঁর চারপাশ। তখন তিনি ক্রমশ অস্বাভাবিক হয়ে পড়েন। তাঁদের চিন্তার বৈকল্যও দেখা দিতে শুরু করে একটা সময়ের পর। তিনি যখন জানেন – যে কোনো ব্যাপারে তাঁর কথাই শেষ কথা – তখন তিনি এলোমেলো বকতে শুরু করেন। আমাদের দেশের অনেক বড় বড় বুদ্ধিজীবীর ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি সেরকম ঘটতে।  কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি তাঁর বয়স যত বেড়েছে – তাঁর মস্তিষ্ক আরো পরিষ্কার হয়েছে, যুক্তি হয়েছে আরো ধারালো। কিন্তু তাঁর বিনয়ে এতটুকু ভাঁটা পড়েনি, আচরণ বদলায়নি একটুও। যতদিন পর্যন্ত তাঁর শরীর ঠিক ছিল – ততদিন তিনি সবসময় নিজে টেলিফোন রিসিভ করেছেন, নিজে দরজা খুলে অভ্যর্থনা করেছেন তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থীদের। মানুষ সত্যজিৎ রায়ের এই দিকটি আমাকে ভীষণ টানে।

           

নব্বই বছর বাঁচলে আশি বছর পর্যন্ত ছবি তৈরি করতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। তিনি নব্বই বছর বাঁচেননি, ১৯৯২ সালে মাত্র ৭০ বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসান হয়। তিনি শিল্প, সংগীত, সাহিত্য, চিত্রকলা ইত্যাদি যেসব বিষয়ে কাজ করেছেন – প্রত্যেকটি বিষয়েই সোনা ফলিয়েছেন। তাঁর কোনো সিনেমার কোথাও কোনো অতি-নাটকীয়তা নেই। তাঁর চরিত্রগুলির জন্য যে সব সংলাপ তিনি নিয়েছেন – তার কোনটাকেই মনে হয়নি অবাস্তব, কিংবা অসংলগ্ন। ভারতীয় চলচিত্রের বেশিরভাগই যেখানে মোটা দাগে চড়াসুরে অতিনাটকীয়তায় ভরপুর, সেখানে এতটা জীবনসমৃদ্ধ ছায়াছবি তিনি কীভাবে তৈরি করে গিয়েছেন একের পর এক? তিনি জানতেন চলচিত্রের বোদ্ধা দর্শক বলতে যাদের বোঝায় – তাঁদের সংখ্যা আমাদের দেশে খুব বেশি নেই। তাঁর সময়ে – যখন মোবাইল ফোন, কিংবা ইন্টারনেটের জন্মও হয়নি – বোদ্ধা দর্শকের সংখ্যা ছিল আরো কম। কীভাবে তিনি নিজেকে স্থির রেখেছিলেন হুল্লোড়ের প্রভোলন থেকে, বাণিজ্যিক ছবির প্রযোজকদের হাতছানি থেকে? তাঁর সিনেমা কি দুর্বোধ্য ছিল? তাঁর কোন সিনেমাই দুর্বোধ্য নয়। তিনি খুব ভালো করে জানতেন ফিচার ফিল্মে দুর্বোধ্যতার কোন স্থান নেই। তার সিনেমায় বাস্তব মানবিকতাই প্রাধান্য পেয়েছে বার বার।

 

সত্যজিৎ রায়ের হাত দিয়ে তৈরি হয়েছে প্রফেসর শংকু আর ফেলুদার মতো পাঠকপ্রিয় চরিত্র। এঁদের গল্প ছাড়াও তিনি আরো শতাধিক গল্প লিখেছেন। প্রত্যেকটি গল্পই স্বতন্ত্র। প্রেমের গল্প বলতে যা বোঝায় – সেরকম রোমান্টিক ভালোবাসার কোন গল্প তিনি লিখেননি। কোন উপন্যাসও লিখেননি। কারণ তাঁর প্রধান ভালোবাসা ছিল সিনেমা। উপন্যাসের প্লট মাথায় এলে তিনি সরাসরি চিত্রনাট্যই তৈরি করে ফেলেছেন। তাঁর সিনেমার ভিলেনরাও রক্তমাংসের মানুষ। দাঁত খিঁচানো ভয়ংকর অঙ্গভঙ্গি করা ভিলেন তিনি তৈরি করেননি। কিন্তু ইনার ভিলেনি, মনের ভেতরের নৃশংসতার ব্যাপারটা তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলিতে বাস্তবভাবেই আছে।

 

সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে চর্চা চলবে আরো অনেক যুগ। তাঁর সৃষ্টির বিশ্লেষণ হবে বিভিন্ন আঙ্গিকে। আমাদের বাংলাদেশে তাঁর জীবদ্দশাতে তাঁর সিনেমা দেখার অবাধ সুযোগ ছিল না। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের সিনেমা হলগুলিতে ভারতীয় বাংলা সিনেমা দেখানো হতো। কিন্তু স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের চলচিত্রকে প্রতিযোগিতাহীনভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেয়ার জন্য বাংলাদেশে ভারতীয় সিনেমা প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়। তাতে কতটুকু লাভ হয়েছে তা আজ আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি। বিশ্বমানের সিনেমার সাথে আমাদের সিনেমা কতটুকু পাল্লা দিতে পারছে, কিংবা পাশাপাশি দাঁড়াতেও পারছে কি না – তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমরা বঞ্চিত হয়েছি ভালো সিনেমা দেখার সুযোগ থেকে। এখন ইন্টারনেট ও বিশ্বায়নের যুগে আমরা বিশ্বের সব সিনেমাই এখন সহজে দেখতে পারি। কিন্তু যে মিডিয়ায় আমরা সত্যজিতের সিনেমা দেখছি – সত্যজিৎ সেধরনের ছোট পর্দার জন্য তৈরি করেননি তাঁর সিনেমাগুলি। ফলে ছোট পর্দায় তাঁর সিনেমার অনেক ডিটেল্‌স আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। সেটুকু বাদ দিয়েও যেটুকু আমাদের মননে ঢোকে – তাতেই আমরা ঋদ্ধ হই। আমরা গৌরব করে বলি – সত্যজিৎ রায় – আমাদেরই তো লোক, আমাদের ভাষাতেই তো তিনি কথা বলেন। তিনিই তো লিখেছেন আমাদের সবার জন্য –

“সে যে সুরের ভাষা, ছন্দের ভাষা,

প্রাণের ভাষা, আনন্দের ভাষা,

ভাষা এমন কথা বলে

বোঝে রে সকলে

উঁচা নিচা ছোট বড় সবাই।

মোরা সেই ভাষাতেই করি গান।

মহারাজা – তোমারে সেলাম।।“

 

মহারাজা – জন্মশতবার্ষিকীতে তোমারে সেলাম।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

R. K. Narayan's 'The Grandmother's Tale'

There are many Indian authors in English literature. Several of their books sell hundreds of thousands of copies within weeks of publication...

Popular Posts