Thursday 22 October 2020

যে গ্রহে সূর্য উঠে পশ্চিম দিকে - পর্ব ৩

 



পৃথিবীর আকাশে শুক্র

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেকগুলো কবিতায় শুকতারার কথা আছে। যেমন স্ফুলিঙ্গে আছে:

হাসিমুখে শুকতারা,

লিখে গেল ভোররাতে।

                                                           আলোকের আগমনী

                                                           আঁধারের শেষপাতে।

 

খুব ভোরে সূর্য উঠার আগে পুবাকাশে শুকতারা দেখা যায়। আবার সন্ধ্যাবেলা পশ্চিমাকাশে দেখা যায় সন্ধ্যাতারা। সন্ধ্যাতারার কথাও রবীন্দ্রনাথের কবিতায় গানে কতভাবে এসেছে। যেমন বিচিত্র পর্যায়ের গানে আছে:

 

মাটির প্রদীপখানি আছে মাটির ঘরের কোলে,
সন্ধ্যাতারা তাকায় তারি আলো দেখবে বলে॥

 

পৃথিবীর আকাশে সবচেয়ে উজ্জ্বল যে বস্তুটিকে আমরা দিনের বেলায় প্রতিদিন দেখি তা হলো সূর্য। আর রাতের বেলায় দেখি জ্বলজ্বলে চাঁদ। চাঁদের নিজের আলো নেই, কিন্তু সূর্যের আলো চাঁদের গায়ে প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে আসে বলে আমরা চাঁদকে দেখতে পাই পৃথিবী থেকে। সূর্য এবং চাঁদের পর তৃতীয় যে উজ্জ্বল বস্তুটি পৃথিবীর আকাশে দেখা যায় - সেটা শুক্রগ্রহ। মানুষ হাজার বছর ধরে এগুলো দেখছে। সূর্য উঠার আগে পূর্বাকাশে এই গ্রহকে দেখা যায় বলে তার নাম দিয়েছে মর্নিং স্টার, যাকে আমরা বাংলায় বলি শুকতারা। আবার সূর্য ডোবার পর পশ্চিমাকাশে এই গ্রহকে দেখা যায় বলে তার নাম দিয়েছে ইভনিং স্টার, যাকে আমরা বাংলায় বলি সন্ধ্যাতারা। শুকতারা এবং সন্ধ্যাতারা যে দুটো আলাদা জিনিস নয় - সেটাও মানুষ জেনেছে মাত্র কয়েক শ বছর আগে। আর শুকতারা বা সন্ধ্যাতারা যে তারা বা নক্ষত্র নয়, সেটাও মানুষ জেনেছে মাত্র কয়েক শ' বছর আগে। শুক্রগ্রহ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের গ্রহ। কাছের গ্রহ বলেই কি শুক্র গ্রহকে এত উজ্জ্বল দেখায় আকাশে? আসলে ঠিক তা নয়। নক্ষত্র গ্রহ কিংবা উপগ্রহের উজ্জ্বলতার কিছু বৈজ্ঞানিক কারণ আছে।

          আগের পৃষ্ঠার ছবিতে দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর আকাশে শুক্রগ্রহ আরেকটি উজ্জ্বল নক্ষত্র স্পাইকার (spica) চেয়ে বেশি উজ্জ্বল। এর কারণ হচ্ছে শুক্রগ্রহের আলবিডো (albedo) অনেক বেশি। কোন গ্রহ উপগ্রহ কতটা উজ্জ্বল তা পরিমাপ করার জন্য বিজ্ঞানীরা যে কথাটি ব্যবহার করে তা হলো আলবিডো। সূর্য থেকে আলো এসে যখন কোন গ্রহ বা উপগ্রহের উপর পড়ে - তখন গ্রহ বা উপগ্রহটি সেই আলোর কিছু অংশ শোষণ করে ফেলে এবং কিছু অংশ প্রতিফলন পদ্ধতিতে ফিরিয়ে দেয়। সূর্যের আলোর শতকরা যত ভাগ গ্রহ বা উপগ্রহ থেকে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে সেই পরিমাপকে বলে আলবিডো।

          আমাদের পৃথিবীর আলবিডো 0.33, অর্থাৎ সূর্য থেকে যে পরিমাণ আলো পৃথিবীতে আসে তার শতকরা 33 ভাগ পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রতিফলিত হয়। চাঁদের আলবিডো সেই তুলনায় অনেক কম; মাত্র 0.12। অর্থাৎ চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে সূর্যের আলোর মাত্র 12 ভাগ প্রতিফলিত হয়। পৃথিবী থেকে চাঁদকে যেরকম উজ্জ্বল দেখায়, পৃথিবীর বাইরে থেকে পৃথিবীকে চাঁদের তিনগুণ বেশি উজ্জ্বল দেখাবে। শুক্রগ্রহের আলবিডো 0.76। শুক্রের পৃষ্ঠ থেকে সূর্যের আলোর শতকরা 76 ভাগ প্রতিফলিত হয়। দেখা যাচ্ছে শুক্রগ্রহ চাঁদের চেয়ে ছয় গুণেরও বেশি উজ্জ্বল। শুক্রগ্রহের উচ্চ তাপমাত্রা এবং ঘন বায়ুমন্ডলের কারণে সূর্যের আলো খুব বেশি শোষিত হয় না বলেই সেখান থেকে আলোর প্রতিফলন বেশি হয়। শুক্র গ্রহের চারপাশে ঘন গ্যাসের আস্তরণের ফলে সূর্যালোক সেখানে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং বেশিরভাগই প্রতিফলিত হয়ে যায়।

          শুক্রের বায়ুমন্ডল সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো একটু পরে। তার আগে দেখে নিই বিভিন্ন সংস্কৃতি ও সভ্যতায় শুক্র গ্রহ সম্পর্কে কী কী ধারণা ছিল। শুক্র গ্রহকে কেন সবচেয়ে সুন্দর দেবীর সাথে তুলনা করা হতো?

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts