Thursday, 12 August 2021

নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী - এরভিন শ্রোডিঙ্গার

 



মহাবিশ্বের প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করার জন্য পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দশটি সমীকরণ বেছে নিতে হলে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সবচেয়ে মৌলিক সমীকরণ – শ্রোডিঙ্গারের তরঙ্গ সমীকরণ বা শ্রোডিঙ্গার ওয়েভ ইকুয়েশান-কে বেছে নিতেই হবে। বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার কোয়ান্টাম মেকানিক্স। বলা হয়ে থাকে কোয়ান্টাম মেকানিক্স তরুণ পদার্থবিজ্ঞানীদের ক্ষেত্র। কারণ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রধান স্থপতিদের সবাই ছিলেন বয়সে তরুণ। ১৯১৩ সালে  নিল্‌স বোর যখন পরমাণুর কোয়ান্টাম মডেল আবিষ্কার করেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৮ বছর। ১৯২৪ সালে লুই ডি ব্রগলি তাঁর ম্যাটার-ওয়েভ থিওরি বা বস্তু-তরঙ্গ তত্ত্ব প্রকাশ করেন তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩২ বছর। ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ যখন ১৯২৫ সালে তাঁর অনিশ্চয়তার সূত্র বা আনসার্টিনিটি প্রিন্সিপাল আবিষ্কার করেন তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৪। পল ডিরাক ১৯২৮ সালে যখন তাঁর ইলেকট্রনের কোয়ান্টাম সমীকরণ প্রতিষ্ঠা করেন – তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৬ বছর। সে তুলনায় আরভিন শ্রোডিঙ্গার কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আবিষ্কারের জগতে প্রবেশ করেন কিছুটা বেশি বয়সে। ১৯২৬ সালে শ্রোডিঙ্গার যখন তরঙ্গ-সমীকরণ আবিষ্কার করেন – তখন তাঁর বয়স ৩৯ বছর। কোয়ান্টাম মেকানিক্সে তাঁর অবদানের জন্য তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৩৩ সালে – পল ডিরাকের সাথে যৌথভাবে। 

পদার্থবিজ্ঞানের জগতে আলবার্ট আইনস্টাইন যেমন প্রায় একাকী গবেষণা করে গেছেন, এরভিন শ্রোডিঙ্গারও সেরকম একা একাই গবেষণা করেছেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্সে তাঁর গবেষণা এবং আবিষ্কার ছিল অনেকটাই হঠাৎ করে করে ফেলার মতো – অসুস্থ হয়ে গৃহবন্দী থাকার সময়। 

এরভিন শ্রোডিঙ্গারের জন্ম ১৮৮৭ সালের ১২ আগস্ট অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায়। তাঁর বাবা রুডল্‌ফ শ্রোডিঙ্গার এবং মা জর্জিন শ্রোডিঙ্গারের একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি। মা-বাবা উভয়দিকের পরিবার ছিল উচ্চশিক্ষিত। তাঁর মায়ের বাবা ছিলেন ভিয়েনা পলিটেকনিক্যালের রসায়নের অধ্যাপক। এদিকে তাঁর বাবার বাবা ছিলেন জার্মানির মিউনিখের বাসিন্দা। এরভিনের বাবা রুডল্‌ফ উত্তরাধিকারসূত্রে কাপড়ের কলের মালিক হয়েছিলেন। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় পরিমাণে উপার্জন হচ্ছিলো। তাতেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। নিজের আগ্রহ ছিল ছবি আঁকা ও বিজ্ঞান – বিশেষ করে উদ্ভিদবিজ্ঞান ও রসায়নের প্রতি। একমাত্র ছেলের সাথে তিনি বন্ধুর মতো মিশতেন – ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা করতেন বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। 

এরভিনের মা বেশ হাসিখুশি প্রাণবন্ত ছিলেন, কিন্তু প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। এরভিনের মায়ের-মা ইংরেজ। তাঁর কাছ থেকে এরভিন ছোটবেলা থেকেই ইংরেজি শিখেছেন এবং তাঁর সংগীদের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন ইংরেজিতে। 

 প্রাথমিক পড়াশোনা বাড়িতেই শুরু হয় এরভিনের। এগারো বছর বয়সে ১৮৯৮ সালে ভর্তি হলো ভিয়েনার জিমনেশিয়ামে (হাই স্কুল)। ১৯০৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশান পাস করেন (উচ্চ-মাধ্যমিকের সমতুল্য)। স্কুলে খুবই ভালো রেজাল্ট করেছিলেন তিনি। স্কুলের বিষয়গুলি ছিল বেশিরভাগই ইতিহাস, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ ভাষা। গণিত ও বিজ্ঞান ছিল খুবই সামান্য। ভালো রেজাল্ট করার পর এরভিন অনেকটাই বদলে যান। অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েন। আর সহপাঠীরা স্বাভাবিকভাবেই তাঁর আত্মবিশ্বাসকে অহংকার মনে করে তার কাছ থেকে দূরে সরতে শুরু করে।  

১৯০৬ সালের শেষের দিকে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন এরভিন শ্রোডিংগার। ভিয়েনার পদার্থবিজ্ঞানী লুডভিগ বোল্‌টজম্যানের কথা এরভিন শ্রোডিংগার শুনে আসছেন ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু শ্রোডিঙ্গারের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শুরু হবার কাছাকাছি সময়েই বোল্‌টজম্যান বেশ কয়েকমাস মানসিক অবসাদে ভুগে আত্মহত্যা করেন। শ্রোডিঙ্গারকে খুব নাড়া দেয় এই ঘটনা। বোল্‌টজম্যান যেমন প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ছিলেন, তেমনি ছিলেন চমৎকার শিক্ষক। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক পদার্থবিজ্ঞানীর উপর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তিনি। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বোল্‌টজম্যানের পর তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়েছিলেন ফ্রেডরিক হাসনল (Friedrich Hasenohrl)। অচিরেই ফ্রেডরিকের পড়ানো আর পদার্থবিজ্ঞান-ভাবনায় মুগ্ধ হয়ে পড়েন শ্রোডিঙ্গার। ফ্রেডরিক ছিলেন গতানুগতিক প্রফেসরদের চেয়ে আলাদা। তিনি কোন নোট বা বই দেখে পড়াতেন না। ক্লাসে পদার্থবিজ্ঞানের যুক্তির পর যুক্তি সাজিয়ে পড়াতেন। ছাত্রদের সাথে তাঁর সম্পর্ক শুধুমাত্র ক্লাসরুমেই সীমাবদ্ধ থাকতো না। তিনি ছাত্রদেরকে তাঁর বাড়িতেও নিয়ে যেতেন। ছাত্রদের সাথে পাহাড়ে চড়তেন, স্কি করতেন। শ্রোডিংগার এসব খুবই পছন্দ করতেন। পরবর্তীতে শ্রোডিংগার নিজেও পড়ানোর সময় ফ্রেডরিকের পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন ফ্রাঞ্জ এক্সনার। সিলেবাসের অংশ হিসেবে যতটুকু এক্সপেরিমেন্ট করতে হয় করেছিলেন, কিন্তু তেমন কোন আগ্রহ তাঁর জন্মায়নি পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি।

১৯১০ সালে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বিনাবেতনে কিছু ক্লাস নিতে শুরু করলেন ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সেই সময় তার মিলিটারি সার্ভিসের ডাক এলো। ইওরোপের বিভিন্ন দেশে তখন পুরুষদের জন্য এক বা দুই বছরের মিলিটারি সার্ভিস বাধ্যতামূলক ছিল। 

এক বছরের মিলিটারি সার্ভিস শেষ করে ১৯১১ সালে শ্রোডিংগার ফ্রাঞ্জ এক্সনারের সহকারী হিসেবে যোগ দিলেন ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শ্রোডিংগারের দায়িত্ব ছিল ফার্স্ট ইয়ারের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে পরীক্ষণ বুঝিয়ে দেয়া। প্রদর্শকের কাজ। ক্লাসরুমে অনেকগুলি ছাত্র, পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি নেই – তাছাড়া পরীক্ষণ দেখানোর প্রতি তেমন কোন আগ্রহও নেই শ্রোডিংগারের। তাই তিনি খুব একটা উৎসাহ পাচ্ছিলেন না কাজে। কিন্তু সেই সময় পদার্থবিজ্ঞানের অন্য কোন চাকরিও নেই অস্ট্রিয়ার কোথাও। পাশের দেশ জার্মানিতে পদার্থবিজ্ঞানীদের জন্য অনেক চাকরি আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু শ্রোডিংগার জার্মানদের সাথে প্রতিযোগিতা করে চাকরি পাবেন কি না জানেন না। 

তখন ইওরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে গেলে পিএইচডি থিসিসের মতো একটা থিসিস জমা দিতে হতো ‘হ্যাবিলিটেশান’ কমিটির কাছে। এই কমিটি যাচাই করে দেখতো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনভাবে পড়ানোর মতো যোগ্যতা প্রার্থীর আছে কি না। শ্রোডিংগার তাঁর গবেষণাপত্র জমা দিলেন। তিনি তখন গবেষণা করছিলেন কাইনেটিক থিওরি অব ম্যাগনেটিজম বা চুম্বকত্বের গতিতত্ত্ব এবং কাইনেটিক্‌স অব ডাই-ইলেকট্রিক্‌স বিষয়ে। কমিটি তাঁর গবেষণা-কাজ দেখে মোটামুটি সন্তুষ্ট হলেন। এবার দ্বিতীয় ধাপ হলো বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা দেয়া। হ্যাবিলিটেশান কমিটি শ্রোডিংগারকে চুম্বকত্ব বিষয়ে বক্তৃতা দেবার সুযোগ দিলেন। কমিটি তাঁর বক্তৃতায় খুব একটা সন্তুষ্ট হলো না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরোপুরি শিক্ষক হওয়া সম্ভব হলো না শ্রোডিংগারের। 

প্রদর্শক হিসেবে তাঁর খুব একটা ভালো লাগছিলো না। অনেক বেশি যোগ্যতা নিয়ে নিচুপদে কাজ করতে হলে এক ধরনের আত্মগ্লানি তৈরি হয়। শ্রোডিংগারেরও হচ্ছিল। কিন্তু তার চেয়েও বেশি সমস্যা হচ্ছিলো তাঁর বিয়ে নিয়ে। 

যৌবনের শুরু থেকেই নারীশরীরের প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ তৈরি হয়েছে শ্রোডিংগারের। সুন্দরী নারীদের প্রতি তাঁর টান তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের চেয়েও বেশি। অনেকগুলি ভালোবাসাহীন শারীরিক সম্পর্কের পর তিনি সম্প্রতি ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন তাঁর বাবার বন্ধু মিস্টার ক্রাউসের মেয়ে ফেলিসির সাথে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারলে ফেলিসিকে বিয়ে করা যেতো। বিয়ের বাজারে প্রদর্শকের সামাজিক মূল্য তেমন নেই। স্বাভাবিকভাবেই একজন প্রদর্শকের সাথে ফেলিসির মা-বাবা মেয়ের বিয়ে দিতে চাইলেন না। শ্রোডিংগার নিজের সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে না পেরে – এবার অন্য পথ ধরলেন। ফেলিসির সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে এবার বেছে বেছে অপেক্ষাকৃত কম সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন মেয়েদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে শুরু করলেন। 

১৯১৩ সালে ভিয়েনায় বেশ বড় একটি পদার্থবিজ্ঞান সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। এটি ছিল জার্মান বিজ্ঞানীদের ৮৫তম বৈজ্ঞানিক সম্মেলন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় সাত হাজার বিজ্ঞান-প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন সেখানে। আইনস্টাইনসহ ইওরোপের অনেক খ্যাতনামা পদার্থবিজ্ঞানী সেই সম্মেলনে বক্তৃতা করেছিলেন। আইনস্টাইন তখন ইওরোপের সেরা পদার্থবিজ্ঞানী। তিনি সেখানে মহাকর্ষ বলের তখনকার অবস্থা সম্পর্কে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছিলেন তখন তিনি। 

শ্রোডিংগার আইনস্টাইনের বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে মহাকর্ষ ও তড়িৎচুম্বক বলের সমন্বয়ে একটি সমন্বিত বলের ব্যাপারে গবেষণা করতে উদ্বুদ্ধ হলেন। পরবর্তী এক বছর ধরে তিনি কাজ করলেন তিনি গবেষণা করে অত্যন্ত দরকারি একটি গবেষণাপত্র ‘On the dynamics of elastically coupled point system’ রচনা করে ‘এনালেন ডার ফিজিক’-এ প্রকাশের জন্য পাঠালেন। এই পেপারে প্রথম শ্রোডিংগারের গভীর গাণিতিক দক্ষতা ও দার্শনিকতার প্রমাণ পাওয়া যায়। 

এসময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধে ডাক পড়ে শ্রোডিংগারের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই প্রকাশিত হয়েছিল আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব। শ্রোডিংগার যুদ্ধরত অবস্থায় এই তত্ত্ব পড়ার সুযোগ পাননি। ১৯১৭ সালে তাঁর যুদ্ধকালীন পোস্টিং হয় ভিয়েনায়। তখন তিনি কিছুটা সময় এবং সুযোগ পান বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিয়ে ভাবার। আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির পাঠ তাঁকে আবার নতুনভাবে উদ্বুদ্ধ করে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার দিকে। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৮ সালে শ্রোডিংগার আবার যোগ দিলেন আগের প্রদর্শক পদে। কিন্তু অন্য জায়গায় ভালো চাকরি খুঁজছিলেন। একটা সুযোগ এলো জার্মানির ইনা (Jena) বিশ্ববিদ্যালয়ে। পদটা যদিও এখনো খুব একটা উঁচুমানের নয়, কিন্তু বিয়ে করার পক্ষে উপযুক্ত। 

এর আগে সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা ফেলিসিকে বিয়ে করতে চেয়ে পারেননি। তাই এবার তিনি আর সম্ভ্রান্ত পরিবারের বিদুষীদের দিকে গেলেন না। বিয়ে করলেন এমন একজনকে যার সামাজিক মর্যাদা, পড়াশোনা কিংবা মেধা তেমন উঁচুপর্যায়ের নয়। ১৯১৮ সালে শ্রোডিংগার বিয়ে করলেন আনামেরি বার্টেলকে। আনামেরির বয়স তখন তেইশ, শ্রোডিংগারের ৩২। 

শ্রোডিংগারের সাথে আনামেরির কোন বিষয়েই মিল নেই। আনামেরি লেখাপড়া তেমনকিছু করেননি। বিজ্ঞানের কিছুই বোঝেন না। শ্রোডিংগারের গভীর দর্শনেরও সঙ্গী তিনি নন। তবে শ্রোডিংগার কেন বিয়ে করেছিলেন তাঁকে? শ্রোডিংগার সম্ভবত বিয়ে করেছিলেন প্রবল যৌনতাড়না থেকে, এবং পদমর্যাদার অভাবে বিয়ে করতে পারছেন না – এই আত্মগ্লানি থেকে মুক্তি পাবার জন্য। শ্রোডিংগার প্রচন্ডভাবে পুরুষবাদী ছিলেন। নারীদের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি খুব একটা সম্মানজনক ছিল না। আনামেরিকে তিনি একজন বিনাবেতনের পরিচারিকা ছাড়া আর কিছুই মনে করতেন না। শুরুতে কিছুদিন শারীরিকভাবে আকৃষ্ট থাকলেও কিছুদিনের মধ্যে সেটাও পুরনো হয়ে যায়। শ্রোডিংগার আনামেরির বর্তমানে বিভিন্নজনের সাথে শারীরিক সম্পর্ক চালিয়ে যেতে থাকেন। আনামেরি সব দেখেশুনেও চুপ করে থাকেন। কোন এক অদৃশ্য কারণে তিনি শ্রোডিংগারকে ছেড়ে যাননি কোনদিন। আর শ্রোডিংগারও আনামেরির কাছ থেকে কোনদিন কোন রকমের বাধা না পেয়ে তাকে ডিভোর্স করার কোন প্রয়োজন মনে করেননি। আনামেরির গর্ভে শ্রোডিংগারের কোন সন্তান হয়নি। কিন্তু অন্য কয়েকজন নারীর গর্ভে শ্রোডিঙ্গারের একাধিক সন্তানের জন্ম হয়েছে। 

১৯১৮ সালে ইনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পর শ্রোডিংগারকে যথাযথ সম্মান দেখানো হলো। কাজে যোগ দিয়েই তিনি পরমাণুর তত্ত্ব সম্পর্কে খুব চমৎকার একটি বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা দিলেন। তাঁর বক্তৃতায় ইনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি এতটাই খুশি হলেন যে শ্রোডিংগারকে দ্রুত প্রমোশন দিয়ে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর করে ফেলা হলো। কিন্তু পদটি ছিল অস্থায়ী। স্থায়ী হতে কতদিন লাগবে শ্রোডিংগার জানেন না। তাই তিনি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী পদের জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখলেন। চার মাস পরেই সুযোগ এলো স্টুটগার্ট ইউনিভার্সিটি থেকে। শ্রোডিংগার স্টুটগার্ট ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিলেন অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরের স্থায়ী পদে। 

ইতোমধ্যে শ্রোডিংগারের মায়ের স্বাস্থ্য আরো খারাপ হয়েছে। ১৯১৯ সালে স্তন ক্যান্সারে মারা যান তিনি। এর কিছুদিন পর ১৯১৯ সালের শেষের দিকে শ্রোডিংগারের বাবাও মারা যান। মা-বাবা দু’জনকে হারিয়ে পারিবারিকভাবে একেবারে একা হয়ে পড়েন শ্রোডিংগার। স্ত্রী আনামেরি সাথে আছেন ঠিকই, কিন্তু শ্রোডিংগারের মনের কোন রকমের সঙ্গী তিনি নন। 

পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে সুনাম হচ্ছে শ্রোডিংগারের। অস্ট্রিয়া ও জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর ডাক আসছে প্রফেসর হিসেবে যোগ দেয়ার। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি যোগ দিলেন জার্মানির ব্রেসলাউ বিশ্ববিদ্যালয়ে (এটা এখন পোলান্ডে)। কিন্তু এখানেও তিনি বেশিদিন থাকলেন না। কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি ডাক পেলেন সুইজারল্যান্ডের জুরিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন স্বয়ং আইনস্টাইন। শ্রোডিংগারের কাছে এর মর্যাদাই আলাদা। খুব খুশিমনে তিনি জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন প্রফেসর হিসেবে। 

চৌত্রিশ বছর বয়সেই ফুল প্রফেসর হয়ে গেছেন শ্রোডিংগার। কিন্তু হিসেব করে দেখতে গেলে তাঁর তখনোপর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোন বৈজ্ঞানিক কাজ নেই। 

সুইজারল্যান্ডে একটু গুছিয়ে বসতে না বসতেই শ্রোডিংগারের শরীর খারাপ হতে শুরু করলো। তাঁর যক্ষা ধরা পড়লো। সুস্থ হবার জন্য তাঁকে আরুজা পর্বতমালার পাদদেশে একটি স্বাস্থ্যনিবাসে থাকতে হলো। এখানেই তিনি রচনা করলেন তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রগুলির একটি – “On a remarkable property of the quantised orbits of an electron”. 

১৯২১ থেকে ১৯২৭ – এই ছয় বছর জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন শ্রোডিংগার। এই ছয় বছরের মধ্যেই তিনি আবিষ্কার করেছেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মূল সমীকরণ – শ্রোডিংগার ইকোয়েশান অব ওয়েভস। 

জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে শ্রোডিংগারের সুনাম ছড়িয়ে পড়লো দ্রুত। তিনি ছাত্রদের সাথে তাঁর শিক্ষক ফ্রেডরিকের শিক্ষণ-পদ্ধতি অনুসারে পড়াতে লাগলেন। সেই সময় প্রফেসররা পড়াতেন লেকচার নোট দেখে দেখে। কিন্তু শ্রোডিংগার ক্লাসে কোন ধরনের বই বা নোট ব্যবহার না করে – সবকিছু তৎক্ষণাৎ ক্লাসেই ব্ল্যাকবোর্ডে তৈরি করতেন যুক্তি দিতে দিতে। এভাবে চোখের সামনে সমীকরণ তৈরি হতে দেখে ছাত্ররা খুবই উৎসাহিত হতো। অনেক সময় তিনি সমুদ্রের তীরে নিয়ে যেতেন ছাত্রদের। সেখানে সৈকতে ব্ল্যাকবোর্ড রেখে সেখানেই পড়াতেন। 

১৯২১ থেকে ১৯২৭ সালের মধ্যে শ্রোডিংগার যখন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সবচেয়ে গভীর চিন্তার ফসল ফলিয়েছেন – তখন তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত জীবন ছিল খুবই টানটান উত্তেজনাময়। সুইজারল্যান্ডের পর্বতমালার পাদদেশে চমৎকার স্বাস্থ্যনিবাসে থাকলেও আনামেরির সাথে তাঁর দাম্পত্যজীবন তখন অসহ্য যন্ত্রণাময় হয়ে উঠেছে। আনামেরিকে ডিভোর্স করবেন কি না চিন্তাও করছেন। এর মধ্যে শ্রোডিংগার নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এলেন তাঁর ভূতপূর্ব প্রেমিকা ফেলিসিকে – যাকে বিয়ে করতে চেয়েও করতে পারেননি অনেক বছর আগে। ফেলিসির বিয়ে হয়েছিল, একটা শিশুকন্যাও আছে তার। কিন্তু স্বামীর সাথে তার ডিভোর্স হয়ে গেছে। একই বাড়িতে আনামেরির বর্তমানেই ফেলিসির সাথে আবার যৌনসম্পর্ক স্থাপন করলেন শ্রোডিংগার। পরবর্তীতে শ্রোডিঙ্গার নিজেই বলেছেন – প্রচন্ড যৌন উত্তেজনার সময় তাঁর বৈজ্ঞানিক চিন্তার ক্ষমতা এবং দক্ষতা অনেক বেড়ে যায়।

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ধারণা প্রথম দিয়েছিলেন ম্যাক্স প্ল্যাংক ১৯০০ সালে। তাপীয় বিকিরণ বিশ্লেষণ করে ক্রমে ফোটনের ধারণা পাওয়া গেছে। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন আলো এবং শক্তির সমন্বয়ক সূত্র প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৩ সালে নিলস বোর পরমাণুর কোয়ান্টাম মডেল দেন। ১৯২০ সালে ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ পরমাণুর ইলেকট্রনের কক্ষপথের ম্যাট্রিক্স মেকানিক্স আবিষ্কার করেন – যেটা দিয়ে পরমাণুর কক্ষপথে ইলেকট্রনের গাণিতিক বর্ণনা দেয়া যায়। ১৯২৪ সালে লুই দ্য ব্রগলি ম্যাটার ওয়েভ বা বস্তু-তরঙ্গের ধারণা দেন। শুরুতে আইনস্টাইন ছাড়া ব্রগলিকে কেউ তেমনভাবে সমর্থন করেননি। আইনস্টাইনের বর্ণনা পড়ে শ্রোডিংগারেরও মনে হয়েছিল যে দ্য ব্রগলির ধারণা সঠিক হতে পারে। ফোটনের মতো করে ইলেকট্রনের তরঙ্গের গাণিতিক সমীকরণও লেখা সম্ভব। এই সময়েই ১৯২৫ সালে শ্রোডিঙ্গার তাঁর বিখ্যাত সমীকরণটি তৈরি করে ফেললেন। ১৯২৬ সালে ‘অ্যানালেন ডার ফিজিক’-এ ধারাবাহিকভাবে চারটি গবেষণাপত্রে শ্রোডিঙ্গার তাঁর সমীকরণ প্রকাশ করেন। শ্রোডিঙ্গারের তরঙ্গ সমীকরণ আর হাইজেনবার্গের ম্যাট্রিক্স বৈজ্ঞানিকভাবে একই ব্যাপারেরই দুটো ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ। 

১৯২৭ সালে শ্রোডিঙ্গার জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদ ত্যাগ করে জার্মানির বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের প্রধান অধ্যাপকের পদে যোগ দেন। ম্যাক্স প্ল্যাংক এই পদে ছিলেন। প্ল্যাংক অবসর নেয়ার সময় নিজেই শ্রোডিংগারকে পছন্দ করেন এই পদের জন্য। এই পদে যোগ দেয়ার কারণে শ্রোডিংগার জার্মানির নাগরিকত্ব পান এবং প্রুশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সের সদস্য মনোনীত হন। 

বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রোডিঙ্গারের অধ্যাপনা বেশ ভালোভাবেই চলছিল। একই সাথে চলছিলো তার একাধিক নারীসঙ্গ। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর এক সহকর্মীর স্ত্রী হিল্ডিগুন্ড মার্ক (Hildegunde March)-এর সাথে তাঁর সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিল যে তাঁদের সম্পর্কের জেরে একটি কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। তার নাম রাখা হয় রুথ জর্জিয়া এরিকা। শ্রোডিংগারের মেয়ে হিসেবেই রুথ বড় হতে থাকে। 

১৯৩৩ সালে জার্মানিতে হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি সরকার ক্ষমতায় এলে ইহুদিদের উপর প্রকাশ্য অত্যাচার শুরু হয়। শ্রোডিঙ্গার নিজে ইহুদি নন, কিন্তু তাঁর ইহুদি সহকর্মীদের উপর নাৎসিদের অত্যাচারের মৌখিক প্রতিবাদ করলেন তিনি। ফলে তাঁর অবস্থানও নড়বড়ে হয়ে গেল। তিনি বার্লিন ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যাবার চেষ্টা শুরু করলেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ম্যাগড্যালেন কলেজে রিসার্চ ফেলো হিসেবে একটি অস্থায়ী পদের ব্যবস্থা করলেন অক্সফোর্ডে শ্রোডিংগারের বৈজ্ঞানিক সহকর্মীরা। শ্রোডিংগারের অনুরোধে তাঁর সাথে তাঁর সহকর্মী ও তার স্ত্রী হিল্ডিগুন্ড মার্ক এবং কন্যা রুথের জন্যও অক্সফোর্ডে থাকার ব্যবস্থা হলো। 

অক্সফোর্ডে যাবার আগে শ্রোডিঙ্গার ব্রাসেলস-এ গেলেন সপ্তম সোলভে কনফারেন্সে যোগ দিতে। সেখান থেকে ফিরে অক্সফোর্ডে যোগ দেয়ার আগেই জানতে পারলেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সে অবদানের জন্য পল ডিরাক এবং  তিনি ১৯৩৩ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। 

১৯৩৩ সলভে কনফারেন্স


১৯৩৩ থেকে ১৯৩৫ পর্যন্ত শ্রোডিংগার অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ছিলেন। ১৯৩৬ সালে তিনি অস্ট্রিয়ার গ্রাজ ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন। কেমব্রিজ থেকে অস্ট্রিয়ায় ফিরে শ্রোডিংগারের স্ত্রী আনামেরি চলে যান তাঁর মায়ের কাছে ভিয়েনায়। কিন্তু শ্রোডিংগার তাঁর সহকর্মীর স্ত্রী হিল্ডিগুল্ড ও কন্যা রুথকে নিজের সাথে নিজের বাসায় রেখে দেন। 

১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত গ্রাজ ইউনিভার্সিটিতে কাজ করেন শ্রোডিংগার। কিন্তু রাজনৈতিক পটভূমি দ্রুত বদলে যায়। হিটলার অস্ট্রিয়া দখল করে নেয়। গ্রাজ ইউনিভার্সিটির সব ইহুদি অধ্যাপককে ছাটাই করা হয়। শ্রোডিংগার ইহুদি না হলেও ইহুদিদের পক্ষে কথা বলেছিলেন – এই খবর নাৎসিদের কাছে আছে। তাঁকে বলা হলো তাঁর কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে একটি খোলা চিঠি লিখতে। শ্রোডিংগার নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তা লিখলেন। কিন্তু তাতেও কোন কাজ হলো না। ১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেয়া হলো। দেশ থেকে চলে যাবার অনুমতি তাকে দেয়া হলো – কিন্তু শর্ত হলো সাথে কোন টাকা-পয়সা নেয়া যাবে না। 

এতদিনের জমানো সবকিছু পেছনে ফেলে সামান্য কিছু জিনিসপত্র সাথে নিয়ে তিনি ইতালিতে চলে গেলেন। শ্রোডিংগারের এই দুঃসময়েও তাঁর সঙ্গী ছিলেন তাঁর স্ত্রী আনামেরি। রোমে বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি তাঁদের অভ্যর্থনা জানালেন এবং টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করলেন। রোম থেকে জেনিভায় গিয়ে আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ইয়ামন দ্য ভ্যালেরি’র সাথে দেখা করলেন শ্রোডিংগার। দ্য ভ্যালেরি তাঁকে জানালেন যে তিনি ডাবলিনে ইন্সটিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন। শ্রোডিংগার যদি সেই ইন্সটিটিউটে যোগ দেন তাহলে ভালো হয়। শ্রোডিংগার ভেবে দেখলেন তাতে ভালোই হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি তখনো তৈরি হয়নি। তাই সেখানে যোগ দেয়ার আগে ১৯৩৯ সালে বেলজিয়ামের গেন্ট ইউনিভার্সিটিতে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এখানে বসে অনেকদিন পর আবার একটি গবেষণাপত্র রচনা করলেন; এবারের বিষয় মহাবিশ্বের প্রসারণ। 

১৯৩৯ সালে শ্রোডিংগার এবং আনামেরি ডাবলিনে পৌঁছলেন। তাঁদের সাথে যোগ দিলেন হিল্ডিগুল্ড মার্ক ও মেয়ে রুথ। ডাবলিনে সমুদ্রতীরে একটি ছোট্ট বাসায় তাঁরা সবাই একসাথে থাকতে শুরু করলেন। ডাবলিন ইন্সটিটিউট অব এডভান্সড স্টাডিজের কাজকর্ম বেশ দ্রুতই প্রসারিত হতে শুরু করলো শ্রোডিংগারের নেতৃত্বে। শ্রোডিংগার তাঁর গবেষণার বেশিরভাগ মনযোগ দিলেন আইনস্টাইনের মতোই – অভিকর্ষ বল ও তড়িৎচুম্বক বলের সমন্বয়ের সূত্র আবিষ্কারের নেশায়। কিন্তু এই কাজে কোন সাফল্য আসেনি। 

কিন্তু শ্রোডিংগার জীববিজ্ঞানের গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করলেন এই সময়। ১৯৩৩ সালেই তাঁর মনে প্রশ্ন এসেছিল জীবকোষের মধ্যে এতগুলি পরমাণু কেন? কিন্তু সেই সময় এই ব্যাপারে আর কোন অনুসন্ধান তিনি করেননি। এখন ১৯৪০ সালে এসে তিনি ভাবছেন জীবকোষের ক্রোমোজমে নিশ্চয় জীবনের সংকেত লেখা আছে। শ্রোডিংগারের আগে কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে জীবন ও পদার্থবিজ্ঞানের সমন্বয়ের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু শ্রোডিংগার পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে জীবনের অর্থ কী হতে পারে সে ব্যাপারে বিস্তারিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিলেন। ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত হলো তাঁর বই ‘What is life?’ আয়ারল্যান্ডে তাঁর বইয়ের খুব একটা সমাদর হলো না – কারণ ধর্মীয়ভাবে ভীষণ গোঁড়া এই দেশে ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যায় এরকম কিছু লেখা খুব সহজ ছিল না। কিন্তু শ্রোডিংগারের বইটি খুবই অনুপ্রেরণা জোগায় অণুজীববিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রিককে। পরবর্তীতে ডি-এন-এ আবিষ্কারে শ্রোডিঙ্গারের বই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষ হয় শ্রোডিংগারের বয়স তখন ষাট। এই বয়সেও তিনি নারীসঙ্গ বন্ধ করেননি। আইরিশ অভিনেত্রী শেইলা মে গ্রিনের সাথে তাঁর নিয়মিত শারীরিক ঘনিষ্ঠতা শুরু হয় এসময়। শেইলার স্বামীর সাথে শেইলার কোন সন্তান হয়নি। কিন্তু শ্রোডিংগারের সাথে শেইলার একটি কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। এরপর শেইলার স্বামী এই কন্যাকে লালনপালন করতে থাকেন। শেইলা তাঁর স্বামীকে ত্যাগ করে চলে যায়। বেশ কয়েকবছর পর শ্রোডিংগারের সাথে শেইলার আবার দেখা হয়। শেইলার গর্ভে শ্রোডিংগারের আরো একটি কন্যাসন্তান জন্মে।

শ্রোডিংগার এই সময় ঘোষণা দেন যে তিনি ইউনিফাইড থিওরি আবিষ্কার করে ফেলেছেন। ডাবলিনের সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর সাফল্যের কাহিনি। আইনস্টাইন তখনো চেষ্টা করে যাচ্ছেন এই তত্ত্ব আবিষ্কারের। তিনি প্রিন্সটনে বসে শ্রোডিংগারের গবেষণাপত্র খুব সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলেন শ্রোডিঙ্গারের তত্ত্বে ভুল আছে। তিনি শ্রোডিঙ্গারকে জানালেন কোথায় ভুল আছে। শ্রোডিংগার বুঝতে পেরে খুবই লজ্জিত হলেন। এতই লজ্জিত হলেন যে তিনি পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা ছেড়ে দিয়ে ভারতীয় দর্শন পড়তে শুরু করলেন। এই সময় তিনি উপনিষদের যতগুলি বই ইংরেজিতে এবং ইওরোপীয় ভাষায় পাওয়া যায় সব পড়ে ফেললেন একের পর এক। যুদ্ধ-পরবর্তী সোলভে কনফারেন্সে যোগ দিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর গবেষণা সম্পর্কে এখন আর তেমন কারো আগ্রহ নেই। তিনি আরো বেশি করে দর্শনের দিকে ঝুঁকলেন। 

১৯৫৬ সালে শ্রোডিংগার ভিয়েনায় ফিরে এলেন। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর জন্য একটি বিশেষ পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। ১৯৫৭ সালে তাঁকে জার্মান অর্ডার অব মেরিট এবং অস্ট্রিয়ান মেডেল ফর আর্টস এন্ড সায়েন্স দেয়া হয়। 

শ্রোডিংগারের শরীর ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করেছে। তাঁর হৃৎপিন্ড এবং ফুসফুসের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে হতে ১৯৬১ সালের ৪ জানুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়। 

তথ্যসূত্র:

1. Ioan James, Remarkable Physicists from Galileo to Yukawa, Cambridge University Press, Cambridge, 2004. 
2. William H Cropper, Great Physicists the Life and Times of Leading Physicists from Galileo to Hawking, Oxford University Press, Oxford, 2001. 
3. World Book’s Biographical Encyclopedia of Scientists, Vol 7, Chicago, 2003. 

2 comments:

  1. শ্রোডিঙ্গার দারুন খেলুডে লোক বলতেই হয়।যক্ষা নিয়েও এত নারীসঙ্গ উপভোগ, সাথে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী🧡

    ReplyDelete
    Replies
    1. প্রিয় পাঠক, অনেক ধন্যবাদ। হ্যাঁ, শ্রোডিঙ্গার অন্যরকম ছিলেন।

      Delete

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts