Sunday 9 May 2021

বুদ্ধদেব গুহর হাজারিবাগের কথা

 


বুদ্ধদেব গুহ শক্তিমান লেখক। লেখায় তিনি শক্তিমান তো বটেই – আমার ধারণা তিনি আক্ষরিক অর্থেও ভীষণ শক্তিমান। যে হাতে তিনি কলম চালান, সেই হাতে তিনি বন্দুকও চালান। আবার সেই হাতে বাদ্যযন্ত্রও বাজান। তাঁর লেখা বেশ কিছু বই আগে পড়েছি। এখন পড়ছি তাঁর ভ্রমণ সমগ্র। প্রথম গল্প – হাজারিবাগের কথা। ভ্রমণ এবং শিকারের মিশ্রকাহিনি।

            হাজারিবাগে তিনি ভ্রমণ করেছেন অসংখ্যবার – পঞ্চাশের দশক থেকে নব্বই এর দশক অবধি। প্রথমবার ১৯৫৭-তে। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পেশার কারণে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে তাঁর অসংখ্য বন্ধু, পরিচিত, পেশাগত আত্মীয়স্বজন। বাঘ শিকার করেছেন তিনি গভীর রাতে জঙ্গলে গিয়ে। জঙ্গলের বর্ণনা, রুক্ষ ধুলিওঠা পথের বর্ণনা জীবন্ত হয়ে ওঠে তাঁর লেখায়। আর আছে খাবারের বর্ণনা। তিনি নিজেই বলেছেন পেটুক এবং খাদ্যরসিক বলেই তাঁর বিভিন্ন জায়গার খাদ্যের স্বাদও পুরোপুরি মনে আছে।

            তাঁর সেন্স অব হিউমার – বাংলায় যাকে রসবোধ বলা যায় – অত্যন্ত উঁচুমানের। নেকড়ে শিকারের জন্য তিনি হাজারিবাগে গিয়েছিলেন। তাঁর শিকারের বন্ধু নাজিম সাহেব তখন একটি গাড়ি কিনেছেন। ৪২ মডেলের গাড়ি। “৩২ মডেলের ড্রাইভারের পরনে একটি ৩২ মডেলের পায়জামা ছিল। সেইটি এই দীর্ঘদিনের ব্যবহারে আন্ডারওয়ারে পরিণত হয়েছিল।“ সেই গাড়ির বর্ণনা দিচ্ছেন তিনি এভাবে – “আমরা দেখলাম, শীতে রাতের অন্ধকারে একটি অদ্ভুত দর্শন, প্রাগৈতিহাসিক জন্তু দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে দিয়ে ধক্‌-ধক্‌-ধক্‌-ধক্‌ করে আওয়াজ আসছে আর পেছনের সাইলেন্সার পাইপের মধ্যে দিয়ে দুর্বাসা মুনির চোখের আগুনের মতো আগুনের হলকা বেরোচ্ছে।“

            “গাড়ি গিয়ারে দিতেই মনে হল গাড়িতে ভূমিকম্প উপস্থিত হল, আর গাড়ি পথে উঠতেই বিনা পয়সায় বেঠোফেনিক অর্কেস্ট্রা শুনতে পেলাম। গাড়ি সামান্য গতি পেতেই দেখলাম সামনের হেড লাইট দুটি ডিক ডিক শব্দ করে একবার ডাইনে একবার বাঁয়ে যেতে লাগল।“

            “পিছনের সিটে বসার সঙ্গে সঙ্গে আমার পেছনে কে যেন কামড়ে ধরল এবং ওঠবার সঙ্গে সঙ্গেই আমার সাধের ব্যারেথিয়ার ট্রাউজারের এক  গিরে কাপড় পেছনের সিটেই আটকে রইল এবং পেছন দিয়ে হু হু করে হাজারিবাগি ডিসেম্বরের হাওয়া ঢুকতে লাগল।“

            সেই গাড়িতে নেংটি ইঁদুর ছোটাছুটি করছিল। এক পর্যায়ে গাড়িটি রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ে যায় নদীর বালিময় বুকের উপর। গাড়ি ছত্রখান হয়ে সবাই ছিটকে পড়ে। পরে দুর্ঘটনার কারণ জানা গেল – “একটা নেংটি ইঁদুর ড্রাইভারের আধছেঁড়া আন্ডারওয়ারের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল।“

            বুদ্ধদেব গুহ মুক্তচিন্তার মানুষ। পথে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে তিনি বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকমের মন্দির দেখেছেন। কিন্তু তাঁর দেবতা মন্দিরে থাকেন না। তিনি লিখছেন, “আমার ঈশ্বর কোনদিনই কোনো মন্দিরের মধ্যে অবস্থান করেননি। আমার ঈশ্বর ছিলেন পথে। সে জন্য তীর্থস্থানের পথই আমাকে চিরদিন আকৃষ্ট করেছে।“

            হাজারিবাগ পালামৌ – এসব জায়গার প্রকৃতি দেখতে যেতে হবে যদি কোনদিন সুযোগ হয়। এই পালামৌ-তে সত্যজিৎ রায় ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ আর ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র শুটিং করেছিলেন। এর পরোক্ষভাবে ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব গুহ।

            ভালো লাগলো তাঁর ভ্রমণ-শিকার কাহিনি। 

No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts