Wednesday 25 August 2021

পরিবেশ এবং আমাদের দায়


সাম্প্রতিক বছরগুলিতে আমরা অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখতে পাচ্ছি। ক’দিন আগেই ইওরোপে ভয়ংকর বন্যা হয়ে গেল – যেখানে গত এক শ’ বছরেও এরকম বন্যা হয়নি কখনো। আমেরিকা, চীন, ভারত, বাংলাদেশ সবখানেই বন্যা হচ্ছে, সাইক্লোন, টাইফুন ইত্যাদির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে, প্রকৃতি ক্রমশ বিরূপ হয়ে যাচ্ছে তা আমরা সবাই বুঝতে পারছি। এর দায় কার? একি শুধুই প্রাকৃতিক? নাকি মানুষ দায়ী এর জন্য? 

মানুষের দেশ আছে। প্রকৃতির কোন দেশ নেই। প্রকৃতি তার আপন গতিতে এগিয়ে চলে। মানচিত্রের লাল-কালো দাগগুলি তার চেনা নয়। নদীর স্রোত, বাতাসের গতি কিংবা দেশান্তরী পাখি কোন কাঁটাতারের বেড়া মানে না, কোন দেশের সীমান্তের পরোয়া করে না। মানচিত্রের দাগগুলি পৃথিবীর স্থলভাগকে বহু আঁকাবাঁকা খন্ডাংশে বিভক্ত করতে পারে। কিন্তু বিশাল জলরাশি অথবা বায়ুমন্ডল উন্মুক্তই রয়ে যায়। এই উন্মুক্ত পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের দায়িত্ব আমাদের প্রত্যেকের। 

প্রকৃতি ধ্বংসকারী মানুষ অনেক সময় এসব বিষয়কে নিজেদের সার্বভৌম বিষয় বলে আড়াল করতে চায়। কিন্তু বিষয়টা সবার, আমাদের এক পৃথিবীর, সাড়ে সাতশ কোটি মানুষের এক পরিবারের। 

পরিবেশের কিছু তত্ত্বীয় ব্যাপার-স্যাপার আছে। পরিবেশ ব্যাপারটা অনেক বড়। আমাদের শরীরের বাইরের যে কোনকিছুই পরিবেশের অংশ। আমাদের জীবদ্দশায় যা কিছু আমাদের প্রভাবিত করতে পারে – তার সবকিছুই কোন না কোনভাবে পরিবেশের সাথে সম্পর্কিত। সুনির্দিষ্টভাবে পরিবেশ – পানি, বাতাস, মাটি এবং এই পৃথিবীতে বসবাসকারী সব উদ্ভিদ, প্রাণি, জীবাণু এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কেই নির্দেশ করে। 

প্রধানত জীবজগৎ, জড়জগৎ আর শক্তি – এই তিনের সমন্বয়ে পরিবেশের সৃষ্টি। পরিবেশের কিছু কিছু উপাদান আপাতভাবে অসীম। যেমন – সূর্যের আলো, বাতাসের প্রবাহ, সমুদ্রের স্রোত ইত্যাদি। প্রকৃতির কিছু কিছু উপাদান নবায়নযোগ্য – যেমন বিশুদ্ধ বাতাস, বিশুদ্ধ পানি, মাটির উর্বরতা, উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল। আবার কিছু কিছু উপাদান সীমিত – কিন্তু নবায়নযোগ্য নয়। যেমন – জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, খনিজ তেল, গ্যাস), খনিজ ধাতু, অন্যান্য খনিজ রাসায়নিক পদার্থ ইত্যাদি। ব্যবহারের ধরনের উপর নির্ভর করে পরিবেশের এসব উপদানের স্থায়ীত্ব কতদিন এবং কতটুকু নবায়নযোগ্য থাকবে। 

পৃথিবী প্রতিমুহূর্তেই পরিবর্তিত হচ্ছে। এই পরিবর্তন একটি প্রাকৃতিক ধারা, যার গতিও প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। কিন্তু প্রয়োজন, ক্ষমতা ও লোভ বাড়ার সাথে সাথে পরিবর্তনের ধারাকে উচ্চগতিতে ত্বরান্বিত করেছে মানুষ।পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব ঘটেছে আজ থেকে প্রায় ৩০০ কোটি বছর আগে। তখনকার সরল এককোষী প্রাণী জৈববিবর্তনের ধারায় জটিল থেকে জটিলতর হতে হতে মাত্র তিরিশ-চল্লিশ হাজার বছর আগে মানব  জাতির আবির্ভাব হয়। 

জৈববিবর্তনের সাথে সাথে প্রকৃতির পরিবেশেরও বিবর্তন ঘটে। প্রকৃতি আপন খেয়ালেই এই বিবর্তনের হাত ধরে চলেছে হাজার হাজার বছর। বিবর্তনের পাতা উল্টালে দেখা যায় মানুষের আবির্ভাবের পর হঠাৎ করে যেন মহাকালের ঘড়ির মিনিটের কাঁটা সেকেন্ডের কাঁটার গতি পেয়ে গেল। পরিবেশ পরিবর্তনে একটা প্রচন্ড গতির সঞ্চার হলো। কালের ধারায় আজ থেকে দশ-বারো হাজার বছর আগে কঠিন মাটির বুক চিরে মানুষ ঘটালো কৃষিবিপ্লব। 

প্রাকৃতিক বিবর্তনের ঘড়ির কাঁটা হঠাৎ করে যেন মিনিটের কাঁটার গতি পেয়ে গেল শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। আর তা ঘটলো মাত্র দুই আড়াই শতাব্দী আগে। হাজার বছর ধরে খরা, বন্যা, ভূমিকম্প যতো না ক্ষতি করলো, বিগত এক শতাব্দীতে তার চেয়ে কয়েকগুণ ক্ষতি করলো মানুষের মতভেদ – যুদ্ধের রূপে। প্রকৃতির স্বাভাবিকতাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে গিয়ে আমরা আমাদের পরিবেশকে করে তুলেছি বিপর্যস্ত। ফলে প্রকৃতি আমাদের সঙ্গে অপ্রত্যাশিত এবং অনাকাঙ্খিত আচরণ করছে। ঘন ঘন সাইক্লোন, ঘূণিঝড়, টাইফুন, জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাচ্ছে প্রতিদিন কোন না কোন জনপদ পৃথিবীর কোথাও না কোথাও। 

প্রকৃতির বৈরি আচরণের জন্য বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নিমায়কের কথা বলে থাকেন। প্রধান কারণ হিসেবে গ্রিন হাইজ এফেক্টের ফলে ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং ওজোন স্তরের ভারসাম্যহীনতাকেই দায়ি করা হয়। বায়ুমন্ডলের ওজোন স্তর আমাদেরকে  সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষা করে, পৃথিবীর উপরিভাগের তাপমাত্রার সমতা রক্ষা করে। এই ওজোন স্তরের ক্ষতি হলে আমাদের পৃথিবীতে দেখা যায় নানা বিপর্যয়। কিন্তু এই বিপর্যয় ঘটেই চলেছে প্রতিনিয়ত। ওজোন স্তরের ক্ষতির পেছনে অনেকগুলি কারণ আছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীতে সৃষ্ট কিছু গ্যাস ওজোন স্তর ধ্বংসের জন্য দায়ি। 

কার্বন ডাই অক্সাইড (জীবজন্তুর শ্বাস প্রশ্বাস থেকে) – ৪৯%
মিথেন (বদ্ধ জলাভূমি, স্যাঁতস্যাঁতে জলাভূমি, ধানক্ষেত, জীবজন্তুর বর্জ্য থেকে) – ১৮%
ক্লোরোফ্লোরোকার্বন (রেফ্রিজারেটর, প্লাস্টিক শিল্প ইত্যাদি) – ১৪%
নাইট্রাস অক্সাইড, যানবাহনের ধোঁয়া – ৬%
অন্যান্য গ্যাস উৎপাদনকারী কারখানা থেকে – ১৩%

উনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই, অর্থাৎ শিল্পবিপ্লবের সূচনা পর্ব থেকেই বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের স্তর ক্রমশ বাড়ছে তো বাড়ছেই। একদিকে শিল্পকারখানা বৃদ্ধি ও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাড়ছে, অন্যদিকে বনসম্পদ ধ্বংস করার ফলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। আমরা বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করি, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করি। গাছপালা সালোক-সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার সময় এই এই কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে বাতাসে অক্সিজেন ছেড়ে দেয়। এভাবে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু ক্রমাগত গাছ কাটার ফলে, বনাঞ্চল উজাড় করে ফেলার ফলে প্রতিদিন যে পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরিত হয়, সে পরিমাণ শোষিত হতে পারছে না। উনিশ শতকে যেখানে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ছিল ২৮০ থেকে ২৯০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন), বিশ শতকে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫০-এ; ২০৫০ সাল নাগাদ এই বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ৫০০ থেকে ৭০০ পিপিএম-এ। 

বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গেলে কী সমস্যা হয়? স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, মিথেন, ক্লোরোফ্লুরোকার্বন ইত্যাদি গ্যাস বায়ুমন্ডলের নিচের স্তরের ঘনত্ব বাড়িয়ে দেয়। সূর্যের আলো যখন পৃথিবীতে আসে, তাপ তৈরি হয়, সেই তাপ বায়ুমন্ডলের নিচের স্তরে আটকে পড়ে। ফলে তাপমাত্রা বেড়ে যেতে থাকে। প্রতিদিন সূর্য থেকে প্রায় পাঁচ শ টেরাওয়াট ক্ষমতার তাপশক্তি পৃথিবীতে আসে। তারমধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ সরাসরি প্রতিফলিত হয়ে ফিরে যায়। বাকি ৭০% পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র ও ভূ-পৃষ্ঠ শোষণ করে এবং বিকিরণের মাধ্যমে কিছুটা ছেড়ে দেয়। কার্বন-ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য গ্যাসের বৃদ্ধির ফলে এই তাপীয় বিকিরণ বাধাগ্রস্ত হয়। তাতে পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকে। এই তাপমাত্রা বাড়ার ফলে পৃথিবীর ইকোসিস্টেম ক্রমশ বদলে যেতে থাকে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে। ফলে নিচুজমিগুলি ক্রমশ জলাজমিতে পরিণত হবে। 

এর কুফল ভোগ করতে হবে বাংলাদেশসহ বিশ্বের আরো অনেক উপকুলীয় অঞ্চলকে। উপকুলীয় অঞ্চলে ঘনবসতির ফলে পরিবেশদূষণও বেশি হয়। প্রাকৃতিক সম্পদ, বনায়ন ধ্বংস করার ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য মোট ভূমির কমপক্ষে ২৫% সংরক্ষিত বনভূমি থাকার দরকার। বাংলাদেশের বনভূমির পরিমাণ ১০% এরও কম। ফলে আমাদের ভোগান্তির পরিমাণ হবে অনেক বেশি। 

এসব সমস্যা বিশ্বজনীন হলেও আমাদের নিজেদের দায়িত্ব অস্বীকার করা যায় না। যার যার উৎস থেকে দূষণ যদি বন্ধ করা যায়, নিদেনপক্ষে কমানোও যদি যায় – তাহলেও অনেক কাজ হয়। পরিবেশ দূষণের উপাদান যদি কম ব্যবহার করা যায়, কিংবা বিকল্প উপাদান ব্যবহার করা যায় – যা কম দূষণকারী, তাতেও অনেক কাজ হয়। 

পরিবেশকে আমাদের অনুকূলে ফিরিয়ে আনতে হলে গ্রিনহাউজ গ্যাসগুলির জমে ওঠার গতি রুখতে হবে। সেজন্যে আমাদের গাছ লাগাতে হবে অনেক বেশি। গাছ-কাটা বন্ধ করতে হবে। বর্জ্য নিষ্কাষণ ও ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন দরকার। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। এসব ব্যাপারে নাগরিকসচেতনতার পাশাপাশি সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়ার দরকার হয়। 

আন্তর্জাতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে, প্রযুক্তির দিক থেকে উন্নতদেশগুলি যদি তাদের সবচেয়ে বড় এবং প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত – যুদ্ধবন্ধের সিদ্ধান্ত যদি নেয়, পরিবেশ দূষণ অনেকটাই বন্ধ হয়ে যাবে। পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য সমষ্টিগত সিদ্ধান্তের প্রয়োজন এবং তা এখন আজই। 

আমাদের একটাই পৃথিবী। আমাদের সকলের জন্যে এবং সকলের যত্নেই তার পরিবেশ থাকতে পারে দূষণমুক্ত, সুন্দর। তারপরেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্ধ হয়ে যাবে - তা নয়। কিন্তু আমাদের দায় তো কমবে। 

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts