Saturday 28 August 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৩৫

 


স্বপ্নলোকের চাবি – ৩৫

‘এটা কিন্তু ভিসিআর না, ভিসিপি। ভিসিআর আর ভিসিপির পার্থক্য জান তো?” – যন্ত্রপাতি সেট করতে করতে আজমভাই প্রশ্নটা সম্ভবত আমাকেই করেছেন। কিন্তু এই যন্ত্রটা সম্পর্কে আমার তেমন কোন ধারণা নেই। আমি আজমভাইয়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে মুকিতভাইয়ের দিকে উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। মুকিতভাই আমার দিকে না তাকিয়ে তাঁর রুমে আগত অতিথিদের বসার ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত। মুকিতভাইয়ের রুমমেট তৌহিদভাই ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির ফাঁকে মুখটা হাসি হাসি করে রাখলেও মনে হচ্ছে তিনি বেশ বিরক্ত এসব ব্যাপারে। তাঁর খাটেও ঠেসাঠেসি করে বসে আছে অনেকে। দোতলার প্রায় সবাই এসে জড়ো হয়েছে রাতজেগে হিন্দি সিনেমা দেখার জন্য। সিনেমার নাম রাখওয়ালা। 

ভিডিওক্যাসেট আর প্লেয়ার দুটোই আজমভাইয়ের। তিনি আমাদের দু’ব্যাচ সিনিয়র, কেমিস্ট্রির। এবার মাস্টার্স পরীক্ষা দেবেন। এ বিল্ডিং-এ এসেছেন বছরখানেক হলো। খুব হাসিখুশি মানুষ। যখনই দেখা হয় – দেখি মুখে হাসি আর সিগারেট দুটোই লেগে আছে। এখনো তাই। হাতে তুড়ি মেরে সিগারেটের ছাই ফেলছেন মুকিতভাইয়ের পরিষ্কার মেঝেতে। 

“এটা কিন্তু অনিল কাপুর আর শাবানা আজমীর নতুন সিনেমা। ফুল কালার। কিন্তু এই ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট টিভিতে কোন কালার দেখা যাবে না। হিন্দি সিনেমার আসল মজাই তো কালার।“ – আজমভাই সিনেমা শুরু হবার সাথে সাথেই আমাদের সতর্ক করে দিলেন। 

সবাই যেভাবে হা করে সাদা-কালো টিভির দিকে তাকিয়ে অনিল কাপুরের মারপিট দেখছে, কালার হলে কী অবস্থা হতো কে জানে। হিন্দি সংলাপ হুবহু না বুঝলেও সিনেমার দৃশ্য দেখে ঘটনা বুঝতে সমস্যা হবার কথা নয়। কিন্তু আজমভাই আমাদের বুঝতে যেন কোন অসুবিধা না হয় সেদিকে কড়া নজর রাখছেন। প্রতিটি সংলাপের আঞ্চলিক অনুবাদ করতে লাগলেন। অভিনেতা অভিনেত্রীদের নাম বলছেন, তাদের জামা-কাপড়ের রঙ বলে দিচ্ছেন। 

এত তথ্য কি সহ্য হয়! মানুষ কোনকিছু জানলেই তা জানানোর জন্য এত ব্যস্ত হয়ে পড়ে কেন জানি না। জ্ঞান কি এতটাই বায়বীয় যে মুখ খুললেই তা সিগারেটের ধোঁয়ার মতো বের হয়ে আসতে হবে? 

আজমভাইয়ের বকবকানির মধ্যেই সবাই সিনেমায় বুঁদ হয়ে আছে। আমাদের সিনেমাহলে ভারতীয় সিনেমা দেখাতে দেয়া হয় না বলেই হয়তো এসব সিনেমার প্রতি এত আকর্ষণ সবার। শুধু সিনেমাহলে নয়, আমাদের টেলিভিশন, রেডিও কোথাও ভারতীয় সিনেমা, নাটক, গান কিছুই প্রচারিত হয় না। আমাদের দেশীয় সিনেমা, নাটক, গানকে প্রতিযোগিতাহীনভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেবার জন্যই হয়তো এই নীতি। আবার এই নীতিও কি সবার জন্য প্রযোজ্য? বিডিআর সিনেমাহলে, শাহীন সিনেমাহলে ভারতীয় সিনেমা চলে কীভাবে? এখন তো শহরের অলিতে গলিতে ভিডিও-লাইব্রেরিভর্তি ভারতীয় সিনেমা। মানুষের ঘরে ঘরে ভিসিআর, ভিসিপি। যেভাবে হিন্দি গিলছে সবাই – কিছুদিনের মধ্যেই সবাই হিন্দি-বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠবে, আজমভাইয়ের অনুবাদের আর দরকার হবে না। 

সিনেমার কাহিনি ক্রমশ জটিল হয়ে উঠতে শুরু করেছে। সাংবাদিক শাবানা আজমী পাগল হয়ে গেছে। আজমভাই এর মধ্যেই আরো কয়েকটা সিগারেট ধ্বংস করে মুকিতভাইয়ের রুমের মেঝের একটা অংশ ছাইদানি বানিয়ে ফেলেছেন। আর ভালো লাগছে না, রুম থেকে বের হয়ে এলাম। নিচে নামার জন্য সিঁড়ির দরজা খুলতেই দেখলাম নিচের তলার দুজন শিবিরনেতা দাঁড়িয়ে আছে। এরাও কি সিনেমা দেখতে ইচ্ছুক? দরজা বন্ধ ছিল বলেই হয়তো দোতলায় ঢুকতে পারেনি। 

“এত রাতে এসব কি শুরু করেছেন আপনারা? আমরা তো ঘুমাতে পারছি না।“ – না ঘুমাতে পারার ক্ষোভ আমার উপর ঝাড়লেন একজন। অন্যজনের গায়ে চাদর জড়ানো। অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে আমার পরিচিত কেউ নয়। তার চাদরের ভেতর বোমা-টোমাও থাকতে পারে। আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। 

বললাম, “আজমভাই সিনেমা দেখাচ্ছেন। আপনারা আজমভাইয়ের সাথে কথা বলেন। আসেন।“ 

আবার মুকিতভাইয়ের রুমে এলাম। আমার পেছনে দুজন ক্রুদ্ধ শিবিরকর্মী। 

“আজমভাই, ইনারা আপনার সাথে কথা বলতে এসেছেন।“ – বলে আমি রুমের ভেতর ঢুকে নিরাপদ জায়গা হিসেবে তৌহিদভাইয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ফতেয়াবাদ গার্লস স্কুলের মৌলভীসাহেবকে নিশ্চয় তারা কিছু বলবে না। 

আজমভাই সিনেমা পজ দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে?”

“সিনেমা বন্ধ করেন। আমরা ঘুমাতে পারছি না।“ 

“ওহ্‌ সরি, শব্দ নিচে যাচ্ছে! আমরা তো দরজা-জানালা বন্ধ করে সিনেমা দেখছি। সাউন্ড তো নিচে যাবার কথা নয়। আমরা সাউন্ড আরো কমিয়ে দিচ্ছি। আপনারাও দরজা-জানালা বন্ধ করে দেন।“ – আজমভাই সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আবার সিনেমা চালু করলেন। ধারাবিবরণীও শুরু করতে যাবেন – তখনই শিবিরনেতা রাগতস্বরে বললেন, “সিনেমা বন্ধ করতে বললাম। মুসলমান হয়ে এসব হারাম কাজ করতে লজ্জা করে না?”

আজমভাইয়ের মুখ থেকে হাসি উধাও হয়ে গেল, সিগারেট নেমে গেল। ভিসিপির পজ বাটন টিপে হিন্দি সিনেমার নায়কের মতো গম্ভীরভাবে বললেন, “কী বললেন আপনি? আমরা হারাম কাজ করছি? আমার মুখ খোলাবেন না। হল পাহারা দেবার নাম দিয়ে আপনাদের নেতারা যে সারারাত বসে বসে ব্লু ফিল্ম দেখে তা সবাই জানে। মানুষ ধরে ধরে জবাই করে দেন আপনারা – সেটা খুব হালাল, না?”

“আপনি বাজে কথা বল্তেছেন।“

“বাজে কথা আপনি শুরু করছেন। ভালো ব্যবহার করলে আপনারা মাথায় উঠে যান। গায়ের জোরে ইমানদার হওয়া যায় না। “ 

আমরা সবাই স্তব্ধ হয়ে দেখছি হিন্দি সিনেমার চেয়েও নাটকীয় এই দৃশ্য। হলে থাকলে আজমভাইয়ের সাহস হতো না এভাবে কথা বলার।

শিবিরদ্বয় বুঝতে পারলো যে ভুল মানুষের সাথে ভুল জায়গায় লাগতে এসেছে। তারা আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। আজমভাই আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে সিনেমা চালু করলেন। দেখলাম তৌহিদভাইয়ের খাটের নিচ থেকে আস্তে আস্তে হামাগুড়ি দিয়ে বের হচ্ছে একজন। এই ছেলেটাকে তো শিবিরের কর্মী বলেই জানি। ছেলেটা তাদের নেতাকে রুমে ঢুকতে দেখে কখন যে খাটের নিচে ঢুকে গেছে জানি না। এবার তো আরো ভয়ের কথা। এই ছেলে কি ভেজাল শিবির, নাকি স্পাই? 

আমাদের ক্যাম্পাসে শুধু নয়, সারা দেশেই প্রচন্ড ভয় পাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কর্মসূচীগুলি যতই বেগবান হচ্ছে – এরশাদও নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে গোলাগুলি হচ্ছে। একদল আরেকদলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলার চেষ্টা চলছে। ডাকসু নির্বাচনে জয়লাভ করলেও ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ বিনাবাধায় কোন কর্মসূচী দিতে পারছে না। আর আমাদের ইউনিভার্সিটিতে সেই যে একদিন বিরাট সমাবেশ হয়েছিল – তারপর থেকে কথায় কথায় অবরোধ ডাকতে শুরু করেছে ছাত্রশিবির। 

আর যখন তখন এত হরতাল হচ্ছে যে কী কারণে কে হরতাল ডাকছে ঠিকমতো বুঝতেও পারছি না। নভেম্বরের ১৩ তারিখ সকাল-সন্ধ্যা হরতাল হলো। কারা ডেকেছে? এমইএস কলেজের শিক্ষার্থীরা। দাবি কী? তাদের কলেজে ডিগ্রি পরীক্ষার সেন্টার দিতে হবে। এরকম করতে করতে হরতাল ব্যাপারটাই এখন গুরুত্বহীন হাস্যকর ব্যাপারে পরিণত হয়ে গেছে। এরশাদও বুঝে গেছেন যে এসব ধর্মঘট হরতালে তার কিছুই হবে না। 

আসলেই তার কিছু হচ্ছে না। সবাই জানে এরশাদ ভন্ডামি করেন সবকিছু নিয়ে। ধর্ম নিয়ে যেসব ভন্ডামি শুরু করেছেন তা সবাই জানার পরেও তাকে কেউ ভন্ড বলে না। জামায়াত-শিবিরও না। এই যে তিনি প্রতি শুক্রবার দেশের কোথাও না কোথাও মসজিদে গিয়ে দাবি করেন যে ঠিক আগের রাতে স্বপ্ন দেখে তিনি সেখানে নামাজ পড়তে গেছেন। অথচ তাঁর নিরাপত্তাবাহিনী অনেকদিন আগে থেকেই সেই মসজিদ এবং আশেপাশে নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। 

বাংলাদেশের ধর্মভীরু মানুষদের ধর্মের দোহাই দিয়ে চুপ করিয়ে রাখা যায় এটা এরশাদ বেশ ভালোভাবেই জানেন। তাই তিনি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম কায়েম করেছেন। ভবিষ্যতে যেদলই ক্ষমতায় আসুক রাষ্ট্রধর্মে হাত দিতে পারবে না। 

কোন ক্ষমতাশালীরই সুবিধাবাদী চাটুকারের অভাব ঘটেনি কোনদিন। এরশাদেরও চাটুকারের অভাব নেই। তাঁর ভাইস-প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমেদ আর প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফরকে দেখলেই বোঝা যায়। কাজী জাফর সম্প্রতি ক্যান্সার হাসপাতাল তৈরি করার জন্য ১০০ বিঘা জমি দান করেছেন। একশ বিঘা জমি তিনি কোথায় পেলেন, কোথায় দান করলেন, ক্যান্সার হাসপাতাল কোথায় হচ্ছে, আদৌ হবে কি না – এসব কেউ জানে না। শুধু ফলাও করে প্রচার হচ্ছে মন্ত্রীমাহাত্ম্য। 

সম্রাট নিরো নাকি পাঁচ হাজার নাইট এবং সৈন্যসামন্ত নিয়ে যেতেন মিউজিক্যাল কনসার্ট করার জন্য, সঙ্গীতজ্ঞ হবার জন্য। আমাদের প্রেসিডেন্ট এরশাদ কবি হতে চেয়েছেন তাতে আর আশ্চর্য কী! এরশাদের লেখা কবিতা – নতুন বাংলাদেশ গড়বো মোরা, নতুন করে আজ শপথ নিলাম – এখন গান হয়ে বিটিভিতে প্রতিদিন কয়েকবার করে বাজে। এখনো চক্ষুলজ্জা কিছুটা আছে হয়তো, নইলে এটাকে জাতীয় সঙ্গীত ঘোষণা করে ফেলতেন। এরশাদ নভেম্বরের মাঝামাঝি দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কবিতা সম্মেলন করছেন বঙ্গভবনে। আমাদের তেলবাজ কবিরা রাজকবি হবার প্রত্যাশায় তাঁর কবিতার তৈলাক্ত প্রশস্তি রচনায় ব্যস্ত। এরশাদই সম্ভবত একমাত্র কবি - যার কবিতা বাংলাদেশের সবগুলি সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়। ক্ষমতা চলে যাবার পর দেখা যাবে কটা কবিতা বের হয় তার মগজ থেকে আর কোথায় তা প্রকাশিত হয়। 

আমাদের ক্লাস চলার গতি কিছুটা শ্লথ হয়ে গেছে। হরতাল অবরোধ না থাকলে ক্যাম্পাসে যাচ্ছি। ক্লাস হলে করছি, প্র্যাকটিক্যালগুলি করার চেষ্টা করছি। আমাদের আগের ব্যাচের পরীক্ষা হয়ে গেছে। শোনা যাচ্ছে আমাদের পরীক্ষারও ডেট দিয়ে দেবে শীঘ্র। তবে চাকসু নির্বাচনের তোড়জোড় চলছে। শিবিরের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করতে পারবে এটা এখন অনেকটাই দুরাশা। কিন্তু এর মধ্যেও কিছু কিছু বিপ্লবীর দেখা পাচ্ছি যারা কিছুতেই হতাশ হয় না। 

ক্যাম্পাসে অনেকদিন পর ক্যাফেটরিয়ার সামনে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল মাসুমভাইয়ের সাথে। অদ্ভুত মানুষ এই মাসুমভাই। চিটাগং কলেজে কেমিস্ট্রি অনার্সে ভর্তি হয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দী হোস্টেলে উঠেছিলেন। সেখানে বেশিরভাগ সিটই ছিল শিবিরের দখলে। মাসুমভাই যে রুমে সিট পেয়েছিলেন সেই রুমের বাকি তিনজনই ছিল শিবিরের কর্মী। তারা স্বাভাবিক নিয়মেই মাসুমভাইকে দ্বীনের দাওয়াত দিতে চেয়েছিল। আর মাসুমভাই তাদের তিনজনকে মার্ক্স-লেনিনের দাওয়াত দিয়েছেন। ফলে যা হবার তাই হলো। একদিন মাসুমভাইকে আধমরা অবস্থায় উদ্ধার করা হলো কলেজের ড্রেন থেকে। সুস্থ হতে অনেকদিন সময় লেগেছিল তার। দুটো দাঁত গেছে, হাতের আঙুল গেছে। এখন তাঁর মুখে দাড়িগোঁফ দেখে ভাবলাম হয়তো আরো অনেক পরিচিত মার্ক্সবাদীর মতো তিনিও শিবিরে যোগ দিয়েছেন। 

“কী খবর মাসুমভাই, আপনাকে তো চেনা যাচ্ছে না?”

মাসুমভাই আসাদুজ্জামান নুরের মতো ঘাড় বাঁকিয়ে হেসে বললেন, “মুখে কাটাদাগ আর উপরের পাটির ভাঙাদাঁত ঢাকতেই এই ব্যবস্থা।“ 

কিছুক্ষণ কথা বলার পরেই বুঝলাম মাসুমভাই কচ্ছপ টাইপের মানুষ। মার্ক্স-লেনিন কামড়ে ধরেছেন, ছাড়ানোর উপায় নেই। ভেতরে ভেতরে মাসুমভাইদের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। এই নিরব কর্মীরা চাকসু নির্বাচনের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছেন ইতোমধ্যে। 

ক্যাফেটরিয়ার সামনে কয়েকজন মোবাইল সিগারেটবিক্রেতা আছে। প্রদীপ নাথ তাদের চেনে। তারা সিগারেটের প্যাকেট কোথায় রাখে কে জানে, চাইলেই বের করে দেয়। আমি মাসুমভাইয়ের সাথে কথা বলছি দেখে প্রদীপ নাথ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট শেষ করলো। মাসুমভাইকে বিদায় দিয়ে ফ্যাকাল্টির দিকে যাবো – এমন সময় “অ্যাই প্রদীপ, শোন” – শুনে আমরা দুই প্রদীপই ফিরে তাকালাম। 

ক্যাফেটরিয়ার বারান্দায় দাঁড়িয়ে শবনম ডাকছে। কাকে ডাকছে এখনো বুঝতে পারছি না। দু’জনই এগিয়ে গেলাম। 

“কাকে ডাকছো? আমাকে না একে?”

“তোমাদের দু’জনকেই।“ 

শবনম সাধারণত কথাবার্তা খুব একটা বলে না। আজ এত সিরিয়াস হয়ে আমাদের দু’জনকেই ডাকছে এক সাথে! ঘণ্টাখানেক আগে ক্লাসের ভেতর বসে থাকতে থাকতে হেড়ে গলায় দুজনে গান ধরেছিলাম সেটা কি শবনম শুনতে পেয়েছে? সে তখন কোথায় ছিল তো খেয়াল করিনি। কিন্তু “ও শবনম, তোমারি মতন, একটি বউ মোর আছে প্রয়োজন” – গানটা তো একটা সিনেমার গান – সে কি মাইন্ড করলো নাকি? 

প্রদীপ নাথ আগবাড়িয়ে বললো, “আমার কিন্তু কোন দোষ নেই, সব এর দোষ।“ 

“কিসের দোষ? কিসের কথা বলছো তোমরা?” 

“তুমি কেন ডেকেছ?”

“তোমাদের মধ্যে কার ভাইয়ের বিয়ে হচ্ছে?”

হঠাৎ এখানে ভাইয়ের বিয়ে আসছে কোত্থেকে? আমার ভাইয়ের তো বিয়ে হচ্ছে না। প্রদীপ নাথের বড় দুই ভাইয়ের তো বিয়ে হয়ে গেছে। 

“আমার ভাইয়ের হচ্ছে না।“ – আমি তাড়াতাড়ি বললাম।

“আমার ভাইয়েরও হচ্ছে না।“ – প্রদীপ নাথও ডানে-বামে মাথা নেড়ে বললো। 

“হচ্ছে হচ্ছে, তোমরা জানো না মনে হয়।“

“কেন বলতো?”

“আরে আমাদের কলোনির এক দিদির সাথে একজনের বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে – যার ভাইয়ের নাম প্রদীপ – যে আমাদের ক্লাসে পড়ে।“

“তারপর?” 

“আমাদের ক্লাসে তো তোমরা দুজনই প্রদীপ। আর কোন প্রদীপ আছে?” 

“চিটাগং কলেজে আমাদের ব্যাচে ফিজিক্সে আরেকজন প্রদীপ নাথ আছে। সম্ভবত তার কথা বলেছে।“

“আরে না, ইউনিভার্সিটিতে।“

“তোমাদের কলোনি মানে কোথায়?”

“ফরেস্ট কলোনি”

বুঝতে পারলাম। আমার দাদার বিয়ের কথাবার্তা চলছে বলে শুনেছি আমি। বিবাহ সম্পর্কে আমার মতামত গতানুগতিকতার বাইরে যায় বলে আমাকে পারিবারিক বিবাহ-কমিটিতে রাখা হয়নি। তাই আমি বিস্তারিত কিছু জানি না। তবে শুনেছি ফরেস্ট কলোনির কোন এক বাসায় আমার বাবা কয়েকবার গেছেন। এখন তো দেখছি তারা আমার ব্যাপারেও তদন্ত চালাচ্ছে। তথ্যের সত্যতা যাচাই করে দেখা তো অবশ্যই দরকার। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে পুরো পরিবারের পুলিশ ভেরিফিকেশান দরকার হয়। বিবাহের ক্ষেত্রে তো আরো বেশি তথ্যযাচাই হওয়া দরকার। এখন আমার যাচাইকারী অফিসার শবনম। 

“তুমি কী রিপোর্ট দিলে?”

“না, আঙ্কেলটা জানতে চাইলেন তো – আমার ক্লাসে প্রদীপ নামে কেউ আছে কি না? আমি বললাম দু’জন প্রদীপ আছে। একজন ফর্সা, অন্যজন কালো। উনি বলেছেন – কালোটাই হবে। কারণ ওই পরিবার কালো পরিবার।“

“আর কিছু জানতে চায়নি?”

“না, তেমন কিছু না। স্বভাব-টভাব কেমন, সিগারেট খাও কি না এসব আর কি।“

“সিগারেটের ব্যাপারে তুমি কী বলেছ?” – প্রদীপ নাথ কৌতূহলে ফেটে পড়ছে।

“বলেছি মাঝে মাঝে খেতে দেখেছি।“ – শবনমের সরল স্বীকারোক্তি।

আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি আমাকে সিগারেট খেতে কখন দেখেছো?” 

“দেখিনি? একটু আগেও তো দেখলাম। তোমরা দুজনই যে চেইনস্মোকার সেটা সবাই জানে। আমি তো অনেক কমিয়ে বলেছি।“ 

আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছি না। প্রদীপ নাথের লাফিং ডিজিজ শুরু হয়ে গেছে। সে হাসতে হাসতে ফ্যাকাল্টির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললো, “তোকে সে সিগারেট খেতে দেখলো কীভাবে?”  

No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts