Thursday 21 June 2018

যুক্তি হোক মুক্তির সোপান



২০০৭ এর বইমেলায় প্রকাশিত যুক্তি পত্রিকাটি দুরন্ত সাহসের প্রতিচ্ছবি। সম্পাদক অনন্ত দাস দুঃসাধ্য একটি কাজ করেছেন যুক্তি প্রকাশের মাধ্যমে। মুক্তমনায় ইলেকট্রনিক বই আকারে যুক্তি প্রকাশিত হয়েছে ২০০৭ এর এপ্রিলে। সে সময়েই যুক্তি আমার হাতে এসেছে। তখন দ্রুত চোখ বুলিয়ে গিয়েছি। কিছু কিছু লেখা মুক্তমনার ওয়েব সাইটে আগেই প্রকাশিত হয়েছিলো। তার সাথে বেশ কিছু নতুন লেখা নিয়ে সমৃদ্ধ যুক্তি। নানারকম কাজের মাঝে কয়েকবার চেষ্টা করেছি দ্রুত পড়ে ফেলতে। কিন্তু যুক্তির লেখাগুলো দ্রুত পঠনের জন্য নয়। এগুলো পড়ে আত্মস্থ করাটা খুব জরুরি। এ বোধ থেকে যুক্তি পড়েছি অনেক সময় নিয়ে। এখন এক ধরনের তাড়না অনুভব করছি এ সম্পর্কে দুটো কথা বলার।



ষোল জন যুক্তিবাদী মানুষের প্রতিকৃতি স্থান পেয়েছে যুক্তির প্রচ্ছদে। এই অসাধারণ মানুষগুলো আমাদের হাজার বছরের ক্রমাগত চিন্তার অন্ধ অনুকরণকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নতুন ভাবে নতুন দৃষ্টিকোণে ভাবনার নতুন যুক্তির খোরাক যুগিয়েছেন। যুক্তির প্রচ্ছদে এঁদের স্থান দেয়ায় যুক্তি সমৃদ্ধ হয়েছে নিঃসন্দেহে। তবে ভেতরের কোন পাতায় প্রচ্ছদের ছবিগুলোর পরিচিতি থাকলে অনেকের জন্য সুবিধে হতো। বিশেষ করে যাঁরা এঁদের নামের সাথে পরিচিত হলেও হয়তো ছবির সাথে নন।

যুক্তির সম্পাদকীয়তে চমৎকার ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যুক্তির প্রয়োজনীয়তা। তবে একটা ব্যাপারে সম্পাদকের সাথে আমার একটু মতদ্বৈততা আছে। সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, এই সংখ্যায় প্রকাশিত সকল লেখাই লেখকগণের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, অভিমত এবং তথ্য সংকলন; এর সাথে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিল কোনোভাবেই (প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে) সম্পৃক্ত নয়। বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিল যুক্তির প্রকাশক। যুক্তিতে প্রকাশিত লেখাগুলো নিশ্চয়ই বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিলের মানসিকতার সাথে মিলে যায়। যুক্তিবাদী কাউন্সিলের নিজস্ব মতবাদ আছে বলেই যুক্তি তাদের মুখপত্র। একান্ত ব্যক্তিগত লেখা যুক্তিতে হয়তো চিঠি আকারে প্রকাশিত হতে পারে, কিন্তু পূর্ণ রচনা প্রকাশিত হলে প্রকাশকের উপর কিছুটা দায়িত্ব এসেই পড়ে যা এড়ানোর চেষ্টা করা যুক্তিগ্রাহ্য নয়।

যুক্তির প্রত্যেকটি লেখাই আমাদের চিন্তার জগতে বিরাট সংযোজন হিসেবে কাজ করবে। প্রফেসর অজয় রায়ের বিজ্ঞান ভাবনা ব্রুনো থেকে আরজ আলী মাতুব্বর-এ যে সাহসী উচচারণে প্রশ্ন করা হয়েছে, ডঃ হুমায়ূন আজাদের খুনিরা কিংবা সাংবাদিক ও বিচারকদের হত্যাকারীরা যদি বলে যে আমাদের ইচ্ছে শক্তি নেই - আমরা তো কলের পুতুল আল্লাহ্‌র ইচ্ছেতেই চলি, কাজ করি, আল্লাহ্‌ই আমাদেরকে দিয়ে হুমায়ূন আজাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছেন, সাংবাদিক ও বিচারকদের হত্যা করিয়েছেন। সাক্ষ্য হিসেবে আদালতে যদি কোরানের এসব বাণী উপস্থাপন করা হয়, তাহলে মাননীয় আদালত কী করে কোরানের বাণীর বিপরীতে কাজ করবেন! সে প্রশ্নের উত্তর আমাদের সবার জানা। নিজেদের স্বার্থে নিজেদের পছন্দমত সৃষ্টিকর্তাকে ব্যবহার করার জন্যই মানুষ সৃষ্টিকর্তার ধারণা তৈরি করে নিয়েছে এবং তাকে সুবিধে মত ব্যবহার করে চলেছে। সে কারণেই সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কিত বেশির ভাগ যুক্তিই স্ববিরোধিতায় ভরা।

অভিজিৎ রায়, বন্যা আহমেদ, জাহেদ আহমদ তাঁদের রচনায় স্বমহিমায় ভাস্বর। ফরিদ আহমদ এর মোহনীয় মোনালিসা ভিন্ন স্বাদের গবেষণাধর্মী রচনা। লিওনার্দো দা ভিন্‌চির মোনালিসা নামের মোহময়ী ছবিটির কতরকম বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এখন সম্ভব হচ্ছে তা সত্যিই আশ্চর্যজনক। একটি ছবি - অথচ কতমাত্রিক তার বিশ্লেষণ। মিহির কান্তি চৌধুরীর ড্যান বার্কারের রচনা থেকে অনুবাদটি সুখপাঠ্য। তবে মূল লেখকের পরিচিতি থাকলে ভালো হতো।

যুক্তির এই সংখ্যায় একটি মাত্র কবিতা স্থান পেয়েছে - মৌ মধুবন্তীডঃ ইউনূস - শান্তি পুরষ্কার। সত্যি বলতে কী - আমার মনে হচ্ছে যুক্তির এই সংখ্যার সবচেয়ে দুর্বল অংশ হলো এ কবিতাটির সংযোজন। কবিতায় কবি আসলে কী বলতে চেয়েছেন এবং কেন তা যুক্তির দৃষ্টিতে যুক্তিগ্রাহ্য হলো তা বুঝতে পারছি না। কবিতার কয়েকটি লাইন এরকম,

কোলে নিয়ে নাচো অমর্ত্য সেনে
এখনো হয়ে আছো গোবেচারা
বাঙালি
হওনি এখনো অহংকারী বাংলাদেশী
তোমাদের নেই কোন বাদ্যযন্ত্রী
নেকাব ছাড়া বাংলার মন্ত্রী

কী বোঝাতে চেয়েছেন কবি এখানে? অমর্ত্য সেন আর ডঃ ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আমাদের স্পষ্ট বিভাজন থাকা দরকার? আমাদের বাঙালি হওয়ার চেয়েও বাংলাদেশী হওয়া বেশি জরুরি? আমাদের যথেষ্ট পরিমাণ বাদ্যযন্ত্রী নেই? বাংলার মন্ত্রীর নেকাব থাকা জরুরি? অযৌক্তিক কথামালা দিয়ে অনেক কবিতা তৈরি হতে পারে। কিন্তু তা যুক্তিতে স্থান পাবে কেন? আসলে মৌ মধুবন্তীর কবিতাটি মোটেও কবিতা হয়ে উঠতে পারেনি। যা হয়েছে তা যুক্তির মূল বৈশিষ্টের পরিপন্থী।

যুক্তির মুক্তমনা ই-বুকের ভূমিকায় অভিজিৎ রায় বলেছেন, অনন্ত বিষবৃক্ষের পাতায় পাতায় কাঁচি চালায়নি, বরং কুঠারের কোপ বসিয়েছে একদম গভীরে, বিষবৃক্ষের গোড়াতেই। অভিজিৎ রায়ের সাথে একমত হয়ে এটুকু বলতে চাই যে - বিষবৃক্ষের গোড়ায় কোপ মেরে থেমে থাকার কোন সুযোগ নেই। কারণ বিষবৃক্ষের প্রতিটি শাখা থেকে জন্ম নেয় নতুন নতুন বিষবৃক্ষ। তাই যুক্তির অস্ত্রে নিয়মিত শান দেয়ার জন্য অযৌক্তিক কুযুক্তির বিষবৃক্ষকে সমূলে উৎপাটন করার জন্য যুক্তি নিয়মিত প্রকাশিত হবে এটাই কাম্য। যুক্তি হয়ে উঠুক মুক্তির সোপান। অজ্ঞানতা থেকে মুক্তি, কুসংস্কার থেকে মুক্তি, উপাসনা ধর্মের অন্ধ শিকল থেকে মুক্তি।


ফেব্রুয়ারি ৯, ২০০৮
তাসমানিয়া, অস্ট্রেলিয়া।
******

অনন্তবিজয় দাস যুক্তির যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছেন তাঁর শেষ দিন পর্যন্ত। ২০১৫ সালের ১২ মে অনন্তকে হত্যা করে মৌলবাদী জঙ্গিরা। 

২০ জুন ২০১৮
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া

No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts