Wednesday, 24 March 2021

সবার জন্য স্যাটেলাইট - পর্ব ৫

 


পঞ্চম অধ্যায়

স্যাটেলাইটের কক্ষপথ

 

স্যাটেলাইট পৃথিবীর চারপাশে বিভিন্ন কক্ষপথে ঘুরতে পারে। পৃথিবীর সাথে অবস্থান ও পৃথিবীর চারদিকে ঘূর্ণনের উপর নির্ভর করে স্যাটেলাইটের বিভিন্ন কক্ষপথ নির্ধারিত হয়। কোন্‌ কক্ষপথে স্যাটেলাইট স্থাপন করা হবে তা নির্ভর করে স্যাটেলাইটের ধরনের ওপর এবং পৃথিবীর কোন্‌ জায়গায় তার সেবা প্রদান করা হবে বা তাকে কোথায় কাজে লাগানো হবে তার ওপর। স্যাটেলাইট কী কাজ করবে তার ওপর নির্ভর করে তার ধরন। কোন কোন স্যাটেলাইটের কক্ষপথ হতে পারে পৃথিবী থেকে মাত্র ১৬০ কিলোমিটার বা ১০০ মাইল দূরে। আবার কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটগুলোর কক্ষপথ হয় পৃথিবী থেকে প্রায় ৩৬ হাজার কিলোমিটার দূরে। কোন কোন স্যাটেলাইট বৃত্তাকার পথে ঘুরে, আবার কোন কোন স্যাটেলাইট উপবৃত্তাকার পথে ঘুরে। বৃত্তাকার কক্ষপথে পৃথিবী থেকে স্যাটেলাইটের গড় দূরত্ব সবসময় সমান থাকে। উপবৃত্তাকার কক্ষপথে পৃথিবী থেকে স্যাটেলাইটের দূরত্ব সবসময় সমান থাকে না, কখনো বাড়ে কখনো কমে।

          স্যাটেলাইটের প্রধান কয়েকটি কক্ষপথ হলো:

  • জিওস্টেশনারি আর্থ অরবিট (Geostationary Earth Orbit - GEO)
  • জিওসিঙ্ক্রোনাস আর্থ অরবিট (Geosynchronous Earth Orbit - GEO)
  • মিডিয়াম আর্থ অরবিট (Medium Earth Orbit - MEO)
  • লো আর্থ অরবিট (Low Earth Orbit - LEO)
  • ইকোয়েটোরিয়াল সার্কুলার অরবিট (Equatorial Circular Orbits - ECO)
  • হাইলি ইলিপ্টিক্যাল অরবিট (Highly Elliptical Orbit - HEO)
  • এক্সট্রিমলি ইলিপ্টিক্যাল অরবিট (Extremely Elliptical Orbit - EEO)
  • মলনিয়া অরবিট (Molniya Orbit)
  • লুপাস অরবিট (Loopus Orbit)
  • সুপার সিঙ্ক্রোনাস অরবিট (Super Synchronous Orbit)

 

জিওস্টেশনারি আর্থ অরবিট এবং জিওসিঙ্ক্রোনাস আর্থ অরবিট (GEO)

যোগাযোগ স্যাটেলাইটের মূল চাবিকাঠি হলো স্যাটেলাইটটিকে যথোপযুক্ত কক্ষপথে সঠিকভাবে স্থাপন করতে পারা। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এবং প্রচলিত কক্ষপথ হলো জিওস্টেশনারি অরবিট বা ভূস্থির কক্ষপথ। কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটগুলো সাধারণত জিওস্টেশনারি অরবিটে থাকে। টেলিভিশন সম্প্রচারের জন্য যে স্যাটেলাইটগুলো ব্যবহার করা হয় তার সবগুলো থাকে জিওস্টেশনারি অরবিটে। এই অরবিট বা কক্ষপথকে ক্লার্ক অরবিটও বলা হয়- স্যার আর্থার সি ক্লার্ক এর নামানুসারে। ১৯৪৫ সালে তিনি এই অরবিটের কথা লিখেছিলেন তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রে। ১৯৬৫ সাল থেকে এই অরবিট ব্যবহৃত হচ্ছে কমিউনিকেশান স্যাটেলাইটগুলোর কক্ষপথ হিসেবে।

          এই কক্ষপথের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পৃথিবীর বিষুব রেখা বরাবর এর অবস্থান। পৃথিবী থেকে এই কক্ষপথের দূরত্ব প্রায় ৩৬,০০০ কিলোমিটার। এই কক্ষপথে স্যাটেলাইটের গতি এমন হয় যে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে আসতে যে সময় লাগে, সেই সময়ে পৃথিবী নিজের অক্ষের ওপর একবার ঘুরে আসে। অর্থাৎ চব্বিশ ঘন্টায় GEO স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর চারপাশে একবার ঘুরে আসে। পৃথিবী নিজের অক্ষের ওপর যে বেগে ঘুরে স্যাটেলাইটও একই বেগে ঘুরে বলে পৃথিবীর যে কোন জায়গা থেকে স্যাটেলাইটটির অবস্থান সবসময় একই থাকে। পৃথিবীর জিও-স্যাটেলাইট স্টেশন বা উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র থেকে স্যাটেলাইটটিকে সবসময় স্থির বলে মনে হয়। ভূ-কেন্দ্রের অ্যান্টেনার দিক বদলাতে হয় না কখনোই। তাই এই কক্ষপথের নাম ভূ-স্থির কক্ষপথ বা জিও-স্টেশনারি আর্থ অরবিট।

 

চিত্র ২৭: GEO স্যাটেলাইটের অবস্থান

 

 

কক্ষপথে পৃথিবীর গতির সাথে স্যাটেলাইটের গতির সমন্বয়ের কারণে এই অরবিটকে জিওসিঙ্ক্রোনাস অরবিটও বলা হয়। তবে জিওস্টেশনারি অরবিট ও জিওসিঙ্ক্রোনাস অরবিটের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে।

          জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটগুলো পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে ঘুরার সময় পৃথিবীর বিষুব রেখার সাথে একই সমতলে থাকে। অর্থাৎ স্যাটেলাইটের তল এবং পৃথিবীর বিষুবীয় তলের মধ্যে কোন কৌণিক পার্থক্য থাকে না। কিন্ত স্যাটেলাইটের বেগের সাথে পৃথিবীর বেগের সমন্বয় সবসময় থাকলেও স্যাটেলাইটের তল ও পৃথিবীর তলের মধ্যে কৌণিক পার্থক্য দেখা দেয় বিভিন্ন সময়ে।

          পৃথিবীর গাঠনিক উপাদানের ঘনত্ব সব জায়গায় সমান নয়। ফলে ভরের তারতম্যের কারণে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বল সব জায়গায় সমান নয়। মাধ্যাকর্ষণ বলের এই তারতম্যের কারণে জিও স্যাটেলাইটের তল প্রতিদিন প্রায় ১ ডিগ্রি করে উত্তর-দক্ষিণ দিকে ঝুঁকে যায়। স্যাটেলাইটের 'স্টেশন কিপিং' পদ্ধতিতে এটাকে আবার পৃথিবীর একই তলে নিয়ে আসা হয়। সেজন্য বলা হয়ে থাকে সব জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট জিওসিঙ্ক্রোনাস স্যাটেলাইট, কিন্তু সব জিওসিঙ্ক্রোনাস স্যাটেলাইট জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট নয়।

 

                    চিত্র ২৮: জিওস্টেশনারি ও জিওসিঙ্ক্রোনাস অরবিট

 

 

জিও-স্টেশনারি অরবিট (GEO) স্যাটেলাইটের বৈশিষ্ট্য:

  • ·       বিষুব রেখা বরাবর অবস্থান করে
  • ·       পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩৬০০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করে
  • ·       জিও-সিনক্রোনাস অরবিট (পৃথিবীর নিজের অক্ষের গতির সাথে স্যাটেলাইটের কক্ষপথের গতিবেগ সমান)
  • ·       পর্যায়কাল প্রায় ১৪৩৬ মিনিট বা প্রায় ২৪ ঘন্টা
  • ·       কৌণিক দৃশ্যপথ বা field of view খুব বড় বা বিস্তৃত
  • ·       রেজ্যুলেশন খুব কম (low resolution)
  • ·       কমিউনিকেশন ডাটা প্রায় ১৫ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে পাওয়া যায়
  • ·       ভার্টিক্যাল সাউন্ডের জন্য খুব একটা উপযোগী নয়
  • ·       মাত্র তিনটি স্যাটেলাইট দিয়ে পুরো পৃথিবী কভার করা যায়
  • ·       কৌণিক গতিবেগ ঘন্টায় প্রায় ১১,০০০ কিলোমিটার
  • ·       উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্রের অ্যান্টেনার দিক বদলাতে হয় না

 

জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের সুবিধা

·       পৃথিবী থেকে প্রায় ৩৬,০০০ কিলোমিটার উপরে থাকে বলে একটা স্যাটেলাইট দিয়ে অনেক বিস্তৃত এলাকা কভার করা যায়। আমাদের বাংলাদেশের মত ছোট আয়তনের দেশের পুরোটাই একটিমাত্র স্যাটেলাইট দিয়ে সেবার আওতায় আনা যায়।

·       উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্রের অ্যান্টেনার দিক পরিবর্তন করতে হয় না। এই অ্যান্টেনার গঠনও খুব সহজ এবং খুব বেশি ব্যয়বহুলও নয়।

·       কক্ষপথে এর রক্ষণাবেক্ষণ অনেক সহজ বলে এ ধরনের স্যাটেলাইটের আয়ুষ্কাল তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। ১৫ থেকে ২০ বছর কর্মক্ষম থাকে এই স্যাটেলাইট।

·       স্যাটেলাইটের আয়ুষ্কাল শেষে খুব সহজেই এদেরকে কক্ষপথ থেকে বের করে মহাশূন্যে রেখে দেয়া যায়।

 

চিত্র ২৯: তিনটি জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট পুরো পৃথিবী কভার করতে পারে

 

 

জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের অসুবিধা

·       পৃথিবী থেকে স্যাটেলাইটের দূরত্ব অনেক বেশি বলে স্যাটেলাইট থেকে গ্রাউন্ড অ্যান্টেনা পর্যন্ত তথ্য আদান-প্রদানের সময় প্রচুর তথ্যের অপচয় হয়, সিগনালের প্রাবল্য (intensity) অনেক কমে যায়।

·       গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে স্যাটেলাইট পর্যন্ত সিগনাল গিয়ে আবার গ্রাউন্ড অ্যান্টেনায় ফিরে আসতে অনেক সময় লাগে। ফলে তথ্য সরবরাহে বিলম্ব হয়। এটাকে ট্রান্সমিশান ল্যাটেন্সি (transmission latency) বলা হয়। জিও স্যাটেলাইটে ট্রান্সমিশান ল্যাটেন্সি প্রায় 0.25 সেকেন্ড পর্যন্ত হতে পারে। তাতে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান সম্প্রচারে খুব বেশি অসুবিধা না হলেও - টেলিফোন ও ইন্টারনেট যোগাযোগে অনেক সমস্যা হয়।

·       জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটগুলোর একটির সাথে অন্যটির যোগাযোগ স্থাপন প্রক্রিয়া অনেক জটিল এবং তার জন্য অনেক উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন যন্ত্রপাতির দরকার হয়।

·       জিওস্যাটেলাইটগুলো আকারে অনেক বড়, প্রযুক্তির দিক থেকে অনেক জটিল আর তৈরি করতেও অনেক বেশি  সময় এবং খরচসাপেক্ষ।

 

মিডিয়াম আর্থ অরবিট (MEO)

মিডিয়াম আর্থ অরবিট বা মধ্য ভূ-কক্ষপথ পৃথিবীর ভূমি থেকে দশ হাজার থেকে বিশ হাজার কিলোমিটার উপরে থাকে। জিও-স্টেশনারি অরবিট থেকে পৃথিবীর অনেক কাছে থাকে বলে কক্ষপথে স্যাটেলাইটের গতি ঘন্টায় প্রায় ১৪,০০০ কিলোমিটার। মিডিয়াম আর্থ অরবিট বা মিও স্যাটেলাইটগুলো প্রতি ১২ থেকে ১৩ ঘন্টায় একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে।

 

চিত্র ৩০: GEO, MEO LEO স্যাটেলাইটের অবস্থান

 

গ্লোবাল পজিশানিং সিস্টেম বা জিপিএস স্যাটেলাইটগুলো সাধারণত এই কক্ষপথে থাকে। জিওস্টেশনারি অরবিট থেকে অনেক কাছে থাকে বলে শুধুমাত্র তিনটি স্যাটেলাইট দিয়ে পুরো পৃথিবীকে স্যাটেলাইট সেবা দেয়া যায় না। কতগুলি স্যাটেলাইট লাগবে তা শুধুমাত্র কক্ষপথের উচ্চতার উপর নির্ভর করে না। স্যাটেলাইটের কী কাজ তার উপরও নির্ভর করে।

 

চিত্র ৩১: MEO জিপিএস স্যাটেলাইট

  

NAVSTAR for GPS-এর জন্য কমপক্ষে চারটি স্যাটেলাইট দরকার হয় যে কোন সময় কোন জায়গার অবস্থান ও দিক সঠিকভাবে নির্ভুলভাবে হিসেব করতে। এই কক্ষপথের স্যাটেলাইটের সাথে পৃথিবীর গ্রাউন্ড রিসিভারের অবস্থান সবসময় বদলাতে থাকে। তাই এক সাথে অনেকগুলো স্যাটেলাইটের সাথে সংযুক্ত থাকতে হয় রিসিভারের। একই সাথে কমপক্ষে ২৪ থেকে ২৭টি জিপিএস স্যাটেলাইট কর্মরত  থাকে।

          MEO স্যাটেলাইট-গুচ্ছ কাজে লাগিয়ে টেলিকমিউনিকেশানের কাজে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু সে পরিকল্পনা কার্যকর করা যায়নি। এখন O3b সিস্টেম নামে একটি গ্লোবাল প্রজেক্ট কাজ শুরু করেছে। O3b অর্থাৎ other three billion পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশের তিন শ কোটি মানুষের জন্য হাইস্পিড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সুবিধা দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। ২০১৩ সালে চারটি কমিউনিকেশান স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০১৪ সালে আরো আটটি, ২০১৮ সালে আরো চারটি স্যাটেলাইট স্থাপন করা হয়েছে MEO-এ। ২০১৯ সালের মধ্যে O3b সিস্টেমের মোট স্যাটেলাইটের সংখ্যা হবে ২০। পৃথিবী থেকে এদের কক্ষপথের দূরত্ব আট হাজার কিলোমিটার। কক্ষপথে এদের গতি ঘন্টায় প্রায় ১৯,০০০ কিলোমিটার। স্যাটেলাইটগুলো দিনে পাঁচবার পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে।

 

মিডিয়াম আর্থ অরবিট স্যাটেলাইটের সুবিধা

  • জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটগুলোর চেয়ে MEO স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর অনেক কাছে থাকে বলে সিগনাল ট্রান্সমিশান লস অনেক কম হয়।
  • দশটি গুচ্ছ-স্যাটেলাইট দিয়ে পুরো পৃথিবীকে স্যাটেলাইট সেবার আওতায় আনা যায়।
  • ট্রান্সমিশান ল্যাটেন্সি 0.1 সেকেন্ড যা জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের চেয়ে কম।
  • গ্রাউন্ড রিসিভারগুলোকে ভালোভাবে কভার করতে পারে।

 

মিডিয়াম আর্থ অরবিট স্যাটেলাইটের অসুবিধা

  • মিডিয়াম আর্থ অরবিট স্যাটেলাইটগুলো জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের চেয়ে পৃথিবীর অনেক কাছে থাকে বলে গ্লোবাল নেটওয়ার্কের জন্য বেশি সংখ্যক স্যাটেলাইটের দরকার হয়।
  • স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের খরচ জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের চেয়ে বেশি।
  • গ্রাউন্ড অ্যান্টেনা তুলনামূলকভাবে জটিল এবং ব্যয়সাপেক্ষ।
  • স্যাটেলাইটের আয়ুষ্কাল জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের চেয়ে কম।
  • আয়ু শেষ হয়ে গেলে স্যাটেলাইটগুলোকে কক্ষপথ থেকে বের করে দিতে অনেক বেশি জ্বালানি খরচ হয়।

 

লো আর্থ অরবিট (LEO)

পৃথিবীর ভূমি থেকে লো আর্থ অরবিট বা নিম্ন ভূ-কক্ষপথের দূরত্ব ১৫০ থেকে ১২০০ কিলোমিটারের মধ্যে হয়ে থাকে। এই কক্ষপথের স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে থাকে। ফলে তাদের ওপর পৃথিবীর আকর্ষণ বল সবচেয়ে বেশি। এবং সে কারণে তাদের গতিও অনেক বেশি। যেসব স্যাটেলাইটের কক্ষপথের দূরত্ব ৪০০ কিলোমিটারের মত,  সেখানে স্যাটেলাইটের গতিবেগ ঘন্টায় সাড়ে ১৭ হাজার মাইল বা ২৮ হাজার কিলোমিটার। তার মানে প্রতি ৯০ মিনিটে স্যাটেলাইটটি পৃথিবীকে একবার পরিক্রমণ করে।

 

চিত্র ৩২: LEO স্যাটেলাইট

 

স্যাটেলাইট ফোন ব্যবহার করা হয় যেসব স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সেগুলো থাকে লো আর্থ অরবিটে। আবার নেভিগেশনের জন্য এবং জিপিএস স্যাটেলাইটগুলোর অনেকগুলো থাকে লোয়ার আর্থ অরবিটে। আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের জন্য ওয়েদার স্যাটেলাইটগুলো এই ধরনের কক্ষপথে ঘুরে। LEO স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর খুব কাছে থাকে বলে পুরো পৃথিবী একসাথে কভার করতে হলে অনেক বেশি স্যাটেলাইটের দরকার হয়। গ্লোবাল কভারেজ দেয়ার জন্য ৪০ থেকে ৮০টি স্যাটেলাইটের দরকার হয়। গ্লোবালস্টার মোবাইল স্যাটেলাইট ৪৮টি LEO স্যাটেলাইট কাজে লাগায়। ইরিডিয়াম মোবাইল স্যাটেলাইট ৬৬টি LEO স্যাটেলাইট কাজে লাগায়।

          LEO সিস্টেম ডিজাইন করা যায়। যেমন দরকার হলে ৬৫ ডিগ্রি নর্থ ও ৬৫ ডিগ্রি সাউথ অক্ষাংশে স্যাটেলাইটগুলো বসানো যায়। ওরকম একটি কক্ষপথ পৃথিবীর ৯৯% জনগণকে সেবা দিতে পারে এই ব্যবস্থায় দক্ষিণ মেরুর অনেক অংশ বাদ যাবে, কিন্তু সেখানে তো মানুষ নেই।

         

লো আর্থ অরবিট স্যাটেলাইটের সুবিধা

  • লো আর্থ অরবিট স্যাটেলাইটগুলো জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের চেয়ে প্রায় চল্লিশ গুণ কাছে থাকে পৃথিবীর। তাতে ট্রান্সমিশান লস কমে যায় প্রায় ১৬০০ গুণ।  
  • ট্রান্সমিশান ল্যাটেন্সি নেই বললেই চলে।
  • মেরু অঞ্চলেও তথ্যসেবা দিতে পারে অনেক সহজে।
  • Path loss beam spread কম। ডাটা/তথ্য ছড়িয়ে যায় না। তথ্যের মান ভালো থাকে।
  • তরঙ্গের পুনব্যবহার বা frequency re-use সহজে করা যায়।
  • Low power/low gain গ্রাউন্ড অ্যান্টেনা দিয়ে অপারেট করা যায় সহজে।
  • স্যাটেলাইটগুলো খুব কাছ থেকে পৃথিবীকে দেখতে পায় বলে পরিস্ফুটন খুব ভালো হয়।

 

