Tuesday 29 September 2020

ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী - পর্ব ৪৯

 49

“দাদা, এটা কোন্‌ জায়গা?”

বাসের মাঝখানের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে জানালার দিকে একটু ঝুঁকে বাইরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন শংকর স্যার। আমি যথাসম্ভব সিরিয়াসভঙ্গিতে বললাম, “হু কুইন্‌’স হ্যাট।”

“কী?” – শংকর স্যার অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে।

“এই জায়গার নাম হু কুইন’স হ্যাট” – একটুও না হেসে আমি আবার বললাম।

পাশাপাশি ডানদিকের সারিতে বসেছেন ইন্তেখাব স্যার। তিনি সিরিয়াস ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। তাঁকে ঠাট্টা-তামাশা খুব একটা করতে দেখিনি কখনো। তিনি স্মিত হেসে বললেন, “শংকরদা, এই জায়গার নাম কেরানির হাট। প্রদীপদা ঠাট্টা করছেন আপনার সাথে।“

“আমিও তো তাই বলছি। হু কুইন্‌স হ্যাট। যদিও হাট বলা উচিত ছিল।“ – আমি নিরুত্তাপ গলায় বললাম।

কয়েক সেকেন্ড লাগলো ক্লিক করতে। তারপর হাহা করে হেসে উঠলেন দু’জনেই। আমরা বসেছি বাসের পেছনের দিকে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রোডের একটা বড় বাস ভাড়া করা হয়েছে আমাদের পিকনিকের জন্য। আমরা পিকনিকে যাচ্ছি অবশেষে। ডিসেম্বরের শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ওরফে শান্তিবাহিনীর সাথে সরকারের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। শান্তিবাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করেছে। জামায়াত-বিএনপি এই চুক্তির বিরুদ্ধে সারাদেশে হরতাল বোমাবাজি জ্বালাও-পোড়াও করেছে অনেক। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের সঙ্গে পুলিশ বিডিআর-এর সংঘর্ষে অনেক হতাহত হয়েছে। এই অবস্থায় বান্দরবানে পিকনিক করতে যাওয়া রিস্কি হতে পারে বলে যাওয়া উচিত কি অনুচিত দোলাচলে ছিলেন অনেকেই। কিন্তু জানুয়ারির শুরুতেই রমজান শুরু হচ্ছে। ঈদের পর কলেজ খুললে পিকনিক করার সময় থাকবে না আর। তাই ডিসেম্বরের শেষের এই শনিবার সকালে আমরা চলেছি। কেরানির হাট থেকে বাম দিকে মোড় নিয়ে বান্দরবান সড়কের মোড়ে থেমেছে আমাদের বাস। সাঈদ স্যার, অঞ্জন স্যার আর ছোলাইমান স্যার বাস থেকে নেমে পাশের দোকানের দিকে গেছেন। কিছু কিনবেন হয়তো।

আমাদের হাসির শব্দ শুনে সামনের দিক থেকে এগিয়ে এলো ইভা।

“অ্যাই প্রদীপ, কী নিয়ে এত হাসাহাসি হচ্ছে?”

“না, একটু ইংরেজি অনুবাদের চেষ্টা করছিলাম।“

“লাইক হোয়াট?”

“মাই মাদার মাদার হু কুইন ওয়ার্ক ডাজ।“

“মানে কী?”

“বাংলায় অনুবাদ করলেই বুঝতে পারবে।“

কয়েক সেকেন্ড পরেই সবাই বুঝে গেল ব্যাপারটা।

“আমার মামা কেরানির কাজ করে। হাহাহা। প্রদীপ, টুমি পাড়োও বটে।“ ইভার ইংরেজি টোনে বাংলা উচ্চারণ বেশ মজার। কিন্তু আমি কি আসলেই কিছু পাড়ি? আমার মজার কথার ডিমগুলি যে কোনটাই আমার নিজের পাড়া নয়; তা মনে হয় বলে দেয়া উচিত। কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই পূর্ণিমা ম্যাডামের গলা শোনা গেল, “ওগুলি মোটেও প্রকুদেবের কথা নয়। ওগুলি সব দুলাভাইয়ের কথা; উনি নিজের নামে চালিয়ে দিচ্ছেন।“

পূর্ণিমা ম্যাডামের ভেতর একটা পুলিশ-পুলিশ ভাব আছে। তিনি কোন কিছু ধরতে পারলেই চেঁচিয়ে উঠেন। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। বেশ কয়েক মাস আগে কলেজে  ইন্সপেকশান উপলক্ষে ছেলে-মেয়েরা বিভিন্ন মনিষীর বাণী লিখে কলেজের বিভিন্ন জায়গায় লাগিয়ে দিতে শুরু করেছে। কলেজের ম্যাগাজিন কমিটির সদস্য হিসেবে তখন রিফাৎ আরা ম্যাডামের সাথে লাইব্রেরিতে বসে দেয়ালিকার জন্য লেখা বাছাই করছিলাম। সেকেন্ড ইয়ারের কয়েকজন ছেলে এলো আমাদের কাছে মনিষীর বাণী সংগ্রহ করার জন্য। স্বদেশী মনিষীর চেয়ে বিদেশি মনিষীর দাম বরাবরই বেশি। তাই রিফাৎ আরা ম্যাডাম বিদেশী মনিষীর বাণী দিলেন, “তোমরা বিজ্ঞান শিক্ষা করো, বিজ্ঞান উন্নতির সোপান।“

খাতায় লিখে নিয়ে ছাত্ররা জানতে চাইলো, “ম্যাডাম এটা কার বাণী?”

“স্ট্রাইপ” – রিফাৎ আরা ম্যাডাম গম্ভীরভাবে বললেন।

“ম্যাডাম, আরেকটা বলেন, প্লিজ।“

“আরেকটা স্যারের কাছ থেকে নাও।“ – রিফাৎ আরা ম্যাডাম আমাকে দেখিয়ে দিলেন। ছাত্ররা খাতা খুলে কলম হাতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মহান মনিষীর বাণী পাওয়া গেলো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই – “কুসংস্কার দূর করো। কুসংস্কার সভ্যতার পরিপন্থী।“

“এটা কার বাণী স্যার?”

“এটা- এটা ডেভিড ল্যাম্প, নাকি উইলিয়াম ল্যাম্প ম্যাডাম?” – আমি রিফাৎ আরা ম্যাডামের কাছে জানতে চাইলাম।

“উইলিয়াম ল্যাম্প।“ – ম্যাডাম চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন।

কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ম্যাডামদের কমনরুমের দেয়ালে স্টাইপের বাণী শোভিত হলো। আর উইলিয়াম ল্যাম্পের বাণী দেখা গেলো দোতলার করিডোরের দেয়ালে। ছাত্ররা স্যারদের কমনরুমেও একটি মহান বাণী লাগিয়ে দিলো – ‘যাহার সব কিছুই শিক্ষণীয়, তিনিই শিক্ষক।‘ নিঃসন্দেহে জোরালো বাণী; তবে কতটুকু সত্য তা জানি না। পরিদর্শকরা আমাদের রুমে ঢুকে এই বাণী দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। তাঁরা তো সহজে খুশি হন না; বাণী দেখে খুশি হয়েছেন দেখে আমাদেরও বেশ খুশি লাগলো।

তারপর কয়েক মাস কেটে গেলো। একদিন টিফিন আওয়ারে পূর্ণিমা ম্যাডাম হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন, “এখনই আসেন। খুব জরুরি দরকার।“

তাঁকে অনুসরণ করে বারান্দা পেরিয়ে দোতলার মেইন করিডোরে এলাম।

“এটা কার বাণী?” – দেয়ালের দিকে আঙুল তুলে রাগী মাস্টারের মত প্রশ্ন করলেন পূর্ণিমা ম্যাডাম।

উইলিয়াম ল্যাম্পের বাণীর দিকে তাকিয়ে আমার মুখে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা দেখা গিয়েছিল হয়তো। তাতেই তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। “তারপর মিস্টার ল্যাম্প, ভেবেছিলেন কেউ বুঝতে পারবে না? আর ওদিকে মিসেস স্ট্রাইপ! ডোরা থেকে স্ট্রাইপ!”

আমার ইচ্ছে করছিলো জিজ্ঞেস করি, স্টাইপের বাণী সামনে নিয়ে এই তিন-চার মাস ধ্যান করার পর বুঝতে পারলেন যে স্ট্রাইপ হলো ডোরা ওরফে রিফাৎ আরা ম্যাডাম? কিন্তু ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম না। আমাদের বাঘ ম্যাডামের বিশেষ প্রশ্রয়ে তাঁর কনিষ্ঠারাও ক্রমশ ব্যাঘ্র হয়ে উঠছেন।

যাই হোক, পূর্ণিমা ম্যাডাম আজ আমাকে অন্যের কথা নিজের নামে চালাতে ধরে ফেলেছেন – এই খুশিতে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছেন। মনে হচ্ছে দুলাভাই শুধু তাঁর একার। ইন্তেখাব স্যারের সাথে এখনো দুলাভাইয়ের পরিচয় হয়নি। তাঁকে পরিচয় দিতে হলো।

“রিফাৎ আরা ম্যাডামের হাজবেন্ড। এমন চমৎকার মজার মানুষ খুব বেশি দেখা যায় না।“

আসলেই তাই। পদার্থবিজ্ঞানীরা খুব খটমটো টাইপের হয় বলে শুনেছিলাম। কিন্তু আমাদের দুলাভাই পদার্থবিজ্ঞানের মানুষ হলেও আনন্দের খনি। এমন সেন্স অব হিউমার খুব কম মানুষের মধ্যে দেখেছি। আজ আমাদের সাথে এলে অনেক মজা হতো। কিন্তু তাঁর অফিসে এখন ট্রেনিং চলছে। তিনি আয়োজক, তাই ছুটির প্রশ্নই উঠে না। মজার কথার কত স্টক যে তাঁর আছে। যে কোন বিষয়েই তিনি মজার কথা বলতে পারেন। একদিন আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করেছিলেন, “এফ ইউ টি ইউ আর ই – উচ্চারণ ফুটারি, না ফাটারি?” আমি অলমোস্ট বলে ফেলেছিলাম ফাটারি।

ইভাকে বললাম, “তুমি তো ইংরেজির মাস্টার, ইন্তেখাব ভাইও আছেন, বলেন দেখি এই লাইনের অর্থ কী – ফিন্ড দি কিন্ট্রি অফ এ গাইভেন কিরকিলি?”

কয়েকবার শোনার পরেও ইভা বুঝতে পারলো না লাইনটা ইংরেজি না অন্যকিছু। পূর্ণিমা ম্যাডাম কিছু বলছেন না। হয়তো তিনি দুলাভাইয়ের এই লাইনটা শোনেননি, কিংবা ধরেই নিয়েছেন আমি যা বলছি সবকিছুই দুলাভাইয়ের কাছ থেকে ধার করা।

শেষে কাগজে লিখে দিতো হলো – Find the centre of a given circle.

“হাহাহাহা”।

হাসতে হাসতে আমরা বান্দরবান যাবার পথের মিলিটারি চেকপোস্ট পার হয়ে গেলাম। তারপর বান্দরবান। শহর থেকে মাত্র ৬৫ কিলোমিটার দূরত্ব। আসতে লাগলো তিন ঘন্টার বেশি। বান্দরবানে একটা সরকারি রেস্ট হাউজে দুপুরের খাবার, একটু বিশ্রাম। ম্যাডামরা অনেকেই অনেক কিছু রান্না করে নিয়ে এসেছেন। মজার মজার খাবার, হৈ চৈ, ঘরোয়া গান-বাজনা, আর হাসি আনন্দে কেটে গেলো সারাদিন। পর্যটকরা যেখানে যেখানে যায়, সেসব জায়গা ঘুরে সন্ধ্যার আগেই অন দি রোড এগেইন।

বহদ্দার হাট দিয়ে শহরে ঢুকে পাঁচলাইশে রিফাৎ আরা ম্যাডামের বাসার সামনে আমিও নেমে গেলাম তাঁর সাথে। ইদ্রিস ভাই আর মিজান ভাই ম্যাডামের খালি ডেকসি দুটো বাস থেকে নামিয়ে গেটের ভেতর ঢুকিয়ে দিলেন। বড় ক্যাসেট প্লেয়ার নেয়া হয়েছিল ম্যাডামের বাসা থেকে। সেটা আমি হাতে নিলাম। বাস দাঁড়িয়ে আছে ইদ্রিস ভাই আর মিজান ভাইয়ের জন্য। ম্যাডাম বললেন, “ইদ্রিস, মিজান – তোমরা চলে যাও। ওগুলি ওখানে রেখে চলে যাও। বাস দাঁড়িয়ে আছে, দেরি হয়ে যাবে সবার।“

দেখলাম সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন দুলাভাই। মনে হচ্ছে একটু আগেই অফিস থেকে ফিরেছেন।

“কেমন হলো পিকনিক?”

“খুব ভালো হয়েছে দুলাভাই। আপনি গেলে আরো ভালো হতো।“

খালি ডেকসিগুলোর একটা হাতে তুলে নিলাম। খালি ডেকসিই এত ভারী। খাবারভর্তি অবস্থায় ম্যাডাম এগুলি চুলা থেকে নামিয়েছেন কীভাবে কে জানে।

“ওগুলি রেখে দেন ওখানে। দারোয়ান তুলে দেবে। আপনি চলেন, বাসায় চলেন।“ দুলাভাই বললেন।

“আপনি আগে যান দুলাভাই, আমি আসছি আপনার পেছনে।“

“তাহলে তো বিপদে পড়বেন ভাই।“

“কী রকম বিপদ?“

“জানেন না, দুলাভাই আর ফুপার পেছনে গেলে গালি শুনতে হয়?”

“কীভাবে?”

“কেউ পরিচয় জিজ্ঞেস করলে দুলাভাই বলবে – শালা, আর ফুপা বলবে – শালার পুত।“

“হাহাহাহা”

>>>>>>>>>>>>>>>>> 

১৮তম বিসিএস এর ভাইভার ডেট দিয়েছে। আমার ভাইভা ফেব্রুয়ারির শুরুতে – ঈদের ছুটির পরপর। প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়েছিল সাতানব্বইর শুরুতে। ভাইভা হচ্ছে আটানব্বই’র ফেব্রুয়ারিতে। লিখিত পরীক্ষার রেজাল্টের পর মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়ে গেছে রোজার আগে। সিরিয়াসলি পরীক্ষা দেয়া বলতে যা বুঝায় তা আমার এমএসসি পরীক্ষার সাথেই শেষ হয়ে গেছে। শুনেছি অনেকে দিনরাত পড়াশোনা করে বিসিএস পরীক্ষা দেয়। ঢাকায় নাকি বিসিএস কোচিং সেন্টারও চালু হয়েছে। দেখা যাবে অচিরেই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে। আমি যখন মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করার হ্যাট্রিক করছিলাম তখন রেটিনা কোচিং সেন্টার সবে উঁকিঝুঁকি মারছিল। তখন কেউ কেউ কোচিং করতো। আর পরের দশ বছরের মধ্যে দেখা গেলো – ভর্তি কোচিং করে না এমন একজনও নেই দেশে। বিসিএস পরীক্ষায় আগে দু’বার ফেল করেছি – সিরিয়াসলি পড়াশোনা করলেই যে মৌখিক পরীক্ষায় পাস করতাম তা বলা যায় না।

ঈদের ছুটির পর কলেজ খোলার আগেই বিসিএস ভাইভা হয়ে গেল। আলাদা করে আর ছুটি নিতে হলো না। ভাইভা দিয়ে বাংলা একাডেমির বইমেলায় গেলাম। রমজান ও ঈদের কারণে এবার বাংলা একাডেমির বইমেলা শুরু হয়েছে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে। আগামী প্রকাশনীতে দেখলাম হুমায়ূন আজাদ নিজেই নিজের বই এগিয়ে দিচ্ছেন পাঠকের হাতে। নিজের বই সম্পর্কে নিজেই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছেন। কেমন যেন খটকা লাগে বিখ্যাত ব্যক্তিদের আচরণ দেখলে। হুমায়ুন আহমেদ যেখানে বসেছেন সেখানে লম্বা লাইন। আমিও লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁর বই কিনে অটোগ্রাফ নিলাম। খুব ছোট ছোট অক্ষরে লেখেন হুমায়ূন আহমেদ।

পরদিন কলেজ খুলবে। রাতের বাসেই চলে আসতে হলো। আমার বাড়িওয়ালা দোতলার বাসা রেডি হওয়ার সাথে সাথেই আমাকে দোতলায় তুলে দিয়েছেন। নিচের তলা থেকে জায়গা বেড়েছে দুই ফুট, কিন্তু ভাড়া বেড়েছে পাঁচ শ টাকা। বেতনের অর্ধেক চলে যাচ্ছে বাসা ভাড়ায়।

স্কুল সেকশানে এবার ক্লাস টেনের ফিজিক্স আর ফাইভের গণিত। আর কলেজে আমি যাদের ক্লাসটিচার তারা এবছর পরীক্ষা দেবে। এই সিস্টেমটা ভালো। আমি চুরানব্বইতে ফার্স্ট ইয়ারের যে সেকশানের ক্লাসটিচার হয়েছিলাম -ছিয়ানব্বইতে তাদের পরীক্ষা হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তাদের ক্লাসটিচার ছিলাম। তারপর সেবছর নতুন ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসটিচার হয়েছি। তারা এবার এইচএসসি দেবে। তারপর নতুন ফার্স্ট ইয়ার এলে তাদের ক্লাসটিচার। আটানব্বইর এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট হয়ে গেছে। টেস্ট পরীক্ষাতে বারো সাবজেক্টের পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। যারা সব বিষয়ে পাস করেনি তাদের ফরম ফিল আপ করতে দেয়া হচ্ছে না। এসময় অনেক অভিভাবক আসেন তাদের ছেলে-মেয়েদের পক্ষে তদবির করার জন্য। তাদের জন্য খারাপ লাগে, কিন্তু কিছু করার তো উপায় থাকে না। কারণ বোর্ড থেকে নিয়ম করে দেয়া হয়েছে টেস্টে পাস না করলে বোর্ডের পরীক্ষায় বসার সুযোগ না দেয়ার জন্য। এমনও হয়েছে যারা টেস্টে ফেল করেছে তাদেরকে আবার টেস্ট পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। আবারো যারা ফেল করেছে তাদেরকে পরের বছরের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

নাইন-টেনের সাবজেক্টগুলি যাঁরা পড়ান তাঁরা যে ব্যাচকে নাইনে শুরু করেন – তাদেরকে ক্লাস টেনেও পড়ান। এতে পড়ানোর ধারাবাহিকতা থাকে। আমি গতবছর নাইনে ফিজিক্স পড়িয়েছি, এবছর তারা টেনে উঠেছে। তাদের সাথে ক্লাস আমার।

ক্লাস ফাইভের ছেলেমেয়েরা বরাবরই ভালো। প্রাইমারি স্কুল, হাই স্কুল, কলেজ একসাথে হওয়াতে এরা ঠিক বড় হতে পারছে না এখানে। শুধুমাত্র প্রাইমারি স্কুল হলে ক্লাস ফাইভ হতো সবচেয়ে সিনিয়র। অথচ এখানে তাদের সিনিয়র আছে আরো সাত ক্লাস। তাই তাদের দাপট ক্লাসরুমের বাইরে খুব একটা খাটে না।

“এই ইসে, প্রদীপ, ছেলে তো এবার ক্লাস ফাইভে উঠলো।“ – দোতলায় উঠার সিঁড়ির মুখে শামসুন্নাহার ম্যাডামের সাথে দেখা হতেই হাসিমুখে বললেন তিনি।

“আশিক, শোন, স্যারকে সালাম দাও।“ – ছেলে ক্লাসের দিকে যাচ্ছিলো। মায়ের ডাকে দৌড়ে এলো।

“স্লামালাইকুম স্যার।“

“ঠিক আছে। আশিক, তুমি ক্লাসে যাও।“

আশিক হরিণের মত দৌড়ে চলে গেল।

“একটু দেখে রাখবেন ভাই।“

“অবশ্যই আপা, তা কি আর বলতে হবে?”

শামসুন্নাহার ম্যাডামের দুটো ছেলেই অলরাউন্ডার। সৈকত, আশিক দুজনই লেখাপড়া, গানবাজনা সবকিছুতেই চৌকশ। তবুও মায়ের মন সারাক্ষণ উৎকন্ঠায় থাকে।

টিচার্স রুমে এখনো “ঈদ মোবারক” আর ঈদের কোলাকুলি চলছে। নতুন বছরের লেখাপড়া শুরু হবার আগে যথাসম্ভব কম সময়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা শেষ করার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। সাঈদ স্যার আর শংকর স্যার অনেক ব্যস্ত ক্রীড়া প্রতিযোগিতার প্ল্যানিং নিয়ে। এর মধ্যেই সাঈদ স্যার বললেন, “প্রদীপ, মেয়ে তো এবার তোমার ক্লাসে।“

“তান্নি ক্লাস ফাইভে উঠে গেছে?”

সাঈদ স্যারের মেয়ে তান্নিকে দেখছি ক্লাস টু থেকে। এর মধ্যেই ক্লাস ফাইভে উঠে গেলো? বড় লক্ষ্মী মেয়ে তান্নি। আমার কেন যেন মনে হয় শিক্ষকদের ছেলেমেয়েরা সবসময় ভালো হয়ে থাকার একটা মানসিক চাপের মধ্যে থাকে। কেয়ার ফ্রি তারা ঠিক মতো হতে পারে না, বিশেষ করে তারা যদি মা-বাবার স্কুলে পড়ে। বাবা-মা ক্লাসে পড়াতে এলে অন্যদের মতো স্যার-ম্যাডাম ডাকতে হয় নিজের বাবা-মাকেও। আর কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট তো আছেই। নিজেদের যোগ্যতাতেই তারা ভালো করে। কিন্তু অনেকে মনে করে শিক্ষকের সন্তান হওয়াতে তারা বেশি সুযোগ পায়। অথচ দেখা যায় শিক্ষক মা-বাবা কঠোরভাবে নিরপেক্ষ থাকতে গিয়ে অনেক সময় নিজের সন্তানের ছোট ভুলকেও অনেক বড় করে দেখেন। এর উল্টোটাও হয়তো আছে, কিন্তু আমি শাহীন কলেজের শিক্ষকদের দেখেছি নিজেদের ছেলে-মেয়েদের একটুও বাড়তি সুযোগ দেননি কখনো। তবে ইদানীং প্রিন্সিপাল স্যারের ব্যাপারে যা শুনছি তা খুব একটা সুখকর নয়।

ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা শেষ হলো। টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতার কোন চিঠি কি কলেজে আর আসে না? জানি না।

মার্চ থেকে পুরোদমে ক্লাস শুরু হয়ে গেল।

>>>>>>>>>>>>>> 

গতবছর জুড়ে আমেরিকা, ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার অনেকগুলি ইউনিভার্সিটিতে উচ্চতর শিক্ষার প্রস্পেক্টাস চেয়ে চিঠি লিখেছিলাম। কলেজের পর ব্রিটিশ কাউন্সিল আর পাবলিক লাইব্রেরির রেফারেন্স ঘেঁটে ঘেঁটে বের করেছি বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির ঠিকানা। রাত জেগে টাইপ রাইটারে চিঠি টাইপ করেছি। শ’খানেক চিঠি পোস্ট করতেও পুরো মাসের বেতন চলে যায়। কোন নির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা নেই। অনেকটা হাতড়ে হাতড়ে পথ খোঁজার মত অবস্থা আমার। প্রোস্পেক্টাস আসতে শুরু করেছে অনেকদিন থেকে। বেশিরভাগ ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লিকেশন ফি চায় পঞ্চাশ ষাট ডলার। অক্সফোর্ডে দরখাস্ত করেছিলাম। ওরা আই-ই-এল-টি-এস দিতে বলেছিল। প্রতিটি ব্যান্ডে গড়ে সেভেন পাওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু আমি পেয়েছি সিক্স পয়েন্ট ফাইভ। অক্সফোর্ডে কিছু হলো না আর। আরো কয়েকটা ইউনিভার্সিটিতে দরখাস্ত করেছিলাম যেগুলিতে দরখাস্ত করতে কোন ফি লাগে না। দুটো ইউনিভার্সিটি থেকে অ্যাডমিশান অফার পেয়েছি, কিন্তু কোন স্কলারশিপ নেই। টিউশন ফি দিয়ে পড়ার মতো সংগতি আমার নেই। তারপরেও এই চ্যাপ্টারটা বন্ধ করে ফেলছি না কেন সেটাই আশ্চর্যের। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির প্রস্পেক্টাস এসেছিল গত বছরের জুলাইয়ের দিকে। অ্যাপ্লিকেশান ফি পঞ্চাশ ডলার। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থা করা অনেক ঝামেলার ব্যাপার। টোফেল আর জি-আর-ই দিয়েছিলাম। তারজন্য আমেরিকান ডলার পাঠাতে হয়েছিল। আগ্রাবাদের সোনালী ব্যাংকের বৈদেশিক শাখা থেকে পঞ্চাশ ষাট ডলারের চেক নিতে কত রকম ফরম যে ফিল আপ করতে হয়েছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম অস্ট্রেলিয়ান ডলারের চেক তারা দেয় না। অস্ট্রেলিয়ান ডলার পাওয়া যাবে কোথায়? একজন বললেন, গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকে খোঁজ নিতে।

রাস্তার ঐপাড়ে খুঁজে পাওয়া গেলো এএনজেড গ্রিন্ডলেজ ব্যাংক। বেশ হাইফাই ব্যাংক। সোনালী ব্যাংকের মতো ভীড় কিংবা হৈ চৈ নেই। রিসেপশানের স্মার্ট তরুণ জানিয়ে দিলেন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট না থাকলে ডলার পাওয়ার উপায় নেই। তাহলে উপায়? অস্ট্রেলিয়ার দরজাও কি বন্ধ হয়ে যাবে? বেরিয়ে আসার জন্য দরজার দিকে যাবার সময় হঠাৎ শুনতে পেলাম, “অ্যাই প্রদীপ, এদিকে এদিকে, টার্ন লেফ্‌ট।“

বামে ফিরতেই দেখলাম – লম্বা কাউন্টারের ভেতরে হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে সুরজিৎ বড়ুয়া। চট্টগ্রাম কলেজে আমরা একই সাথে উচ্চমাধ্যমিক পড়েছি। তারপর সে কমার্স ফ্যাকাল্টিতে। ক্যাম্পাসে মাঝে মাঝে দেখা হয়েছে, কিন্তু সেভাবে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল না। মাস্টার্সের পর গত পাঁচ বছরে একবারও দেখা হয়নি। সে যে আমাকে মনে রেখেছে এটাও তো বেশি। সে এই ব্যাংকে কাজ করছে গত তিন বছর ধরে। আমার অস্ট্রেলিয়ান ডলারের চেকের দায়িত্ব সে নিলো। অ্যাকাউন্ট না থাকলে বৈদেশিক মুদ্রা দেয়ার নিয়ম নেই। তাই সে তার নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে আমার জন্য পঞ্চাশ ডলারের চেক রেডি করে দিলো। আমি টাকাটা তাকে দিয়ে দিলাম। কিন্তু তার উপকারের জন্য আমি তার কাছে চিরঋণী হয়ে রইলাম।

সেই চেকসহ দরখাস্ত পাঠিয়েছিলাম মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে। ডিসেম্বরে একটা কন্ডিশনাল অফার লেটার এসেছে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি থেকে। কিন্তু সেখানে লেখা আছে অফারটি যেন আমি এখন গ্রহণ না করি। কারণ আমার স্কলারশিপের কিছু সিদ্ধান্ত এখনো মুলতবি আছে। স্কলারশিপ না পেলে বছরে সাড়ে সতের হাজার ডলার টিউশন ফি জোগাড় করার সাধ্য আমার নেই। তাই ঐ অফারটি আরো তিনটা অফার লেটারের সাথে ফাইলে রেখে দিয়েছি। আজ থেকে বহুবছর পর এগুলি দেখে দেখে হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলবো। মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির কথা আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম।

মার্চের প্রথম সপ্তাহে ছোট্ট একটা খামে এক পৃষ্ঠার একটা চিঠি এলো মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি থেকে। ওরা আমাকে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের মাস্টার্স লিডিং টু পিএইচডি গবেষণার জন্য একটা স্কলারশিপ অফার করেছে – মেলবোর্ন রিসার্চ স্কলারশিপ।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

বিজ্ঞানী গীতাঞ্জলি রাও

  পানি-দূষণের মাত্রা নির্ধারণের দ্রুততম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ‘টেথিস’ উদ্ভাবন করে গীতাঞ্জলি রাও যখন   ২০১৭ সালে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ তরুণ বিজ্ঞানীর শ...

Popular Posts