Monday 9 July 2018

প্রাপক: ড. মুহাম্মদ ইউনূস




শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভিনের সন্তান সুমন জাহিদ মারা গেছেন ১৪ জুন ২০১৮। আমরা এখনো নিশ্চিত নই তাঁর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে। তিনি কি আত্মহত্যা করেছেন, না কি তাঁকে হত্যা করা হয়েছে আমরা জানি না। চির-প্রতিবাদী সুমন জাহিদ জীবনে প্রতিবাদ করেছেন, লড়াই করেছেন কত ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ২০০৭ সালে ডক্টর ইউনূস যখন রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন - সেই সময়ের কিছু ঘটনা ধরা রয়েছে এই পুরনো লেখায় - যেখানে আছে সুমন জাহিদের প্রসঙ্গ।



প্রাপক: ড. মুহাম্মদ ইউনূস
প্রদীপ দেব



স্যার,

বাংলাদেশের সকল নাগরিকের প্রতি দুটো খোলা চিঠি লিখে আপনি নাগরিক শক্তি নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির খোলনলচে পালটে দিয়ে একটি সম্পুর্ণ নতুন ধারার রাজনীতি প্রবর্তনের লক্ষ্যেই আপনার এই প্রয়াস। আপনার এই মহান প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই।

আপনার নোবেল পুরস্কার পাবার সাথে সাথে সারা বাংলাদেশ একাত্ম হয়ে আপনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে, আনন্দে গর্বে এভারেস্ট শৃঙ্গে উঠে গেছে, সমস্ত রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক বিভেদ ভুলে গিয়ে নোবেল জয়ের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়েছে। কিন্তু আপনি নিশ্চয় খেয়াল করেছেন মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই সে উচ্ছ্বাস বিভক্ত হয়ে গেছে। কারণ নোবেল বিজয়ী ডঃ ইউনূস সবার কাছে সমান গ্রহণযোগ্য হলেও রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ডঃ ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতা সবার কাছে সমান নয়।

১১/০২/২০০৭ তারিখে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের প্রতি আপনি চিঠি লিখে আপনার রাজনৈতিক দল গঠন করার পক্ষে বিপক্ষে মতামত চেয়েছেন। আপনি লিখেছেন, আপনার কাছে আমি এই চিঠিটি লিখছি এর জবাবে আপনার কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে একটি চিঠি পাওয়ার আশায়। আপনার মতো মানুষকে ব্যক্তিগত চিঠি লেখার সুযোগ পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। কয়েক লক্ষ মানুষ সে মহান সু্যোগ গ্রহণ করে আপনাকে চিঠি লিখেছেন, ইমেইল করেছেন ও এসএমএস পাঠিয়েছেন। এর সবগুলো আপনি নিজেই পড়েছেন এরকম অবাস্তব চিন্তা করা উচিত নয়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় হলে তা আপনার কর্মীরা নিশ্চয় আপনাকে দেখিয়ে থাকবেন।

১৪/০২/২০০৭ তারিখের দৈনিক সংবাদে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের সন্তান সুমন জাহিদের একটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। আপনাকে লেখা এ খোলা চিঠিটি আমার কাছে মনে হয়েছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এতে আপনার যোগাযোগের ঠিকানাকে মারাত্মক ভুল বলা হয়েছে। 

সুমন জাহিদ লিখেছেন, আপনার পাঠানো খোলা চিঠি যা ১১-২-২০০৭ইং সব দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচার করেছে, সেখানে ঠিকানায় মারাত্মক ভুল আছে। আপনারা প্রচার করেছেন যোগাযোগের ঠিকানা:

ড. মুহাম্মদ ইউনূস
হাল মারস
৬/ডি, ৬৬ আউটার সার্কুলার রোড
মগবাজার, ঢাকা-১২১৭।

অথচ আউটার সার্কুলার রোড নামে ঢাকা সিটি করপোরেশন-এর নথিতে এখন আর কোন সড় কের নাম উল্লেখ নেই (এই নামে কোন রোড নেই)। পুরনোটা ছিল ৬৬, বড় মগবাজার। গত ২০-৩-২০০২ইং তারিখে সিটি করপোরেশনের এক আদেশ (২১১১/প্রঃবিঃ/৪০০) বলে মৌচাক মোড় হতে মগবাজার পর্যন্ত রাস্তাটিতে এবং এর উভয় পার্শ্ব শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক নামে নামকরণ করা হয় এবং সেই সঙ্গে উভয় পাশের সব হোল্ডিং নম্বরও পরিবর্তন হয়। আপনাদের বর্তমান হোল্ডিং নং- ৫, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক। এই ভুলটা সম্ভবত অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়ে থাকতে পারে। তবে এর সংশোধনটা অতি জরুরি। ১৩-১২-২০০৬ইং দৈনিক প্রথম আলো নারীমঞ্চ পাতা পড়লেই এ ব্যাপারে আপনার সব তথ্য পাবেন। আশা করি স্বাধীনতা যুদ্ধে একজন শহীদের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করবেন। 

আশা করেছিলাম এ ব্যাপারটি আপনার নজরে আসবে। কিন্তু আপনার পরের চিঠিতেও (২২/২/২০০৭) যখন আপনি আপনার পুরনো ঠিকানাই ব্যবহার করেছেন বুঝতে পেরেছি সুমন জাহিদ সহ আমরা যে ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি আপনার কাছে তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে কি সুমন জাহিদের দেয়া তথ্য সঠিক নয়?

২২/২/২০০৭ তারিখে নাগরিকের প্রতি আপনি আপনার রাজনৈতিক দল গঠন করার ঘোষণা দিয়ে যে চিঠিটি লিখেছেন সে প্রসঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। যাঁরা আপনাকে রাজনীতিতে যোগদান করা থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেছেন তাঁদের আপনি বলেছেন, আল্লাহই মানুষকে সম্মান দেন। সম্মান নিতে হলে তাঁকেই নিতে হবে। আপনার এরকম যুক্তি মুক্তচিন্তার পরিপন্থি। যে কলুষিত রাজনীতিকে বিশুদ্ধ করার ইচ্ছায় আপনি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করছেন সে কলুষিত রাজনৈতিক দলগুলোর বেশির ভাগ দূষিত নেতাই কথায় কথায় আল্লাহর নাম নেন। নিজেদের ব্যর্থতার দায় অলৌকিক সৃষ্টিকর্তার ওপর চাপিয়ে দেয়া অতি পুরনো পদ্ধতি। সে পদ্ধতি আপনাকে মানায় না।

প্রবাসীদের উদ্দেশ্যে আপনি লিখেছেন, আপনারা যে যে দেশে আছেন সেখানে সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে তুলুন। আপনাদের কর্মস্থলে কিংবা বাড়িতে কার্যালয় স্থাপন করুন। যোগাযোগ কেন্দ্র স্থাপন করুন। ইন্টারনেটে যোগাযোগ, মতবিনিময়ের এবং মত প্রচারের যত ব্যবস্থা আছে তার সদ্ব্যাবহার করুন। দেশে আপনার নিজের গ্রামে বা শহরে সমর্থক গোষ্ঠী সৃষ্টির জন্য উদ্যোগ নিন। সম্ভব হলে একবার সপ্তাহ বা দুসপ্তাহের জন্য দেশে এসে ঘুরে যান। নিজের এলাকায় গিয়ে সংগঠন সৃষ্টি করে দিয়ে আসুন। তাদের আর্থিক সহায়তা দেয়ার নিশ্চয়তা দিন। নিজের এলাকার সৎ ও যোগ্য প্রার্থী চিহ্নিত করে তাদের সঙ্গে আলাপ করে তাদের নাগরিক শক্তিতে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করুন। আমাদের সঙ্গে ই-মেইলে ক্রমাগত যোগাযোগ রাখুন এবং আপনাদের কাজের বর্ণনা দিন। আমাদের প্রতি পদে পদে পরামর্শ দিন। সম্ভব হলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় পর্যন্ত চাকরি কিংবা ব্যবসা যে কাজেই থাকুন না কেন, ছুটি নিয়ে দেশে চলে আসুন। আপনার নিজের হাতেই দেশের নতুন রাজনীতি গড়ার গৌরব অর্জন করার এখনই সুযোগ। বোঝা যাচ্ছে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর মত আপনিও প্রবাসীদের কাজে লাগাতে চাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু তাদের ভোটাধিকার প্রশ্নে আপনারও মাথাব্যথা নেই। ভোট দিতে হলে প্রবাসীদের দেশে গিয়ে ভোটার হতে হবে, ভোট দিতে হবে। আপনি লিখেছেন কর্মস্থলে আপনার রাজনৈতিক দলের কার্যালয় স্থাপন করার জন্য। কাজটি কতটুকু সমর্থনযোগ্য?

আপনার দলের হয়ে কাজ করার জন্য দীর্ঘ ছুটি নিয়ে দেশে চলে যেতে আহবান করেছেন প্রবাসী কর্মজীবীদের। রাজনীতি করার জন্য ছুটি চাইলেই কি দিয়ে দেবেন কর্তৃপক্ষ? যাঁরা দেশের ভেতরেও এলাকার বাইরে কর্মরত আছেন তাঁদের উদ্দেশ্যেও আপনি লিখেছেন, সম্ভব হলে কর্মক্ষেত্র থেকে কয়েক মাস দীর্ঘ বিরতি নিয়ে বাড়ি চলে যান। দেশে বা বিদেশে কোথাও কি সম্ভব এটা? আজ গ্রামীণ ব্যাংকের কোন কর্মকর্তা যদি বলেন যে রাজনৈতিক কাজের জন্য দীর্ঘ ছূটি চাই দেয়া হবে তাঁকে? নাগরিক শক্তির কাজে হয়তো দেয়া হতে পারে। কিন্তু তিনি যদি হয়ে থাকেন আওয়ামি লিগের বা বিএনপির সমর্থক?

এখানেই নোবেল বিজয়ী আর রাজনীতিবিদের পার্থক্য। রাজনীতি করতে গেলে যে অনেক ওজনহীন কথা বলতে হয়, বলা হয়ে যায় তা তো আমরা আপনার দল গঠন প্রক্রিয়া শুরু হতে না হতেই দেখতে পাচ্ছি। আমরা এখনো জানিনা আপনার আদর্শের সাথে অন্যান্য দলের আদর্শের পার্থক্য কোথায়। সব দলেই ভালো ভালো আদর্শের কথা থাকে। সে কথা কেউ রাখেনা। আপনি আপনার কথা রাখবেন এ আশা আমাদের।

একটা ছোট্ট প্রশ্ন আমাদের মনে জেগেছে। তা হলো ২১শে ফেব্রুয়ারি দেশে থেকেও আপনি শহীদ মিনারে যাননি। কেন? 


০২ মার্চ, ২০০৭।
ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts