Friday 23 October 2020

যে গ্রহে সূর্য উঠে পশ্চিম দিকে - পর্ব ৪

 


তৃতীয় অধ্যায়

 শুক্র সম্পর্কে প্রাচীন বিশ্বাস

 

উপরের ছবিটি প্রায় দু'হাজার বছর আগে আঁকা রোমানদের দেবী ভেনাসের ছবির প্রতিকৃতি। হাজার বছর আগে মানুষের জ্ঞান ও কারিগরী দক্ষতা আজকের মত এত উন্নত ছিল না। প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করতে করতেই মানুষ আবিষ্কার করেছে প্রাকৃতিক রহস্য। যে রহস্যের কোন উত্তর মানুষের হাতে ছিল না - তখন মানুষ সেখানে কল্পনার আশ্রয় নিতো। সেই কল্পনা থেকে সৃষ্টি হয়েছে নানারকম দেব-দেবীর উপকথা এবং বিভিন্ন রকমের বিশ্বাস। যে প্রাকৃতিক শক্তিকে মানুষ জয় করতে পারতো না, কিন্তু করতে চাইতো - সেই প্রাকৃতিক শক্তির পেছনে এক বা একাধিক দেবতা আছে বলে কল্পনা করে নিতো মানুষ। সে দেবতাদের তারা নাম দিয়েছে, সেই দেবতাদের মূর্তি গড়েছে, ছবি এঁকেছে। দেবতাদের নিয়ে গল্প তৈরি করেছে এবং দেখা গেছে কিছু অলৌকিক ক্ষমতা থাকলেও বেশিরভাগ দেবতার আচরণ একেবারে মানুষের মত। মানুষের মতই দেবতাদের ক্ষুধা পায়, দেবতারা ঘুমায়, দেবতাদের ছেলেমেয়ে হয়, তাদের রাগ আছে, হিংসা আছে, ভালোবাসা আছে। দেবতারা মানুষের উপকার করে আবার ক্ষতিও করে। আকাশের গ্রহ উপগ্রহ নক্ষত্র - সবকিছুকেই দেবতা বলে মনে করেছে প্রাচীন কালের মানুষ। নিজেদের সব কাজের জন্যই মানুষ কোন না কোন দেবতার আশ্রয় নিয়েছে।

          পৃথিবীতে মানুষের উদ্ভব হবার অনেক আগেই অন্যান্য অনেক প্রাণি ও উদ্ভিদের উদ্ভব হয়েছে। মানুষের বেঁচে থাকার সব প্রাকৃতিক উপাদানই তখন পৃথিবীতে ছিল। খাবার পানি, বিশুদ্ধ বাতাস, গাছের ফল সব। কিন্তু প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করতে হয়েছে মানুষের। আকাশের দেখেছে উজ্জ্বল সূর্য। সেই সূর্য তাপ দেয়, আলো দেয়। সেই সূর্য এক দিক থেকে আকাশে আসে, তারপর অন্যদিক দিয়ে চলে যায়। যখন রাত আসে - অন্ধকারে মানুষ ভয় পায়। কারণ অন্যান্য প্রাণীরা অন্ধকারে আক্রমণ করে মানুষকে। সেই অন্ধকার থেকে মুক্তি দেয় সূর্য। তাই সূর্য মানুষের আদিদেবতা। পৃথিবীর সব সংস্কৃতিতেই সূর্য একটি দেবতা। রাতের বেলা চাঁদ আলো দেয়। চাঁদও দেবতা হলো। কত গল্প কাহিনির উৎপত্তি হলো চন্দ্রসূর্য সম্পর্কে। অন্যান্য তারা সম্পর্কেও। আকাশ দেখতে দেখতে খালি চোখেই মানুষ অনেক কিছু পর্যবেক্ষণ করেছে। দেখেছে কালো মেঘ সূর্যকেও ঢেকে দিতে পারে - তার মানে মেঘের যে দেবতা সে সূর্যের চেয়েও বড় - এরকম ইত্যাদি অনেক গল্প। আকাশে সূর্য ও চাঁদের পরেই উজ্জ্বলতার দিক থেকে শুক্রের স্থান। এই উজ্জ্বল বস্তুটি নিয়েও প্রাচীন মানুষের অনেক রকমের গল্প ও বিশ্বাস ছিল। খুব সংক্ষেপে দেখা যাক - কী ধরনের গল্প প্রচলিত ছিল শুক্র গ্রহ সম্পর্কে।

          অনেক ভারতীয় পন্ডিত মনে করেন শুক্র গ্রহ নাম হওয়ার কারণ হলো এর উজ্জ্বলতা। শুক্লতা থেকে শুক্র শব্দটি এসেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের পৌরাণিক কাহিনিতে শুক্রকে দানবদের গুরু বলে বিবেচনা করা হয়। পুরাণে মানুষের জন্য যা কিছু ভালো - তার কৃতিত্ব দেয়া হয় দেবতাদের, আর মানুষের জন্য যা কিছু ক্ষতিকর - তার দায় নিতে হয় দানবদের। দেবতাদের গুরু হলেন বৃহস্পতি। পুরাণে সৌরজগতের সব গ্রহকেই এক একজন দেবতা বলে ধরে নেয়া হয়। বৃহস্পতি দেবতাদের গুরু এবং শুক্র দানবদের গুরু বলে বৃহস্পতি ও শুক্রের মধ্যে সম্পর্ক ভালো নয়। শুক্রকে দানবরা যে গুরু মানে তার মূল কারণ হচ্ছে শুক্রের মৃতসঞ্জীবনী ক্ষমতা। অর্থাৎ শুক্র নাকি মৃতকে জীবিত করে ফেলতে পারেন। কিছুদিন পরপরই দেবতা ও দানবদের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যায়। দেবতারা দানবদের মেরে ফেললে শুক্র সেই মৃত দানবদের আবার জীবিত করে দেন। কিন্তু দেবতাদের গুরু বৃহস্পতির তো সেই ক্ষমতা নেই। তাই দেবতাদের কাছে বৃহস্পতির তো প্রেস্টিজ থাকে না। সেক্ষেত্রে বৃহস্পতি যে শুক্রকে পছন্দ করবে না তা তো স্বাভাবিক।

          শুক্র গ্রহকে সূর্যোদয়ের আগে ও সূর্যাস্তের ঠিক পরপর কিছুক্ষণ দেখা যায়। কিন্তু মাঝরাতে কখনোই দেখা যায় না পৃথিবীর আকাশে। এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে প্রাচীন কালের মানুষ। পুরাণে এর কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে বেশ চমকপ্রদ গল্পের মাধ্যমে। পুরাণে শুক্রের আরেক নাম পরশুরাম। তিনি খুবই ক্ষমতাশালী ব্রাহ্মণ। তিনি প্রচন্ড গতিসম্পন্ন। ভোরে গিয়ে পূর্বাকাশে উঠেন, সন্ধ্যায় গিয়ে পশ্চিমাকাশে উঠেন। মধ্যরাতে মাঝ আকাশের স্বর্গের পার্টিতে যোগ দেন। এই স্বর্গের মালিক তিনি নিজে। কিন্তু অযোধ্যার রাজা রামচন্দ্রের উপর তার অনেক রাগ। কারণ রামচন্দ্র রাজা জনকের বাড়িতে গিয়ে হরধনু ভঙ্গ করে সীতাকে বিয়ে করে। হরধনু ভেঙে ফেলতে অনেক শক্তি লাগে। রাম সেই শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। পরশুরাম নিজেকে রামের চেয়ে বেশি শক্তিশালী মনে করেন। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া একটি পাওয়ারফুল ধনু পরশুরামেরও ছিল। স্বয়ং বিষ্ণু সেই ধনু দিয়েছিলেন পরশুরামের বাবার বাবাকে। পরশুরাম রামকে চ্যালেঞ্জ করেন। রাম যদি বিষ্ণুর দেয়া এই ধনু ভেঙে ফেলতে পারে - তবেই তিনি মেনে নিতে পারেন যে রামের শক্তি আছে। রাম এই চ্যালেঞ্জে অনেক রেগে গেলেন। তিনি ধনু তুলে তাতে তীর সংযোগ করে পরশুরামকে বললেন, 'ব্রাহ্মণ বলে আপনাকে আমি হত্যা করবো না। কিন্তু আপনার অহংকার ভেঙে দেবো। হয় আপনার স্বর্গ ধ্বংস করে ফেলবো, নয়তো আপনার গতি নষ্ট করে দেবো। আপনিই ঠিক করেন কোন্‌টা করবো'। পরশুরাম বললেন, 'গতি নষ্ট করে দিলে তো আমি আকাশে ছুটাছুটি করতে পারবো না। আপনি আমার স্বর্গ ধ্বংস করে দেন।' রাম তাই করলেন। মাঝ আকাশের স্বর্গ ধ্বংস হয়ে যাওয়াতে পরশুরাম তথা শুক্র গ্রহকে আর মাঝ আকাশে মাঝরাতে দেখা যায় না, কেবল ভোরে ও সন্ধ্যায় দেখা যায়। চমৎকার গল্প। কিন্তু বাস্তব কারণের সাথে এর কোন মিল নেই।

          শুক্র গ্রহের ভেনাস (venus) নামটি এসেছে রোমানদের ভালোবাসার দেবী ভেনাসের নাম থেকে। সৌরজগতের সবগুলো গ্রহের নামই এসেছে গ্রিক বা রোমান লোককাহিনি থেকে। গ্রহগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র শুক্র গ্রহের নামই হয়েছে কোন দেবীর নামে। অন্য সবগুলো গ্রহের নামকরণ করা হয়েহে পুরুষ দেবতার নামে। সে হিসেবে সৌরজগতের গ্রহগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র শুক্র গ্রহই নারী গ্রহ, আর সবগুলোই পুরুষ গ্রহ। কিন্তু ভারতীয় পুরাণে শুক্র গ্রহও একটি পুরুষ গ্রহ।

          গ্রিকরা সূর্য ও চাঁদের পর আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল সুন্দর বস্তুটাকে তুলনা করেছিল তাদের সবচেয়ে সুন্দর দেবী আফ্রোদিতির সাথে। তাই তারা এই গ্রহটির (তখনো জানতো না যে এটা একটি গ্রহ) নাম দিয়েছিল আফ্রোদিতি। আফ্রোদিতির জন্ম সম্পর্কে অনেক মজার গল্প আছে। অনেকে বলে থাকেন আফ্রোদিতির জন্ম হয়েছিল ইউরেনাসের শরীরের একটি অংশ থেকে। আবার অনেকে বলে থাকেন আফ্রোদিতির জন্ম ফেনা থেকে। গ্রিক শন্দ আফ্রোস (aphros) অর্থ ফেনা। সমুদ্র থেকে তাঁর উদ্ভব হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। পরবর্তীতে রোমানরা তাদের ভালোবাসার দেবী ভেনাসের নাম অনুসারে শুক্রগ্রহের নাম রাখে ভেনাস। গ্রিকদের যিনি আফ্রোদিতি, রোমানদের তিনি ভেনাস।

          বিখ্যাত ইতালিয়ান চিত্রকর সান্দ্রো বত্তিচেল্লি ১৪৮০ সালে আঁকা তাঁর 'দি বার্থ অব ভেনাস' ছবিতে দেখিয়েছেন অপরূপ রূপবতী ভেনাস একটি বিশাল ঝিনুকের খোলের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। বাতসের দেবতা জোরে বাতাস দিচ্ছে ভেনাসের গায়ে। সেই বাতাসে উড়ছে ভেনাসের দীর্ঘ সোনালী চুল।


চিত্র 4: বত্তিচেল্লির 'দি বার্থ অব ভেনাস' ছবি থেকে ভেনাসের মুখ

 

মূল ছবি থেকে ভেনাসের মুখটা দেখানো হলো উপরের ছবিতে। ফ্লোরেন্সের উফিজি গ্যালারিতে আসল ছবিটি সংরক্ষিত আছে। এই ছবির অসংখ্য কপি সব জায়গায় পাওয়া যায়।

          রোমান কল্পকাহিনিতে আছে - ভেনাসের সৌন্দর্যে সব দেবতারাই মুগ্ধ এবং সবাই তাকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু কাউকেই পাত্তা দেয় না সুন্দরী ভেনাস। (সুন্দরীরা কোন কালেই কাউকে পাত্তা দেয়নি।) দেবতাদের গুরু বৃহস্পতি অর্থাৎ জুপিটার ভেবেছিলেন ভেনাস অন্তত তাকে না করবে না। কিন্তু জুপিটারও পাত্তা পেলো না। জুপিটার রেগে গেলো। সে কিনা দেবতাদের নেতা, তাকেই না করলো ভেনাস। এত সাহস! নারীস্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না এসব পুরুষ দেবতারা। জুপিটার সব দেবতাদের হাত করে ভেনাসকে জোর করে বিয়ে দিলো আগুনের দেবতা হিফিস্টাসের সাথে। সব দেবতারাই সুদর্শন হবে এমন কোন কথা নেই। হিফিস্টাস ছিলেন কদাকার। স্বাভাবিকভাবেই ভেনাসের জন্য এটা ছিল একটা বিরাট শাস্তি। হিফিস্টাসের জন্যও এটা শাস্তি ছিল। কারণ ভেনাস কখনোই হিফিস্টাসকে ভালোবাসতে পারেনি। হিফিস্টাসকে ভেনাসের মন পাওয়ার জন্য সাইপ্রাসে খুব সুন্দর প্রাসাদ তৈরি করে দেন। সাইপ্রাসের পশ্চিম উপকুলে বেশ কিছু বড় বড় পাথর এখনো 'আফ্রোদিতির পাথর' নামে পরিচিত। পর্যটকদের অনেকেই এগুলো দেখতে যায়। অনেকে বিশ্বাস করে এই পাথরগুলোর চারপাশে সাঁতার কাটলে আফ্রোদিতি বা ভেনাসের মতো সৌন্দর্য লাভ করা যায়। যাই হোক, ভেনাসের যেসব কাহিনি প্রচলিত আছে তাতে দেখা যাচ্ছে ভেনাসের সাথে মঙ্গলগ্রহ থেকে শুরু করে সবগুলো গ্রহের সাথেই ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। আমাদের মঙ্গলগ্রহ সম্পর্কে আলোচনায় সেসব কথা আবার আসবে।

 

শুক্র গ্রহের প্রতীক

 

মৌলিক পদার্থগুলিকে ইংরেজি বর্ণের সাহায্যে সংকেত দিয়ে লেখা হয় সেটা তোমরা জানো। যেমন মৌলিক পদার্থ তামা বা কপারের সংকেত হলো Cu। অক্ষরের বদলে অনেকক্ষেত্রে প্রতীক দিয়েও এদের নির্দেশ করা হয়। তামা বা কপারের যে প্রতীক, প্ল্যানেট ভেনাস বা শুক্র গ্রহেরও একই প্রতীক। জীববিজ্ঞানে স্ত্রীবাচক প্রতীক হলো একটি বৃত্তের নিচে লাগানো একটি যোগ চিহ্ন। শুক্র গ্রহের  প্রতীক হলো এই স্ত্রীবাচক প্রতীক। শুক্র গ্রহের এই প্রতীক হওয়ার কারণ খুবই স্পষ্ট। সৌরজগতের গ্রহগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র ভেনাস বা শুক্র গ্রহের নামকরণ করা হয়েছে একজন নারীর নামে। তাই এই গ্রহের প্রতীক নারীর প্রতীক।

          আমরা এই বইয়ের আরো পরে দেখবো যে শুক্র গ্রহের সবগুলো জায়গা, পাহাড়-পর্বত, গহ্বর, আগ্নেয়গিরি কিংবা উপরিতলের অন্যান্য অংশের সবগুলোর নামকরণ করা হয়েছে নারীদের নামে। সেখানে ইংল্যান্ডের রানিদের নাম যেমন আছে, তেমনি আছে ক্লিওপেট্রার নাম। আছে মেরি উলস্টোনক্রাফট, সিমন দ্য ব্যুভেয়র-এর মতো নারীবাদী লেখকদের নাম। আছেন লেখক আগাথা ক্রিস্টি, বিয়াট্রিক্স পটার প্রমুখ। আছেন বিজ্ঞানী আইরিন জুলিও-কুরি, লিজা মেইটনার।   এ বিষয়ে আমরা আরো বিস্তারিত আলোচনা করবো পরে। তার আগে দেখে নিই শুক্র গ্রহের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এ ইতিহাস শুক্র গ্রহের বৈজ্ঞানিক ইতিহাস। 

পর্ব - ৫

No comments:

Post a Comment

Latest Post

অলিভিয়া নিউটন-জন

  কাজের সুবাদে মাঝে মধ্যে যেতে হয় অস্টিন হাসপাতালে। ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ সেখানে ক্লিনিক্যাল কাজকর্ম শেখে, আবার অনেকেই পাস কর...

Popular Posts