লো আর্থ অরবিট স্যাটেলাইটের অসুবিধা

  • অনেকগুলো স্যাটেলাইটের দরকার হয়। ফলে খরচ বেড়ে যায় অনেক বেশি।
  • উৎক্ষেপণের খরচ বেশি
  • অরবিট অপারেশন জটিল
  • স্যাটেলাইটের আয়ুষ্কাল কম, মাত্র সাত বছরের মত টেকে।
  • পৃথিবী ও স্যাটেলাইটের মধ্যে মাধ্যাকর্ষণ বল খুব বেশি হওয়াতে স্যাটেলাইটের স্টেশন কিপিং-এ জ্বালানি বেশি খরচ হয়।
  • স্যাটেলাইটের সাথে স্পেস জাংক বা মহাশূন্যের আবর্জনা'র সংঘর্ষ ঘটার সম্ভাবনা অনেক বেশি।


 


ইকুয়েটরিয়েল সার্কুলার অরবিট (ECO)

ইকুয়েটরিয়েল সার্কুলার অরবিট বা নিরক্ষীয় বৃত্তাকার কক্ষপথ হলো বিশেষ ধরনের মিডিয়াম আর্থ অরবিট। এই বিশেষ স্যাটেলাইট-গুচ্ছে বিষুব রেখা বরাবর পৃথিবীর চারপাশে পরস্পর সমান দূরত্বে ছয়টি বা আটটি স্যাটেলাইট স্থাপন করার পরিকল্পনা করা হয় বলে এই কক্ষপথকে স্ট্রিং অব পার্লস বা মুক্তার মালা কক্ষপথও বলা হয়ে থাকে। বিষুবীয় রেখা বরাবর পৃথিবীর তিন থেকে চার হাজার কিলোমিটার উপরে এই স্যাটেলাইট-গুচ্ছ পৃথিবীর প্রায় আড়াই থেকে তিন শ কোটি মানুষের তথ্যসেবা প্রদান করতে পারবে। এই স্যাটেলাইটগুলো ঘুরতে ঘুরতে বিষুব রেখা বরাবর সব দেশের উপর দিয়ে ঘুরবে। কোন একটি স্যাটেলাইট ব্রাজিল, কিংবা কলম্বিয়া, কিংবা ইকুয়েডর, কিংবা পেরু, কঙ্গো, কেনিয়া, উগান্ডা, ইন্দোনেশিয়া কিংবা ভারত - যে কোন দেশের উপর থাকতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো এতগুলো দেশ একসাথে এই সিস্টেম ব্যবহার করলে বিভিন্ন ধরনের কূটনৈতিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।



হাইলি ইলিপ্টিক্যাল অরবিট (HEO)

হাইলি ইলিপ্টিক্যাল অরবিট বা অতি-উপবৃত্তাকার কক্ষপথ খুবই বিশেষায়িত কক্ষপথ। এই কক্ষপথকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয় - মলনিয়া অরবিট, এক্সট্রিমলি ইলিপ্টিক্যাল অরবিট, কিংবা লুপাস অরবিট। এই কক্ষপথ অতি-উপবৃত্তাকার, দেখতে অনেকটা সিগারের মত। অনেক বছর থেকে রাশিয়া তাদের বেশ কিছু কমিউনিকেশান স্যাটেলাইট মলনিয়া অরবিটে স্থাপন করে তথ্য ও টেলিভিশন সম্প্রচার করছে। এই অরবিটে পৃথিবী থেকে সবচেয়ে কাছের দূরত্ব মাত্র কয়েক শ কিলোমিটার, অন্যদিকে সবচেয়ে দূরের বিন্দুর দূরত্ব জিওস্টেশনারি অরবিটের দূরত্বের দুই থেকে তিন গুণ পর্যন্ত হতে পারে। ফলে দূরবর্তী দূরত্বে স্যাটেলাইটের গতি এতই কম হয় যে কোন একটি দেশের ওপর স্যাটেলাইটটি প্রায় আট ঘন্টা পর্যন্ত থাকতে পারে। বর্তমানে জিওস্টেশনারি অরবিটে নতুন স্যাটেলাইটের জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে অতি-উপবৃত্তাকার কক্ষপথ জিওস্টেশনারি অরবিটের বিকল্প হয়ে উঠছে।



সুপারসিঙ্ক্রোনাস অরবিট 

বাণিজ্যিক স্যাটেলাইট কিংবা বৈজ্ঞানিক স্যাটেলাইট - সব ধরনের স্যাটেলাইটের কক্ষপথ খুব সহজেই খুঁজে বের করা যায়। GEO, MEO, LEO - সব কক্ষপথের স্যাটেলাইটের অবস্থান খুঁজে বের করা যায়। কিন্তু সামরিক বাহিনীর বিশেষ গোয়েন্দা এবং প্রতিরক্ষা স্যাটেলাইটগুলো এমন কিছু বিশেষ কক্ষপথে থাকে যাদের সহজে খুঁজে বের করা যায় না। ফলে সেই স্যাটেলাইটগুলোর নেটওয়ার্ক জ্যাম করে দেয়া সম্ভব হয় না, বা তথ্য অনুসরণ করা বা হ্যাক করা সম্ভব হয় না। বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর এরকম অনেক গোপন স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক আছে মহাকাশে। সুপারসিঙ্ক্রোনাস অরবিট হলো জিওসিঙ্ক্রোনাস অরবিটের চেয়ে অনেক অনেক দূরের কক্ষপথ। প্রায় চাঁদের অক্ষের কাছাকাছি এই কক্ষপথ পৃথিবী থেকে এত দূরে যে - এই কক্ষপথের স্যাটেলাইটগুলোকে সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না।

 

কক্ষপথের উপর মহাজাগতিক বিকিরণের প্রভাব

স্যাটেলাইটের কক্ষপথ নির্ধারণ করার সময় মহাকাশের মহাজাগতিক বিকিরণের প্রভাব বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখতে হয়। আমাদের সৌরজগতে সূর্যের সৌরঝড়ের কারণে প্রচুর চার্জিত কণার নির্গমন ঘটে। এই কণাগুলো অত্যন্ত তেজস্ক্রিয়।  এই চার্জিত কণাগুলো সৌরজগতের গ্রহগুলোর চৌম্বকক্ষেত্রের  দিকে আকৃষ্ট হয়ে গ্রহগুলোর চারপাশে চার্জিত কণার বেল্ট বা বলয়ের সৃষ্টি করে। আমেরিকান বিজ্ঞানী জেমস্‌ ভ্যান অ্যালেন পৃথিবীর চারপাশে এরকম তেজস্ক্রিয় বলয় বা রেডিয়েশান বেল্ট আবিষ্কার করেন। এই বেল্টকে ভ্যান অ্যালেন রেডিয়েশান বেল্ট বলে। পৃথিবীর চারপাশে এরকম দুইটি রেডিয়েশান বেল্ট আছে।   

 

চিত্র ৩৩: ভ্যান অ্যালেন রেডিয়েশান বেল্ট

 

পৃথিবীপৃষ্ঠের ১০০০ থেকে ৬০০০ কিলোমিটার উঁচুতে ইনার রেডিয়েশান বেল্ট এবং ১৩,০০০ থেকে ৬০,০০০ কিলোমিটার উঁচুতে আউটার রেডিয়েশান বেল্ট। রেডিয়েশান বেল্টের ভেতর দিয়ে যদি স্যাটেলাইট যায় - তবে উচ্চশক্তির বিকিরণের প্রভাবে স্যাটেলাইটের ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় স্যাটেলাইটের সোলার সেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে স্যাটেলাইটের আয়ুষ্কাল কমিয়ে দেয়। তাই স্যাটেলাইটের কক্ষপথ পরিকল্পনা করার সময় ভ্যান অ্যালেন বেল্ট এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা হয়।

  

মাধ্যাকর্ষণ ও স্যাটেলাইটের কক্ষপথ 

কক্ষপথে যখন স্যাটেলাইটগুলো ঘুরতে থাকে তখন পৃথিবী মাধ্যাকর্ষণ বল দ্বারা তাদেরকে নিজের কেন্দ্রের দিকে টানে। যদি স্যাটেলাইটগুলোর নিজস্ব কোন বেগ না থাকতো তাহলে পৃথিবীর টানে স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর দিকে ফিরে চলে আসতো। এই মাধ্যাকর্ষণ বলকে অতিক্রম করার জন্য স্যাটেলাইটগুলোকে প্রচন্ড গতিশীল থাকতে হয় সবসময়।


চিত্র ৩৪: কক্ষপথে স্যাটেলাইটের গতির কারণ মাধ্যাকর্ষণ বল

  

কক্ষপথে স্থাপনের পর স্যাটেলাইটটি যখন কক্ষপথে সমান কৌণিক বেগে ঘুরতে থাকে তখন কেন্দ্রমুখী বল বা সেন্ট্রিপিটাল ফোর্স কাজ করতে থাকে। কৌণিক বেগের মান সমান হলেও স্যাটেলাইটটি প্রতি মুহূর্তে দিক পরিবর্তন করে বলে সেখানে ত্বরণের সৃষ্টি হয়। সেই ত্বরণের সাথে ভরের গুণফল হলো কেন্দ্রমুখী বল।

স্যাটেলাইটের কৌণিক বেগ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বলকে প্রতিহত করে। মাধ্যাকর্ষণ বল ও স্যাটেলাইটের সেন্ট্রিপিটাল ফোর্স বা কেন্দ্রমুখী বল সমান হলেই স্যাটেলাইটগুলো কক্ষপথ থেকে ছিটকে না পড়ে সমান কৌণিক বেগে কক্ষপথে ঘুরতে থাকে।

          ধরা যাক, স্যাটেলাইটের ভর = ms

                  কক্ষপথে স্যাটেলাইটের বেগ = vs

            পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে স্যাটেলাইটের দূরত্ব = d

পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে স্যাটেলাইটের দূরত্ব জানা থাকলে সমীকরণ (5.3) থেকে আমরা স্যাটেলাইটের বেগ হিসেব কষে বের করতে পারি।

     স্যাটেলাইটটির অরবিট বা কক্ষপথ যতই পৃথিবীর কাছাকাছি হবে তার প্রতি পৃথিবীর আকর্ষণ বল বা মাধ্যাকর্ষণ বল ততই বেশি হবে। এই বলকে কাটিয়ে ওঠার জন্য স্যাটেলাইটের গতিও হতে হবে তত বেশি। তার মানে স্যাটেলাইটকে অনেক দ্রুত ঘুরতে হবে। স্যাটেলাইট পৃথিবী থেকে যত দূরে থাকবে তার গতিও হবে তত কম।

         

কক্ষপথে স্যাটেলাইটের বেগ

পৃথিবী থেকে স্যাটেলাইটের দূরত্ব জানা থাকলে স্যাটেলাইটের বেগ নির্ণয় করা যায় খুব সহজেই। পৃথিবীর ভূমি থেকে জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের দূরত্ব ৩৬,০০০ কিলোমিটার। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে সমীকরণ (5.3)-এ d হলো পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে স্যাটেলাইটের দূরত্ব।

 

সুতরাং দেখা যাচ্ছে জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটগুলো ঘন্টায় ১১০০০ কিলোমিটার বেগে ঘুরছে কক্ষপথে। প্রতি ২৪ ঘন্টায় তারা একবার ঘুরে আসে পৃথিবীর চারপাশে। আমাদের বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট এখন ঘন্টায় প্রায় ১১,০০০ কিলোমিটার বেগে ঘুরছে পৃথিবীর চারপাশে।

          জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের কক্ষপথ বৃত্তাকার। পৃথিবী থেকে তার দূরত্ব সবসময় সমান থাকে। তাই কক্ষপথে তার বেগও সবসময় সমান থাকে। কিন্তু MEO কিংবা LEO স্যাটেলাইটের কক্ষপথ উপবৃত্তাকার। সেই কক্ষপথে স্যাটেলাইটের দূরত্ব পৃথিবী থেকে সব সময় সমান থাকে না। তাই সেই সব স্যাটেলাইটের বেগও সবসময় সমান থাকে না। স্যাটেলাইট যখন পৃথিবীর খুব কাছে আসে - স্যাটেলাইটের বেগ তখন সবচেয়ে বেশি হয়, আবার যখন দূরে চলে যায় তখন স্যাটেলাইটের বেগ কমে যায়। স্যটেলাইটের ভর এবং পৃথিবী থেকে তার দূরত্ব জানা থাকলে সমীকরণ (5.3) ব্যবহার করে স্যাটেলাইটের বেগ নির্ণয় করা যায়।



No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts