ষষ্ঠ
অধ্যায়
পৃথিবীর কাছের গ্রহ শুক্র
শুক্র পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের গ্রহ এবং দূরত্বের ভিত্তিতে সূর্যের দ্বিতীয় গ্রহ। সৌরজগতের গ্রহগুলোর মধ্যে পৃথিবী ও শুক্রের আয়তন প্রায় কাছাকাছি।
কত বড় কত ভারী
শুক্র গ্রহের আকার আকৃতি আয়তন ঘনত্ব সবকিছুই পৃথিবীর কাছাকাছি। এই গ্রহটি একটি পরিপূর্ণ গোলক। শুক্র গ্রহের নিরক্ষীয় ব্যাসার্ধ (equatorial radius) ও মেরু ব্যাসার্ধ (polar radius) সমান (6,051.8 km)। ফলে গ্রহটি একটি নিখুঁত গোলক, যার উপবৃত্ততার (ellipticity) মান শূন্য (চিত্র 8)।
ব্যাস: শুক্রের ব্যাস (diameter at equator) 12,103 কিলোমিটার। এই ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের শতকরা 95 ভাগ।
পরিসীমা: শুক্রের পরিসীমা (circumference) 38,025 কিলোমিটার।
ক্ষেত্রফল: শুক্রের ক্ষেত্রফল (surface area) 460 মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার। (46 কোটি বর্গ কিলোমিটার)। শুক্রের ক্ষেত্রফল পৃথিবীর ক্ষেত্রফলের 90%।
আয়তন:
শুক্রের আয়তন (volume) 9.38x1011 ঘন কিলোমিটার। (9380 কোটি ঘন কিলোমিটার)। শুক্রের আয়তন পৃথিবীর
আয়তনের প্রায় 88% (৮৮%)।
চিত্র 8: শুক্র গ্রহের নিরক্ষীয় ব্যাসার্ধ (equatorial radius) ও মেরু ব্যাসার্ধ (polar radius) সমান। ফলে
গ্রহটি একটি নিখুঁত গোলক, যার উপবৃত্ততার (ellipticity) মান শূন্য।
ভর: শুক্রের ভর (mass) 4.867 x 1024 কিলোগ্রাম (4867 কোটি কোটি কোটি কিলোগ্রাম)। শুক্রের ভর পৃথিবীর ভরের 81.5%।
ঘনত্ব: শুক্রের ঘনত্ব (density) 5.24 গ্রাম/ঘন সেন্টিমিটার (g/cm3)। শুক্রের ঘনত্ব পৃথিবীর ঘনত্বের 95%।
পৃথিবীর সাথে শুক্র গ্রহের আকার ও আয়তনের একটি তুলনামূলক চিত্র পরের পৃষ্ঠার সারণিতে (সারণি 2) দেয়া হলো।
সারণি
2:
শুক্র ও পৃথিবীর আকারের তুলনা
বৈশিষ্ট্য |
শুক্র |
পৃথিবী |
ব্যাস |
12,103 km |
12,742 km |
পরিসীমা |
38,025 km |
40,075 km |
ক্ষেত্রফল |
460 million km2 |
510.1 million km2 |
আয়তন |
9.38x1011 km3 |
1.08 x 1012 km3 |
ভর |
4.867 x 1024 kg |
5.972 x 1024 kg |
ঘনত্ব |
5.24 g/cm3 |
5.51 g/cm3 |
চিত্র 9: শুক্র ও পৃথিবীর কক্ষপথ
থাকে কত দূরে, কত বেগে ঘুরে
সূর্যের দ্বিতীয় গ্রহ শুক্র। সূর্য থেকে শুক্রের
গড় দূরত্ব 108.2 মিলিয়ন কিলোমিটার (10
কোটি 82
লক্ষ কিলোমিটার)। এই দূরত্বে
থেকে শুক্র সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। শুক্র গ্রহের এক পাশে আছে বুধ, অন্যপাশে আছে
পৃথিবী। শুক্র থেকে বুধের গড় দূরত্ব প্রায় 50 মিলিয়ন
কিলোমিটার (5 কোটি কিলোমিটার)। অন্যদিকে শুক্র থেকে পৃথিবীর গড়
দূরত্ব 41.4 মিলিয়ন কিলোমিটার। সুতরাং দেখা যাচ্ছে শুক্রের
নিকটতম প্রতিবেশী পৃথিবী। আবার পৃথিবীর একপাশে যেমন শুক্র আছে, তেমনি অন্যপাশে আছে
মঙ্গল। মঙ্গল ও পৃথিবীর গড় দূরত্ব 78.34 মিলিয়ন কিলোমিটার। তার মানে পৃথিবীরও নিকটতম
প্রতিবেশী হলো শুক্র গ্রহ। সূর্যের চারপাশে একবার ঘুরে আসতে শুক্রের লাগে প্রায় 225 দিন।
শুক্রের গতি সম্পর্কে আরো ভালোভাবে জানতে হলে আমাদের আগে দেখতে হবে তার কক্ষপথ কী
রকম।
চিত্র 10: সূর্য থেকে শুক্রের সবচেয়ে কাছের ও সবচেয়ে দূরের
বিন্দুর দূরত্ব
শুক্রের কক্ষপথ
শুক্র গ্রহের কক্ষপথ (orbit) প্রায়
বৃত্তাকার। সৌরজগতের গ্রহগুলোর মধ্যে শুক্র গ্রহের কক্ষপথই সবচেয়ে বৃত্তাকার। এর
উপবৃত্তের উৎকেন্দ্রিকতা (eccentricity) শূন্যের কাছাকাছি (0.0067)। বৃত্তের
উৎকেন্দ্রিকতার মান শূন্য। শুক্র গ্রহের কক্ষপথ পৃথিবীর কক্ষপথের চেয়েও বৃত্তাকার।
পৃথিবীর উৎকেন্দ্রিকতা 0.0167। সূর্যের চারপাশে
প্রায় বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরার কারণে সূর্য থেকে শুক্রের দূরত্ব সবসময় প্রায় একই
থাকে। তবুও সামান্য যেটুকু উপবৃত্তের আভাস আছে তার জন্য সূর্য থেকে শুক্রের
দূরত্বের খুব সামান্য পার্থক্য দেখা দেয় কক্ষপথের বিভিন্ন অবস্থানে।
শুক্র সূর্যের একেবারে কাছে যে বিন্দু
পর্যন্ত যেতে পারে সেখান থেকে সূর্যের দূরত্ব 107.48 মিলিয়ন কিলোমিটার, অর্থাৎ দশ কোটি চুয়াত্তর লক্ষ আশি হাজার কিলোমিটার। শুক্র
থেকে সূর্যের সবচেয়ে কাছের এই বিন্দুকে বলে পেরিহিলিয়ন (perihelion) বা অনুসুর
বিন্দু। (চিত্র 10 দেখো)
শুক্র সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরে যে বিন্দু
পর্যন্ত যেতে পারে তার দূরত্ব 108.94 মিলিয়ন
কিলোমিটার অর্থাৎ দশ কোটি উননব্বই লক্ষ চল্লিশ হাজার কিলোমিটার। সূর্য থেকে শুক্রের
সবচেয়ে দূরের এই বিন্দুকে বলে অ্যাপহিলিয়ন (aphelion) বা অপসুর
বিন্দু। (চিত্র 10 দেখো)
সূর্য থেকে শুক্রের গড় দূরত্ব 108.2
মিলিয়ন কিলোমিটার অর্থাৎ দশ কোটি বিরাশি লক্ষ কিলোমিটার।
সূর্য থেকে শুক্রে আলো আসতে কতক্ষণ সময় লাগবে বলতে পারবে? আলোর গতি সেকেন্ডে 3 x 108 m অর্থাৎ 300 মিলিয়ন মিটার বা 0.3 মিলিয়ন
কিলোমিটার। সেহিসেবে সূর্য থেকে শুক্রে আলো আসতে 360.66 সেকেন্ড বা প্রায় ছয় মিনিট সময় লাগে।
কক্ষপথে শুক্রের গতি
সূর্যের চারপাশে শুক্র পৃথিবীর চেয়ে বেশি গতিতে ঘুরছে। অনুসুর বা পেরিহিলিয়ন
বিন্দুতে শুক্রের গতিবেগ সবচেয়ে বেশি; সেকেন্ডে 35.26 কিলোমিটার
বা ঘন্টায় 1,26,936 কিলোমিটার। অপসুর বা
অ্যাপহিলিয়ন বিন্দুতে শুক্রের গতিবেগ
সবচেয়ে কম; সেকেন্ডে প্রায় 34.79 কিলোমিটার বা
ঘন্টায় 1,25,244 কিলোমিটার। কক্ষপথে শুক্রের গড় গতিবেগ সেকেন্ডে প্রায় 35.02 কিলোমিটার, অর্থাৎ ঘন্টায় 1,26,072 কিলোমিটার।
শুক্রের বছর
সৌরজগতের গ্রহগুলোর বছর
হিসেব করা হয় সূর্যের চারপাশে এক বার ঘুরে আসতে যে সময় লাগে তার ভিত্তিতে। সূর্যের
চার পাশে একবার ঘুরে আসতে পৃথিবীর যেখানে লাগে 365 দিন সেখানে শুক্রের সময় লাগে প্রায় 225 দিন। তার
মানে শুক্রের এক বছর হলো পৃথিবীর 225 দিনের সমান।
নিজের অক্ষে শুক্রের গতি
সৌরজগতের গ্রহগুলো সূর্যকে কেন্দ্র করে সূর্যের চারপাশে কক্ষপথে যেরকম
ঘুরছে, তেমনি ঘুরছে নিজের অক্ষের উপর। সূর্যের চারপাশে গ্রহগুলো ঘুরছে ঘড়ির কাঁটা
যেদিকে ঘোরে তার বিপরীত দিকে অর্থাৎ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে। একটা ঘড়ি টেবিলের
উপরে রেখে উপর থেকে ঘড়ির ডায়ালের সাথে লম্বভাবে দেখলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবে।
শুক্র গ্রহও সূর্যের চারপাশে একইভাবে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে ঘুরছে। গ্রহগুলো যখন
নিজের অক্ষের উপর ঘুরে - তখনও ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘুরে। অর্থাৎ পশ্চিম থেকে
পূর্ব দিকে ঘুরে। আমাদের পৃথিবীও পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে ঘুরে। কিন্তু শুক্র গ্রহের
বেলায় দেখা যাচ্ছে উল্টো ব্যাপার ঘটছে। শুক্র গ্রহ নিজের অক্ষের উপর ঘোরে ঘড়ির
কাঁটা যেদিকে ঘোরে সেদিকে। অর্থাৎ পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে।
চিত্র 11: নিজের অক্ষে শুক্রের ঘূর্ণনের দিক পৃথিবীর
ঘূর্ণনের বিপরীত দিকে
গ্রহগুলোর মধ্যে আরেকটি মাত্র গ্রহ ইউরেনাস নিজের অক্ষে শুক্র গ্রহের মতো
পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে ঘুরে। শুক্র গ্রহের এই বিপরীতমুখী ঘূর্ণনের ব্যাপারটা
বিজ্ঞানীরা অনেক বছর ধরতেই পারেননি। শুক্রের চারদিকে ঘন গ্যাসের আস্তরণের কারণে
পৃথিবী থেকে গ্রহটির ঘূর্ণন ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছিলো না। ১৯৫০ থেকে ১৯৬০
এর মধ্যে র্যাডার প্রযুক্তির সাহায্যে বিজ্ঞানীরা শুক্রের এই বিপরীত দিকে
ঘূর্ণনের ব্যাপারে নিশ্চিত হন। পৃথিবী নিজের অক্ষের উপর একবার ঘুরতে সময় নেয় 24 ঘন্টা।
সেজন্য পৃথিবীতে 24 ঘন্টায় এক দিন। কিন্তু শুক্র নিজের অক্ষের উপর খুবই আস্তে আস্তে ঘুরে।
নিজের অক্ষের উপর একবার ঘুরতে শুক্রের সময় লাগে 5832.6 ঘন্টা বা 243.6 দিন।
অর্থাৎ শুক্রের এক দিন পৃথিবীর 243 দিনের সমান।
নিজের অক্ষে শুক্রের
গতিবেগ খুবই কম। ঘন্টায় মাত্র 6.52 কিলোমিটার। একজন সাধারণ মানুষও
এই বেগে দৌড়াতে পারবে। পৃথিবী নিজের অক্ষের উপর ঘন্টায় প্রায় 1670 কিলোমিটার বেগে ঘোরে।
শুক্র গ্রহ কেন অন্যান্য
গ্রহগুলোর বিপরীত দিকে ঘোরে সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা এখনো একমত হতে পারেননি। ভিন্ন
ভিন্ন তিনটি ধারণা বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন। বিজ্ঞানীরা মনে করেন শুক্র গ্রহও উদ্ভব
হবার পর পর অন্যান্য গ্রহের মত পশ্চিম থেকে পূর্বদিকেই ঘুরতে শুরু করেছিল। কিন্তু
কোন এক অজানা কারণে হঠাৎ গ্রহটি 1800 কোণে উল্টে গিয়ে উপরের দিক নিচে আর নিচের দিক উপরে উঠে যায়। ফলে ঘুর্ণনের
দিক হয়ে যায় উল্টো। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন শুক্র গ্রহের অভ্যন্তরীণ ভৌগোলিক কারণে
কিংবা বায়ুমন্ডলের প্রচন্ড চাপে এই উল্টেযাওয়ার ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। আবার অনেকে
মনে করেন বড় ধরনের কোন গ্রহাণুর আঘাতে শুক্র গ্রহ উল্টে গিয়েছিল।
ফ্রান্সের
জ্যোতির্বিজ্ঞানী আলেক্সান্দ্রে কোরেইয়া (Alexandre Correia) এবং জ্যাক লাস্কার (Jacques Laskar)
কম্পিউটার সিম্যুলেশানের মাধ্যমে দেখান যে শুক্র গ্রহের কক্ষপথে গতির দিক এবং
নিজের অক্ষে গতির দিক শুরুতে একই রকম ছিল। সেই সময় শুক্রের নিরক্ষীয় রেখা বরাবর
বক্রতার পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। শুক্র সেই সময় নিজের অক্ষের উপর অনেক দ্রুত ঘুরছিল।
কিন্তু বক্রতার কারণে এবং শুক্রের বায়ুমন্ডলের তীব্রতার কারণে নিজের অক্ষের উপর
শুক্রের গতি ক্রমশ কমতে কমতে একসময় বিপরীত দিকে ঘুরতে শুরু করে। কারণ যাই হোক, এই
বিপরীতমুখী ঘূর্ণনের ফলে শুক্রের সাথে আমাদের পৃথিবীর গতিপ্রকৃতির মিলের চেয়ে
অমিলই বেশি।
No comments:
Post a Comment