Friday 2 October 2020

ছিন্নপাতার সাজাই তরণী - পর্ব ৫০

 50

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম স্থপতি পল ডিরাক ঠিক কথাই বলেছেন – কবিতার কাজ হলো সহজ জিনিসকে জটিল ভাবে প্রকাশ করা, আর বিজ্ঞানের কাজ হলো জটিল জিনিসকে সহজ করা। পঠিত বিজ্ঞানের কিছু কিছু ব্যাপার আমি চেষ্টা করলে বুঝতে পারি, কিন্তু কবিতার মতিগতি আমি ঠিক বুঝি না। সে আমার কাছে চিররহস্যময়ী। পদে পংক্তিতে সে যতটুকু ভাব ব্যক্ত করে, অব্যক্ত রেখে দেয় তার চেয়ে বেশি। এই অব্যক্ত ভাব যে যত বেশি বুঝতে পারে, সে তত বেশি কবিতাপ্রেমিক। কবিতার সাথে প্রেম আমার সে কারণেই জমছে না। আমার কয়েকজন কবিতাপ্রেমিক বন্ধু আমাকে এ ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছে। আমি নাকি কবিতাকে বুঝতে গিয়ে কবিতার ব্যবচ্ছেদ করে ফেলি। অধরা কবিতাকে নাকি না ধরেই বুঝতে হয়। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতাটির কথা ধরা যাক। আমার মনে হয়েছে এটা একটি পারিবারিক কবিতা। যেখানে পরিবারের কর্তা দূরদেশে চাকরি করেন। পূজার ছুটি শেষে এক দুপুরে ফিরে যাচ্ছেন কর্মক্ষেত্রে। কবিতাটি শুরু হচ্ছে এভাবে: “দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি; বেলা দ্বিপ্রহর; হেমন্তের রৌদ্র ক্রমে হতেছে প্রখর।“ গৃহিনী ঘট পট হাঁড়ি সরা ভান্ড বোতল বিছানা বাক্স – রাজ্যের বোঝাই দিচ্ছেন সাথে:

“সোনামুগ সরু চাল সুপারি ও পান;

ও হাঁড়িতে ঢাকা আছে দুই-চারিখান

গুড়ের পাটালি; কিছু ঝুনা নারিকেল;

দুই ভান্ড ভালো রাই-সরিষার তেল;

আমসত্ত্ব আমচুর; সের দুই দুধ-

এই-সব শিশি কৌটা ওষুধবিষুধ।

মিষ্টান্ন রহিল কিছু হাঁড়ির ভিতরে,

মাথা খাও, ভুলিয়ো না, খেয়ো মনে করে।“

এতো লটবহর নিয়ে কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাবার সময় কর্তার চার বছর বয়সী আদরের কন্যা বলে, “যেতে আমি দিব না তোমায়।“ - সেখান থেকেই পারিবারিক কবিতা হঠাৎ হয়ে ওঠে দর্শনের আধার। কবিতার ছত্রে ছত্রে ব্যক্ত হতে থাকে বিশ্বব্রহ্মান্ডব্যাপী যেতে নাহি দিতে চাওয়ার আকাঙ্খা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কবিতাটি লিখেছিলেন ১৮৯২ সালে। তারপর এই শতাধিক বছর ধরে যে কোন বিদায় অনুষ্ঠানেই এই কবিতার মাঝখান থেকে কয়েকটি নির্দিষ্ট লাইন উচ্চারিত হয়। আজও হচ্ছে। ফারাহ শারমিন গলায় বেশ আবেগ ঢেলে আবৃত্তি করছে:

“এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত্য ছেয়ে,

সবচেয়ে পুরাতন কথা, সবচেয়ে

গভীর ক্রন্দন ‘যেতে নাহি দিব’। হায়,

তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।“

 

ফারাহ’র বাচনভঙ্গি বেশ সুন্দর। চমৎকার আবৃত্তি করছে সে। অবশ্য এখানে আবৃত্তি ঠিক নয়। ১৯৯৮ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করছে সে। এবার এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে ১৬ এপ্রিল থেকে। প্রতিবছর এসএসসি পরীক্ষার কয়েকদিন আগে পরীক্ষার্থীদের আনুষ্ঠানিক বিদায় দেয়া হয়। ক্লাস টেনের শিক্ষার্থীদের উপর থাকে আয়োজনের ভার। এই আয়োজনের জন্য মনে হয় তারা প্রস্তুত হতে থাকে অনেকদিন আগে থেকে। ক্লাস টেনের সব মেয়ে আজ সাজগোজ করে শাড়ি পরে এসেছে, ছেলেরা পরেছে লম্বা পাঞ্জাবী। বিদায়ের গাম্ভীর্যের চেয়েও আনন্দের উৎসব উৎসব মেজাজ সবার। অবশ্য পরীক্ষার্থীরা দেখলাম সবাই মন খারাপ করে বসে আছে। পুরনো বিল্ডিং-এর বারান্দায় বিদায়ী মঞ্চ। তার একপাশে কয়েক সারি চেয়ারে বসেছি আমরা শিক্ষকরা। বিদায়ী শিক্ষার্থীরা বসে আছে তার পরে সারি সারি বেঞ্চে। চৌকোণা চত্বরে বেঞ্চের উপর বসেছে ক্লাস নাইন আর টেনের শিক্ষার্থীরা। অন্যান্য ক্লাস আজ ছুটি। কলেজের ছেলে-মেয়েরা এই অনুষ্ঠানে আসতে আগ্রহী হয় না।

 

এবার যে ব্যাচটা বিদায় নিচ্ছে - এই প্রতিষ্ঠানের স্কুল সেকশানে তারা আমার প্রথম ব্যাচ। ক্লাস সেভেনে আমি তাদের ক্লাসটিচার ছিলাম। শিক্ষক আর শিক্ষার্থীর মধ্যে যে টান – সে টান যে কত গভীর তা বোঝা যায় বিদায়ের সময়। আমি ঘাড় ফিরিয়ে তাদের দিকে তাকালাম। তারা সবাই স্কুল ড্রেস পরে পরিপাটি গম্ভীর হয়ে বসে আছে। রেহনুমা - কাবুলিওয়ালার মিনির মতো যে ‘একদন্ড কথা না কহিয়া থাকিতে পারে না’ – সেও আজ চুপচাপ গম্ভীর। ফেরদৌসী – যে কথায় কথায় হাসে – তার মুখে আজ হাসি নেই। সুলতানা ইয়াসমিন, কানিজ নাইমা, পার্সা লোহানী, সুব্রত, করিম মোহাম্মদ, আবদুল আলীম, হুমায়ূন কবির, ওমর হাম্মাদ আলী, সরফরাজ, আবদুল্লাহ আল মামুন, সবাইকে দেখতে পাচ্ছি। এসএসসি পরীক্ষার পরেই সবাই কলেজে উঠে যাবে। ভাবতেই পারছি না এই ছেলে-মেয়েগুলি বড় হয়ে যাচ্ছে। বিদায় অনুষ্ঠানে শিক্ষকরা উপদেশমূলক বক্তৃতা দেন। যথারীতি রিফাৎ আরা ম্যাডাম বললেন, তৃপ্তি ম্যাডাম বললেন। ছাত্রদের মধ্যে সুব্রত বললো। সে এমনিতেই গম্ভীর থাকে, আজ আরো গম্ভীর মনে হচ্ছে। কিঞ্চিৎ গোঁফের রেখা উঁকি দিচ্ছে তার মুখে। তার স্মৃতিচারণে বিষাদের সুর। এদের মধ্যে অনেকে দশ বছর ধরে পড়াশোনা করছে এই প্রতিষ্ঠানে। বিদায়কালে তাদের অনেক বেশি খারাপ লাগছে বুঝতে পারছি। শিক্ষকদেরও তো খারাপ লাগছে। কলেজের শিক্ষার্থীদের বিদায় দিতে এত খারাপ লাগে না। একাদশ-দ্বাদশ দুই বছর বলা হলেও বড় জোর ১৩-১৪ মাস সময় পাওয়া যায় কলেজে। কর্তব্য করতে করতেই সময় চলে যায়। কিন্তু স্কুলের ক্ষেত্রে শেঁকড়টা অনেক বেশি গভীর। আমি এদের দেখেছি মাত্র চার বছর। আর যারা এদেরকে ক্লাস ওয়ান থেকে এপর্যন্ত আদরে স্নেহে শাসনে ভালোবাসায় ঘিরে রেখেছেন তাদের কেমন লাগছে? হয়তো এখানেই কবিতার দর্শন কাজ করে:

“ব্যথিত হৃদয় হতে বহু ভয়ে লাজে

মর্মের প্রার্থনা শুধু ব্যক্ত করা সাজে

এ জগতে। শুধু বলে রাখা, ‘যেতে দিতে

ইচ্ছা নাহি’। হেন কথা কে পারে বলিতে

‘যেতে নাহি দিব’।“

>>>>>>>> 

 

কলেজের পুরনো বিল্ডিং-এ এসএসসি পরীক্ষার সেন্টার। এপ্রিলের ১৬ তারিখ থেকে পরীক্ষা শুরু হয়েছে। কিন্তু পরের দিনই খবর পাওয়া গেল চট্টগ্রামে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। আমাদের শিক্ষার্থীদের কারোরই ফাঁস হওয়া প্রশ্ন নিয়ে পরীক্ষা দেয়ার দরকার নেই। কিন্তু শোনা যাচ্ছে কোন কোন পত্রিকা নাকি সেই ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ছাপিয়ে দিয়েছে। ১৯ তারিখ চট্টগ্রামের দৈনিক কর্ণফুলি ও কুমিল্লার দৈনিক কুমিল্লা বার্তার তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে পত্রিকায় প্রশ্ন প্রকাশ করার অপরাধে। সরকার প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পাঁচ লাখ টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করেছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়ার চক্রান্তে লিপ্ত আছে অনেকেই। প্রশ্নফাঁস করে চলেছে সেই চক্র। মুষ্টিমেয় কয়েকজন এই চক্রে পড়লেও বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই পড়াশোনা করে সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা দিচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন ফাঁসের মানসিক চাপ তো থেকেই যায়।

 

বোর্ড থেকে ঘোষণা করা হয়েছে প্রথম দুইটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে সেজন্য সেই দুটি পরীক্ষা আবার দিতে হবে। পরীক্ষার্থীরা কেউই আবার পরীক্ষা দিতে রাজি নয়। কেন দেবে আবার পরীক্ষা? তারা তো প্রশ্ন দেখেওনি। তত্ত্বীয় পরীক্ষা শেষ হবার পর আবার পরীক্ষা নেবার বিরুদ্ধে আন্দোলনে যেতে হলো এসএসসি পরীক্ষার্থীদের। শেষপর্যন্ত বোর্ড আবার পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করলো। আমাদের এসএসসি পরীক্ষার্থীরা তত্ত্বীয় পরীক্ষা শেষে পিকনিকের আয়োজন করে ফেললো।

 

শাহীন কলেজ থেকে শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এই প্রথম কোন পিকনিকে গেলাম। মুহুরি প্রজেক্টে। এদের আয়োজন দেখে মনে হচ্ছে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েই এরা সবাই বেশ করিৎকর্মা হয়ে উঠেছে। শিক্ষার্থীদের আয়োজনে যেসব পিকনিক হয়, সেখানে তারা যখন শিক্ষকদের নিয়ে যায় – তখন শিক্ষকদের অবস্থা হয় ছোটখাট রাজা-বাদশার মতো। আপ্যায়নের ত্রুটি নেই। নিখুঁত আয়োজন তাদের।

 

চট্টগ্রাম থেকে মুহুরি প্রজেক্টের দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটারের মতো। আড়াই ঘন্টার মতো লাগলো বাসে যেতে। আনন্দ-কোলাহল নাচ-গানের মধ্যে সময় কোন দিক দিয়ে চলে গেলো বোঝাই গেল না। সুব্রত আর মৌসুমী যে এত ভালো নাচতে পারে তা না দেখলে জানতেই পারতাম না।

মুহুরি প্রজেক্ট রোডের দুপাশে যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। ফেনী নদীকে শাসন করে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করে চমৎকার সেচ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে। সরকারি রেস্ট হাউজ আছে একটি। সেখানেই আমরা নামলাম। নদীর পাড়ে সবুজ ঘাস আর বড় বড় গাছের ফাঁকে চমৎকার জায়গা। এখানেই পিকনিক স্পট। পাশেই নদী। ভ্রমনের জন্য নৌকা উপস্থিত সেখানে। স্যার-ম্যাডামরা অনেকেই হৈচৈ করতে করতে নৌকা-ভ্রমণে চলে গেলেন। রিফাৎ আরা ম্যাডাম ফেনীর কন্যা। তাঁর শৈশবের অনেক স্মৃতি হয়তো আছে এই নদী ঘিরে। এরকম খোলামেলা প্রাকৃতিক পরিবেশে এলে তাজা অক্সিজেন পেয়ে সবার মনই ভালো হয়ে যায়। ভীষণ ভালো কাটলো একটা দিন।

 

গাছের নিচে খোলা জায়গায় বসে লাঞ্চ। অনেক গান, অনেক মজা। আমাদের ছেলে-মেয়েগুলিকে এতদিন স্কুল-ইউনিফর্মে দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম। যে কোন ইউনিফর্মই একটা অদৃশ্য ফর্মাল দূরত্ব তৈরি করে রাখে। আজ সবাইকে নানা রকমের পোশাকে দেখে একেবারে নিজের বাড়ির ছেলে-মেয়ে বলে মনে হচ্ছে। সবার ভেতর আনন্দ।

 

কিন্তু আনন্দযজ্ঞ থামিয়ে দিতে হলো মাঝপথে। রাস্তায় প্রথমে একটা মোটরসাইকেল দেখা গেল তিনজন যুবককে নিয়ে চক্কর দিচ্ছে। একটু পরে আরো দুটি মোটরসাইকেলে আরো কিছু যুবককে দেখা গেলো। তাদের দৃষ্টি ভালো নয়। যে কোন উন্নয়নের জমিতেই প্রচুর আগাছা জন্মায়। এই আগাছাগুলিকে সময়মতো নিয়মিত উপড়ে ফেলতে হয়। নইলে উন্নয়ন চাপা পড়ে আগাছার নিচে। এই মোটরসাইকেল আরোহীদের সম্পর্কে অনেক খবর প্রকাশিত হচ্ছে ইদানীং যেগুলি মোটেও ভালো খবর নয়। এই আগাছাগুলিকে যারা পরিষ্কার করতে পারে, তারা করে না। রাজনৈতিক প্রশ্রয় পেয়ে এরা মানুষকে উত্যক্ত করে। এখন মোটর সাইকেলের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে।

 

দ্রুত সব গুটিয়ে আমাদের ছেলে-মেয়েদের যথাসম্ভব কিছু বুঝতে না দিয়েই তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হবে বলে বাসে ওঠানো হলো। তারা মন খারাপ করে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাসে উঠলো। আমাদের বাস ছাড়ার পর দেখা গেল অনেকগুলি মোটরসাইকেল আমাদের বাসকে তাড়া করছে। মোটরসাইকেল আরোহীরা আমাদের মেয়েদের উদ্দেশ্যে কিছু কথাবার্তাও ছুঁড়ে দিচ্ছিল বলে মনে হলো। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আমাদের তরুণদের মনোজগত তো অনেক ভালো হবার কথা। সেই ভালোদের চেয়ে এই মোটরসাইকেলওয়ালাদের দাপট এত বেশি কেন?

 

হঠাৎ আমাদের কাশেম স্যার রেগে উঠলেন, “অ্যাই, হাত দেখাচ্ছো কেন তাদের দিকে?” কাশেম স্যারকে এভাবে রেগে উঠতে আগে দেখিনি কখনো। কে কার দিকে হাত দেখাচ্ছে বুঝতে পারলাম না। কীভাবে যেন কাশেম স্যারের ধারণা হয়েছে আমাদের মেয়েদের কেউ সেই ছেলেদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়েছে। আমরা তো শুধু এটুকুই পারি। আমাদের ঘরের মেয়েদের উপর রেগে যেতে পারি। বাইরের অনাচার বন্ধ করতে পারি না। তাই নিজের মেয়েদের ধমক দিয়ে ঘরের ভেতর আটকে রাখতে চাই। আমাদের রেগে যাওয়া আসলে আমাদের অসহায়তারই পরিচয়।

>>>>>>>>>> 

 

শাহীন কলেজে পদত্যাগের হিড়িক পড়েছে। পরপর তিন জনের পদত্যাগের খবর পেলাম। সংযুক্তা ম্যাডাম পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। শাহীনের সাথে তাঁর অনেক বছরের সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে জুনের শুরুতে। আইভী ম্যাডামও চলে যাচ্ছেন জুনের শুরুতে। তিনিও শাহীনে এসেছিলেন আমার আগে। ইংরেজির ওয়াহিদা হাসনাত ম্যাডামও পদত্যাগ করেছেন। সবাই নিয়ম অনুযায়ী দু’মাস আগে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। আমিও যাচ্ছি। কিন্তু দু’মাস আগে পদত্যাগপত্র জমা দিতে পারিনি। কারণ আমার অস্ট্রেলিয়ান ভিসা কনফার্ম হবার আগে রিজাইন করি কীভাবে?

 

স্কলারশিপের চিঠি পাওয়ার পর অনেককিছু করতে হয়েছে। স্কলারশিপ একসেপ্ট করে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে ইমেইল পাঠানো, ফার্স্ট সেমিস্টারের বদলে সেকেন্ড সেমিস্টারে যাওয়ার জন্য আবেদন করা, অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনে গিয়ে ভিসার দরখাস্ত জমা দেয়া, মেডিকেল টেস্ট, ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির কনফার্মেশান লেটার – সবকিছু ঠিক হতে জুনের প্রথম সপ্তাহ চলে গেলো। ইতোমধ্যে আরো একটি ঘটনা ঘটেছে। আমি ইন্ডিয়ান গর্ভমেন্টের একটা স্কলারশিপ পেয়েছি পিএইচডি করার জন্য। এর আগেও একবার ইন্ডিয়ান স্কলারশিপ পেয়েছিলাম। কিন্তু তখন সিলেক্টেড হবার পরেও নানারকম তদবির করতে হতো। আমি করিনি। তাই ফাইনালি হয়নি আমার। এবার সরকার বদলের পর শুনেছি স্কলারশিপ প্রক্রিয়া অনেক স্বচ্ছ হয়েছে।

 

পদত্যাগপত্র লিখে জমা দেয়ার আগে অ্যাকাউন্ট্যান্ট কাদের সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমি কত বেতন পাই কাদের ভাই?”

“সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার এক শ টাকা। কেন স্যার?”

“রিজাইন করলে দুই মাসের বেতনের চেক দিতে হয় না? চেক কার নামে লিখবো?”

কাদের ভাই অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় যাচ্ছেন স্যার?”

“অস্ট্রেলিয়া।“

 

প্রিন্সিপাল স্যার ছুটিতে। ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডামের হাতে দিলাম পদত্যাগপত্র ও দশ হাজার দুই শ টাকার চেক। ম্যাডাম কিছুক্ষণ কোন কথা বললেন না। ওটা বাড়িয়ে দিলেন পাশের টেবিলে নাসির স্যারের দিকে। নাসির স্যার একটু দেখেই বললেন, “কোথায় যাচ্ছো?”

“স্যার, অস্ট্রেলিয়া। একটা স্কলারশিপ পেয়েছি।“

নাসির স্যার উঠে দাঁড়িয়ে আমার সাথে কোলাকুলি করলেন।

“আমি খুব খুশি হয়েছি প্রদীপ। কনগ্র্যাচুলেশানস।“

 

খবর প্রচারিত হতে সময় লাগলো না। সহকর্মীদের সবাই জেনে গেলেন। আমার ডেস্ক পরিষ্কারের কাজ শুরু হয়ে গেল। প্রথম মেয়াদী পরীক্ষা হয়ে গেছে। ক্লাস টেনের ফিজিক্স খাতা কেটে রেজাল্ট জমা দিয়ে দিয়েছি ক্লাস টিচারের কাছে। ক্লাস ফাইভের খাতাও কেটে রেজাল্ট জমা দিয়ে দিয়েছি। কলেজের সেকেন্ড ইয়ার এখন নেই। এইচএসসি পরীক্ষা সামনে। ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষার প্রশ্নও তৈরি করে দিয়েছি। মহিউদ্দিন স্যারের মেয়ে পড়ে ফার্স্ট ইয়ারে। বইপত্র নোট যা ছিল সবই তাকে দিয়ে দিলাম যদি তার কোন কাজে লাগে।

 

জুনের ২০ তারিখ এসে গেল। শনিবার। ক্লাস এইট পর্যন্ত ছুটি। ক্লাস টেনের ক্লাস ছিল। ক্লাস শেষ করার পর বললাম, “কাল থেকে আমি আর আসবো না। তোমরা সবাই ভালো থেকো।“ মনে হলো তারা ঠিক বুঝতে পারলো না আমি কী বললাম। আমি ক্লাস থেকে বের হয়ে ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসে চলে গেলাম। তাদেরকেও ক্লাস শেষ করে জানালাম – চলে যাচ্ছি।

 

এগারোটায় ছুটি হয়ে গেল। কলেজের ছেলেমেয়েরা এসে ভীড় করলো আমার জানালার কাছে বারান্দায়। আদনান, রুবায়েত, সায়মা, মুশতারি সবাই। আমি কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। শুধু বললাম, “আবার দেখা হবে কোথাও না কোথাও। তোমরা অনেক বড় হবে জীবনে।“

 

তিন তলায় বড় ক্লাসরুমে বসেছেন সব শিক্ষক। আইভী ম্যাডাম এসেছেন আজ। লাইলুন নাহার ম্যাডাম অবসরে যাচ্ছেন। তাঁকেও বিদায় জানানো হবে আজ। সংযুক্তা ম্যাডাম আর ওয়াহিদা ম্যাডামকেও আজ আনুষ্ঠানিক বিদায় জানানোর কথা ছিল। কিন্তু তাঁরা আসেননি। সবার সাথে বেঞ্চেই বসতে স্বাচ্ছন্দ্য আমার। কিন্তু আজ সবার সামনে ডায়াসে বসতে হলো প্রিন্সিপাল স্যার, আইভী ম্যাডাম আর লাইলুন্নাহার ম্যাডামের সাথে। বিদায় অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে হয়। শিক্ষকদের সামনে আমি এপর্যন্ত কোনদিন ফর্মাল কিছু বলিনি। আজ যাবার সময় বলতে হলো। আসলে কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। সাঈদ স্যার প্রায়ই বলেন, তুমি যত বেশি কষ্ট দেবে, ততবেশি মনে রাখবে তোমাকে। এখন আমি যদি বলি আপনারা আমাকে মনে রাখবেন, তাহলে তো বুঝতে হবে আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি। তার চেয়ে ভুলে যেতে বলাই ভালো।

 

শিক্ষকরা চাঁদা দিয়ে উপহারসামগ্রী কিনে এনেছেন। ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডাম নিজের হাতে প্যাকেট খুলে পরিয়ে দিলেন টাইটান ঘড়ি। আনুষ্ঠানিকতার পরে অনানুষ্ঠানিকভাবে স্যার-ম্যাডামরা যখন একে একে এসে বিদায় জানাচ্ছিলেন, ভেতরে এক ধরনের যন্ত্রণা হচ্ছিলো, শেকড় ছেঁড়ার যন্ত্রণা।

 

টিচার্স রুমে এসে দেখি রুবায়েৎ আর ফারাহ দাঁড়িয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে বাসায় গিয়ে আবার এসেছে।

“স্যার এগুলি আপনার জন্য।“ – একটা সুন্দর র‍্যাপিং পেপারে মোড়ানো প্যাকেট এগিয়ে দিলো ফারাহ। তার চোখ ভেজা।

“তুমি কাঁদছো কেন?”

“জানি না স্যার।“

“স্যার এটা আমার ইমেইল অ্যাড্রেস। প্লিজ ইমেইল মি হোয়েন ইউ রিচ দেয়ার।“ রুবায়েত চমৎকার ইংরেজি বলে। সে তার বোনের মতো কাঁদছে না, তবে বেশ বিষন্ন মনে হচ্ছে।

একটু পরে দেখা গেলো অঞ্জন স্যার আর একজন ভদ্রলোক এগিয়ে আসছেন আমাদের দিকে। তাদের পেছনে ক্লাস সিক্সের ক্রিস্টিন। রুবায়েত আর ফারাহ চলে গেলো।

 

“প্রদীপ, দেখো তোমার সাথে দেখা করতে এসেছেন অধিকারী স্যার। পর্ণার বাবা।“

 

 ক্রিস্টিনের ডাক নাম পর্ণা।  আজ তাদের ছুটি। কিন্তু কীভাবে খবর পেয়েছে কে জানে। তার বাবার সাথে আমার আগে কখনো পরিচয় হয়নি। এয়ারফোর্স অফিসার, অথচ মনে হচ্ছে একটুও অহংকার নেই। কিছুক্ষণ কথাবার্তা হলো।

“অস্ট্রেলিয়ার কোথায় যাচ্ছেন?”

“মেলবোর্নে।“

“মেলবোর্ন খুব সুন্দর শহর। আমি গিয়েছিলাম কয়েক বছর আগে। খুব ভালো লেগেছে আমার।“

ক্রিস্টিন একটা কথাও বলছে না। ভীষণ ট্যালেন্ট এই মেয়েটি ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। এই ছুটির দিনে তার বাবাকে টেনে নিয়ে এসেছে আমাকে বিদায় জানাতে।

 

অফিসে গিয়ে আয়া-পিয়ন আর অফিস স্টাফদের সাথে শেষ বারের মতো দেখা করে এলাম।

 

সময় শেষ হয়ে গেল। শাহীন কলেজে আমার চার বছর সাত মাস ছয় দিনের জমানো স্মৃতি নিয়ে বের হয়ে গেলাম কলেজ কম্পাউন্ড থেকে।

 

শাহীন কলেজ আমার জীবনের প্রথম কর্মক্ষেত্র। এই প্রতিষ্ঠানই আমাকে দিয়েছে আমার যোগ্যতার প্রথম স্বীকৃতি। এখানে আমার সহকর্মীদের কাছ থেকে পেয়েছি আদর স্নেহ। এই প্রতিষ্ঠানেই আমি অর্জন করেছি শত শত শিক্ষার্থীর ভালোবাসা। এই অফুরান ভালোবাসার ঋণ শোধ করার সাধ্য আমার নেই।

 

 

শেষ

4 comments:

  1. তুমি এরকম দুঃখ দিয়ে কেন কাহিনিটা শেষ করলে! তোমার প্রত্যেকটা পর্বের শুরু এবং শেষটা খুব ভালো লেগেছে আমার। তোমার এখানের পিকনিক কাহিনির শেষ প্যারার কথাগুলো আমার দারুণ লেগেছে। সেখানে খুব সরল উক্তিতে আমার মনের একটা প্রশ্নের উত্তর তুমি দিয়েছে। তোমাকে এত সুন্দর একটা গল্প লেখার জন্য ধন্যবাদ। তুমি সবসময় ভালো থেকো, নিজের যত্ন নিও।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ সবগুলি পর্ব পড়ার জন্য।

      Delete
  2. স্যার আমি এইমাত্র শেষ করলাম। সামনে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু হলে আশাকরি আপনার সাথে নিয়মিত কথা হবে মেইলের মাধ্যমে। আপনি সামনের বইমেলায় বাংলাদেশে এলে অবশ্যি আমরা দেখা করবো। জীবন সুন্দর হোক।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ এবং শুভকামনা রইলো।

      Delete

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts