Thursday 6 September 2018

বইয়ের দাম




"বইমেলার ছবি দেখেছো?"

"দেখলাম তো। সেজেগুঁজে একেবারে নতুন সাদা-কালো বর্ণমালা শাড়ি পরে। পার্লারে গিয়েছিলে নাকি মেলায় যাবার আগে?"

"যাবো না? একুশে ফেব্রুয়ারিতে বইমেলায় যাবো - ভূতের মতো যাবো নাকি? একুশের ফ্যাশান ফলো করতে হবে না?"

"কী বই কিনলে?"

"কিনবো কীভাবে? তোমার বইগুলোর যা দাম! দুই তিনশ' টাকার নিচে কোন বইই নেই। কেনার উপায় আছে?"

"তবে কী করলে?"

"ঘুরলাম। কিছু সেল্‌ফি তুললাম। আর পিৎজা-হাটে গিয়েছিলাম।"

"বইমেলায় পিৎজা-হাট?"

"আরে না। বেইলি রোডে। বন্ধুদের সাথে গিয়েছিলাম।"

"দাম কেমন ওখানে?"

"খুব একটা বেশি না, চলে। আমরা চারজনে খেয়েছি তো - তেইশ শ পঞ্চাশ টাকায় হয়ে গেছে।"

"দুই হাজার তিন শ পঞ্চাশ টাকা!"

"আসলে দুই হাজার তিন শ টাকা। পঞ্চাশ টাকা টিপ্‌স দিয়েছি। ওয়েটারটা খুব কিউট ছিল। হা হা হা।"

সে হাসে। এরকম হাসিখুশি তরুণ-তরুণীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে এতে আমার খুশি হবার কথা। কিন্তু পারছি না। কোথাও একটা যন্ত্রণা হচ্ছে।

সৈয়দ মুজতবা আলী আজ থেকে ৬৫ বছর আগে 'বই কেনা' প্রবন্ধটিতে লিখেছিলেন:

বাঙালির "মুখে ঐ এক কথা 'অত কাঁচা পয়হা কোথায়, বাওয়া, যে বই কিনব?'
কথাটার মধ্যে একটুখানি সত্য - কনিষ্ঠাপরিমাণ - লুকনো রয়েছে। সেইটুকু এই যে, বই কিনতে পয়সা লাগে - ব্যস্‌। এর বেশি আর কিছু নয়।
            বইয়ের দাম যদি আরো কমানো যায়, তবে আরো অনেক বেশি বই বিক্রি হবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তাই যদি প্রকাশককে বলা হয়, 'বইয়ের দাম কমাও', তবে সে বলে 'বই যথেষ্ট পরিমাণে বিক্রি না হলে বইয়ের দাম কমাবো কি করে?'
            'কেন মশাই, সংখ্যার দিক দিয়ে দেখতে গেলে বাঙলা পৃথিবীর ছয় অথবা সাত নম্বরের ভাষা। এই ধরুন ফরাসি ভাষা। এ ভাষায় বাঙলার তুলনায় ঢের কম লোক কথা কয়। অথচ যুদ্ধের পূর্বে বারো আনা, চৌদ্দ আনা, জোর পাঁচ সিকে দিয়ে যে-কোন ভাল বই কেনা যেত। আপনারা পারেন না কেন?'
            'আজ্ঞে, ফরাসি প্রকাশক নির্ভয়ে যে-কোন ভালো বই এক ঝটকায় বিশ হাজার ছাপাতে পারে। আমাদের নাভিশ্বাস ওঠে দু'হাজার ছাপাতে গেলেই, বেশি ছাপিয়ে দেউলে হব নাকি?'
            তাই এই অচ্ছেদ্য চক্র। বই সস্তা নয় বলে লোকে বই কেনে না, আর লোকে বই কেনে না বলে বই সস্তা করা যায় না।
............
বাঙালির মতো "এরকম অদ্ভুত সংমিশ্রণ আমি ভূ-ভারতের কোথাও দেখিনি। জ্ঞানতৃষ্ণা তার প্রবল, কিন্তু কেনার বেলা সে অবলা। আবার কোনো কোনো বেশরম বলে, 'বাঙালির পয়সার অভাব' বটে? কোথায় দাঁড়িয়ে বলছে লোকটা এ-কথা? ফুটবল মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে, না সিনেমার টিকিট কাটার 'কিউ' থেকে?"
......

৬৫ বছরে একটুও কি বদলেছে আমাদের বই কেনার অভ্যাস? বদলেছে নিশ্চয়। এখন আমরা ফুটবল খেলি না, খেলা দেখিও না। আর সিনেমা হলগুলোর বেশিরভাগ বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আমরা ক্রিকেট দেখি। আর ফাস্ট ফুড খাই আর সোশাল মিডিয়া করি।

এই ৬৫ বছরে সবকিছুর দাম বেড়েছে, মানুষের বেতনও বেড়েছে, ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছেসোনার দাম বেড়েছে, জমির দাম বেড়েছে। এখন অবশ্য সেগুলো সবাই কিনতে পারেন না। কিন্তু সবাই যেগুলো কিনতে পারেন, যেমন চাল - দাম বেড়েছে প্রায় তিরিশ গুণ, মাছের দাম বেড়েছে প্রায় দুইশ' গুণ। সেই তুলনায় বইয়ের দাম বেড়েছে খুব বেশি হলে বিশ গুণ। কিন্তু সবাই দোষ দেয় শুধু বইয়ের দামের। 

বাংলাদেশে যে বড় পিৎজা তিন হাজার টাকা দাম দিয়ে কিনে খাবার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে মানুষ, সেই পিৎজা অস্ট্রেলিয়ায় দশ ডলার মানে ছয় শ টাকায় পাওয়া যায়। অস্ট্রেলিয়ায় একটি দুইশ' পৃষ্ঠার বইয়ের দাম কমপক্ষে বিশ ডলার অর্থাৎ বারো শ টাকাআর বাংলাদেশে একটা দুই শ পৃষ্টার বইয়ের দাম সবচেয়ে বেশি হলে তিন শ টাকা। অস্ট্রেলিয়ার পাঁচ গুণ দাম দিয়ে পিৎজা খাবার মানুষ আছে বাংলাদেশে অথচ চার ভাগের এক ভাগ দাম দিয়ে বই কেনার মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না।


এর মাঝেও অনেক ব্যতিক্রমী মানুষ আছেন যারা বই কেনেন। মূলত তাঁদের জন্যই বই-প্রকাশকেরা এখনো বইয়ের মেলা করতে সাহস পান।

"ভেবে-চিন্তে অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করে বই কেনে সংসারী লোক। পাঁড় পাঠক বই কেনে প্রথমটায় দাঁতমুখ খিঁচিয়ে, তারপর চেখে চেখে সুখ করে করে, এবং সর্বশেষে সে কেনে ক্ষ্যাপার মত, এবং চুর হয়ে থাকে তার মধ্যিখানে। এই একমাত্র ব্যসন, একমাত্র নেশা যার দরুন সকালবেলা চোখের সামনে সারে সার গোলাপী হাতি দেখতে হয় না, লিভার পচে পটল তুলতে হয় না।"

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts