Friday 22 June 2018

প্রসঙ্গ: বাংলাদেশের শিক্ষা



বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কিছু শিক্ষা-ব্যবসায়ী ছাড়া আর কেউ সন্তুষ্ট আছেন বলে আমার মনে হয় না। স্বাধীনতার আগে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কেমন ছিল আমি জানি না। তবে মনে হয় গুণগত মান আজকের তুলনায় খুব একটা খারাপ ছিল না। কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁদের প্রায় সবাই তখনকার পূর্ব-পাকিস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফসল। অনেককেই বলতে শুনি - স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জাতীয় পরীক্ষায় গণ-নকলের মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষায় দুর্নীতির বীজ রোপিত হয়। তারপর আমরা পড়ছি তো পড়ছিই। এই পড়া মানে পড়াশোনা নয়, এই পড়া হলো পতন। আমি জানি এতটা জেনারালাইজড করে ফেলা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু শিক্ষার সামগ্রিক পতনের কাছে আমাদের অর্জন এতটাই সামান্য যে তাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোর চেষ্টা করলে নিজেকেই ফাঁকি দেয়া হয়।
           
স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের শিক্ষা নিয়ে নানারকম ব্যবস্থা-অব্যবস্থার কমিটি গঠিত হয়েছে। একটা গঠনমূলক পরিপূর্ণ শিক্ষানীতির লক্ষ্যে অনেকগুলো কমিশন গঠিত হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ এখনো কিছু হয়নি। শিক্ষায় আমাদের প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী, শিক্ষক সবকিছুরই সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু কমে গেছে গুণগত মান। একসময় যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে পরিচিত ছিল - সে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান আজ বিশ্বের প্রথম পাঁচহাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একেবারে শেষের দিকে। আশ্চর্যের বিষয় হলো আমাদের বেশির ভাগেরই যেন তাতে কিছুই যায় আসে না।
           
সত্যি বলতে কী - বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ শুধুমাত্র সুস্থভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রামেই এত  ব্যস্ত যে তাঁদের ওপর যখন যা চাপিয়ে দেয়া হয় তারা তা মেনে নিতে বাধ্য হন। যখন যাদের হাতে ক্ষমতা থাকে তখন তারা তাদের মত করে একটা কিছু পরিবর্তন করে - আর জনগণ তা বাধ্য হয়ে মেনে নেয়।   

১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১ম শ্রেণী থেকে স্নাতকোত্তর পর্যায় পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। এই বিশ বছরের আমার বাংলাদেশী ছাত্রজীবনে নানারকম প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় রাজনৈতিক আন্দোলন দেখেছি - কিন্তু একবারও অতি প্রয়োজনীয় শিক্ষা-আন্দোলন ঘটতে দেখিনি। ছাত্র-ইউনিয়ন সহ কয়েকটি বাম সংগঠন মাঝে মাঝে শিক্ষা-আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে - কিন্তু তাও সীমাবদ্ধ থেকেছে শিক্ষা-উপকরণের দাম কমানো, টিউশন ফি কমানোর স্লোগানে। শিক্ষকরাও নানারকম আন্দোলন করেছেন - তাদের বেশির ভাগই হলো রাজনৈতিক কারণে কিংবা নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে। সুতরাং আমাদের সবার চোখের সামনে দিয়ে ধীরে ধীরে আমাদের শিক্ষাকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে।
           
যে সিস্টেমের ভেতর দিয়ে লেখাপড়া করে এসেছি তার বাইরেও কোন সিস্টেম - বা অন্যরকম ভালো কোন সিস্টেম থাকতে পারে তা আমি জানতামই না দেশের বাইরের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার আগে।

দেশের বাইরে এসে আমরা যারা অন্যদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে কিছুটা পরিচিত হই - তখন মনে হয় - আহা যদি আমাদের দেশেও এরকম হতো! সে তাড়না থেকেই আমরা আমাদের মনের কথা লিখে জানাই। জানি আমাদের কথায় কেউ কান দেবে না। দেশের কোন পরিবর্তন আমরা করতে পারবো না। তবুও নিজের কাছে একটা সান্ত্বনা থাকবে - আমরা যেটুকু জানি বা জেনেছি তা জানাতে চেয়েছিলাম। ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন - দেশের বাইরে থাকতে তিনি একবারও দেশের কোন ব্যবস্থার সমালোচনা করে কিছু লেখেননি। তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে দেশে ফিরে গিয়ে একটা শক্তিশালী অবস্থানে আসা। যেটা আমাদের অনেকের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই দেশের প্রতি আমাদের ভালবাসার প্রকাশ হলো দেশের জন্য উদ্বেগ। তাই আমাদের লেখায় দেশের অনেক ব্যবস্থার সমালোচনা থাকে। সেটা দেশকে ছোট করার জন্য নয় - বরং দেশের উন্নতিতে যদি সামান্যও কোন কাজে আসি সে আশায়।


আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থার পুরোটাই এখন পরীক্ষার ফলাফল নির্ভর। লেখাপড়া করার মূল উদ্দেশ্য এখন পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা, কোন কিছু শেখা নয়। এই ফলাফলের জন্য আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের দিনরাত মুখস্ত করা ছাড়া আর কোন কাজ তেমন নেই। অভিভাবকরা বাকি সব কাজ নিজেরাই করে দেন; অন্তঃত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার আগ-পর্যন্ত। একটু খেয়াল করলেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কিছু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে:

  • স্কুল-কলেজ পর্যায়ে আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষার অবস্থা খুব খারাপ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোন কার্যকরী ব্যবস্থা এখনো নেয়া হচ্ছে না। শহর পর্যায়ে বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখনো হতাশাজনক না হলেও গ্রাম-পর্যায়ের স্কুল কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে কমে যাচ্ছে। তার মানে আগামী দশ বছর পরে বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষকেরও অভাব দেখা দেবে। ইউনিভার্সিটি পর্যায়েও এখন মৌলিক বিজ্ঞান বিষয়ের কোন কদর নেই। 
  • শহরের নামী স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য কত কোটি টাকার ব্যবসা চলছে তার যদি সঠিক পরিসংখ্যান থাকতো - আমরা দেখতে পেতাম - ভর্তি বাণিজ্যে এখন কত লাভ! অভিভাবকরা ভর্তি-বণিকদের হাতে জিম্মি। ভালো স্কুলে ভর্তি করাতে পারলে ছেলে-মেয়ে ভাল পড়াশোনা শিখবে - এটাই যে প্রধান লক্ষ্য তা বলা যাবে না। তথাকথিত ভালো স্কুলগুলো ঠিক কোন মাপকাঠিতে ভাল তার কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম আমাদের জানা নেই। হয়তো বিশাল বিশাল বিজ্ঞাপন আর প্রচারের কল্যাণে।
  • বছর দশেক আগেও দেখা যেতো একদম প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুল কলেজ থেকেও কোন না কোন শিক্ষার্থী জাতীয় পর্যায়ের মেধাতালিকায় স্থান পাচ্ছে। এখন সে সংখ্যা কমতে কমতে একেবারে শূন্যের কোঠায় এসে পৌছেছে। এখন গ্রামের স্কুল-কলেজগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। গ্রামেও যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা সামান্য ভালো - তারা তাদের ছেলেমেয়েদের শহরের স্কুলে লেখাপড়া করানোর চেষ্টা করেন। আর শহরের অলিতে গলিতে এখন ইংরেজি বাংলা মেশানো নানারকম নামের নানারকম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একই বাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়, কমিউনিটি সেন্টার, সেলুন, সুপারমার্কেট সব একসাথে দেখা যায়। প্রচুর উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়ে এখন সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হচ্ছেন - কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার মান একটুও বাড়ছে না। 
  • বাংলাদেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার পেছনে যত সময় ব্যয় করে তা উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের শিক্ষার্থীর চেয়ে অনেক বেশি। একবার স্কুল-কলেজের ক্লাস করে প্রায় প্রত্যেকেই আবার কোচিং সেন্টারে যায়। 
  • বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন খুব কম। গ্রামের শিক্ষকদের অবস্থা আসলেই খুব খারাপ। কিন্তু শহরের নামী কোন স্কুল-কলেজের শিক্ষক হতে পারলে এবং নীতি বিসর্জন দিয়ে সুযোগের সদ্‌ব্যাবহার করতে জানলে শিক্ষকদের পক্ষে মাসে লাখ টাকা উপার্জন করা এখন কোন ব্যাপারই নয়। কিন্তু তারপরও শিক্ষকতা পেশায় কেউ আসতে চান না। সে কারণেই দেখা যায় - বিসিএস পরীক্ষায় শিক্ষকতার অপশানের চেয়ে পুলিশের বা কাস্টমসের চাহিদা কয়েকশ গুণ বেশি। এর কারণ কী তা  বাংলাদেশের নিরিখে আমরা সবাই জানি। 
  • স্কুলে এখন ধরতে গেলে ক্লাস ওয়ান থেকেই ধর্মশিক্ষা পড়ানো হয়। আর ধর্ম মানেই বিভাজনের শিক্ষা দেয়া। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান এই আলাদা পরিচয় ঢুকিয়ে দেয়া হয় শিশুদের মনে। যে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় স্কুল পর্যায়ে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক সেদেশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার চর্চা হবে এটাই স্বাভাবিক। ধর্ম শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য যদি নৈতিক শিক্ষা দেয়া হয়, তাহলে গত ৩৫ বছর ধরে যে দেশের স্কুলে ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক - সেদেশে তো কোন দুর্নীতি থাকার কথা নয়।  
  • ব্যবসায়ীরা যখন স্কুল-কলেজ খোলেন তখন তা তাদের অন্য ব্যবসার মত হবে এটাই তো স্বাভাবিক। তবে আমরা তাদের গালাগালি করি ঠিকই- আবার আমরাই টাকার লোভে ছুটে যাই সেসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কিছু দাক্ষিণ্য পেতে। বাংলাদেশে এখন অনেক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। সেখানে সরকারী মেডিকেল কলেজের, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা ঘন্টায়  দশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা পারিশ্রমিক নিয়ে ক্লাস নিতে যান। তো এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি এক ধরনের মমত্ববোধ তো তৈরি হয়েই যায়। এখন বেসরকারী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে শুরু করে কী নেই! কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই তো টাকার বিনিময়ে ডিগ্রি বেচে। 
  • আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় রাজনীতি এবং দুর্নীতি এত বেশি ভূমিকা রাখে যে 'সবার জন্য শিক্ষা'র ব্যাপারটা কার্যকর করা খুবই কঠিন।


পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উন্নত শিক্ষাব্যবস্থায় স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষা-পরিকল্পনা থাকে। দেশের জনসম্পদকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য এবং দক্ষ জনশক্তির নিয়মিত জোগান দেয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকে। শিক্ষা গবেষণা যে কোন দেশের জন্যই খুবই দরকারি একটি বিষয়। আমাদের দেশের শিক্ষা নিয়ে কতটুকু গবেষণা হয় আমাদের জানা নেই। আমরা শুধু দেখি মন্ত্রণালয়ে কিছু ক্ষমতাশালী মানুষ টুকটাক সভা করেই বড় বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। এভাবে কাজের কাজ কী হচ্ছে তা তো আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts